বৃষ্টির পেছনের বিজ্ঞান [১]

লিখেছেন

লেখাটি , , বিভাগে প্রকাশিত

“মেঘ মাদলে ভরা বাদলে
বরষা বুঝি আসে ওই।
জল বরণে তৃষিত
মন ভিজিয়ে হাসে ওই।”

বৃষ্টি : মেঘ মাদলে ভরা বাদলে

বৃষ্টির সৌন্দর্যের দিক থেকে আমাদের বাংলাদেশের মানুষের মত ভাগ্যবান মানুষ মনে হয় পৃথিবীর আর কোথাও নেই। সব দেশে তেমন বৃষ্টি হয় না। প্রায় দেশেই তুষারপাত হয়। বরফে ঢাকা, কিংবা মাইলের পর মাইল মরুভূমি। আবার সব দেশে টিনের চাল নেই। বাংলাদেশের মানুষদের জন্য আশ্চর্য এক সমাবেশ ঘটেছে ফোটায় ফোটায় বৃষ্টি আর টিনের চাল। ঝমঝম করে যখন টিনের চালে বৃষ্টি পড়ে তখন যে কী স্বর্গীয় এক সুখানুভূতি হয় তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। বৃষ্টি এতোটাই পাগলকরা যে তার প্রেমে একজন পাকিস্তানিকেও বাংলাদেশে থেকে যেতে দেখা যায়। [১]

বৃষ্টি ব্যাপারটা এতই সুন্দর মনোহর আর গ্রহণযোগ্য যে অনেক লেখক কবি শিল্পীই এটা নিয়ে কিছু না কিছু সৃষ্টিকর্ম করেছেন। তাদের বেশিরভাগই বৃষ্টির সৌন্দর্য বৃষ্টির কাব্যিক বর্ণনা। বৃষ্টির ভেতরকার রসায়ন, বৃষ্টির ভেতরের ভৌতবিজ্ঞান, বৃষ্টির কলাকৌশল নিয়ে সে তুলনায় খুব কমই আলোচনা হয়েছে। আমরা আজকে বৃষ্টির ভেতরের বিজ্ঞান, বৃষ্টির মেকানিজম সম্পর্কে কিছুটা আলোকপাত করতে যাচ্ছি। বৃষ্টির ভেতরের বিজ্ঞান একটা ক্লাসিক কবিতা বা উপন্যাস থেকে কোনো দিক থেকে কম মনোহর নয়।

পৃথিবীর চার ভাগের প্রায় তিন ভাগই সমুদ্র। সে সমুদ্রে অবিরত সূর্যের আলো এসে পড়ে। সূর্যের সে আলোকের তেজ প্রতিনিয়ত সমুদ্রের পানিকে বাষ্প করে নিয়ে যাচ্ছে। শুধু সমুদ্রই না, মাঠ-ঘাট, নদী-নালা, থেকেও বাষ্পীভবন প্রক্রিয়ায় পানি বাতাসে মিশে যাচ্ছে। এমনকি গাছের পাতা থেকেও জৈব রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় পানির কণা বাতাসে মিশছে। গাছ তার মূল দিয়ে মাটির নিচ হতে পানি সংগ্রহ করে। কিছুটা পানি তার নিজের কাজে লাগায় বাকি বেশখানিকটা পানি তার কাজে লাগে না। অবশিষ্ট সেই পানি সে ছেড়ে দেয় বায়ুমণ্ডলে। এমন নানা উপায়ে আসা বায়ুমণ্ডলের সকল বাষ্প-রূপ পানি আস্তে আস্তে ওঠে যায় উপরে। উপরে গিয়ে বিশাল যজ্ঞ, নানান শর্ত সাপেক্ষে সে মাঝে মাঝে বৃষ্টি, মাঝে মাঝে তুষার, মাঝে মাঝে শিলা হয়ে ঝড়ে পড়ে। একই জিনিসের নানান রূপ।

**
প্রত্যেকটা বস্তুই অণু-পরমাণু সমন্বয়ে গঠিত- এমনকি পানিও। একটা বস্তুর মাঝে অণু-পরমাণুগুলো সদা কম্পনশীল কিংবা চলনশীল। কঠিন পদার্থের বেলায় অণুগুলো কম্পনশীল, এবং বায়বীয় বা তরল পদার্থের বেলায় অণুগুলো চলনশীল। এর মাঝে তরল পদার্থের অণুগুলো বায়বীয় ও কঠিনের মাঝামাঝি একটা বৈশিষ্ট্যের আচরণ প্রদর্শন করে।

চিত্র: বস্তুর কণাগুলো সবসময়ই চলাচলরত অবস্থায় আছে কিংবা কম্পনরত অবস্থায় আছে।

পানির অণুগুলো চলনশীল- এখান থেকে ওখানে লাফালাফি ঝাপাঝাপি করে বেড়ায়। পানির যে সকল অণুগুলো উপরিতলের পানি-পৃষ্ঠের কাছাকাছি থাকে তাদের গতিশক্তি একটু বেশি হয়ে থাকে। এর কারণ হচ্ছে কোনো বস্তুর উপর যখন তাপ শক্তি এসে পড়ে তখন বস্তুর কণা সে তাপশক্তি শোষণ করে নিয়ে অধিক পরিমাণ গতিশক্তি অর্জন করতে পারে। আর নদী-সমুদ্রে বিরতিহীন ভাবেই সূর্যের তাপ আসছে এবং সবচে বেশি তাপ পাচ্ছে সমুদ্রের উপরের স্তরের পানিগুলোই। এমনি করে সমুদ্রের পৃষ্ঠের দিকের কণাগুলো লাফাতে লাফাতে একসময় পানির বাইরে বায়ুর জগতে প্রবেশ করে ফেলতে পারে। পানি সাধারণত তার সহজাত আকর্ষণ ধর্ম দিয়ে কণাগুলোকে আটকে রাখে, কিন্তু যদি গতিশক্তি সেই আকর্ষণ শক্তির চেয়ে বেশি হয় তাহলে পানির আকর্ষণকে ডিঙ্গিয়ে সে পানি কণার বাতাসে মিশে যায়।


চিত্র: পানির অণুগুলো যে হাইড্রোজেন বন্ধনী দিয়ে দুর্বলভাবে পরস্পর যুক্ত সেখানে সূর্যের তাপ কিংবা অন্য কোনো তাপ শক্তি এসে পড়লে অণুগুলোর গতিশক্তি হাইড্রোজেন বন্ধনীর শক্তিকে ডিঙ্গিয়ে যেতে পারে। এভাবেই পানির কণা বাতাসে মিশে যেতে পারে।

শুধু সমুদ্র থেকেই যে পানি বাষ্পীভূত হয়ে বাতাসে যায় তা না। বাতাস থেকেও বাষ্পের কণা সমুদ্রে আসে। বাতাসে ওঠে যাওয়া কণাগুলো বাতাসেও লাফালাফি করে বেড়ায়। সেই লাফে আবার বাতাস থেকে পানিতে এসে পড়ে। তবে মোটের উপর পানি থেকে বাতাসেই যায় বেশি। বাতাস সবসময় এক অবস্থানে থাকে না। খুব দ্রুত তার অবস্থান পরিবর্তন করে। জলীয় বাষ্প মিশ্রিত যে বাতাস সেটা থাকে কিছুটা ভারী। এটা খুবই স্বাভাবিক যে সাধারণ বাতাসের যে ভর হবে তার সাথে জলীয় বাষ্প মিশ্রিত হলে সে বাতাসের ভর কিছুটা বেড়ে যাবে। এই ভারী বাতাস থাকে বায়ুমণ্ডলের একদম নিচের দিকে- পৃথিবী পৃষ্ঠের কাছাকাছি। উপরের দিকে থাকে হালকা বাতাস। যতক্ষণ পর্যন্ত ভারী ও হালকা বাতাসের মাঝে সমতা না আসবে ততক্ষণ তারা তাদের অবস্থান একের সাপেক্ষে অপরজন পরিবর্তন করে যাবে। ভারী বাতাস উপরে ওঠবে হালকা বাতাস নিচে নামবে। এভাবে বাতাসের একটা পরিচলন গতির সৃষ্টি করে।


চিত্র: জলীয় বাষ্প ধারণকারী বাতাস ক্রমান্বয়ে উপরে ওঠে যায়।

আমরা হয়তো পানি গরম করার সময় খেয়াল করে থাকব পানি যখন ফুটে ওঠে তখন পানিগুলো চলাচল করতে শুরু করে। পানির এই চলাচলটা হচ্ছে পরিচলন প্রবাহ। পানি [তরল] তার ধারণকারী পাত্রের মাঝখান দিয়ে উপরে ওঠে এবং কিনারা ঘেঁসে আবার নিচে চলে যায়। ঠিক এই প্রক্রিয়াটাই চলে জলীয় বাষ্পহীন শুষ্ক বাতাস এবং জলীয় বাষ্পধারী সিক্ত বাতাসের মাঝে।

এই কারণটার জন্যই আমরা কাপড় শুকাতে পারি। নইলে সূর্যের তাপে ভেজা কাপড় গরমই শুধু হয়ে যেত শুকাতো না কখনো। সমুদ্রের পানি পৃষ্ঠের কাছাকাছি কিংবা কাপড়ের কাছাকাছি চারিদিকে বাতাস জলীয় বাষ্প দ্বারা সিক্ত হয়ে যায়- আর বাতাসের মাঝে বাষ্প ধারণের একটা সীমা আছে। চাইলেই বাতাস অধিক পরিমাণ বাষ্প নিজের বুকে নিয়ে রাখতে পারে না। ধরা যাক কাপড়ের আশে পাশে কিছুটা অঞ্চল সিক্ত হয়েছে। এখন সেখানে নতুন করে শুষ্ক বাতাস এলে কাপড় আবার কিছুটা জল ত্যাগ করতে পারবে। এভাবেই বাতাসের আসা যাওয়ার মাধ্যমে একটি ভেজা কাপড় শুকায়।


চিত্র: বাতাসের চলাচল আছে বলে বাতাসে ভেজা কাপড় রাখলে সে কাপড় শুকিয়ে যায়।

আবার একই ব্যাপার ঘটে গরমের দিনে পাখার বাতাস, কিংবা ইলেকট্রিক ফ্যানের বাতাসের মাঝে। মানুষ যখন একটা স্থানে থাকে তখন তার শরীরের গরম আশেপাশের বাতাসে সঞ্চালিত হয়ে যায়। বাতাস তাপের জন্য তেমন ভাল একটা পরিবাহী নয়, তাই সে বেশি এলাকা পর্যন্ত শরীরের তাপ নিয়ে যেতে পারে না। যখন শরীরের আশেপাশের বাতাস গরম হয়ে ওঠে তখন মানুষের “গরম” লাগে। তবে কোনোভাবে যদি বাতাসের মাঝে প্রবাহের সৃষ্টি করা যায় তবে গরমটা কেটে যায়। এর মেকানিজমটা এরকম- বাতাসের প্রবাহ সৃষ্টি হলে শরীরের পাশে থাকা বাতাস অন্যত্র চলে যায় এবং নতুন বাতাস এসে হাজির হয়। সে বাতাস কিছুটা তাপ শুষে নিতে পারে। একসময় নতুন এই বাতাস গরম হয়ে ওঠার আগেই আরেক পশলা বাতাস এসে হাজির হয়। ফলে আমরা অনুভব করি ঠাণ্ডা। [২]

সিক্ত বাতাস বা আর্দ্র বাতাস যখন আস্তে আস্তে বায়ুমণ্ডলের উপরে ওঠতে থাকে তখন সে বাতাস স্বল্প চাপের সম্মুখীন হয়। বায়ুমণ্ডলের যত উপরে যাওয়া যাবে বাতাসের চাপ তত কমবে। কম চাপের এলাকায় গিয়ে অধিক চাপের বাতাস হুট করে প্রসারিত হয়ে যায়। চাপ কমলে গ্যাসের তাপমাত্রা কমে যায়। এ নিয়ে গ্যাসের সূত্র আছে। একটি ব্যবস্থা বা সিস্টেমে যখন কিছুটা গ্যাস স্বল্প আয়তনে অধিক চাপের মাঝ থেকে হুট করে অল্প চাপ ও অধিক আয়তনের মাঝে এসে প্রসারিত হবার সুযোগ পায় তখন সে গ্যাসটা খুব ঠাণ্ডা হয়ে যায়। এমনকি কিছু কিছু ক্ষেত্রে সে গ্যাস তরলও হয়ে যায়। গ্যাস লাইটারের মাঝে আমরা যে তরল গ্যাস দেখতে পাই তা এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই তৈরি। বায়ুর এই ঠাণ্ডা হবার ব্যাপারটা মোটামুটি জুল-থমসন প্রভাবের মত।[৩]  আর্দ্র বাতাস উপরে ওঠে প্রসারিত হয়ে শীতল হয়ে পড়ে। শীতল হয়ে পড়ে জলীয় বাষ্পগুলোও। জলীয় বাষ্পগুলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জলকণা বা বরফ কণা হয়ে ভাসতে থাকে। এদেরকেই আমরা ভাসমান মেঘ বলে দেখি।


চিত্র: মেঘ রূপে আমরা যা দেখি সেগুলো আসলে শীতলিত জলকণা বা বরফকণার দলবদ্ধ অবস্থান।

বাষ্প থেকে বরফ কিংবা জল হয়ে গেছে তাই হিসেবে এখন এদের মাটিতে পড়ার কথা। কিন্তু এই জলকণা বৃষ্টি বা তুষার কিংবা শিলা হয়ে পড়ার প্রক্রিয়াটা মোটেই এত সরল নয়। জলকণা ও বরফ কণাগুলো এতই ক্ষুদ্র যে এদের হিসাব করতে রীতিমত ন্যানোমিটার, মাইক্রন একক ব্যবহার করতে হয়। এত ক্ষুদ্র কণা অনায়াসেই বাতাসে ভর করে ভাসতে পারে। নিচে বৃষ্টি হয়ে নামার জন্য দরকার ঘনীভবন। পানি যখন তরল অবস্থা থেকে বায়বীয় অবস্থায় রূপান্তরিত হয়ে বায়ুতে মিশে তখন সে প্রক্রিয়াটাকে বলে বাষ্পীভবন। যখন এই প্রক্রিয়ার ঠিক বিপরীতটা ঘটে, বাষ্প থেকে পানিতে পরিণত হয় এবং নিচে নেমে আসে তখন সে প্রক্রিয়াটাকে বলে ঘনীভবন। ঘনীভবনটা আবার এমনি এমনি হয়ে যায় না। ঘনীভবন সংঘটন করতে দরকার হয় প্রভাবকের। পৃথিবীর এই বায়ুমণ্ডলটা যদি একদম শতভাগ পরিষ্কার হতো তাহলে কখনোই জলীয় বাষ্পগুলো বৃষ্টি হয়ে ঝড়ে পড়ত না। এমনকি ঠাণ্ডা হতে হতে অতি সম্পৃক্ত [৪] হয়ে গেলেও হতো না। গবেষণাগারে কৃত্রিমভাবে পরিষ্কার বাতাস নিয়ে জলীয় বাষ্পের এই পরীক্ষাটি করে এমন ফলাফলই পাওয়া গেছে। যে জিনিষটা বায়ুমণ্ডলে ঘনীভবন ঘটিয়ে বৃষ্টির সৃষ্টি করে সেটা খুব নগণ্য একটা উপাদান। ধুলাবালি। ধুলাবালি বলতে সকল প্রকারের “ডাস্ট” কণাগুলোকে বুঝানো হচ্ছে। এর মাঝে লবণের কণাও আছে।

দ্রষ্টব্য:
লেখার পরের অংশ দ্বিতীয় পর্বে

লেখাটি 2,419-বার পড়া হয়েছে।


আলোচনা

Responses

  1. একদম উপরে কবিতার মত করে চারটি লাইন আছে। নাহ, এই লাইন চারটি কবিতা না! কোনো বিখ্যাত কবির কোনো লাইন না। একেবারেই সাধাসিধে। ন্যান্সির একটা গানের প্রথম কয়েকটা লাইন! গানটা শুনছিলাম, ভাল লেগেছিল দারুণ- তাই তুলে দিয়েছিলাম। বিজ্ঞান লেখার মাঝে অমুক বড় কবির তমুক বড় লেখকের লাইন আমার জানা আছে এমন “ভাব” দেখানো অর্থহীন!! 😛 😉

  2. খেয়াল করেছো কি, লেখাটা আষাঢ় মাস শুরুর ঠিক আগের দিন ব্লগে দিয়েছো?

    1. আমি এই সময়টার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। যেমন ভূমিকম্পের লেখা ব্লগে দিয়েছিলাম ভূমিকম্পের দিনে! আমি কেন জানি বাস্তব দিনকাল নির্ভর হয়ে যাচ্ছি। [সেদিন ডিম কিনতে গিয়ে মনে হল ডিমের মাঝে হাজারে বিজারে বিজ্ঞান আর গণিত ছড়িয়ে আছে। ডিম এত উপকার করে, খুব অল্প সময়ে রান্না করা যায় অন্য তরকারির মাত্র ৪%-৫% সময় লাগে মাত্র(অনুমান)। ডিম নিয়ে একটা বিজ্ঞান ফাদা যায় কিনা? 😀 ওমা, হিসাব করে দেখলাম এত বড় হয়ে যাচ্ছে যে একটা লেখায় হবে না, একাধিক পর্ব ;লাগবে। ! O.o :O ]

Leave a Reply to আরাফাত রহমানCancel reply

ই-মেইলে গ্রাহক হয়ে যান

আপনার ই-মেইলে চলে যাবে নতুন প্রকাশিত লেখার খবর। দৈনিকের বদলে সাপ্তাহিক বা মাসিক ডাইজেস্ট হিসেবেও পরিবর্তন করতে পারেন সাবস্ক্রাইবের পর ।

Join 908 other subscribers