ভূমিকম্পের বিজ্ঞান [১]

লিখেছেন

লেখাটি , বিভাগে প্রকাশিত

মাস কয়েক আগে আমি আমার খাটের উপর বসে কিছু একটা কিছু একটা করছিলাম এমন সময়ে হঠাৎ করে মনে হল যেন খাটটা নড়ে উঠেছে। আমি যেন স্পষ্ট অনুভব করলাম চলন্ত ট্রেনের সিটে বসে থাকলে যেমন একধরনের দুলুনি হয় তেমন একটা দুলুনি বয়ে গেছে সামান্য সময়ের জন্য। তখন তখনই মনে মনে ভেবে নিয়েছিলাম এটা একটা ভূমিকম্প। টর্নেডো সাইক্লোন জলোচ্ছ্বাস বন্যা এসব দুর্যোগের আগাম খবর পাওয়া গেলেও ভূমিকম্পের আগাম খবর সাধারণত পাওয়া যায় না। ঘটনা ঘটে যাবার বেশ কিছুটা সময় পর জানতে পেরেছিলাম এটি আসলেই ভূমিকম্প ছিল এবং সেটি হয়েছিল সুদূর ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে। আমার শহর ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে ত্রিপুরা রাজ্য কাছে হলেও খুব একটা কাছে নয়। ভেবে অবাক হই সাধারণ মাত্রার একটা ভূমিকম্প কোথায় শত শত কিলোমিটার দূরে হয়েছে আর তার রেশ এসে লেগেছে এখানে এত দূরে। কি এক বিশাল শক্তির অধিকারী যার ফলে পানির ঢেউ যেমন পানি বেয়ে এগিয়ে যায় এটিও তেমন ঢেউয়ের মত করে এগিয়ে যায় মাটি বেয়ে। আমিতো হাজার কিলোমিটার দূরে থেকে ভূমিকম্পটির সামান্য রেশাংশ মাত্র অনুভব করতে পেরেছি, এর বেশি তেমন কিছুই আমার কিংবা আমার আশেপাশের কারোরই হয়নি। কিন্তু ভূমিকম্পটি ঠিক যে অঞ্চলটিতে সংঘটিত হয়েছিল সে অঞ্চল এবং তার আশেপাশের এলাকার যে কী অবস্থা হয়েছিল।

ভূমিকম্প যদি আগ্নেয়গিরির মত হতো তবে মানুষ সহ অন্যান্য প্রাণীকুলের এতটা ক্ষতি করতে পারতো না। কিংবা ভূমির এই এই ‘কম্প’ যদি শুধু কম্পনেই শেষ হয়ে যেত তবে আর মানুষের এত ক্ষতি হত না। ক্ষয়ক্ষতি হয় বাড়িঘর, গাছপালা, বিদ্যুৎ সংযোগ সহ নানা অবকাঠামো ধ্বংসের ফলে। এই কম্পনের ফলেই ধ্বংস হয় বাড়িঘর। আর বাড়িঘরের নিচে চাপা পড়ে মারা যায় মানুষ।

ভূমিকম্পের ভয়াবহতা এতোই বিশাল পরিমাণের হতে পারে যে মাত্র একটি ভূমিকম্পের ফলে কয়েক লক্ষ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে। যেখানে বাংলাদেশের এক বছরের বাজেট হয় দেড় লক্ষ কোটি টাকা। ২০১১ সালে জাপানে একটি ভূমিকম্প সংঘটিত হয় যার ফলে কয়েক হাজার কোটি ডলারের বেশি সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি হয়। ভূমিকম্পের এমনও নজির আছে যেটি লক্ষাধিক মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল। এমনকি ছোটখাটো একটা যুদ্ধেও এত পরিমাণ মানুষ মারা যায় না।

কারণ:
পৃথিবীর গঠনে আমরা দেখতে পাই পৃথিবীর উপরিভাগটা অশ্মমণ্ডল বা ক্রাস্ট(Crust) নামক একটি স্তর দিয়ে গঠিত। উপরিভাগের এই স্তরটি কতগুলো প্লেট বা খণ্ডকে বিভক্ত। এই প্লেটগুলো আবার স্থির নয়, বছরের পর বছর ধরে ধীরে ধীরে চলে বেড়ায়। এই চলে যাওয়া বা সরে যাওয়ার প্রকৃতি পরস্পর সম্পর্কযুক্ত দুটি প্লেটের উপর নির্ভর করে। সব দিক থেকে আমরা প্লেট টেকটোনিকসের তিন ধরণের চলন দেখতে পাই।


চিত্র: পৃথিবীর প্লেট যেগুলো প্রতিনিয়ত চলাচল করছে। 

এক. দুটি প্লেট পরস্পর কাছে আসা, এই চলনের নাম অভিসারী চলন। দুই. দুটি প্লেট পরস্পর হতে দূরে সরে যাওয়া, যার নাম অপসারী চলন। তিন. দুটি প্লেট পাশাপাশি বা পরস্পর ঘেঁসে ঘেঁসে চলা। একে বলে পরিবর্তী চলন বা ট্রান্সফর্ম মুভমেন্ট। প্রথম দুই প্রকার চলাফেরায় আপাতত আমাদের কোনো সমস্যা হচ্ছে না। প্রথম দুই প্রকার চলাফেরারও ফল আছে তবে সেটা সূক্ষ্ম এবং সুদূরপ্রসারী আর তার সাথে আমরা কিংবা জীবজগত সহজেই খাপ খাইয়ে নিতে পারি। কিন্তু বিপত্তি বাধছে তৃতীয় প্রকার চলনে। দুটি প্লেট যখন অকল্পনীয় শক্তি বহন করে একটা আরেকটার সাথে ঘর্ষণে লিপ্ত হয় তখন নড়েচড়ে উঠে পৃথিবীর উপরিভাগ। বেশ খানিকটা শক্তি বিমুক্ত করে কম্পন আকারে ছড়িয়ে দেয় চারিদিকে। এই বিপুল পরিমাণ শক্তিশালী কম্পনে ভেঙ্গে ফেটে চৌচির হয়ে যায় মাটি। মানবজাতির কাছে এর নাম ভূমিকম্প। আবার একটি প্লেট যদি আরেকটি প্লেটের মাঝে ঢুকে যায় তবেও হতে পারে ভূমিকম্প। প্রকৃতির কাছে হয়তো এটা সামান্য একটা ধাক্কা লাগলে যা হয় এরকম একটা কিছু, যেন এটা প্রকৃতির একটা মামুলি জিনিস মাত্র। কিন্তু মানবজাতি অত্যন্ত ক্ষুদ্র এক স্বত্বা। তার কাছে প্রকৃতির এই সামান্য জিনিসই বিশাল ধ্বংসযজ্ঞ। প্রকৃতির সামান্য কেপে ওঠাই মানুষের কাছে বাস্তু হারা, খাদ্য হারা, ধ্বংস মৃত্যু সহ আরও কত কী।

ভূমিকম্প হবার বিবিধ কারণ থাকতে পারে কিন্তু সিরিয়াসভাবে ভূমিকম্প বলতে টেকটোনিক প্লেটের চলনের ফলে সৃষ্ট এই কম্পনকেই বোঝায়। যে স্থানে দুটি প্লেটের সীমান্তরেখা অবস্থান করে তাকে বলে ফল্ট লাইন। এই ফল্ট লাইনেই বেশিরভাগ ভূমিকম্পগুলো হয়।


চিত্র: ফল্ট লাইনে একটি কেন্দ্রস্থ বিন্দু থেকে ছড়িয়ে পড়ছে ভূমির কম্পন।

আবার আগ্নেয়গিরির সক্রিয়তার ফলেও ভূমিকম্প হতে পারে। আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণ ও গলিত লাভা বের হবার ফলে ভূমির যে কম্পনের সৃষ্টি হয় সেটা এত তীব্র নাও হতে পারে। অন্যদিকে ভূ-ভাগের অভ্যন্তরের কোনো দুর্ঘটনা থেকেও ভূমিকম্পের সৃষ্টি হতে পারে। ছোটবেলায় এমন ভাবতাম ব্রাহ্মণবাড়িয়া অঞ্চলটা পুরোটাই গ্যাসে ভর্তি [তিতাস গ্যাস] । আর গ্যাসে ভরাট হয়ে থাকলে মাটির নিচে বেশ খানিকটা জায়গায় মাটির অনুপস্থিতি রয়েছে, মানে ফাঁকা। এই ফাঁকা জায়গার মাঝে হয়তো উপরিভাগের মাটি ধসে পড়ে প্রকৃতির নিয়ম অনুসারে তা ভরাট করবে এবং এর ফলে বিশাল এলাকার মাটি ভেঙ্গে, উল্টে ধ্বংস হয়ে যাবে। আর এটাই হবে ভূমিকম্প। এই ভেবে ভেবে নিজে একটা চাপা ভয় নিয়ে থাকতাম। আমার ছোটবেলার ভাবনাটার সত্যতা কতটুকু বা সম্ভাবনা কতটুকু সেটা আমার জানা নেই। তবে আগের ভয়টা আর নেই, এখন আমি নাকে তেল দিয়ে ঘুমাই!

ভূ-অভ্যন্তরের আন্দোলন ছাড়াও নিউক্লিয়ার বিস্ফোরণের ফলেও ভূমিকম্পের সৃষ্টি হতে পারে। সাধারণভাবে যদি কোনো নিউক্লীয় বোমার বিস্ফোরণ ঘটানো হয় তবে তো তবে তো ভূ-ভাগ কেপে উঠেই। এই বিস্ফোরণটাই যখন ঘটানো হয় মাটির নিচে তখন মাটির কেপে উঠার পরিমাণ যায় বেড়ে। নিউক্লিয়ার বোমা বিস্ফোরণের ফলে তা থেকে বিপুল পরিমাণ ক্ষতিকারক তেজস্ক্রিয় বিকিরণ হয় এবং তা বাতাসে মিশে বিশাল হুমকির সৃষ্টি করে। একটি বোমা কি পরিমাণ ধ্বংসক্ষমতা সম্পন্ন তা পরীক্ষার জন্য বিভিন্ন রাষ্ট্র নিউক্লীয় বোমার পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণ ঘটিয়ে থাকে। মাটির নিচে এটা করা হলে বায়ুমণ্ডল তেজস্ক্রিয়তার হাত থেকে কিছুটা রেহাই পায়।


চিত্র: একটি মাত্র নিউক্লীয় বোমার বিস্ফোরণে সৃষ্টি হওয়া ভূমির কম্পন। যার ফলে সমস্ত শহর ধ্বংস হয়ে যায়। ছবিটি একটি ইংরেজি চলচিত্র থেকে স্ক্রিনশটের মাধ্যমে নেয়া।

একইভাবে বড় আকারের কোনো গ্রহাণুর পতনের ফলেও ভূমিকম্পের সৃষ্টি হতে পারে। একেকটি বড় আকারের গ্রহাণু কয়েক হাজার নিউক্লিয়ার বোমার সমান শক্তি নিয়ে আঘাত হানতে পারে। আমাদের ভাগ্য ভাল এমন ঘটনা খুব বেশি একটা হয় না! এমন একটা গ্রহাণুর আঘাতেই তো ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল প্রাচীন ডায়নোসরের সভ্যতা। আর ডায়নোসর শেষ হয়ে গেছে বলে আমরা মানুষেরা পৃথিবী শাসন করে বেড়াচ্ছি, তারা থাকলে নিশ্চয় ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে মানুষকে পৃথিবী শাসন করতে দিতো না। এই হিসেবে প্রলয়ঙ্করী গ্রহাণুর আঘাতকে মানুষের জন্য আশীর্বাদ বলা যেতে পারে।[১]

প্রতি বছরে পৃথিবীতে ছয় হাজারের মত ভূমিকম্প হয়। এত্ত বিশাল পরিমাণ ভূমিকম্প যে কারণটার জন্য হয় সেটা ফল্ট লাইনের এদিক সেদিক হওয়া।

চিত্র: ফল্ট লাইনের বিভিন্ন দশা।

ফল্ট লাইনের চ্যুতির ফলে বিশাল পরিমাণ শক্তি সিসমিক তরঙ্গ(Seismic waves) আকারে ছড়িয়ে পড়ে। সিসমিক তরঙ্গ হল সেই সকল কম্পন-ঢেও যেগুলো মাটির ভেতর দিয়ে এগিয়ে চলে। ভূ-পৃষ্ঠের অভ্যন্তরে যে বিন্দুকে কেন্দ্র করে এই মাটি বয়ে চলা তরঙ্গগুলো ছড়িয়ে পড়ে তাকে বলে চোখ বা Focus । মূল-কেন্দ্রের এই স্থানটাকে হাইপোকেন্দ্রও (Hypocenter) বলা হয়। ভেতরে থাকা মূল-কেন্দ্রের ঠিক উপরের দিকে একদম উলম্বভাবে যে বিন্দুটি থাকে তাকে বলে উপকেন্দ্র(Epicenter) । ভূমিকম্প যে স্থানটায় উৎপন্ন হয় সেখানটায় এর তীব্রতা থাকে বেশি। মূল কেন্দ্রে ভূমিকম্পের তীব্রতা সবচে বেশি।

চিত্র: পরিচারী চলনের ফলে ফল্ট লাইনে সৃষ্টি হতে পারে ভূমিকম্প।

দ্রষ্টব্য:
লেখাটা একটু বড়। মোট তিন পর্ব। এরপর দেখুন দ্বিতীয় পর্বে

লেখাটি 1,202-বার পড়া হয়েছে।

ই-মেইলে গ্রাহক হয়ে যান

আপনার ই-মেইলে চলে যাবে নতুন প্রকাশিত লেখার খবর। দৈনিকের বদলে সাপ্তাহিক বা মাসিক ডাইজেস্ট হিসেবেও পরিবর্তন করতে পারেন সাবস্ক্রাইবের পর ।

Join 908 other subscribers