বিজ্ঞান নিয়ে লেখা তেমন কঠিন নয়

বিজ্ঞান নিয়ে লেখা তেমন কঠিন নয়

আব্দুল্লাহ আল-মুতী

বিজ্ঞান কী আর বিজ্ঞান নিয়ে লেখারই বা দরকার কি সেটা বোধহয় আজ আর ব্যাখ্যা করে বলার প্রয়োজন নেই। আমাদের দেশে এক কালে কিশোর-কিশোরী মাত্রই উঠতি বয়সে কিছু না কিছু কবিতা লিখত। সেই কবিতার চর্চা নিশ্চয়ই এখনও ফুরিয়ে যায় নি; কিন্তু সেই সঙ্গে বিজ্ঞান বিষয়ে কিছু না কিছু লেখা — অন্তত স্কুলের রচনা লেখার জন্য হলেও – আজ প্রায় সব ছেলেমেয়েকেই করতে হচ্ছে। বড়দের মধ্যেও অনেকে, হয়তো পেশার তাগিদে, কখনো বা শখের বশে বিজ্ঞান, কৃষি, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা এসব বিষয় নিয়ে লিখছেন।

কারো কারো ধারণা বিজ্ঞান একটা খুব কাঠখোট্টা রকম কঠিন জিনিস; তা নিয়ে লেখাও প্রায় সে রকমই। আসলে বিজ্ঞান হল প্রকৃতির নিয়ম-কানুন জানার পদ্ধতি; এই পদ্ধতি সম্পর্কে মাদাম কুরী একদিন বলেছিলেন, বিজ্ঞান হলো পরম সুন্দর। আর লেখার সঙ্গে যে শিল্পের একটা সম্বন্ধ আছে সে আর কে না জানে? তাই বিজ্ঞান নিয়ে যিনি লিখবেন তাঁকে যদি পাঠকেরা একই সঙ্গে বিজ্ঞানী আর শিল্পী হিসেবে দেখতে চান তাহলে আশ্চর্যের কিছু নেই। তবু এটুকু বলা যায় যে, আসলে বিজ্ঞান নিয়ে লেখা মোটেই কঠিন নয় – যদি আপনার জানা থাকে আপনি কেন লিখছেন, কার জন্য লিখছেন, আর কী ধাঁচের লেখা আপনি লিখতে চান।

ইতিহাসে দেখা যায়, কখনো কখনো খুব গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের কথা মানুষ প্রথম জেনেছে খুব সাদামাটা সংক্ষিপ্ত লেখার মাধ্যমে। এরকম লেখার নমুনা হিসেবে উল্লেখ করা যায়: আইনস্টাইনের বস্তু ও শক্তির অভিন্নতার সূত্র (১৯০৫), সত্যেন্দ্রনাথ বসুর বসু-আইনস্টাইন সংখ্যায়ন (১৯২৪) বা ডি.এন.এ.-র গড়ন সম্পর্কে ওয়াটসন ও ক্রিক-এর যুগান্তকারী নিবন্ধ (১৯৫৩)। এসব নিবন্ধ লেখা হয়েছিল মূলত বিদগ্ধ বিজ্ঞানী সমাজের এক ক্ষুদ্র বিশেষজ্ঞ গোষ্ঠীকে লক্ষ্য করে। সাধারণ পাঠক সমাজের জন্য সুখপাঠ্য ভাষায় লেখার কোন দায় সে লেখকদের ছিল না। কিন্তু বিজ্ঞান বিষয়ে অনেক লেখালেখির বেলায় এই বিশেষ দায়ের প্রশ্নটি দেখা দেয়; ফলে সে সব লেখার ভাষা আর রচনাশৈলী রীতিমত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।

কার জন্য আর কেন লেখা

দেখা যাচ্ছে বিজ্ঞান নিয়ে লেখার বেলায় সেটা কি উদ্দেশ্যে আর কার জন্য লেখা হচ্ছে এসব প্রশ্ন রীতিমত জরুরী – কেননা মূলত তার ওপরই নির্ভর করবে লেখার ধরন বা শৈলী।

কেন লেখা হচ্ছে – প্রথমে এ প্রশ্নটা বিবেচনা করা যাক। গোড়াতেই বলে নেওয়া দরকার যে, লেখালেখির ব্যাপারটা আসলে বিজ্ঞানচর্চার একটা অপরিহার্য অঙ্গ। পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে বিজ্ঞানীরা প্রকৃতির যেসব রহস্য উদ্ঘাটন করেন তা তাঁরা অন্য বিজ্ঞানীদের জানাতে চান; এটা বিজ্ঞানীদের পেশার একটা শর্ত। বিজ্ঞানীদের মধ্যে ক্রমাগত অভিজ্ঞতা আর ভাবের আদান-প্রদান না ঘটলে বিজ্ঞান মোটেই এগোতে পারে না।

আজকের দিনে মানুষ প্রকৃতির এমন সব জটিল রহস্য উদ্ঘাটনের সাধনায় মগ্ন যে, তাতে বহু ক্ষেত্রের অসংখ্য বিজ্ঞানীর সমষ্টিগত প্রচেষ্টা ছাড়া সাফল্য লাভ করা দুঃসাধ্য। এই সমষ্টিগত উদ্যোগের জন্যে নিরবিচ্ছিন্নভাবে পরস্পরের মধ্যে অভিজ্ঞতার বিনিময় ছাড়া উপায় নেই। এজন্যই বিজ্ঞান গবেষণার ক্ষেত্রে প্রকাশনাকে এমন গুরুত্ব দেওয়া হয়। এই অভিজ্ঞতা ও ভাবের বিনিময় যেমন প্রয়োজন বিশেষ গবেষণাক্ষেত্রের ছোট বিশেষজ্ঞ গন্ডির মধ্যে, তেমনি প্রয়োজন নানা ক্ষেত্রের বৃহত্তর বিজ্ঞানী সমাজের মধ্যে – যাঁদের কাজের সঙ্গে ঐ গবেষণার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সম্পর্ক থাকতে পারে।

সেই সঙ্গে বিজ্ঞান সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন কোন সত্তাও নয়। সমাজ যেমন একদিকে বিজ্ঞানের ক্রিয়াকলাপের মধ্য দিয়ে প্রভাবিত হয়, তেমনি আবার অন্যদিকে বিজ্ঞানকে সমর্থন ও সহযোগিতা যোগায়। বিজ্ঞানীরা সাধারণ মানুষকে তাঁদের আবিষ্কারের কথা জানালেই কেবল মানুষ তা কাজে লাগাতে পারে। আবার সমাজের সমর্থন ছাড়া শুধু যে বিজ্ঞানের অগ্রগতি দুঃসাধ্য হয় তা নয়, তার অস্তিত্বই সঙ্কটাপন্ন হয়ে ওঠে। তাই বিজ্ঞানীরা কি করছেন আর তা কিভাবে মানুষের জীবনকে প্রভাবিত করতে পারে সে বিষয়ে গবেষণাগারের সঙ্কীর্ণ গন্ডির বাইরে সাধারণ মানুষকেও সব সময়ই অবহিত রাখার প্রয়োজন আছে।

এভাবে বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব ও তথ্যের প্রচার নিঃসন্দেহে সাধারণ মানুষের জীবনকে সমৃদ্ধ করে তুলতে সহায়তা করে। এক্ষেত্রে স্বার্থ যে শুধু সাধারণ মানুষের তা নয়; বিজ্ঞানীদের স্বার্থও যথেষ্ট। আজকের দিনে বৈজ্ঞানিক গবেষণা রীতিমত ব্যয়বহুল; আর সেজন্য প্রয়োজনীয় অর্থসংস্থান ব্যাপক জনসমাজের সমর্থন ছাড়া ঘটা সম্ভব নয়। আর গণতান্ত্রিক সমাজে দেশের সম্পদ কিভাবে ব্যয় হচ্ছে সে সিদ্ধান্তের বেলায় সাধারণ মানুষের মতামতের অবশ্যই মূল্য রয়েছে। লোকে বিজ্ঞানীদের সমর্থন দেয় বলেই তাঁরা তাঁদের গবেষণাকাজ চালাতে পারেন। তাছাড়া বিজ্ঞানীরা তাঁদের গবেষণা আর আবিষ্কারের কথা সাধারণ মানুষকে জানিয়ে প্রায়শই প্রচুর আনন্দও পেয়ে থাকেন। এমনি আদান-প্রদানের মধ্য দিয়ে কখনো কখনো তাঁরা সাধারণ মানুষের কাছ থেকে নির্দেশনাও পান। বিজ্ঞানের কোন আবিষ্কার যদি মানুষের জন্য অকল্যাণ বয়ে আনে তাহলে সে বিষয়ে বিজ্ঞানীদের জানাবার অধিকার মানুষের আছে। সে সব মতামত জেনে বিজ্ঞানীরা তাঁদের গবেষণার ধারা বদলাতে পারেন।

সমাজের আর দশজন মানুষের কল্যাণ সাধণের মহৎ সদিচ্ছার কথা বাদ দেওয়া যাক। শেষ বিচারে এই সমাজের অগ্রগতির সঙ্গে বিজ্ঞানীদের কল্যাণও অঙ্গাঙ্গিভাবে সম্পর্কিত। বিজ্ঞানীদের কর্মধারা শুধু যে আজকের দিনের মানুষের জীবনকে প্রভাবিত করে তা নয়, মারণাস্ত্র তৈরি বা বংশগতির ধারা বদলে দেওয়া এমনি ধরনের কোন কোন গবেষণা মানব সভ্যতার জন্য গুরুতর বিপদও ডেকে আনতে পারে। গণতান্ত্রিক সমাজে মানুষই মানুষের ভাগ্য-নিয়ন্তা। কিন্তু মানুষ এসব বিষয়ে তাদের মতামত বা সিদ্ধান্ত জানাতে পারে যদি তাদের মধ্যে সাধারণ সাক্ষরতার সঙ্গে সঙ্গে বৈজ্ঞানিক সাক্ষরতা জন্মায়, নানা বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের ভাল-মন্দ তারা বিচার করতে পারে।

বিজ্ঞানের নতুন নতুন অগ্রগতির নানা বিষয়ে মানুষ জানতে চায়। জনসংখ্যা বিষ্ফোরণ, পরিবেশ দূষণ, প্রাকৃতিক সম্পদের সংরক্ষণ, পরমাণু-শক্তি, কম্পিউটার – এমনি কত বিষয় আজ মানুষের সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে, তাদের জীবনে ছায়া ফেলছে সেসব মানুষ বুঝতে চায়। এমনকি কালব্যাধি ‘এইডস’, জলবায়ুর পরিবর্তন, মহাকাশ গবেষণা, কৃষ্ণবিবর, জিন-প্রযুক্তি, ‘তথ্য-বিপ্লব’ এধরনের নানা বিষয়ও মানুষকে ভাবিয়ে তোলে; এসব নিয়েও মানুষের কৌতূহল কম নয়।

তাহলে দেখা যাচ্ছে, বিজ্ঞান নিয়ে লেখা হতে পারে প্রধানত দু’ধরনের : শুধু বিজ্ঞানীদের জন্য, আর সাধারণ মানুষের জন্য। এই দু’ধরনের লেখার মধ্যে উদ্দিষ্ট পাঠকের পার্থক্যের কারণে বিষয়বস্তুর জটিলতায় এবং প্রকাশভঙ্গিতে তফাত ঘটতে পারে অনেকখানি। যেমন, একটি নির্দিষ্ট সীমাবদ্ধ ক্ষেত্রের বিজ্ঞানীদের জন্য যদি কেউ তাঁর গবেষণার বিষয়ে একটি নিবন্ধ লেখেন তাহলে তার ভাষা হতে পারে রীতিমত পরিভাষায় ভরাক্রান্ত। আবার নানা ক্ষেত্রের বিজ্ঞানী যদি হন উদ্দিষ্ট পাঠক তাহলে ‘রিভিউ’ বা পর্যালোচনা-জাতীয় লেখার বিষয়বস্তুর ব্যাপ্তি হতে পারে বেশি আর ভাষাও হতে পারে অপেক্ষাকৃত কম পরিভাষাযুক্ত।

সারা পৃথিবীতে আজ লাখখানেক বিজ্ঞান-পত্রিকা প্রকাশিত হয়। তাদের কোনটির প্রচার সংখ্যা মাত্র কয়েকশ’, আবার কোনটির হয়তো বহু লক্ষ। এসব পত্রিকার প্রতিটির নিজস্ব স্টাইল বা প্রকাশভঙ্গি রয়েছে। কোন বিজ্ঞানী যদি বিশেষ একটি পত্রিকায় তাঁর নিবন্ধ প্রকাশ করতে চান তাহলে তাঁকে সেই পত্রিকার লেখার বিশেষ ধাঁচটি অনুসরণ করতে হবে। কিন্তু লেখাটি যদি হয় সাধারণ মানুষের জন্য তাহলে রচনাশৈলীর প্রশ্ন সম্পূর্ণ ভিন্ন এক মাত্রা নেয়।

উদ্দীষ্ট পাঠক আর রচনাশৈলী

বিজ্ঞান নিয়ে লেখার ক্ষেত্রে রচনাশৈলীর প্রশ্ন তুললেই লেখাটি কার জন্য সে প্রশ্নটি আগে ওঠে। পাঠকরা হতে পারেন নানা বয়স আর শিক্ষাগত যোগ্যতার, নানা পেশা আর সামাজিক পটভূমির মানুষ; তাঁরা হতে পারেন বয়স্ক নারী-পুরুষ বা শিশু-কিশোর; গ্রামবাসী বা শহরবাসী। সে সব পাঠকের সবার যে একই ধরণের বিষয়ে আগ্রহ থাকবে তাও নয়, বিভিন্নজনের থাকতে পারে ভিন্ন ভিন্ন আগ্রহের বিষয়। আর তাই আপনার লেখা ধাঁচ অনেকটাই নির্ভর করবে পাঠকদের বিশেষ ধরনের ওপরে।

কোন বিজ্ঞানী যখন সতীর্থ বিজ্ঞানীদের কাছে তার গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করার জন্য লিখতে বসেন তখন তিনি তাঁর পাঠকদের সেই বিষয়ে বেশ খানিকটা পূর্বজ্ঞান আছে বলে ধরে নিতে পারেন। অবশ্য তাঁকে তাঁর পরীক্ষার পদ্ধতি ও উপাত্তের বর্ণনা এমন নিখুঁতভাবে দিতে হবে যেন আর কেউ একই পরীক্ষা করে তার সত্যাসত্য যাচাই করে দেখতে পারেন। তাছাড়া অন্য কোন বিজ্ঞানীর গবেষণায় পাওয়া উপাত্তের উল্লেখ করতে হলে সেই সঙ্গে তার সূত্র নির্দেশ করতে হয়।

পাঠ্যপুস্তক লেখার সময় রচনাশৈলী হবে বৈজ্ঞানিক নিবন্ধ লেখা থেকে ভিন্ন ধরনের। এখানের বিষয়ের ব্যাপ্তি হয় বেশি, তথ্যের সমাবেশ হতে হয় সুবিন্যস্ত। আর ভাষা হওয়া চাই যে বয়সের বা যে স্তরের শিক্ষার্থীর জন্য লেখা হচ্ছে তার উপযোগী। আবার রচনাটি যদি হয় শিশু-কিশোরের পাঠ্য কোন পত্রিকার জন্য তাহলে রচনাভঙ্গী হবে অন্য সব রচনা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখানে লেখককে গোঁড়া থেকেই ধরে নিতে হবে তাঁর পাঠকদের বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের পরিধি বেশ সীমাবদ্ধ; তাই তাদের জন্য ব্যবহার করতে হবে অতি সরল ভাষা; আর আকর্ষণীয় ছবির সাহায্যে এবং আরো নানা ভাবে পাঠকদের আগ্রহ সৃষ্টির চেষ্টা করতে হবে। আবার রচনাটি যদি হয় বেতারে সম্প্রচারের জন্য তাহলে শ্রোতাদের আগ্রহ ধরে রাখতে হবে বক্তার বর্ণনা, বাচন-ভঙ্গি এবং প্রয়োজনমতো সহায়ক শব্দ সমাবেশের মাধ্যমে (যেমন পাখির বিষয়ে আলোচনা হলে নানা রকম পাখির ডাক; ঝড়-বৃষ্টি সম্পর্কে হলে মেঘের গর্জন)।

কাজেই উদ্দিষ্ট পাঠক-শ্রোতার সঙ্গে মাধ্যমের প্রশ্নটিও বিবেচনায় আনতে হয়। নানা ধরনের মাধ্যমের ওপরে নির্ভর করে রচনাশৈলীতে যথেষ্ট তারতম্য দেখা দিতে পারে। যেমন, মাধ্যম হতে পারে: বিজ্ঞান পত্রিকা; সাহিত্যপত্র; পাঠ্যপুস্তক; বিজ্ঞান-সংবাদ; সংবাদপত্রে প্রবন্ধ বা ফিচার; বেতার বা টেলিভিশনে কথিকা; জনসমক্ষে বক্তৃতা; অথবা বিশেষজ্ঞদের সামনে বক্তৃতা। এছাড়া বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার মেজাজও থাকে ভিন্ন ভিন্ন ধরনের। একটি গুরুগম্ভীর সাময়িকীর জন্য যে ধরনের লেখা উপযোগী হবে, কোন চটুল রম্য সাপ্তাহিক পত্রিকায় হয়তো তা একেবারেই মানানসই হবে না। শিশু-কিশোরদের উপযোগী লেখাও হতে পারে প্রধানত শিক্ষামূলক অথবা প্রধানত বিনোদনমূলক ধাঁচের। আবার সংবাদপত্রের জন্য বিজ্ঞান বিষয়ক লেখা হতে পারে নিবন্ধ ধরনের, সাক্ষাৎকার ধরনের অথবা ‘রিপোর্টাজ’ ধরনের।

রচনাশৈলী অনেকটাই নির্ভর করে লেখকের নিজস্ব জ্ঞান, অভিজ্ঞতা আর ‘স্টাইল’ – এর উপর। অন্যের স্টাইল বা শৈলী অনুকরণ করে খুব সার্থক লেখক হওয়া যায় না। কোন্ লেখকের রচনাভঙ্গি কেমন হওয়া উচিত তা অন্য কারো পক্ষে বলে দেয়া শক্ত। তবে বিজ্ঞান নিয়ে লিখে যাঁরা সফল হয়েছেন তাঁরা প্রায় সবাই এমন বিষয় বেছে নেন যা সাধারণ মানুষের জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত – যাঁরা পাঠকের মনে আগ্রহ জাগাতে পারেন; তাঁরা ভাষা ব্যবহার করেন সহজ ও সরাসরি; বিজ্ঞানের বিমূর্ত জগতের সঙ্গে তাঁরা মানুষের বাস্তব জীবনের সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করেন; আর যেখানেই সম্ভব তাঁরা কিছুটা মানবিক আবেদনের মাধ্যমে বক্তব্যকে হৃদয়গ্রাহী করে তুলতে চেষ্টা করেন।

সার্থক বিজ্ঞান লেখকেরা প্রায়শ নিছক বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব ও তথ্যের বর্ণানায় সীমাবদ্ধ না থেকে পাঠকের মনে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি সঞ্চারিত করতে চেষ্টা করেন। বিজ্ঞান মুক্ত মন নিয়ে পৃথিবীর দিকে তাকাতে, প্রকৃতির নিয়মাবলী উদ্ঘাটন করতে এবং সে সব নিয়মকে কাজে লাগিয়ে সমস্যার সমাধান করতে শেখায়। অনুসন্ধিৎসা, বস্তুনিষ্ঠতা, কুসংস্কারমুক্ততা, যুক্তিবাদিতা, প্রকৃতিকে জয় করে মানুষের জীবনকে আরো সুন্দর করে তোলা – এ সবই বিজ্ঞানের শিক্ষা। এই বৈজ্ঞানিক মনোভঙ্গি আয়ত্ত না করে যেমন ভাল বিজ্ঞানী হওয়া যায় না তেমনি ভালো বিজ্ঞান-লেখকও হওয়া যায় না।

লেখক হলেন সেতুবন্ধ

বিজ্ঞান-লেখকের একটা প্রধান ভূমিকা হলো বিজ্ঞানীর বিমূর্ত জগত আর সাধারণ মানুষের রোজকার জীবনের মধ্যে একটা যোগসূত্র রচনা করা। এই লেখক হতে পারেন গবেষণারত বিজ্ঞানী যিনি নিজের গবেষণার বিষয়ে বা তার নিজের ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের অগ্রগতির বিষয়ে সাধারণ মানুষকে জানাতে চান। আবার লেখক হতে পারেন একজন সাংবাদিক যিনি বিজ্ঞানীদের কাজের ফল বা তার তাৎপর্য সম্বন্ধে জনসাধারণকে অবহিত করতে চাইছেন। একালের একজন বহুপ্রজ বিজ্ঞান-লেখক আইজাক অ্যাসিমভ (১৯২০-৯২) নানা বিষয়ে চারশ’র ওপর বই লিখেছেন। ১৯৬৯ সালে তার শততম গ্রন্থ প্রকাশনা উপলক্ষে তিনি বলেছিলেন, “আমি আমার লেখায় গভীর পান্ডিত্য দেখাবার চেষ্টা করি না। … আমার কাজ হলো তরজমা করা। কোন বিষয়ে ডজনখানেক নীরস বই পড়ে আমি সে বিষয় নিয়ে একটি সরস বই লিখে ফেলি।”

Isaac.Asimov01.jpg

অ্যাসিমভ বিনয় প্রকাশ করে বলেছিলেন তাঁর তেমন কোন ‘সৃষ্টিশীল অবদান নেই’; কিন্তু বিজ্ঞানী ও সাধারণ মানুষের মধ্যে অথবা ‘বৈজ্ঞানিক’ ও ‘মানবিক’ সংস্কৃতির মধ্যে সেতুবন্ধ রচনার কাজটি তা বলে নেহাত সামান্য নয়। আজের দিনে বৈজ্ঞানিক কর্মকাণ্ড হয়ে উঠেছে মানুষের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের একটি প্রধান নিয়ামক আর সেই সঙ্গে বিজ্ঞানের অগ্রগতি ও সাধারণ মানুষের বিজ্ঞান-সাক্ষরতার মাধ্যেকার ফারাক যেন বেড়েই চলেছে। এ অবস্থায় এই ব্যবধান ঘোচাবার জন্য সেতুবন্ধ রচনার কাজটির গুরুত্বও ক্রমেই বাড়ছে।

বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করার বিষয়টি আজ আরো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দীর্ঘকালে ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণের ফলে এসব দেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিপ্লবের সুফল ভোগ করার সুযোগ পায় নি বললেই চলে; আজ তারা গা ঝাড়া দিয়ে উঠে তাদের দীর্ঘকালের পশ্চাদপদতা ঝেড়ে ফেলে সামনে এগিয়ে যেতে চাইছে। বৈজ্ঞানিক জ্ঞান ও দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপক বিস্তার এই লক্ষ্য অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করতে পারে।

অবশ্য সেতুবন্ধ রচনা করার ব্যাপারে কিছু সমস্যার কথাও মনে রাখতে হবে। সাধারণ পাঠকদের জন্য সহজ করে লিখতে গিয়ে যেন তথ্যের যথার্থতা নষ্ট না হয় সেদিকে নজর রাখা দরকার। সাংবাদিকদের সাধারণত বেশ চাপ আর ব্যস্ততার মধ্যে অল্প সময়ের মধ্যে খুব তাড়াহুড়ো করে লিখতে হয়; আর এমনি তাড়াহুড়োর মধ্যে লেখার সময় তথ্য বা ব্যাখ্যায় কিছু ভুল ঘটে যাওয়া বিচিত্র নয়। বিজ্ঞানের লেখায় এরকম ভুল শুধু যে বিজ্ঞানীদেরই খুব অপছন্দ তা নয়, এভাবে পাঠকদের মধ্যে ভুল ধারণার বিস্তার ঘটলে তাতে তাঁদের বা অন্যদের মারাত্মক ক্ষতিও হতে পারে। সেজন্য লেখার পর সেটি বিশেষজ্ঞদের দেখিয়ে নেওয়া বা বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা করে নেওয়া নিরাপদ।

জনপ্রিয় পত্রপত্রিকায় লেখার এমনি আরেক রকম বিপদ হলো লেখাকে ফেনানো বা বেশ জমকালো করে তোলা। অনেক সময় নতুন লেখকরা অতিমাত্রায় সাফল্য দাবি করতে কিংবা নাটকীয় আবেদন বা রোমাঞ্চ সৃষ্টির চেষ্টা করতে প্রলুব্ধ হন। লেখাকে সরস করা আর তাকে ফেনিয়ে তোলার মধ্যে ভেদরেখা খুব সামান্য; কিন্তু অভিজ্ঞ লেখককে সেই সীমানা সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে। বিজ্ঞানের আজকের অগ্রগতি এমনিতেই নাটকীয় যে, তাকে অতিরঞ্জিত করে দেখাবার জন্য কোন প্রয়োজন নেই। হয়তো নতুন আবিষ্কৃত কোন ঔষুধের কার্যকারিতা সম্বন্ধে বেশ কিছুটা বাড়িয়ে লেখা হলো। কিছুদিন পর যখন দেখা যাবে সে ঔষুধে তেমন কাজ হচ্ছে না তখন পাঠকদের আশাভঙ্গ হবে। তাতে লেখকের সুনাম ক্ষুণ্ন হতে পারে। অবশ্য কখনো কখনো একজন উদ্ভাবকও তার আবিষ্কার সম্বন্ধে অতিরিক্ত দাবি করে বসতে পারেন। লেখককে সে সম্বন্ধে সচেতন থাকতে হবে। অর্থাৎ তাঁর লেখার বিষয়বস্তু সম্বন্ধে বেশ ভালো করে খুঁটিয়ে জেনে নিয়ে তারপর লেখাটি প্রকাশ করা উচিত। দরকার হলে অন্য বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে তথ্যের নির্ভরযোগ্যতা যাচাই করে নেওয়া যেতে পারে।

অবশ্য এসব কথার অর্থ এ নয় যে, বিজ্ঞানে কল্পনার কোন স্থান নেই। বিজ্ঞানের নানা ক্ষেত্রে অনেক ভবিষ্যদ্বাণী – যেমন এইচ. জি. ওয়াল্স্ ও আর্থার সি. ক্লার্কের মহাকাশ জয় সম্পর্কিত ভবিষ্যদ্বাণী আজ নাটকীয়ভাবে বাস্তব রূপ নিয়েছে। তবে বিজ্ঞান নিয়ে লিখতে গিয়ে কল্পনাকে বাস্তবের সীমার মধ্যে রাখা প্রয়োজন। তবে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর আর বিজ্ঞান-রচনা যে এক নয় সে কথাও মনে রাখা দরকার।

তৃতীয় এক সমস্যা হলো বক্তব্যের চেয়ে ভাষা বা প্রকাশভঙ্গির ওপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া। লেখক কখনো কখনো তাঁর লেখাকে আকর্ষণীয় করতে গিয়ে কিছুটা অচেতনভাবেও এটা করতে পারেন। বিজ্ঞান-লেখক বিজ্ঞান ও সাধারণ মানুষের মধ্যে সেতুবন্ধ হলেও তাঁর রচনায় স্বভাবতই তাঁর নিজস্ব ব্যক্তিত্ব ও প্রকাশভঙ্গির ছাপ পড়বে। সামাজিক পটভূমির সঙ্গে সংযোগ রক্ষার জন্য তিনি হয়তো তাঁর লেখায় কিছুটা সাংস্কৃতিক বা সাহিত্যিক চরিত্রও আরোপ করবেন। কিন্তু লক্ষ্য রাখা দরকার ভাষার সজ্জা বেশি প্রাধান্য পেয়ে বৈজ্ঞানিক বক্তব্যটুকু যেন নিষ্প্রভ হয়ে না পড়ে। কখনও কখনও তরুণ বা অনভিজ্ঞ লেখকরা পাণ্ডিত্য জাহির করার জন্য লেখায় অপ্রয়োজনীয় জটিল বিষয়ের অবতারণা করেন। কিন্তু বুদ্ধিমান পাঠক এ ধরনের লেখায় চমৎকৃত হন না, বরং এতে লেখার মান ক্ষুণ্ন হয়।

শুরুটাই সবচেয়ে কঠিন

কোন বিজ্ঞানী যখন বিজ্ঞান পত্রিকায় তাঁর গবেষণার বিষয় নিয়ে লেখেন তখন তাঁকে তার রচনাশৈলী নিয়ে তেমন মাথা ঘামাতে হয় না; সচরাচর তিনি সেই পত্রিকায় প্রচলিত রচনাশৈলী অনুসরণ করেন। অবশ্য ভাষার প্রাঞ্জলতা ও তথ্যনিষ্ঠার বিষয় তাকে সতর্ক থাকতে হয়; কিন্তু সাধারণ পাঠক তাঁর লেখা পড়ে কতটা বুঝবে তা নিয়ে তাঁর কোন দুশ্চিন্তার কারণ ঘটে না। তিনি যদি ইংরেজিতে লেখন তাহলে তো কথাই নেই, তবে যদি এর আগে বাংলায় লেখার তাঁর তেমন অভ্যাস না থেকে থাকে তাহলে হয়তো পরিভাষার ব্যাপারটা কিছু সমস্যা সৃষ্টি করবে, কিন্তু তাতে রচনাশৈলীতে তেমন হেরফের ঘটবে না।

সে তুলনায় সাধারণ মানুষের জন্য লেখার ব্যাপারটা বেশ খানিকটা জটিল। এখানে লেখার ভাষা অবশ্যই হবে সাধারণ মানুষের ভাষা। হয়তো একজন বিজ্ঞানী লেখা শুরু করতে চাইবেন তাঁর প্রিয় কোন বিষয় নিয়ে যেমন যে বিষয় নিয়ে তিনি গবেষণা করছেন তার ওপরে। কিন্তু বিষয়টা এমন হওয়া চাই যা সাধারণ পাঠকদের কাছেও বেশ আকর্ষণীয় মনে হবে। অধিকাংশ লেখকের পক্ষেই লেখার বিষয়বস্তু স্থির করা আর লেখা শুরু করাটা সবচাইতে কঠিন বলে মনে হয়। কোন বিষয়ে প্রবন্ধ লিখতে গেলে তার প্রথম অনুচ্ছেদটা রীতিমতো গুরুত্বপূর্ণ। এটি একাধারে হওয়া চাই এমন সহজ, সরাসরি এবং আকর্ষণীয় যেন তা পাঠককে তার পরের বিষয়গুলোতে টেনে নেয়, সে বিষয়ে আরো জানতে আগ্রহীয় করে তোলে। আরম্ভটা ভাল হলে ‘শুরুতেই কেল্লা ফতে’ এ কথাটা খেটে যেতেও পারে।

লোকে সাধারণত এমন সব বিষয় জানতে চায় যেগুলো তাদের জীবনে প্রভাব বিস্তার করে বলে সহজেই বোঝা যায় – যেমন, খরা, বন্যা, ঝড়বৃষ্টি, অসুখ-বিসুখ, চাষ-বাস, বনভূমির বিনাশ, পুষ্টি সমস্যা, জনসংখ্যা বিস্ফোরণ, সূর্যগ্রহণ ইত্যাদি। এসব বিষয় নিয়ে লিখতে গিয়ে এগুলোর পেছনের বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের কথা আনা যায়। সমসাময়িক কোন সমস্যা নিয়ে লিখলে পাঠক সহজেই সে লেখা পড়তে আগ্রহী হয়ে ওঠে।

এই শতাব্দীর একজন সেরা বিজ্ঞান-লেখক জেবিএস হ্যালডেন (১৮৯২-১৯৬৪) যে-কোন অতি সাধারণ বিষয় নিয়ে লিখেও তাকে পাঠকদের কাছে অত্যন্ত আকর্ষণীয় করে তুলতে পারতেন। একজন অতি উঁচুমানের জীববিজ্ঞানী হয়েও তিনি বিলেতের শ্রমিকদের পত্রিকা ‘দ্য ডেইলি ওয়ার্কার’-এর জন্য সপ্তাহে বিজ্ঞানের কোন বিষয় নিয়ে একটি করে প্রবন্ধ লিখতেন। তিনি এসব রচনায় ‘পোকামাকড়’ বা ‘ব্যাঙেরা কেন আমার পছন্দ’ এধরনের সাদামাটা বিষয় নিয়ে যেমন লিখতেন, তেমনি লিখতেন ‘চিন্তাশীল যন্ত্রাদি’ বা ‘দর্শনের প্রয়োজন কি’ এমনি সব জটিল বিষয় নিয়েও। তাঁর এসব রচনা ত্রিশ, চল্লিশ এবং পঞ্চাশের দশকে অনেকগুলো বইয়ের আকারে সঙ্কলিত হয়। পরে অবশ্য একপর্যায়ে হ্যালডেন তাঁর মাতৃভূমি ইংল্যান্ডের ওপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে ভারতে এসে বসবার করতে থাকেন এবং সেখানেই মারা যান।

চল্লিশের দশকের মাঝামাঝি হ্যালডেন একটি প্রবন্ধে তাঁর জনপ্রিয় রচনাশৈলীর কিছু কৌশল তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন, “লেখা শেষ হবার পর সেটা কোন বন্ধুকে পড়তে দিন – বন্ধুটি যদি লেখাপড়া কম জানেন তাহলে আরো ভালো। কিংবা লেখাটি ছ’মাস ফেলে রেখে দেখুন তার পরও আপনি নিজে সেটা পড়ে বুঝতে পারেন কি না। হয়তো দেখবেন সময় লেখার সময় যে সব বাক্য খুব সহজ মনে হয়েছিল এমন কিছু অংশ এখন বেশ জটিল ঠেকছে।” এরপর তিনি এ ধরনের জটিলতা কাটিয়ে ওঠার কিছু কৌশল বলেছেন। যেমন, যেখানে যেখানে সম্ভব লম্বা বাক্যকে ভেঙে ফেলে ছোট ছোট বাক্য ব্যবহার করুন; ক্রিয়াপদের ক্ষেত্রে পরোক্ষ ক্রিয়াপদ ব্যবহার না করে প্রত্যক্ষ ক্রিয়াপদ ব্যবহার করুন; কোন ঘটনা বর্ণনা করে এক লাফে তার কারণে না চলে গিয়ে কারণটা আগে বলে নিয়ে তারপর ধাপে ধাপে তার ফলাফলে গিয়ে পৌঁছান।

এসব সুপারিশ যদিও প্রধানত ইংরেজি ভাষার লেখকদের জন্য করা হয়েছিল তবু এগুলো সব দেশের এবং সব ভাষার জন্যই প্রযোজ্য। আমাদের দেশের লেখকদের জন্য এর সঙ্গে আরো কিছু পরামর্শ যোগ করা যেতে পারে। যেমন: চলতি ভাষা আর সাধু ভাষার মিশেল যেন না ঘটে সেদিকে খেয়াল রাখুন; বিধায়, অত্র, কতিপয, যদিচ, তথাপি, ইহা – এ ধরনের পুরনো ধাঁচের শব্দ বর্জন করুন; ‘কেবলমাত্র’ না লিখে লিখুন ‘কেবল’ বা ‘মাত্র’, ‘ফলশ্রুতিতে’ না লিখে লিখুন ‘ফলে’। লেখাটি পড়ার সময় ভেবে দেখুন আপনার পাঠক-পাঠিকা সহজে আপনার লেখার অর্থ উদ্ধার করতে পারে কি না। পাঠকের পড়ার সুবিধের জন্য অপ্রচলিত শব্দের বদলে যথাসম্ভব সহজ ও প্রচলিত শব্দ ব্যবহার করুন। যেমন ‘গ্যাস নির্গত হয়’ না লিখে বরং লিখুন ‘গ্যাস বেরোয়’, ‘ভক্ষণ করা’ না লিখে লিখুন ‘খাওয়া’, ‘অভ্যন্তরে’ না লিখে লিখুন ‘ভেতরে’; ছোট ছোট বাক্যে যথাসম্ভব সঠিক ও স্পষ্ট ভাষা ব্যবহার করুন; তথ্য সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে লিখুন; লেখার সঙ্গে সম্ভব হলে কিছু ছবি ব্যবহার করুন।

বিজ্ঞানের প্রত্যেক ক্ষেত্রে কিছু নিজস্ব শব্দ-সমাহার আছে। জনপ্রিয় বিজ্ঞান-রচনায় এসব শব্দ কতখানি ব্যবহারিত হবে তা অনেকটাই নির্ভর করবে উদ্দিষ্ট পাঠকদের ধরনের ওপরে। অবশ্য ছোট ছোট বাক্যের ব্যাবহার সব শ্রেণীর পাঠকদের জন্যই সুবিধাজনক। খুব সহজ বাক্য ব্যবহার করেও অনেক গভীর ও জটিল ভাব প্রকাশ করা যায় – আমাদের সাহিত্যে তার বহু নজির রয়েছে। তবে সহজ ভাষায় জটিল ভাব প্রকাশ কিছুটা চেষ্টা ও যত্নসাপেক্ষ সেকথা মানতেই হবে। ‘সহজ করে লিখতে আমায় কহ যে, সহজ কথা যায় না বলা সহজে’ – বলেছেন ভাষার জাদুকর রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং। যে লেখকের মনে তাঁর নিজের বিষয় এবং পাঠকের জন্য যথেষ্ট দরদ আছে তাঁর কাছে সহজ ভাষায় লেখার জন্য এই বাড়তি শ্রম সার্থক বলে মনে হবে।

এসব সমস্যা রয়েছে বলে বিজ্ঞান-লেখকদের নিরুৎসাহিত হবার কারণ নেই। সারা পৃথিবীতে আজ বিজ্ঞানীদের সংখ্যা দ্রুতগতিতে বাড়ছে; সেই সঙ্গে বাড়ছে বিজ্ঞান বিষয়ক নানা লেখার চাহিদা। তার ফলে এ জাতীয় লেখার ঐতিহ্যও ক্রমেই সমৃদ্ধ হচ্ছে। এই ঐতিহ্য হয়তো আজও কবিতা বা নাটকের ঐতিহ্যের মতো শক্তিশালী হয়ে ওঠে নি, কিন্তু বিজ্ঞান বিষয়ে লেখার গুরুত্ব ও মর্যাদা যে ভবিষ্যতে আরো বাড়তে থাকবে তা আজ নিঃসন্দেহে বলা যায়।

এক গৌরবময় ঐতিহ্য

সৌভাগ্যক্রমে বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান বিষয়ে লেখার এক দীর্ঘকালীন ও গৌরবময় ঐতিহ্য রয়েছে। উনিশ শতকের মাঝামাঝি আধুনিক বাংলা গদ্যের উদ্ভবের প্রায় শুরু থেকেই বিজ্ঞান নিয়ে লেখারও সূত্রপাত ঘটে। অক্ষয়কুমার দত্ত (১৮২০-৮৬), বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৩৮-৯৪), রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী (১৮৬৪-১৯১৯), রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১) প্রমুখ বাংলা সাহিত্যের সেকালের দিকপালরা এই ঐতিহ্যকে শক্তিশালী করে তুলেছেন।

বাংলা ভাষায় শুধু যে সাহিত্যসেবীরাই এক্ষেত্রে অবদান রেখেছেন তা নয়, বাংলাভাষী প্রায় সব প্রথম সারির বিজ্ঞানীও আন্তরিকতা ও নিষ্ঠা নিয়ে বাংলাভাষায বিজ্ঞান আলোচনায় এগিয়ে এসেছেন। জগদীশ চন্দ্র বসু (১৮৫৯-১৯৩৭), প্রফুল্ল চন্দ্র রায় (১৮৬১-১৯৪৪), মেঘনাদ সাহা (১৮৯৩-১৯৫৬), সত্যেন্দ্রনাথ বসু (১৮৯৪-১৯৭৪), কাজী মোতাহার হোসেন (১৮৯৭-১৯৮১), মোহাম্মাদ কুদরাত-এ-খুদা (১৯০০-১৯৭৭) প্রমুখ বিশিষ্ট বিজ্ঞানী এক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছেন। বৈজ্ঞানিক গবেষণায় অবদানের জন্য তাঁদের খ্যাতি দেশের সীমানা ডিঙ্গিয়ে বিদেশেও বিস্তৃত।

এঁদের নাম উল্লেখ শুধু আজকের বিজ্ঞান-লেখকদের মনে করিয়ে দেবার জন্য যে, বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান রচনার ক্ষেত্রে তাঁরা এক সমৃদ্ধ ও উজ্জ্বল ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী। এই ঐতিহ্যকে এগিয়ে নিতে হলে আরো প্রাঞ্জল, আরো আকর্ষণীয় রচনার মাধ্যমে বিজ্ঞানকে দেশের ব্যাপক জনসমাজের কাছে পৌঁছে দেবার উদ্যোগ তাঁদের নিতে হবে।

বিজ্ঞান নিয়ে যাঁরা লেখেন তাঁদের কখনো কখনো এরকম একটি প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়: বিজ্ঞান নিয়ে লেখা আসলে কতটা বিজ্ঞান আর কতখানি শিল্পকলা বা সাহিত্য? – এ প্রশ্নের কোন সর্বজনীন বা চূড়ান্ত জবাব দেওযা শক্ত। কেননা সে জবাব অনেকটাই নির্ভর করবে লেখক, তার নিজস্ব রচনাভঙ্গি এবং পাঠক ভুবনের ওপর।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একেবারে জীবন সায়াহ্নে এসে ‘বিশ্ব-পরিচয়’ নামে বিজ্ঞান বিষয়ক একটি বই লিখেছিলেন। এ বইতে তিনি রীতিমতো ‘সাহিত্যিক’ ভাষা ব্যবহার করেছেন – তাতে ছড়ানো অসংখ্য কাব্যময় উপমা। এ রকম ভাষার ব্যবহার রবীন্দ্রনাথের জন্য খুব স্বাভাবিক ছিল; কিন্তু এ ভাষায় বিজ্ঞান নিয়ে লিখে সার্থকতা লাভ সবার পক্ষে সম্ভব নয়।

আসলে প্রত্যেক লেখকেরই রয়েছে নিজস্ব পরিমণ্ডল ও অভিজ্ঞতা এবং সেই সঙ্গে নিজের ব্যক্তিসত্তা। এসবের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে তাঁর নিজের বিশেষ রচনাভঙ্গি। প্রত্যেকের জন্য তাঁর নিজের রচনাভঙ্গিই তাই সবেচেয়ে উপযোগী। আর সে রচনাশৈলী যদি পাঠকদের মনোপূত হয় তাহলে তা নিঃসন্দেহে সার্থক।