মহাবিশ্বের শেষ প্রান্তে : মহাকর্ষের গতি ও রবীন্দ্রনাথ

লেখাটি বিভাগে প্রকাশিত
[পূর্বের পোস্ট]

রবীন্দ্রনাথের নাম উচ্চারণ ছাড়া বাঙ্গালী নাকি এক পাও এগুতে পারে না। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের বিশ্বপরিচয় প্রতিটি বিজ্ঞান-পিপাসু বাঙ্গালীর পড়া উচিত। এই বইটি রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনের শেষ-প্রান্তে (১৯৩৭এ প্রকাশ) লিখেছিলেন, উৎসর্গ করেছিলেন সত্যেন বসুকে। এর উপসংহারে রবীন্দ্রনাথ এনট্রোপী ও মহাবিশ্বের শীতল মৃত্যু নিয়ে লিখেছিলেনঃ

“পণ্ডিতেরা বলেন, বিশ্বজগতের আয়ু ক্রমাগতই ক্ষয় হচ্ছে এ কথা চাপা দিয়ে রাখা চলে না। মানুষের দেহের মতোই তাপ নিয়ে জগতের দেহের শক্তি। তাপের ধর্মই হচ্ছে যে খরচ হতে হতে ক্রমশই নেমে যায় তার উষ্মা। সূর্যের উপরিতলের স্তরে যে তাপশক্তি আছে তার মাত্রা হচ্ছে শূণ্য ডিগ্রির উপরে ছয় হাজার সেন্টিগ্রেড। তারই কিছু কিছু অংশ নিয়ে পৃথিবীতে বাতাস চলছে, জল পড়ছে, প্রাণের উদ্যমে জীবজন্তু চলাফেরা করছে। সঞ্চয় তো ফুরোচ্ছে, একদিন তাপের শক্তি মহাশূণ্যে ব্যাপ্ত হয়ে গেলে আবার তাকে টেনে নিয়ে এনে রূপ দেবার যোগ্য করবে কে। একদিন আমাদের দেহের সদাচঞ্চল তাপশক্তি চারি দিকের সঙ্গে একাকার হয়ে যখন মিলে যায়, তখন কেউ তো তাকে জীবযাত্রায় ফিরিয়ে আনতে পারে না। জগতে যা ঘটছে, যা চলছে, পিঁপড়ের চলা থেকে আকাশে নক্ষত্রের দৌড় পর্যন্ত, সমস্তই তো বিশ্বের হিসাবের খাতায় খরচের অঙ্ক ফেলে চলেছে। সে সময়টা যত দূরেই হোক একদিন বিশ্বের নিত্যখরচের তহবিল থেকে তার তাপের সম্বল ছড়িয়ে পড়বে শূণ্যে। এই নিয়ে বিজ্ঞানী গণিতবেত্তা বিশ্বের মৃত্যুকালের গণনায়  বলেছিল।”

Rabindranath Tagore | Biography, Poems, Short Stories, Nobel Prize, & Facts  | Britannica

বর্তমান পর্যবেক্ষণ বলছে মহাবিশ্বের প্রসারণ বন্ধ হবার কোন লক্ষণ নেই। কাজেই মহাবিশ্বে এনট্রোপী ক্রমাগত বাড়বে এবং বিশ্ব ক্রমশঃ শীতল হতে থাকবে। জেমস জীনস, এডিংটন বা অন্যদের বই পড়ে রবীন্দ্রনাথ ওপরের প্যারাটা লিখতে পেরেছিলেন, এটা তাঁর গভীর অন্তর্দৃষ্টির পরিচয়। কিন্তু বিশ্বপরিচয় পড়তে গিয়ে আমার নীচের প্যারাটি চোখে পড়ল –

মহাকর্ষ সম্বন্ধে এই যে মতের আলোচনা করা গেল ন্যুটনের সময় থেকে এটা চলে আসছে। এর থেকে আমাদের মনে এই একটা ধারণা জন্মে গেছে যে, দুই বস্তুর মাঝখানের অবকাশের ভিতর দিয়ে একটা অদৃশ্য শক্তি টানাটানি করছে।

কিন্তু এই ছবিটা মনে আনবার কিছু বাধা আছে। মহাকর্ষের ক্রিয়া একটুও সময় নেয় না। আকাশ পেরিয়ে আলো আসতে সময় লাগে সে কথা পূর্বে বলেছি। বৈদ্যুতিক শক্তিরাও ঢেউ খেলিয়ে আসে আকাশের ভিতর দিয়ে। কিন্তু অনেক পরীক্ষা করেও মহাকর্ষের বেলায় সেরকম সময় নিয়ে চলার প্রমাণ পাওয়া যায় না। তার প্রভাব তাৎক্ষণিক। আরো একটা আশ্চর্যের বিষয় এই যে, আলো বা উত্তাপ পথের বাধা মানে কিন্তু মহাকর্ষ তা মানে না। একটা জিনিসকে আকাশে ঝুলিয়ে রেখে পৃথিবী আর তার মাঝখানে যত বাধাই রাখা যাক না তার ওজন কমে না। ব্যবহারে অন্য কোনো শক্তির সঙ্গে এর মিল পাওয়া যায় না।

অবশেষে আইনস্টাইন দেখিয়ে দিলেন এটা একটা শক্তিই নয়। আমরা এমন একটা জগতে আছি যার আয়তনের স্বভাব অনুসারেই প্রত্যেক বস্তুই প্রত্যেকের দিকে ঝুঁকতে বাধ্য। বস্তুমাত্র যে-আকাশে থাকে তার একটা বাঁকানো গুণ আছে, মহাকর্ষে তারই প্রকাশ। এটা সর্বব্যাপী, এটা অপরিবর্তনীয়। এমন-কি, আলোককেও এই বাঁকা বিশ্বের ধারা মানতে বাধ্য। তার নানা প্রমাণ পাওয়া গেছে। বোঝার পক্ষে টানের ছবি সহজ ছিল কিন্তু যে-নূতন জ্যামিতির সাহায্যে এই বাঁকা আকাশের ঝোঁক হিসেব করে জানা যায় সে কজন লোকেরই বা আয়ত্তে আছে।”

(বোল্ডফেস আমার দেয়া)

রবীন্দ্রনাথ সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্বকে দু-কথায় চমৎকার ভাবে উপস্থাপিত করেছেন। তাঁর ভাষার সহজ বাঁধুনীর সঙ্গে কে পাল্লা দেবে? (তিনি কসমোলজীকে বলেছেন জগতত্ত্ব।) কিন্তু কেন জানি তাঁর মনে হয়েছে “মহাকর্ষের ক্রিয়া একটুও সময় নেয় না… তার প্রভাব তাৎক্ষণিক।” তাছাড়া ওজন নিয়ে তিনি যে কথাগুলো বলেছেন সেটাও মহাকর্ষের সঙ্গে ওজনের যে সম্পর্ক সেটা তুলে ধরে না বরং জলকে আরো ঘোলা করে।

নিউটন ভাবতেন মহাকর্ষ ভ্রমণ করে তাৎক্ষণিক ভাবে, কিন্তু আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্বের একটা স্বীকার্য হল মহাকর্ষের গতি আলোর গতির সমান। তবে রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশায় এই বইটির কয়েকটি সংস্করণ প্রকাশ করা হয়। সত্যেন বসু বা শান্তিনিকেতনের অধ্যাপক প্রমথ সেনগুপ্ত, যিনি বিশ্বপরিচয়ের প্রথম ভার্সানটার রূপ দিয়েছিলেন, তাঁরা কেন এটা সংশোধন করে দেন নি? কিন্তু রবীন্দ্রনাথের ও তাঁদের পক্ষ নিয়ে বলব সেই সময়ের ও পরবর্তীতে বিজ্ঞানের যে সমস্ত লেখা আছে তাতে এই জিনিসটা কখনই পরিষ্কার করে বলা হয় নি। এমন কি এডিংটন যাঁর লেখা রবীন্দ্রনাথ হয়তো পড়েছিলেন এবং যিনি সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্বের একজন বড় প্রবক্তা ছিলেন তিনিও এই সম্বন্ধে বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন কথা বলেছেন। তাই মহাকর্ষের গতি অনেকের কাছেই একটা বড় প্রপঞ্চ হয়ে রয়ে গেছে। Hulse ও Taylor একটি যুগ্ম পালসার সিস্টেম ব্যবহার করে মহাকর্ষ ক্ষেত্র যে সাধারণ আপেক্ষিকতা মেনে চলে সেটা প্রমাণ করেন, তাঁরা এর জন্য নোবেল পান। তবেঁ একটি মাত্র এক্সপেরিমেন্ট দাবী করে যে সরাসরি ভাবে মহাকর্ষের গতি নিরূপণ করা গেছে (আলোর গতির সমান), কিন্তু সেই এক্সপেরিমেন্টটি সর্বজনগ্রাহ্য হয় নি এখনো।

পাঠকরা ইন্টারনেটের বদৌলতে বিশ্বপরিচয় পড়তে পারবেন।

http://rabindra.rachanabali.nltr.org/node/4?subcatid=11&catId=6

এই লেখার সাথে গগেন ঠাকুরের আঁকা রবীন্দ্রনাথের একটি ছবি দিলাম। রবীন্দ্রনাথ যেন এক অন্ধকার গুহায় দাঁড়িয়ে আছেন, বহুদূরে আলো দেখা যাচ্ছে। হয়তো অন্ধকার থেকে বহুদূরের আলোকময় জ্ঞানের খোঁজে আমাদের যাত্রাকেই এই ছবি বোঝাতে চাইছে। আর একদম ওপরের ছবিতে কোন সুপারনোভা বিস্ফোরণের ফলে যে মহাকর্ষ তরঙ্গ সৃষ্টি হয় তার সরাসরি পর্যবেক্ষণের জন্য LISA ডিটেকটরের একটা ছবি দেয়া হল, LISA চালু হতে হতে ২০৩০ হয়ে যেতে পারে। http://scienceblogs.com/startswithabang/2010/08/what_is_the_speed_of_gravity.php

পূর্বে ফেসবুকে নোট হিসেবে প্রকাশিত

লেখাটি 310-বার পড়া হয়েছে।

ই-মেইলে গ্রাহক হয়ে যান

আপনার ই-মেইলে চলে যাবে নতুন প্রকাশিত লেখার খবর। দৈনিকের বদলে সাপ্তাহিক বা মাসিক ডাইজেস্ট হিসেবেও পরিবর্তন করতে পারেন সাবস্ক্রাইবের পর ।

Join 906 other subscribers