৮৫ বছর, ড্রপগুলির অপেক্ষায়!

(বলা হয় বিজ্ঞানকে তাড়া দেয়া যায়না। যদিও নিবন্ধ প্রকাশের প্রতিযোগিতা বা ফান্ডিং এর সুযোগ এই ব্যাপারটাকে ঠিক সাহায্য করেনা। কিন্তু কিছু কিছু বিজ্ঞানের পরীক্ষাকে চাইলেও তাড়া দেয়া যায়না। যেমন মানুষের জীবন-দৈর্ঘ্য নিয়ে গবেষণা বা মহাজাগতিক পরীক্ষা। এদের জন্য সময় দিতে হয়। এমনই দীর্ঘ সময় ধরে চলা কিছু পরীক্ষা নিয়ে এই সিরিজ। প্রথম পর্ব)

গত ২৩ আগষ্ট হ্রদযন্ত্র বন্ধ হয়ে মারা গেলেন অষ্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জন মেইনস্টোন। এই বিজ্ঞানী বিখ্যাত কিন্তু অতি ধীরগতির এক পরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছিলেন গত ৫০ বছর ধরে। ১৯৬১ সালে তার বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার ২য় দিনে একটি ক্ষুদ্রাকার পরীক্ষার সংস্পর্শে আসলেন যেটা একটি শেলফের ভেতরে ৩৪ বছর ধরে চলছিল। ৫০ বছর পর, তিনি জীবনের শেষদিন পর্যন্ত এই পরীক্ষার অতি-নাটকীয় ফলাফলের জন্য অপেক্ষা করছিলেন।

পিচ-ড্রপ নামের পরীক্ষাটি শুরু হয়েছিল যখন কুইন্সল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যার প্রথম অধ্যাপক থমাস পারনেল একটা ক্লাসে ছাত্রদেরকে পেট্রোলিয়াম-জাত পিচ (পিচ হল কঠিন পলিমার, উদ্ভিদ বা পেট্রোলিয়াম থেকে পাওয়া যায়। রাস্তা বানানোর সময়ে যেসব কালো পিচ দেয়া হয় সেরকম) যে একটি ফানেলের ভিতর দিয়ে গলে যেতে পারে এবং ড্রপ আকারে পরতে পারে সেটা দেখাচ্ছিলেন। আসলে পিচ এমন শক্ত হয় যে ঠান্ডা পিচকে হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করলে ভেঙে যায়। যন্ত্রটা হত পৃথিবীর ধীরতম কাঁচ-ঘড়ি। এপরবর্তিতে এটা আসলেই পৃথিবীর ধীরতম ঘড়ি হিসেবে বিবেচিত হল- এক ড্রপ পিচ গলে পরতো প্রতি ৬ থেকে ১২ বছরে। সাবধানী হয়েই মেইনস্টোন ভাবতেন – নবম ড্রপটি পরবে এবছরেরই শেষদিকে। কিন্তু দূর্ভাগ্যজনকভাবে সেটা আর তাঁর দেখে যাওয়া হলনা।

পিচ-ড্রপ পরীক্ষা এখন পর্যন্ত ৮টি ড্রপ তৈরি করেছে ১৯২৭ সাল থেকে

বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের দিক দিয়ে এই পরীক্ষা যদিও খুব ফসলী নয়। ৮৫ বছরে মাত্র একটি বৈজ্ঞানিক নিবন্ধ তৈরি করেছে (সূত্র 3)। নিবন্ধটিতে দেখানো হয়েছে যে পিচ পানির চেয়ে ২৩০ বিলয়ন গূণ বেশি ঘণ। আর ২০০৫ সালে এরকম পরীক্ষার জন্য ব্যাঙ্গাত্বক ‘ইগ নোবেল প্রাইজ’ পেয়েছে।

এরপরও যদিও এখানের কিছু বৈজ্ঞানিক বিষয় জানার বাকি আছে। কেউ এখন পর্যন্ত কোন ড্রপ পরতে সরাসরি দেখেনি- একটি ওয়েবক্যাম বসানো হয়েছিল, কিন্তু সেটাও ২০০০ সালের নভেম্বরে ড্রপটিকে মিস করেছে। তাই, ড্রপ পরার পরপর উপরে মূল পিচে কি ঘটে সেটা এখনও জানা যায়নি। এরপর আরো কয়েক দশক লাগবে এটাই বুঝতে কিভাবে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ, আবহাওয়া এবং দালান সারানোর কাজকর্মের কারনে কম্পণ কিভাবে একই ড্রপ পরার হারকে প্রভাবিত করেছে।

কিন্তু মেইনস্টোন বলছেন যে, এই পরীক্ষার গুরুত্ব ঠিক বিজ্ঞানের মধ্যে নেই,বরং এর আছে ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক গুরুত্বঃ এই পরীক্ষা ভাষ্কর, কবি এবং লেখকদের অনুপ্রাণিত করেছে সময়ের পথ এবং আধুনিক জীবনযাত্রার গতিকে ব্যাখ্যা, তুলনা, বর্ণনা করতে। এটা বৈজ্ঞানিক ইতিহাস এবং স্থায়িত্ব বা টিকে থাকার মধ্যে সংযোগ স্থাপনও করেছে। মেইনস্টোনের কথায়- ‘পৃথিবীতে যখন ধুন্দুমার কান্ড ঘটে যাচ্ছে তখন দিনের পর দিন ধরে এই যন্ত্র তার কাজ করে চলেছে।’

সেইসঙ্গে যেহেতু এখনও অনেকখানি পিচই রয়ে গেছে যন্ত্রটিতে সেহেতু এই যন্ত্র আরও ১৫০ বছরের মত পৃথিবীর এই মহাযঞ্জকে উপেক্ষা করে যাবে। আশার কথা, ৭৮ বছর বয়সে মারা যাওয়ার আগে মেইনস্টোন তাঁর এক তরুণ সহকর্মীকে তাঁর মৃত্যুর পর এই যন্ত্র দেখভালের জন্য দায়িত্ব দিয়ে গেছেন।

মহান এই মানুষটির জন্য শ্রদ্ধা। এমন পরীক্ষা টিকে থাকুক আরও অনেক অনেক দিন।

আপডেট: অবশেষে ইহা দেখা গেল: http://www.nature.com/news/world-s-slowest-moving-drop-caught-on-camera-at-last-1.13418?WT.mc_id=FBK_NatureNews

সূত্রঃ

1. Nature 495, 300-303; 2013
2. Nature 437, 938-939; 2005
3. Edgeworth, R., Dalton, B. J. & Parnell, T. Eur. J. Phys. 5, 198-200 (1984)

লেখাটি 397-বার পড়া হয়েছে।


আলোচনা

Response

  1. মজার তো! কল্পনাই করা যায় না দুনিয়াতে এই রকম এক্সপেরিমেন্ট হয়!

Leave a Reply

ই-মেইলে গ্রাহক হয়ে যান

আপনার ই-মেইলে চলে যাবে নতুন প্রকাশিত লেখার খবর। দৈনিকের বদলে সাপ্তাহিক বা মাসিক ডাইজেস্ট হিসেবেও পরিবর্তন করতে পারেন সাবস্ক্রাইবের পর ।

Join 905 other subscribers