অ্যান্টিবডির ইতিহাস ও গাঠনিক বৈচিত্র্য

লেখাটি বিভাগে প্রকাশিত

প্রাচীন গ্রীকের একজন প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ এবং সেনাপতি ছিলেন থুসিডাইডেস। স্পার্টান এবং এথেনিয়ানদের মধ্যে সংঘটিত যুদ্ধ নিয়ে তিনি লিখেছেন History of the Peloponnesian War যার জন্য তিনি অমর। ওনার এই ঐতিহাসিক সন্দর্ভটি নিয়ে প্রচুর পাঠ, গবেষণা, বিশ্লেষণ, আস্বাদনের মাধ্যমে থুসিডাইডেস এর চিন্তাধারা, মনন ও বিশ্বাসের কাঠামো সম্পর্কে ধারনা করা গেলেও, আধুনিক ইতিহাসবিদরা ব্যক্তি থুসিডাইডেসকে জানেননা বললেই চলে। সে যাই হোক, রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা কি, সেটা জানার অনেক অনেক আগেই মানুষ জানতো তার মধ্যে এই জিনিসটা রয়েছে। চারশত খ্রীষ্টপূর্বাব্দে থুসিডাইডেসের পেলোপনেশিয়ান যুদ্ধ নিয়ে লেখাতেও আমরা সেই উদাহরণ খুঁজে পাই। উনি লক্ষ্য করেছিলেন, যেসব সৈন্যেরা কোন রোগে অসুস্থ হবার পর আবার সুস্থ হয়, তারাই নতুন আক্রান্ত সৈন্যদের সেবা দেয়ার জন্য সবচেয়ে উপযোগী। কারণ তারা সাধারণত ওই রোগে ফের আক্রান্ত হয়না, হলেও সেটা আর মারাত্নক আকার ধারণ করেনা। থুসিডাইডেস নিজের অজান্তেই বর্ণনা করছিলেন রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার অন্যতম চমকপ্রদ একটা বৈশিষ্ট্য, যাকে বলে ইমিউনোলজিক্যাল মেমরি।

এরকম নিজের অজান্তেই বিশাল কিছু করে ফেলা আরেক অমর ব্যক্তিত্ব ব্রিটিশ সার্জন এডোয়ার্ড জেনার। ১৭০০ সালের দিকে স্মলপক্স ছিলো মানুষের জন্য এক বিভিষীকা। এই স্মলপক্সেরই আরেক মৃদুরূপ দেখা যেত গরুতে যাকে বলা হয় কাউপক্স। এডোয়ার্ড সাহেব মানুষকে কাউপক্সে আক্রান্ত করার চেষ্টা করে দেখতে পান তাদের মধ্যে এক তৃতীয়াংশ মারাত্নক স্মলপক্স থেকে সুরক্ষিত থাকছে। উনি যে ধরনের এক্সপেরিমেন্ট করেছিলেন এই যুগে সেটা হতো ঘৃণ্য অপরাধ। তবে তখন সময় ছিলো অন্যরকম, আর তার টার্গেট ছিলো প্রলেতারিয়েত শ্রেণীর মানুষ তাই আইনের চোখ হয়তোবা রয়েল সোসাইটির সদস্য এডোয়ার্ড জেনারের প্রতি সহনশীল ছিলো। ওই এক্সপেরিমেন্টগুলোতে গরু থেকে সংগৃহীত উপাদান ব্যবহার হতো। আর গরুর ল্যাটিন নাম হচ্ছে Vacca, সেখান থেকেই এসেছে Vaccination যাকে আমরা বাংলায় টিকা বলি।

জেনার কিংবা অন্য কারো বিন্দুমাত্র ধারণা ছিলোনা যে জিনিসটা কেন কাজ করছে। তবে দার্শনিক না হয়ে বাস্তববাদী মানুষ হওয়ায় তিনি সেটা খুব একটা গায়ে মাখেননি। যে রোগে প্রতি বছর শুধু ইউরোপেই অর্ধলক্ষাধিক মানুষ মারা যাচ্ছে এবং তার প্রায় ৪ গুণ বাকী জীবন বিকৃত চেহারা নিয়ে কাটাচ্ছে, সেরকম একটা যুগে টিকার কার্যকরণ খুঁজে সময় নষ্ট করাটা বিলাসিতা।

সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিলো, রোগটা কেন হচ্ছে সেটাই তখন কেউ বুঝতোনা। বেশিরভাগই মানুষই ভাবত রোগব্যাধী শ্রেফ দূর্ভাগ্য। পাদরিরা বলতেন সৃষ্টিকর্তার মানুষকে শাস্তি দেয়ার পন্থা রোগ। এডোয়ার্ড জেনারের টিকা আবিষ্কারের প্রায় এক শতক পরে বিজ্ঞানীরা অনুজীবের অস্তিত্ব এবং ছোঁয়াচে রোগের সাথে এর সম্পর্কের কথা প্রমাণ করেন। তবে যাদের চোখেই দেখা যায়না, তারা নাকি জ্যান্ত , আবার তারাই নাকি এমন সর্বনাশ ঘটাতে পারে সেটা সাধারণ মানুষকে বুঝাতে অবশ্যই আরো সময় নিয়েছিলো।

তবে আপাত অদৃশ্য জিনিসগুলো যে আসলেই রোগ সৃষ্টি করতে পারে সেটার হাতে নাতে প্রমাণ পাওয়া যায় উনিশ শতকের মধ্যভাগে। না, এবার কোন মানুষ নয় বরং রেশম পোকা হচ্ছে ভুক্তভোগী। সেসময় ফ্রান্সে দেখা গেল মুলবেরী পাতা খেয়ে কিছু পোকা অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে। আর তার পরপরই পুরো পোকার পাল বিনাশ হয়ে গেলো। অনেকেই ধারণা করলেন হয়তো মুলবেরি পাতায় থাকা কোন বিষাক্ত কোন কিছুর কারণে এমন হচ্ছে। কিন্তু লুই পাস্তুর এগিয়ে আসেন ভিন্ন ধারণা নিয়ে। তিনি দেখান যে মারা যাওয়া পোকাগুলোর ভেতরে একধরনের অনুজীব কিলবিল করছে যাদের মাইক্রোস্কোপের নিচে দেখা যাচ্ছে। সে অনুজীবগুলো পৃথক করে সুস্থ্য পোকার দেহে ঢুকালে সেটিও আক্রান্ত হয়ে যাচ্ছে। এটাই ছিলো রোগের জীবাণুতত্বের(Germ Theory of Disease) জন্ম। কিছুদিনের মধ্যেই পাস্তুর আবার দেখান যে একই ঘটনা ভেড়ার এনথ্রাক্স এর ক্ষেত্রেও সত্য।

রোগের জীবাণুতত্বের অন্বেষনে ছিলেন ফ্রান্সে লুই পাস্তুর এবং জার্মানিতে রবার্ট কচ। রোগের কারণ হিসেবে অন্য কোন ধারণার পেছনে সারাজীবন ব্যয় করা অনেক রথী মহারথী তাদের এই তত্বকে প্রচন্ডভাবে নাকচ করে দেন। তবে ১৮৯১ সালে কচ যক্ষার পেছনে অনুজীবের তৎপরতার শক্তিশালী প্রমাণ নিয়ে আসেন। কিভাবে এদের খুঁজে পেতে হয় তা বুঝতে পারার পর স্বাভাবিকভাবেই কিছুদিনের মধ্যে মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর বিভিন্ন মারাত্নক রোগের সাথে জড়িত অনুজীবদের কাহিনী একের পর এক উন্মোচিত হতে থাকে।

এটা মেনে নেয়া কষ্টকর, আর মেনে নিলে তো চিন্তা আরও বেড়ে যায়। যাদের দেখিইনা তাদের থেকে আমরা কিভাবে নিরাপদে থাকবো? সবাই কি তবে মাইক্রোস্কোপ নিয়ে ঘুরে বেড়াবো আর কোন কিছু ধরা ছোঁয়ার আগে তাতে দেখে নেব অনুজীব মুক্ত কি না? জীবন তো তাহলে তেজপাতা হয়ে যাবে।

এইবারও ত্রানকর্তা রবার্ট কচ। ১৮৯০ সালের দিকে জানা গিয়েছিলো ব্যাক্টেরিয়া একধরনের বিষাক্ত পদার্থ নিঃসরনের মাধ্যমে রোগ সৃষ্টি করে। কচের ল্যাবরেটরির ছাত্ররা করলো কি, ব্যাক্টেরিয়া থেকে ধনুষ্টংকারের জন্য দায়ী এই বিষাক্ত পদার্থ সংগ্রহ করে অল্প মাত্রায় খরগোশের দেহে ঢুকিয়ে দিলো। মাত্রাটা এমন ছিলো যে খরগোশটি অসুস্থ হবে, কিন্তু মারা যাবেনা। এরপরে তারা ওই খরগোশের রক্ত থেকে রক্তরস(Serum) আলাদা করার পর পরীক্ষা করে পেল যে এর মধ্যে এমন কিছু আছে যা ওই ব্যাক্টেরিয়াকে মারতে এবং তার বিষকে নিষ্ক্রিয় করতে সক্ষম। এখানেই শেষ নয়, তারা এই রক্তরসের কিছু অংশ সুস্থ্ খরগোশে প্রয়োগ করার পর যখন তাদের দেহে সেই বিষাক্ত পদার্থ প্রয়োগ করা হলো এমন মাত্রায় যা দুই দিনের মধ্যে খরগোশটিকে মেরে ফেলতে পারতো। কিন্তু এখন তারা একটা হাঁচিও দেয়নি। আরেকটি অজান্তেই আবিষ্কারের খবর, এবারের আবিষ্কার অ্যান্টিবডি!

অল্পদিনেই রবার্ট কচ এবং তার দল বুঝতে পারেন এই পদ্ধতিতে শুধু প্রতিরোধই নয়, প্রতিকারও সম্ভব। ১৮৯১ সালের ক্রিসমাসে বার্লিনের বার্গম্যান ক্লিনিকে ডিপথেরিয়া আক্রান্ত এক মেয়ের দেহে প্রথম অ্যান্টিসিরাম(যেই সিরামে অ্যান্টিবডি রয়েছে) দেয়া হয়। ডিপথেরিয়া তখন একটি মারাত্নক ছোঁয়াচে রোগ ছিলো যা প্রায়ই বিভিন্ন শহরের হাসিখুশি শিশুদের খেলার মাঠকে গোরস্থান বানিয়ে দিতো। সেই মেয়েটি বেঁচে গিয়েছিলো এবং এই চমৎকারীত্বের অন্যতম কারিগর, এমিল ভন বেহরিং পরবর্তীতে চিকিৎসাশাস্ত্রের প্রথম নোবেল পুরষ্কার গ্রহন করেন। অ্যান্টিসিরাম দেয়ার মাধ্যমে প্রতিরোধ্য করে তোলা এখনো কার্যকর। বায়োটেররিজম, সাপের দংশনে কিংবা এধরনের জরুরী অবসথায় অ্যান্টিসিরাম বহুল ব্যবহৃত।

এই সবকিছুই ছিলো শুরুর কথা। জ্ঞানের নতুন একটি ক্ষেত্রের আবির্ভাব হলো, যার নাম রোগপ্রতিরোধবিদ্যা(Immunology)। এমিল ভন বেহরিং দিয়ে শুরু করে এই ক্ষেত্রের গবেষকরা এখন পর্যন্ত আরো ২২ টি নোবেল পুরষ্কার অর্জন করেছেন।

ইমিউনোলজি নামের বিজ্ঞানের এই নব্য শাখাটির নবীন বিজ্ঞানীদের ডাকা হয় ইমিউনোলজিস্ট বলে। প্রথম প্রজন্মের ইমিউনোলজিস্টদের মাথা ব্যাথাই ছিলো এন্টিবডি কি সেটা বুঝা। এই যে রক্তের মধ্যে থাকা সুরক্ষাদানকারী বস্তু, যেটা প্রাকৃতিকভাবেই তৈরি হয় কিংবা কৃত্রিমভাবে প্রয়োগ করা যায় সেটা যে কি তা বুঝতে মেলাদিন সময় লেগেছিলো। ৩০ বছর কাঠখড় পোড়ানোর পর জানা গেল এটা আর কিছুই না, গামা গ্লোবিউলিন শ্রেনীরই অন্তর্গত একগুচ্ছ প্রোটিন।

চিত্রঃ অ্যান্টিবডির গঠন

তবে এন্টিবডি সম্পর্কে কাজের কিছু বুঝার জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছিলো ১৯৬০ সাল পর্যন্ত। সে বছর রকফেলার বিশ্ববিদ্যালয়ের জেরার্ড এডেলম্যান এবং লন্ডনের রডনি পোর্টার অ্যান্টিবডির গঠন বর্ণনা করেন। জেনে রাখুন এরা সেই ২২ টি নোবেল পুরষ্কারের একটির যৌথ মালিক। অ্যান্টিবডি দেখতে অনেকটা এরকমঃ

দেখতেই পাচ্ছেন এন্টিবডি Y আকৃতির। দ্বিপ্রতিসম এই জিনিসটার প্রতি অংশে রয়েছে একটি করে ভারী চেইন, আর একটি হালকা চেইন। যে অংশ দুটিতে হালকা এবং ভারী চেইন পাশাপাশি রয়েছে সেই অংশটিই অ্যান্টিজেনকে শনাক্ত করে। অ্যান্টিজেন হতে পারে ব্যাক্টেরিয়া, ভাইরাস, ছত্রাক, প্রোটিন, স্টার্চ যেকোন কিছু যা জৈবদেহ তৈরিতে কাজে লাগে। কোন জিনিসটা কার জন্যে অ্যান্টিজেন হবে সেটা প্রত্যেক স্বতন্ত্র প্রাণীতে আলাদা। আমার রক্ত আমার জন্য প্রয়োজনীয়, কিন্তু সেটা আপনার কিংবা অন্য কোন প্রাণীর জন্য অ্যান্টিজেনস্বরূপ। যেকোন জৈব বস্তু যা আপনার দেহে সচরাচর দেখা যায়না, কিংবা বাইরে থেকে অনুপ্রবেশ করে তা-ই আপনার সাপেক্ষে অ্যান্টিজেন।

বিজ্ঞানীদের অ্যান্টিবডির অ্যান্টিজেন শনাক্তকারী অংশটি নিয়ে গবেষণা করার জন্য প্রয়োজন ছিলো এমন একটি উৎস যা থেকে প্রচুর অ্যান্টিবডি পাওয়া যাবে এবং ল্যাবে রক্ষনাবেক্ষন সহজ হবে। তারা এজন্য বি-সেল লিম্ফোমা(B Cell Lymphoma) নামের একধরনের টিউমারকে বেছে নিলেন। এই টিউমারে যত বি-সেল রয়েছে তারা সবাইই একই অ্যান্টিবডি তৈরি করে, কারণ টিউমারের সব বি-সেলই একইরকম্। এরা প্রত্যেকেই একটা কোষের ক্লোন যেটার স্বাভাবিক কোষীয় চক্র নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো এবং এর পর থেকে উপর্যুপরি কোষ বিভাজিত হতে থাকছে ।

দিনে দিনে নতুন নতুন এরকম টিউমার এবং তাদের থেকে তৈরি হওয়া অ্যান্টিবডিকে বিজ্ঞানীরা চিনতে পারলেন। একটা একটা নতুন টিউমারের অ্যান্টিবডি শনাক্ত হয়, আর তাদের কপালে চিন্তার রেখা মোটা হয়। কারণ, কোন একটা অ্যান্টিবডিই আরেকটার মতো নয়। সম্পুর্ন আলাদা! কখনো কখনো হয়তো এদের কয়েকটাকে দেখে মনে হয় হয়তো কোনভাবে সম্পর্কিত। কিন্তু তবুও আলাদা। কিন্তু দুইটা অ্যান্টিবডি, যারা কিনা একই অ্যান্টিজেনের প্রতিই সাড়া দেয়, এমনকি একই প্রাণীর দেহেই তৈরি হয়। তবুও কখনোই সম্পুর্ন একরকম না। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হয়েছিলো টিউমার হয়তো সুস্থ্ স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার প্রতিনিধিত্ব করেনা। তবে দ্রুতই সেই ধারণা উবে গিয়েছিলো। তারা যে হাজার হাজার আলাদা বি-সেল লিম্ফোমা দেখছেন, তা প্রকৃতপক্ষেই দেহের মধ্যে হাজার হাজার ভিন্ন বি-সেল থাকার প্রতিফলন। রোগপ্রতিরোধব্যবস্থায় প্রতিটা আলাদা বি-সেল আলাদা অ্যান্টিবডিই তৈরি করে।

আগের লেখাটিতে বলেছিলাম অনুজীবদের বেসম্ভব রকমের দ্রুত গতির প্রজনন, সংখ্যাবৃদ্ধি ও মিউটেশন আমাদের লড়াইয়ে তাদেরকে সুবিধা দিচ্ছে। কিন্তু আমাদের প্রতিরোধব্যবস্থাও কিন্তু পিছিয়ে নেই। অ্যান্টিবডির মাধ্যমেই জীবানুদের শনাক্তকরন এবং নিষ্ক্রিয়করার প্রক্রিয়া শুরু হয়। আর অনুমান করা যায় মানুষ কিংবা ইদুর একশ মিলিয়ন কিংবা তারও বেশি সংখ্যক আলাদা অ্যান্টিবডি তৈরি করতে পারে যা আলাদা আলাদা অ্যান্টিজেনকে চিনতে পারে। এই অ্যান্টিজেনদের মধ্যে এসব জীবাণুও তো রয়েছেই। এটা ভেবে আশ্চর্য হওয়া যায় কি?

আশ্চর্যের ভাবটা কেটে যাওয়ার পর প্রশ্ন আসতে পারে এত ভিন্ন ভিন্ন অ্যান্টিবডি তৈরি করা কিভাবে সম্ভব? এর উত্তর দিতে দুই ধরনের তত্বের আবির্ভাব হয়েছিলো। একটা হলো জার্মলাইন থিওরি, এর মতে প্রচুর সংখ্যক অ্যান্টিবডির আগে থেকে বিদ্যমান জিন এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে পরিচলিত হয়। অন্যটি সোমাটিক মিউটেশন থিওরি। কয়েক বছরের টানাহেঁচড়ার পর শেষ পর্যন্ত সোমাটিক মিউটেশন থিওরিই বিতর্কে টিকে যায় এবং আরেকটি নোবেল প্রাইজ ইমিউনোলজিস্টদের দখলে যায়। এবারের বিজয়ী জাপানের তরুণ বিজ্ঞানী সুসুমু তোনেগাওয়া।

দুইটা অ্যান্টিবডির মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করে মূলত তার পরিবর্তনশীল অংশটি। হালকা এবং ভারী চেইনের এই পরিবর্তনশীল অংশটি মিলে তৈরি হয় অ্যান্টিজেন শনাক্তকারী অঞ্চল । এর বৈচিত্র্যের কারণেই অ্যান্টিবডিগুলো বিচিত্র সব অ্যান্টিজেন শনাক্ত করতে পারে।

আমাদের বাবা-মায়ের থেকে আমরা ৩০ হাজার থেকে ৪০ হাজার জিন আমরা পেয়ে থাকি, এই সব জিনকে একসাথে বলে জিনোম। দেহের প্রায় প্রতিটা কোষেই এই জিনোম রয়েছে। জিনোমের মধ্যে কিছু জিন চামড়া তৈরি করে, কিছু পেশী তৈরি করে, কিছু হাড্ডি তৈরি করে এভাবে এদের কাজ ভাগ করে দেয়া। তেমনই কিছু জিন অ্যান্টিজেন গ্রাহক তৈরি করে।

যদিও সহজ করে বুঝার জন্য আমরা বলে থাকি এই জিনটা দেহের ওই অংশটা তৈরি করে। কিন্তু ব্যাপারটা এত সহজ না। যদি অ্যান্টিজেন শনাক্তকারী অঞ্চলের কথাই চিন্তা করি, শুধু এতটুকু জিনিসটার জন্যই বেশ অনেকগুলো জিন কাজ করে। সেই জিনগুলো আবার জিনোমের একেক জায়গায় থাকে। পাজলের মত। আগেই বলেছি জিনোম দেহের প্রায় প্রতিটা কোষেই থাকে। কিন্তু সব জিন সব কোষে তার বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করেনা। শুধুমাত্র লিম্ফোসাইটের মধ্যেই এই জিনগুলো বিভিন্ন বিন্যাসে সাজিয়ে অ্যান্টিজেন শনাক্তকারী অঞ্চলের ব্লু-প্রিন্ট তৈরি হয়। এটাই সোমাটিক মিউটেশন থিওরি।

এবার অ্যান্টিবডির বৈচিত্র্যের একটু ক্রিটিকাল ডিটেইলস দিতে চাই, তাই পাঠকে বিশেষ মনযোগ আশা করছি। অ্যান্টিবডির চিত্রটি খেয়াল করুন, দুইভাগে ভাগ করা হয়েছে। V(Variable)পরিবর্তনশীল অঞ্চল এবং C(Constant)অপরিবর্তনশীল অঞ্চল। C অঞ্চলটি একই শ্রেনীভুক্ত বিভিন্ন অ্যান্টিবডির মধ্যে স্থির থাকে .আর এর কাজ মূলত অ্যান্টিবডির গাঠনিক সংযুক্তি বজায় রাখা। কিন্তু V অঞ্চল C এর তুলনায় বেশ ছোট হলেও তিন ধরনের ভিন্ন ভিন্ন সেটের থেকে আসা জিনখন্ড(Gene fragment) নিয়ে একটা কার্যকর পরিবর্তনশীল অঞ্চল তৈরি হয়। তিনটা সেটকে আবার বলা হয় V, D এবং J।

এখন যদি একটা ভারী চেইন তৈরি করতে হয় তাহলে প্রথমে J সেটের অনেকগুলো জিনখন্ড থেকে একটা পছন্দ করা হয়, তারপর তার সাথে D সেটের গুলোর থেকে একটা জুড়ে দেয়া হয়। এই জোড়ার সাথে তারপর যুক্ত হয় V সেট থেকে আসা আরেকটি জিনখন্ড। এখন পর্যন্ত তাহলে পরিবর্তনশীল অঞ্চলটি প্রস্তুত হলো, এখন এর সাথে C অর্থাৎ অপরিবর্তনশীল অঞ্চলের জিনখন্ডটি লাগিয়ে দিলেই একটা ভারী চেইনের জন্য প্রয়োজনীয় জিনটা তৈরি হলো।

এবার জেনে রাখুন V, D ও J সেটের ভেতর যথাক্রমে ৫০, ৬ এবং ২৭ টি জিনের টুকরা শনাক্ত করা গেছে। তাই এদের থেকে দৈবভাবে একটা করে নিয়ে ৫০ x৬ x২৭ = ৮১০০ টি ভিন্ন পরিবর্তনশীল অঞ্চল সম্ভব যার সাথে অপরিবর্তনশীল অঞ্চলের জিনখন্ড যুক্ত হয়ে তৈরি হবে ভারী চেইন।

প্রায় একই উপায়ে প্রায় ৪৩৩ রকমের হালকা চেইন তৈরি সম্ভব। কিন্তু অ্যান্টিজেন গ্রাহকে তো পাশাপাশি একটা হালকা ও ভারী চেইনের পরিবর্তনশীল অঞ্চল থাকে। আর ভারী আর হালকা চেইনও যেহেতু দৈবভাবেই মিলিয়ে দেয়া হয় তাই এখানেও ৪৩৩ x ৮১০০ = ৩৫০৭৩০০ আলাদা অ্যান্টিবডি তৈরি করা সম্ভব শুধুমাত্র দৈবচয়নের ভিত্তিতে।

এখানেই শেষ হয় প্রতিটা চেইনের পরিবর্তনশীল অঞ্চল তৈরির সময় যখন আলাদা আলাদা সেট থেকে আসা জিনখন্ড যুক্ত করা হয় তখন প্রায় সময়েই বাড়তি কিছু সিকোয়েন্স চলে আসে কিংবা কিছু সিকোয়েন্স হারিয়ে যায়। তাহলে শেষ পর্যন্ত বলা যায় যে, আসলে অ্যান্টিবডির বৈচিত্র্য সংখ্যায় অনুমান করা কষ্টকর।

এই মহাবিশ্বের দ্রুত পরিবর্তনশীল জীবাণুদের সাথে পাল্লা দিতে এর চাইতে চমৎকার সমাধান আর কি হতে পারে? হ্যা স্বাভাবিক প্রজননে জিনের গুচ্ছে অদলবদল হয়। কিন্তু, তা তো যথেষ্ট ধীর। সেভাবে হয়তো প্রতি প্রজন্মে হাজার খানেক নতুন অ্যান্টিবডি তৈরি হতো। কিন্তু সোমাটিক মিউটেশনের মাধ্যকে প্রত্যেক ঘন্টাতেই শত শত মিলিয়ন নতুন অ্যান্টিবডি আমাদের সুরক্ষায় তৈরি হচ্ছে।

অ্যান্টিবডির ইতিহাস, গঠন ও গাঠনিক বৈচিত্র্য সম্পর্কে জানার পর এবার ছোট্ট করে বলতে চাই সত্যিকারের জীবন্ত প্রাণির দেহে অ্যান্টিবডি কিভাবে কাজ করে। অ্যান্টিবডি তৈরি করে বি সেল। এই বি সেল তৈরি হয় অস্থিমজ্জায় এবং পরিণত হবার পর লসিকা গ্রন্থি কিংবা প্লীহায় অবস্থান নেয়। পরিণত হবার সময়ে প্রতিটা বি সেলের মধ্যেই ভারী চেইন এবং হালকা চেইনের জিনখন্ডগুলোর মধ্যে উপরের বর্ণনার মতো সমন্বয় ঘটে, যেটা অনুযায়ী অ্যান্টিবডি তৈরি হয়।
বি সেল একটি অ্যান্টিবডি তার কোষদেহের বাইরের দিকে সবসময় রেখে দেয়। এটা বলা যায় তার পরিচিতির মতো যে সে কোন অ্যান্টিবডি তৈরি করতে পারে। আবার এটার মাধ্যমেই সে কিন্তু সব অ্যান্টিজেনকে যাচাই করে থাকে। তাই এটাকে বলা হয় বি সেলের অ্যান্টিজেন গ্রাহক(Antigen receptor)।

যে সকল বি সেল কোন অ্যান্টিজেনের দেখা পায়নি তারা লসিকা গ্রন্থি কিংবা প্লীহায় বসবাস শুরু করে এবং অ্যান্টিজেনের জন্য অপেক্ষারত থাকে। প্রতিটা বি সেল জন্মের সময়ই তার ভেতরে কিছু আত্নবিধ্বংসী যন্ত্রপাতি নিয়ে জন্মায় এবং যদি প্রায় এক সপ্তাহের মধ্যে সে কোন অ্যান্টিজেনের দেখা না পায় তখন এই যন্ত্রপাতিগুলো চালু হয়ে বি সেলটি মারা যায় এবং নতুন নতুন বি সেল তার জায়গা দখল করে।

চিত্রঃ বি কোষের ক্লোনাল এক্সপানশন

কিন্তু, যখন কোন বি সেল অ্যান্টিজেনের দেখা পায়, মানে আসলে কোন অ্যান্টিজেন যখন সেলটির গ্রাহকের সাথে রাসায়নিক মিথস্ক্রিয়ায় জড়ায় তখনই সে সক্রিয় হয় এবং ভুর ভুর করে অ্যান্টিবডি তৈরি শুরু করে। সেই অ্যান্টিবডিগুলো রক্ত ও লসিকায় ঘুরে ঘুরে সেই অ্যান্টিজেনের অন্য কপিগুলো খুঁজে।

আরেকটি ঘটনা ঘটে, তা হলো বি সেল সক্রিয় হবার পর নিজের অনেক ক্লোন তৈরি করে। যেই ক্লোনগুলো আবার এমন ভাবে পরিবর্তীত যেন তারা অনেকদিন টিকে থাকে এবং স্বাভাবিক বি সেলের চেয়ে অনেক দ্রুত সাড়া দিয়ে ভুরভুর করে অ্যান্টিবডি তৈরি করতে পারে। এভাবেই আমাদের রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থা কোন সংক্রমণকে চিনে রাখে, যাকে বলা হয় ইমিউনোলজিক্যাল মেমরী যেটা সেইই কত শত বছর আগে থুসিডাইডেস বর্ণনা করেছিলেন । আর যে পদ্ধতিতে সক্রিয় বি সেল নিজের কপি তৈরি করে তাকে বলে ক্লোনাল এক্সপানশন এবং এই তত্বের জন্য ১৯৬০ সালে অস্ট্রেলিয়ার ম্যাকফার্লেন বার্নেট……বাকীটা ধরতেই পারছেন আশা করি।

তথ্যসূত্র:

১। In defense of self; Willian R. Clark

২। Roitt’s Essential Immunology; P. Delves

লেখাটি 1,139-বার পড়া হয়েছে।

ই-মেইলে গ্রাহক হয়ে যান

আপনার ই-মেইলে চলে যাবে নতুন প্রকাশিত লেখার খবর। দৈনিকের বদলে সাপ্তাহিক বা মাসিক ডাইজেস্ট হিসেবেও পরিবর্তন করতে পারেন সাবস্ক্রাইবের পর ।

Join 911 other subscribers