মহাকাশে আবর্জনা: ঝুঁকি ও ভবিষ্যৎ

লিখেছেন

লেখাটি , বিভাগে প্রকাশিত

মহাকাশের প্রতি মানুষের কৌতুহল সেই প্রাচীনকাল থেকে। রাতের আকাশে উজ্জ্বল তারা দেখে দেখে পৃথিবী নামক গ্রহের অধিবাসীদের মহাকাশের প্রতি ভালবাসা, আবেগ ও অনুভূতি জন্মায়। মহাকাশের সৌন্দর্য মানুষের মনে জিজ্ঞাসার জন্ম দেয়। নানা সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতে মানুষের মাথায়  মহাকাশ ভ্রমণের ভূত মাথায় চেপে বসে। 

নানা চড়াই উৎড়াই পেড়িয়ে উনবিংশ শতকের পঞ্চাশের দশক থেকে মানুষের কাঙ্খিত মহাকাশ যাত্রা সফলতার মুখ দেখে। পৃথিবীর বাইরের জগৎ অন্বেষণের জন্য মহাকাশযুগের সূচনার পর থেকে আমরা প্রতিনিয়ত পৃথিবীর কক্ষপথে মহাকাশ অভিযান পরিচালনা করছি। বিভিন্ন কক্ষপথের উদ্দেশ্য হাজার হাজার রকেট, কৃত্রিম উপগ্রহ উৎক্ষেপণ করছি। কিন্তু নির্দিষ্ট কাজ করার জন্য এসব মহাকাশযান ও উপগ্রহগুলো তাঁদের কাজ সম্পাদন করে সেখানেই থেকে যাচ্ছে। মৃত বা বিকল হলে পড়ে আছে পৃথিবীর কক্ষপথে। এসব মৃত উপগ্রহ, রকেট বা তাঁদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র যন্ত্রাংশ কক্ষপথে আবর্জনার সৃষ্টি করছে।  যা বর্তমানে উপকারের থেকে ক্ষতিই বেশি করছে। হুমকির মুখে ফেলে দিচ্ছে সমস্ত মহাকাশ ব্যবস্থাপনাকে। বিজ্ঞানীরা এর নাম দিয়েছেন স্পেস জাঙ্ক বা মহাকাশ আবর্জনা।

কক্ষপথে ঘূর্ণয়মান স্পেস জাঙ্ক বা মহাকাশ আবর্জনা। ছবি সূত্র: ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি

মহাকাশ আবর্জনা কি?

মহাশূন্যে পৃথিবীর কক্ষপথে মানুষের প্রেরিত কোন মহাকাশযান বা উপগ্রহের ধ্বংসাবশেষ অথবা ইচ্ছা বা আনিচ্ছাকৃতভাবে মানুষের রেখে আসা যন্ত্রাংশই  স্পেস জাঙ্ক, বা মহাকাশ আবর্জনা। এটি যেমন  উপগ্রহের মত বিশাল আকৃতির কয়েকশো কেজি ভরের একটি বস্তু হতে পারে তেমনি একটি সাধারণ  ক্ষুদ্র স্ক্র, নাট-বোল্ট, কাঁচের টুকরাও হতে পারে। বিজ্ঞানীরা এই অব্যবস্থাপনাকে মহাকাশ দূষণ বলে আখ্যায়িত করেছেন।

২০২০ সালের ২৬ জুন নাসার নভোচারী ক্রস কেসেডি ও বব ভেনকেন ISS’র বাইরে ব্যাটারির কাজ করছিলেন। তখন কেসেডির স্পেস স্যুটে লাগানো একটা আয়না খুলে যায়। তাঁর কবজিতে বাঁধা ৫ ইঞ্চি বাই ৩ ইঞ্চির আয়নাটা মহাকাশে দ্রুত বেগে হারিয়ে যায়। সেটাও এখন অরবিটাল ট্রাশ হিশেবে কক্ষপথে আছে।

শাটল রকেট থেকে ছিটকে পড়া রকেট বুস্টারের ধ্বংসাবশেষ যা অ্যালুমিনিয়াম অক্সাইডের একটি মহাকাশ বর্জ্য। ছবি সূত্র: নাসা

এরকম মহাকাশযান ও নভোখেয়াযানের রকেট বুস্টার, পে-লোড অ্যাডাপ্টর, নভোচারিদের পোশাক সহ আনুষাঙ্গিক খুলে পড়া বা ছিটকে যাওয়া বস্তুগুলোও মহাকাশে থেকে যাচ্ছে। এসব বর্জ্যগুলো কক্ষপথে ঘন্টায় ১৭ হাজার মাইলের উপরে বেশি গতি নিয়ে ঘুরছে। সেগুলোই এখন মহাকাশে জটিলতার সৃষ্টি করছে।

স্পেস ট্রাশ কিভাবে তৈরি হয়? 

১৯৫৭ সালে প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ স্পুটনিক-১ পৃথিবীর কক্ষপথে প্রবেশের সাথেই মহাকাশ আবর্জনা যুগেরও সূচনা ঘটে। তখন থেকেই নর্থ আমেরিকা অ্যারোস্পেস ডিফেন্ড কমান্ড (NORAD) কক্ষপথে উৎক্ষেপিত উপগ্রহ ও রকেটের সার্বিক অবস্থা নিয়ে ডাটাবেস তৈরি করা শুরু করে। নাসা সেই ডাটাবেস সংরক্ষণ করে এবং পরবর্তীতে ১৯৮০’র দশকে সেলস ট্রাক বুলেটিন বোর্ড সেই সংবাদ প্রকাশ করে। 

১৯৬০ এর দশকে প্রথম স্পেস জাঙ্ক নিয়ে জ্যোতির্বিজ্ঞানিরা সবথেকে বেশি চিন্তিত হয়ে পড়েন। তখন ইউএস মিলিটারি প্রজেক্ট ওয়েস্ট ফোর্ড নামের একটি প্রকল্পের পরিকল্পনা অনুযায়ী লক্ষ লক্ষ তামার উত্তেজককর-নিডল(Needles) কক্ষপথে পাঠাতে চেয়েছিলো। এগুলো রেডিও তরঙ্গের মাধ্যমে যোগাযোগ করতে পারবে এবং দীর্ঘ দূরত্বের রেডিও তরঙ্গকে প্রতিবিম্বিত করতে সক্ষম। ১৯৬৩ সালে ইউএস বিমানবাহিনী এসব নিডলকে কক্ষপথে পাঠায় এবং প্রতিফলক বেল্ট গঠন করতে সফল হয়। এর প্রধান উদ্দেশ্য ছিলো পৃথিবীর উপরিভাগে একটি কৃত্রিম আয়োনোস্ফিয়ার তৈরি করা। কিন্ত পরের তিন বছরে নিডলগুলো কক্ষপথের বাইরে ছিটকে পড়ে। মহাকাশ ব্যবস্থাপনার হুমকি বিবেচনা করে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা এর বিরোধীতা করেন। পরবর্তীতে এই প্রকল্প তখন স্থগিত করা  হয়। 

কৃত্রিম উপগ্রহ ও মহাকাশ বর্জ্যের সাথে সংঘর্ষে ধ্বংসাবশেষ বর্জ্য তৈরি। ছবি সূত্র: ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি

কক্ষপথে বৃহদাকার স্পেস ট্রাশের থেকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আবর্জনাগুলো বেশি ক্ষতিকর। নিয়ন্ত্রণহীন বিকল স্যাটেলাইটের মধ্যকার পারস্পরিক সংঘর্ষ ও অ্যান্টি স্যাটেলাইট মিশনের (ASAT) মত বিধ্বংসী  ও আত্মঘাতী পরিকল্পনাগুলো এই আবর্জনা তৈরির জন্য সবথেকে বেশি দায়ী।

২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি কক্ষপথের উদ্দেশ্যে চীন তাঁদের প্রথম অ্যান্টি স্যাটেলাইট মিসাইল পাঠায়। আবহাওয়া পর্যবক্ষেণকারী ফেঙ্গুইন সিরিজের ৭৫০ কেজি ভরের ৮কি.মি/সেকেন্ডে ঘুরতে থাকা FY-1C স্যাটেলাইটটি তাঁরা ধ্বংস করে ফেলে। মিশনে তাঁরা সফল হলেও স্যাটেলাইটটির প্রায় তিন হাজার ছোট ছোটু টুকরো ধ্বংসাবশেষ এখন পর্যন্ত কক্ষপথে ঘুরছে।

চীনের FY-1C ধ্বংসের একমাস পরের  ঘূর্ণয়ণরত ধ্বংসাবশেষের কক্ষপথ। ছবি সূত্র: উইকিপিডিয়া

২০০৮ আমেরিকা তাঁদের গুপ্তচর – স্যাটেলাইট USA-193  ধ্বংস করে। ২০১৫ সালে রাশিয়া তাঁদের PL-19 Nudol নামের অ্যান্টি-স্যাটেলাইট মিশন পরিচালনা করে। পরবর্তীতে ইসরাইল, ভারত ইত্যাদি দেশ যুদ্ধের সক্ষমতা দেখাতে অ্যান্টি স্যাটেলাইট মিশন পরিচালনা করে। উপগ্রহগুলো ধ্বংসের পর সেগুলো বিচূর্ণ হয়ে যায়। পরবর্তীতে সেগুলোই পৃথিবীর কক্ষপথে ঘুরতে থাকে। যুদ্ধ বিগ্রহ এখন কেবল পৃথিবীকেই অস্থির করে তুলছেনা, মহাকাশকেও অস্থির করে তুলছে। সামরিক সক্ষমতা দেখাতে গিয়ে ধ্বংসের লালসা আমাদের উপরিভাগকেও দিন দিন ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছে।

ভারতের অ্যান্টি স্যাটেলাইট ASAT মিশনের একটি বিশ্লেষণ  চিত্র। ছবি সূত্র: নিউস্কেইপ

এছাড়াও অনিচ্ছাকৃত ভাবে মহাকাশে সংঘর্ষ ঘটে থাকে। ১৯৯৪ সালে Soyuz TM-17 এবং রাশিয়ান মির স্পেস স্টেশনের সাথে ধীর গতির সংঘর্ষ ঘটে। ১৯৯৭ সালে  Progress M-34 সাপ্লাই শিপের সাথে রাশিয়ার মির স্পেস স্টেশনের সাথে সংঘর্ষ ঘটে। ২০০৫ সালে USA DART spacecraft এবং কমিউনিকেশন স্যাটেলাইট  USA MUBLCOM মধ্যে লো স্পিড সংঘর্ষ ঘটে। 

১৯৯৬ সালে ফ্রান্সের চেরিস মিলিটারি পুনরুদ্ধার স্যাটেলাইট ও আরিয়ানা রকেটের ধ্বংসাবশেষের সাথে উচ্চ গতির সংঘর্ষ ঘটে। ২০০৯ সালে ইরিডিয়াম-৩৩ ও রাশিয়ান মহাকাশযান কসমস্ ২২৫১ এর সাথে হাই স্পিড সংঘর্ষ ঘটে।

মহাকাশ আবর্জনা কেন ক্ষতিকর? 

২০১৩ সালে চীনের অ্যান্টি স্যাটেলাইন মিশনে ধ্বংস হওয়া  ফেঙ্গুইন -১ সি স্যাটেলাইটের ধ্বংসাবশেষের সাথে রাশিয়ান ন্যানো স্যাটেলাইট BLITS এর সাথে সংঘর্ষ ঘটে। সংঘর্ষের কিছুদিন পর থেকে এটার সাথে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। 

২০১৮ সালে ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির পরিবেশ গবেষণার জন্য প্রেরিত ক্রায়োসাট-২ স্যাটেলাইটটি একটি উচ্চ গতি সম্পন্ন ধ্বংসাবশেষের সাথে সংঘর্ষরে সম্মুখীন হতে যাচ্ছিলো। পরে স্যাটেলাইটটিকে নিম্ন কক্ষপথে নিয়ে এসে সেই সংঘর্ষের হাত থেকে রক্ষা করা হয়। 

২০০৭ সালে উচ্চ গতিতে ঘূর্ণ্যমান একটি ক্ষুদ্র ধ্বংসাবশেষের টুকরার সাথে নাসার নভোখেয়াযান এনডেভারের সংঘর্ষ ঘটে। বস্তুটি এনডেভারের গায়ে ০.২৫ ইঞ্চির এইট ক্ষত সৃষ্টি করে। পরবর্তীতে ক্ষতটি দ্বিগুন হয়ে যায়। 

স্পেস শাটল এনডেভারের সাথে স্পেস বর্জ্যের সংঘর্ষে সৃষ্ট ক্ষত। ছবি সূত্র: নাসা

কক্ষপথে ঘুরতে থাকা  বস্তু নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষের ফলে একের পর এক বস্তু ধ্বংস হয়ে নতুন কোন ধ্বংসাবশেষ তৈরি করে। সেগুলো আবার পরবর্তীত অন্যান্য সক্রিয় বস্তুগুলোর জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। এভাবে কৃত্রিম ও অনিয়ন্ত্রিত সংঘর্ষগুলো প্রতিদিন বেড়েই চলছে। এক ধ্বংসাবশেষ থেকে তৈরি হচ্ছে নতুন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অসংখ্য আবর্জনা। যা কিনা কক্ষপথের সমস্ত পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাকে হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে। 

সংঘর্ষের পর ধ্বংসাবশেষ অরবিটালে কত দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে ছবিতে তা দেখানো হয়েছে। ছবি সূত্র: নাসা

মহাকাশে কি পরিমাণ স্পেস জাঙ্ক রয়েছে?

পৃথিবীর নিম্নকক্ষপথ গুলোতে মহাকাশ বর্জ্যের পরিমাণ বেশি।  কারণ সর্বোচ্চ ২০,০০০ কি.মি. উচ্চতায় LEO-তেই (LEO-Low Earth Orbit) অধিকাংশ কৃত্রিম উপগ্রহ ঘূর্নয়মান অবস্থায় রয়েছে। ১৯৫৭ সালে মহাকাশ যাত্রা শুরু করে এখন পর্যন্ত অবিরত চলছে। ১৮  নভেম্বর, ২০২০ সালে  ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী  মহাকাশ যুগের সূচনার পর থেকে এখন পর্যন্ত মোট ১০,৪৯০ টি স্যাটেলাইট মহাকাশে প্রেরণ করা হয়েছে। উপগ্রহগুলো প্রেরণের জন্য ৫৯৯০ টি রকেট ব্যবহার করা হয়। মহাকাশে ৬০৯০ টি স্যাটেলাইট এখনো রয়ে গিয়েছে। তার মধ্যে ৩৩০০-টি কৃত্রিম উপগ্রহ সক্রিয় রয়েছে। বাকিসব উপগ্রহগুলো মৃত ও বিকল অবস্থায় এখনও কক্ষপথে ঘুরছে । এদের মধ্যবর্তী ভাঙ্গন, বিস্ফোরণ, সংঘর্ষ ও অন্যান্য বিচ্ছিন্ন ঘটনাবলির আনুমানিক সংখ্যা ৫৫০। নিয়ন্ত্রণহীন হওয়ার কারণে  সংঘর্ষের ফলে আপনাআপনি কক্ষপথ পরিবর্তন করে অন্যসব সক্রিয় উপগ্রহের কর্মকান্ডে বাধা প্রদান করছে। এসব মৃত স্যাটেলাইট ও তাঁদের ধ্বংসাবশেষ স্পেস বর্জ্যে সৃষ্টির প্রধান কারণ ।

 ১৯৫৭ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত প্রেরিত স্যাটেলাইটের সমীক্ষা। ছবি সূত্র: স্টটিসটা.কম

ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির উক্ত তথ্য মতে  ১০ সেন্টিমিটারের বড় এমন ৩৪,০০০ আবর্জনা বস্তু মহাকাশের কক্ষপথে ভ্রমণরত অবস্থায় রয়েছে। ১ – ১০ সেন্টিমিটার দৈর্ঘ্যের ৯ লক্ষ বর্জ্য মহাকাশে রয়েছে। ১ মি.মি -১ সে.মি দৈর্ঘ্যের ১২০ মিলিয়ন ট্রাশ অবজেক্ট রয়েছে । এসকল বর্জ্যের ভর ৯১০০ টন।  কোটি কোটি ক্ষুদ্র আবর্জনা বস্তু যা নিমিষেই কোন সক্রিয় স্যাটেলাইটকে যে কোন সময় ধ্বংসের মুখে ফেলে দিতে সক্ষম। এই বিপুল সংখ্যক মহাকাশ বর্জ্য মহাকাশের পরিবেশকে দিন দিন অধিকতর অস্থির করে তুলছে

মহাকাশে কোন সময়ে কি ধরণের বর্জ্যের পরিমাণ বেড়েছে তার বিশ্লেষণ ছবি। ছবি সূত্র: ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি

আমরা যে কেবল কক্ষপথে আবর্জনা ফেলে রেখেছি তা নয় বরং আমাদের ফেলে রাখা বর্জ্য মহাকাশের অন্যত্রও ছড়িয়ে পড়ছে। চাঁদের পৃষ্ঠেও অনেক ধ্বংসাবশেষ রয়েছে। চন্দ্র অভিযানের স্পেস শিপ ও রোবটগেুলো সেখানে রয়ে গিয়েছে। অ্যাপোলো ১৫,১৬,১৭ এর বগি গুলো সেখানে রয়েছে। চন্দ্র পৃষ্টে অবতরণ করেছে বা ক্রাশ হয়ে পড়ে আছে এমন ৫৫ টি অভিযানের ধ্বংসাবশেষ সেখানে আছে। যার মোট ভর প্রায় দুই লক্ষ কেজি!

ভবিষ্যৎ ঝুঁকি কি?

সময়ের সাথে দিন দিন মহাকাশে অভিযান বেড়েই চলছে। স্যাটেলাইট মালিকের তালিকায় দিন দিন যুক্ত হচ্ছে বাংলাদেশ সহ নতুন নতুন দেশ। বানিজ্যিক স্যাটেলাইটের পরিমাণ ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে।  বেসরকারি মহাকাশ  কোম্পানি  স্পেস-এক্স ইন্টারনেট স্টারলিংকের জন্য এই বছর প্রতি মাসে একটি করে স্যাটেলাইট উড্ডয়নের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এই প্রকেল্পের আওতাধীন ইতোমধ্যে তাঁরা ৬০০ টিরও বেশি স্যাটেলাইট মহাকাশে পাঠিয়েছে।  আরও ১০০০ স্যাটেলাইট উড্ডয়নের পরিকল্পনা তাঁদের রয়েছে। বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান অ্যামাজন  সম্প্রতি বিশ্বের ইন্টারনেট আন্তঃ-সংযুক্ত অংশগুলিতে ইন্টারনেট সংযোগ সরবরাহ করতে ৩০০০ এর বেশি উপগ্রহের একটি মেগা পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে। গবেষণা সংস্থা ইউরোকনসাল্ট ২০২০ সালকে ছোট বা ক্ষুদ্র উপগ্রহের দশক হিসাবে পূর্বাভাস দিয়েছে এবং তাঁরা প্রতি বছর গড়ে এক হাজার ছোট (ন্যানো) স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এরকম প্রকল্পগুলো সফল হলে খুব শীঘ্রই পৃথিবীর কক্ষপথে প্রায় ৫০,০০০ হাজার স্যাটেলাইট যুক্ত হবে। যা কক্ষপথে জট লাগাতে নেতিবাচক ভূমিকা পালন করবে। এসব প্রকল্পগুলোকে সফল করতে ও  উপগ্রহগুলোকে নিরাপদ রাখার জন্য হলেও মহাকাশ পরিস্কার রাখা দরকার। মহাকাশের বর্জ্যে নিষ্কাষণ দরকার। নয়ত মহাকাশে স্যাটেলাইট জটের পাশাপাশি স্পেস জাঙ্কের সংঘর্ষে সব ধ্বংসের মুখোমুখি হবে। 

১৯৭৮ সালে নাসার বিজ্ঞানী ডোনাল্ড কেসলার মহাকাশ বর্জ্য নিয়ে  ন্যাশনাল রিসার্চ কাউন্সিল -এর হয়ে  তার একটি একটি গবেষণা প্রকাশ করেন। তিনি বলেছিলেন যে, কক্ষপথে যদি খুব বেশি জায়গার জঞ্জাল থাকে তবে এটি একটি চেইন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে যেখানে আরও বেশি সংখ্যক বস্তু সংঘর্ষে নেমে প্রক্রিয়াটি পৃথিবীর কক্ষপথকে অকেজো করে দিতে পারে। বিজ্ঞানী কেসলারের এই ধারণাকে কেসলার সিনড্রোম বলা হয়। 

কিভাবে কক্ষপথ পরিস্কার করা যায়?

কক্ষপথ পরিস্কার রাখার চিন্তাকে মাথায় রেখে নাসা, রস-কসমস, ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি সহ  বিভিন্ন দেশের মহাকাশ সংস্থার বিশেষজ্ঞগণ বেশ কিছু কার্যকরী সমাধান খুঁজে বের করেছে।  তাঁদের প্রস্তাবিত বিভিন্ন পদ্ধতির মধ্যে ৭ টি পদ্ধতি সমাদৃত হয়েছে। ডিফেন্স এডভান্সড রিসার্চ প্রজেক্টস এজেন্সি (ডারপা) পরামর্শ দিয়েছে জাল, লেজার বা বড়শির মাধ্যমে বর্জ্যগুলোকে ধীরে ধীরে উচ্চ কক্ষপথ থেকে নিম্ন কক্ষপথে নিয়ে আসা হবে অতঃপর কক্ষপথের বাইরে পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে ফেলে দিলে সেগুলো কক্ষপথ থেকে সরে আসবে। বাতাসের সাথে ঘর্ষণে আগুন ধরে পুড়ে ছাই হবে যাবে অথবা ভূপৃষ্ঠে পতিত হবে। 

বর্জ্য শিকারি স্যাটেলাইট গুলো বড়শির মত আংটা দিয়ে বর্জ্যগুলোকে ধরে ফেলতে পারে। সেজন্য উচ্চ শক্তি সম্পন্ন চৌম্বকের ব্যবহার করার পরিকল্পনা করেছে। 

 রাশিয়ার মহাকাশ সংস্থা স্টার্ট-রকেট ফোম ব্যবহার করে বিপদজ্জনক বর্জ্যগুলো অপসারণের একটি নতুন পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে।

রাশিয়ার মহাকাশ গবেষণা সংস্থা স্টার্ট-রকেট পলিমার ফোম ব্যবহার করে মহাকাশ বর্জ্য অপসারণ পদ্ধতি। ছবি: স্টার্ট-রকেট

স্যাটেলাইট দিয়ে জাল ব্যবহার করেও স্পেস আবর্জনাগুলোকে ধরে ফেলা সম্ভব বলে বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন। সেগুলো পরবের্তীতে স্পেস শাটল দিলে পৃথিবীতে নিয়ে আসা হবে অথবা বায়ুমন্ডলে নিক্ষেপ করা হবে।

জাপানি অ্যারোস্পেস এক্সপ্লোরেশন কোম্পানি ইলেকট্রোডায়নামিক পাওয়ার ইলেকট্রিসিটি ব্যবহার করে বর্জ্যের গতি কমিয়ে বর্জ্যগুলোকে  ধীরে ধীরে পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে ছিটকে ফেলার প্রস্তাবনা দিয়েছে।

এছাড়াও ফায়ারিং লেজার ব্যবহার করে বর্জ্যগুলোকে উত্তপ্ত করে পুড়ে ফেলে বা বায়মন্ডলীয় টান বাড়িয়ে সেগুলোকে অরবিট থেকে ফেলে দেওয়া সম্ভব বলে বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন।

উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপসমূহ:

জাতিসংঘ ইতোমধ্যে সকল কোম্পানিকে  মিশন শেষে তাঁদের স্যাটেলাইটগুলোকে কক্ষপথ থেকে সরিয়ে নেওয়ার জন্য ২৫ বছরের সময়সীমা দিয়েছে। অনেকটা জটিল প্রক্রিয়া হলেও বেশ কিছু কোম্পানি জাতিসংঘের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে। ২০০০ সালে ইন্টার এজেন্সি স্পেস ডেব্রিস কোঅর্ডিনেশন কমিটি এ বিষয়ে কিছু নীতিমালা প্রনয়ণ করে।

২০১৮ সালে জুনে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের(আইএসএ) নভোচারীরা নিম্ন কক্ষপথের কিছু স্পেস বর্জ্য পরিস্কারের জন্য একটি স্পেসক্রাফট চালু করেন। যেটি সক্রিয় বর্জ্য অপসারণ (এডিআর) প্রযুক্তি ব্যবহার করে। ইউনিভার্সিটি অব সারে দ্বারা নিয়ন্ত্রিত মহাকাশ যানটি বর্জ্য অপসারণের জন্য একটি জাল ও একটি হারপুন (আংটা), একটি ড্রাগ সেল ও দুটি কিউবসেট ব্যবহার করে। জাল এবং হারপুন বর্জ্যের লক্ষ্যে সফল হলেও অন্য দুটি ব্যর্থ হয়। 

সম্প্রতি ২০২০ সালের ২৬ নভেম্বর, ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি সুইস স্টার্টআপ কোম্পানী ক্লিয়ার স্পেস এস.এ. -র সাথে ১০২ মিলিয়ন ডলারের একটি চুক্তি করেছে। চুক্তি অনুযায়ী ২০২৫ সালে মহাকাশ আবর্জনা ধ্বংসাবশেষ অপসারণ মিশন পরিচালিত হবে। মিশনের প্রথম পর্যায়ে ১২০ কেজি ভরের একটি রকেটের ভেসপা পে-লোড অ্যাডাপ্টরকে অপসারণ করা হবে। যেটি ২০১৩ সালে একটি স্যাটেলাইট উড্ডয়নের কাজে ব্যবহার করা হয়েছিলো। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে এটিই হতে যাচ্ছে পৃথিবী থেকে প্রথম মহাকাশ বর্জ্য অপসারণ মিশন।

তবে, এই পদ্ধতিগুলি কেবলমাত্র পৃথিবী প্রদক্ষিণ করে বড় উপগ্রহগুলির জন্যই কার্যকর। ছোট ছোট টুকরো বর্জ্যগুরো অপসারণের জন্য এখন পর্যন্ত আমাদের সত্যিই কোন  উপায় জানা নেই। আমাদের কেবল তাদের প্রাকৃতিকভাবে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। তাই সবশেষ প্রশ্ন থেকেই যায় কক্ষপথে ভবিষ্যতে কি ঘটবে। সকল ব্যবস্থা ‍মুখ থুবড়ে পড়বে নাকি তার পূর্বেই কোন সমাধান পাওয়া যাবে। 

তথ্য সূত্র: 

১.History of spaceflight
২. What is space junk and why is it a problem?
৩. Space junk facts and information
৪. What is Space Junk and What Can We Do About It?
৫. Space debris
৬. The quest to conquer Earth’s space junk problem
৭. Project West Ford
৮. Anti-satellite weapon
৯. 2007 Chinese anti-satellite missile test
১০. Satellite collision
১১. BLITS
১২. Endeavor Space Debris Damage
১৩. 29 thoughts on “How many satellites are orbiting the Earth in 2018?”
১৪. UCS Satellite Database
১৫. ESA – Space debris by the numbers
১৬.How many satellites orbit Earth and why Space Traffic Mgmt is crucial
১৭. Space Junk Clean Up: 7 Wild Ways to Destroy Orbital Debris
১৮. space debris | Facts, Removal, & Research
১৯. Space Junk Clean Up: 7 Wild Ways to Destroy Orbital Debris
২০.Astronaut Drops a Mirror During a Spacewalk. Now There’s Another Piece of Space Junk
২১. Watch a satellite spear space debris with a harpoon
২২.Nations Collaborate to Remove Space Debris from Low Orbit

লেখাটি 632-বার পড়া হয়েছে।

ই-মেইলে গ্রাহক হয়ে যান

আপনার ই-মেইলে চলে যাবে নতুন প্রকাশিত লেখার খবর। দৈনিকের বদলে সাপ্তাহিক বা মাসিক ডাইজেস্ট হিসেবেও পরিবর্তন করতে পারেন সাবস্ক্রাইবের পর ।

Join 908 other subscribers