জাহাজভাঙা শিল্পঃ বিপন্ন পরিবেশ

লেখাটি বিভাগে প্রকাশিত

জাহাজভাঙা শিল্প এমন একটি বিধ্বংসী শিল্প যা পরিবেশ ও মানুষের মারাত্নক ক্ষতিসাধন করে। বাংলাদেশে জাহাজভাঙা শিল্পের যাত্রা শুরু হয় মূলত ১৯৬০ সালে। সেই সময় ঝড়ের কবলে পড়ে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত ‘এম ভি আলপাইন’ নামের একটি জাহাজ চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডের উপকূলবর্তী এলাকায় আটকে পড়ে। কোনভাবেই এটিকে আবার সমুদ্রে ভাসানো সম্ভব হচ্ছিল না। মূলত ওই জাহাজটিকে সৈকতে টেনে এনে খন্ডিত করার মাধ্যমে শুরু হলেও বাণিজ্যিকভাবে জাহাজভাঙা শুরু হয় স্বাধীনতার পর। সত্তরের দশকেই বাণিজ্যিক ব্যাংকের সহযোগিতায় কেটে বিক্রি করার উদ্দেশ্যে জাহাজ আমদানি শুরু করা হয়। আশির দশকের শেষের দিকে এ অঞ্চলের জাহাজভাঙা শিল্পের সংখ্যা ৬০ থেকে ৮০ টিতে উন্নীত হয়।

জাহাজভাঙা শিল্প পরিবেশের ভয়ানক ক্ষতি করে। ভাঙার জন্য আমদানি করা জাহাজগুলোতে থাকে কালো তেল, অ্যাসবেসটস, ক্ষতিকারক রঙ ও বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্য। অ্যাসবেসটসকে ধুয়ে পুনরায় ব্যবহারের উপযোগী করায় প্রচুর পরমিাণ দূষিত পানি নির্গত হয়।  জাহাজ কাটতে গিয়ে সৃষ্টি হয় পুনর্ব্যবহারের অনুপযোগী লোহার গুঁড়া। এসব বর্জ্যের শেষ গন্তব্য হয় সমুদ্র। ফলে জাহাজভাঙা শিল্প এলাকার সমুদ্র আস্তাকুঁড়ে পরিণত হয়েছে। সমুদ্রের পানির রং ঘোলাটে, কালো হয়ে যায়। সীতাকুন্ডের সমুদ্র উপকূলে মৎস্য আহরণ ৮০ শতাংশের মতো কমে গেছে। শ্রাবণ-ভাদ্র মাসে পাওয়া যেত প্রচুর রূপালী ইলিশ, যা দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। এছাড়া, সমুদ্রের পানির ওপরে যে তেল ও বর্জ্য জমা হয়, তা সূর্যের আলোকে পানির নিচে পৌঁছাতে বাধা দেয়। এতে পানির নিচের উদ্ভিদ জগতের সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়। এসব উদ্ভিদ ছোট ছোট মাছ ও ক্ষুদে সামুদ্রিক প্রাণীদের খাদ্য সরবরাহ করে। সালোকসংশ্লেষণ বাধা পেলে উদ্ভিদের জন্ম ও বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে যায়। এর ফলে ২১ প্রজাতির মাছ বিপন্ন হয়ে পড়েছে। এক সময় সমুদ্র উপকূলে যেসব পাখির দেখা মিলত, তা এখন আর দেখা যায় না।

জাহাজ ভাঙার ফলে উপকূলীয় এলাকার মাটিতে বিষাক্ত ধাতু ছড়িয়ে পড়ে। তার মধ্যে রয়েছে পারদ, সীসা, ক্রোমিয়াম, ক্যাডমিয়াম, ক্যালসিয়াম এবং ম্যাগনেসিয়াম।  শব্দদূষণ এখানকার নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। জাহাজভাঙা শিল্পের সঙ্গে জড়িত শ্রমিকদের অনেক ধরনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে হয়। এ শিল্প থেকে সৃষ্ট লোহা ও সীসার অতি মিহি ধুলো ওই অঞ্চলের বাতাসে ভেসে বেড়ায় এবং নিঃশ্বাসের সাথে মানবদেহে প্রবেশ করে। এছাড়া যেকোন ধরনের বিস্ফোরণজনিত ঘটনা ঘটতে পারে। তাই শ্রমিকদের নিরাপত্তার জন্য মাস্ক, হেলমেট, নিরাপদ পোশাকের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। কিন্তু কোন কোম্পানিই এগুলো সরবরাহ করে না এবং করলেও এর পরিমাণ খুবই কম। প্রায় প্রতি বছর বিভিন্ন শিপইয়ার্ডে বিস্ফোরণ অথবা দুর্ঘটনাজনিত কারণে ছোট-বড় মৃত্যুর ঘটনা ঘটে থাকে। এছাড়া বিষ্ফোরণের কারণে বাতাসে বিভিন্ন ক্ষতিকারক রাসায়নিক দ্রব্যের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। ফলে শ্রমিকরা স্বল্পমেয়াদী ও দীর্ঘমেযাদী রোগে আক্রান্ত হয়। স্থানীয় বাসিন্দাদের শরীরেও নানা রোগের উপসর্গ দেখা দেয়। গত ২০ বছরে জাহাজভাঙার কাজ করার সময় প্রায় ৫০০ লোকের প্রাণহানি ঘটে। আহত হয়েছে আরো ছয় হাজার।

পৃথিবীতে ১৯৫টি দেশের মধ্যে মাত্র ১৪টি দেশের নিজের লোহা আছে। বাকিরা বাইরে থেকে লোহা আমদানি করে। মাত্র ৫টি দেশ লোহার জন্য জাহাজ ভাঙে- তারা হচ্ছে চীন, তুরস্ক, বাংলাদেশ ভারত ও পাকিস্তান। চীন ভারী যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তি ব্যবহার করে জাহাজ ভাঙে। তাদের প্রক্রিয়াটিকে সত্যিকার একটি শিল্পই বলা যায়। তুরস্ক তাদের জাহাজভাঙা খুব কমিয়ে এনেছে। শ্রীলঙ্কাকে জাহাজভাঙার প্রস্তাব দিয়েছিল, তারা রাজি হয়নি। থাইল্যান্ড আইন করে জাহাজভাঙা বন্ধ করেছে। অথচ বাংলাদেশে মেয়াদোত্তীর্ণ জাহাজ আমদানি বাড়ছে। বাংলাদেশে মাত্র ২৫-৩০ শতাংশ লোহা আসে জাহাজভাঙা শিল্প থেকে। বাকি চাহিদা পূরণ হয় লোহার ‘বিলেট’ আমদানি করে। তাতে খরচ পড়ে প্রতি মেট্রিক টনে ৬০০ ডলারের মতো। আর জাহাজ ভেঙে লোহা উৎপাদন করলে প্রতি মেট্রিক টনে এর চেয়ে মাত্র ১০০ ডলার (সাত হাজার টাকা)  কম খরচ হয়। প্রতি মেট্রিক টন লোহায় মাত্র ৭০০০ হাজার টাকা বাঁচাতে গিয়ে আমরা আমাদের পরিবেশ, প্রকৃতি ও জীবনকে যে ভয়াবহ দিকে নিয়ে যাচ্ছি তার মূল্য কে দেবে?

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) করা রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৯ সালের ১৭ই মার্চ হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ জাহাজভাঙা শিল্প নিয়ন্ত্রণে কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন। এতে বলা হয়, বাংলাদেশের উপকূলে কোন জাহাজ আনতে হলে আগেই দূষণমুক্ত করে আনতে হবে। পরিবেশগত ছাড়পত্র ছাড়া জাহাজভাঙার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন আদালত। কিন্তু এরপরও পরিস্থিতির তেমন একটা উন্নতি হয়নি। উল্টো উপকূলীয় বন কেটে একের পর এক নতুন শিপইয়ার্ড তৈরি করা হচ্ছে। অবিলম্বে এ শিল্প বন্ধে সরকারের উপযুক্ত নীতিমালা গ্রহণ করা উচিত। তা না হলে এ শিল্পের ভয়াবহতা থেকে আমাদের পরিবেশকে বাঁচানো সম্ভব হবে না।

লেখাটি 141-বার পড়া হয়েছে।


আলোচনা

Response

  1. খান ওসমান Avatar
    খান ওসমান

    গুরুত্বপূর্ণ লেখা।

    ২০০২/৩ সালে একটা ওয়ার্কশপ করেছিলাম এই জাহাজভাঙা শিল্প সৃষ্ট দুষণের উপর, সিতাকুন্ডের কাছে জাহাজভাঙা এলাকায় গিয়েছিলাম (http://2.bp.blogspot.com/_4lQQyoQe3jw/SizUWvct8oI/AAAAAAAABvY/ZekSSY1akqs/s1600/sitakunda.jpg)। এই এলাকার সমুদ্্রতীরে বালি ভর্তি তেল দেখা যায়।

    অন্য বিষয় বলি, এইখান থেকে একটা ভাল গবেষণার উপাত্ত পাওয়া যেতে পারে। আরেকটি পোষ্ট আসলো আজকে অণুজীব দিয়ে বায়োরিমেডিয়েশান করার উপর। আসলে এই জাহাজভাঙা কারখানার বালুর মধ্যে খুঁজলে হয়তো তেল ভাঙতে পারে এমন অণুজীব পাওয়া যাবে। কেউ কি দেখেছেন খোঁজ করে?

Leave a Reply

ই-মেইলে গ্রাহক হয়ে যান

আপনার ই-মেইলে চলে যাবে নতুন প্রকাশিত লেখার খবর। দৈনিকের বদলে সাপ্তাহিক বা মাসিক ডাইজেস্ট হিসেবেও পরিবর্তন করতে পারেন সাবস্ক্রাইবের পর ।

Join 908 other subscribers