আমাদের মানবদেহ এক চলমান বিস্ময়। ক্ষুদ্র স্কেলে এটি আশ্চর্য জটিলতায় ভরা। প্রতিটা কদমে, প্রতিটা পলকে, প্রতিটা নড়াচড়ায় ঘটে যাচ্ছে পদার্থবিদ্যার দারুণ কিছু প্রয়োগ। প্রতিটা ভাবনায়, বিন্দু পরিমাণ ভালোবাসায়, বেড়ে ওঠায় খেলা করছে রসায়নের বিশাল কারসাজি। এখানে ক্ষুদ্র স্কেলের দেহের স্থাপত্যের কিছু নিদর্শন দেখে নেই।
মেদকলা বা চর্বির কোষগুচ্ছ: বিশেষ ধরণের রঞ্জকে রঞ্জিত ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপের নিচে দৃশ্যমান ছবি এটি। মেদ কোষের বেশিরভাগ অংশ শুকনো থাকে, সাইটোপ্লাজম থাকে না বললেই চলে। তাই ছবিতে এদের এমন মধুপোকার বাসার কুঠুরির মতো দেখাচ্ছে। ত্বকের নিচের তুলতুলে অংশে থাকা এই মেদকলা আমাদের সহ সকল প্রাণীর দেহের শক্তির সংগ্রহশালা।
প্রয়োজনের সময় দেহ, চর্বি হতে শক্তি গ্রহণ করে। সেজন্যই খেয়াল করলে দেখা যায় মেদবহুল মোটা মানুষেরা না খেয়ে থাকতে পারে বেশিক্ষণ। কারণ না খাওয়ার ফলে শক্তির যে অভাব হচ্ছে তা চর্বি থেকে ভেঙ্গে নিচ্ছে শরীর। হ্যাংলা-পাতলা মানুষের বেলায় চর্বির যোগান থাকে না বলে তারা না খেয়ে থাকলে অল্পতেই দুর্বল হয়ে পড়ে।
পেনিসিলিয়াম ছত্রাক: দেখতে ফুলের মতো কিংবা চায়ের ট্রেতে প্রিন্ট করা ফুলের ছবি। এরা ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপের নিচে দৃশ্যমান পেনিসিলিয়াম ছত্রাকের গুচ্ছ। হালকা পিঙ্ক রঙে দেখানো সুতার মতো অংশগুলোকে বলে ‘কনিডিওফোর’ আর কিছুটা হলদেটে ভাবের গুচ্ছগুলো হচ্ছে ‘কনিডিয়া’। গুচ্ছের শেষের অংশটা হচ্ছে এদের বংশবিস্তারের অঙ্গ।
জনজীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি এন্টিবায়োটিক ‘পেনিসিলিন’ আসে এই পেনিসিলিয়াম ছত্রাক থেকে। ১৯২৮ সালে আলেকজান্ডার ফ্লেমিং এই এন্টিবায়োটিকটি কাকতালীয়ভাবে আবিষ্কার করে ফেলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই পেনিসিলিন গুলি খাওয়া, ক্ষতিগ্রস্ত অঙ্গ সাড়াতে সফল হয়েছিল। পেনিসিলিন কিংবা এন্টিবায়োটিকের সফল কার্যকারিতা সে সময় প্রমাণ হয়ে গিয়েছিল। এর জন্য ফ্লেমিং ১৯৪৫ সালে চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পান।
মস্তিষ্কের কোষ: ফ্লোরোসেন্ট বাতির মতো দেখতে এরা হচ্ছে মস্তিষ্কের দুই ধরণের কোষ। এরা মানব মস্তিষ্কের খুব গুরুত্বপূর্ণ কোষ। সবুজ রঙে রঞ্জিত কোষটা হচ্ছে মাইক্রোগ্লিয়াল কোষ আর কমলা রঙের ও একটু বড় আকৃতির কোষটা হচ্ছে অলিগোডেন্ড্রোসাইট। সবুজ রঙের কোষগুলো কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রে রোগ-প্রতিরোধ ব্যবস্থায় সাড়া প্রদান করে। এ ধরণের কোষগুলো শরীরের আক্রান্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত অংশগুলোকে শনাক্ত করে এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে সংকেত প্রেরণ করে।
কমলা রঙের অলিগোডেন্ড্রোসাইটের অসমতল কিছু এলাকা নিউরনকে অধিক পরিমাণ মায়েলিন সরবরাহ করতে পারে। যার ফলে নিউরনগুলো একে অপরের সাথে বেশি পরিমাণ বৈদ্যুতিক সংকেত আদান-প্রদান করতে পারে। যার অর্থ হচ্ছে মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়।
যকৃতের কোষ (Liver cell): কলিজার যেকোনো স্থানের কর্তিত অংশের আণুবীক্ষণিক চিত্র। অঙ্গাণুগুলো বিশেষ রঙে রঞ্জিত। নীল রঙের বড় বড় স্পটগুলো হচ্ছে মাইটোকন্ড্রিয়া। মাইটোকন্ড্রিয়াগুলো কোষের ভেতরে থেকে শক্তি উৎপাদন করে এবং সে শক্তি কোষে সরবরাহ করে। সবুজ রঙের তন্তুর মতো দেখতে রেখাগুলো গলগি বস্তু। এরা প্রোটিন প্রস্তুত করে।
হলুদ রঙের কিছুটা বিবর্ণ অংশগুলো চর্বির ক্ষুদ্র অংশ। বাদামী রঙের অংশগুলো হচ্ছে শক্তি সংগ্রাহক গ্লাইকোজেন।
ইনসুলিন কেলাস: দুটি প্রধান মেরু সম্পন্ন অষ্টতলকীয় বস্তুগুলো হচ্ছে মানুষের হরমোন ইনসুলিন। ইনসুলিন তৈরি হয় অগ্নাশয়ে। এদের কাজ হচ্ছে রক্তে চিনির (গ্লুকোজ) মাত্রা ঠিক রাখা। দেহে এই ইনসুলিনের সরবরাহ অপর্যাপ্ত হয়ে গেলে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বেড়ে যায়। রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বেড়ে গেলে হয় ডায়াবেটিস।
ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস: এরা ইনফ্লুয়েঞ্জা A H1N1 virus. এই ইনফ্লুয়েঞ্জা A পরিবারের ভাইরাসগুলো মানুষ, শূকর, পাখি, এবং ঘোড়াকে আক্রান্ত করতে পারে। ২০০৯ সালে মহামারী আঁকারে সোয়াইন ফ্লু ছড়িয়েছিল এই H1N1 ভাইরাসগুলো। প্রত্যেকটির মাঝের অংশের গোলাপি রঙে রঞ্জিত অংশগুলো বংশগত তথ্যভাণ্ডার। এদের DNA থাকে না, তাই এমনভাবে বংশগত তথ্য বহন করতে হয়। এই বংশগত তথ্যগুলো প্রোটিন দ্বারা সুরক্ষিত থাকে। ঘিরে রাখা হলুদ রঙের অংশগুলো হচ্ছে প্রোটিনের আস্তরণ। H1N1 এর H ও N এসেছে Haemagglutinin ও Neuraminidase থেকে। এরা হচ্ছে একধরণের প্রোটিন। চিত্রে বাইরের দিকে সবুজ রঙে তাঁদের চিহ্নিত করা হয়েছে।
ব্যাকটেরিওফাজ: ব্যাকটেরিওফাজ হচ্ছে একধরণের বিশেষ ভাইরাস যেগুলো ব্যাকটেরিয়াকে আক্রমণ করে। চিত্রে দৃশ্যমান ভাইরাসটি হচ্ছে T4 ব্যাকটেরিওফাজ। এটি মাত্র তার ভাইরাল DNA একটি E. coli ব্যাকটেরিয়ার ভেতর প্রবেশ করালো। এই ধরণের ভাইরাস তাঁদের তন্তুগুলো দিয়ে ব্যাকটেরিয়ামের গায়ে নোঙর করে। ফাজ ভাইরাসের মাঝ বরাবর দণ্ড-সদৃশ অংশটা অনেকটা সিরিঞ্জের মতো। ব্যাকটেরিয়ার কোষ মেমব্রেন বা পর্দাকে ছিদ্র করে মাথার মতো দেখতে মূল অংশ থেকে DNA প্রবেশ করিয়ে দেয়। ভেতরে T4 এর ফাজ বৃদ্ধি পায়, তারপর ব্যাকটেরিয়াকে মেরে বেরিয়ে আসে। সবটা কাজ হয় মাত্র ৩০ মিনিটে।
জমাট রক্ত: আণুবীক্ষণীক এই চিত্রে দেখা যাচ্ছে রক্তের লাল কণিকাগুলো সাদা ও হলুদাভ ফাইব্রিনে আটকা পড়ে গেছে। ফাইব্রিন হচ্ছে একধরণের অদ্রবণীয় প্রোটিন। এরা প্লাটিলেটের সাহায্যে ফাইব্রিনোজেন নামক দ্রবণীয় প্রোটিন হতে উৎপন্ন হয়। প্লাটিলেট হচ্ছে শ্বেত রক্তকণিকার অসম্পূর্ণ অংশ বা প্রকারভেদ। আর ফাইব্রিনোজেন স্বাভাবিকভাবেই রক্তে উপস্থিত থাকে।
শরীরের কোনো অংশ কেটে ছড়ে গেলে এই রক্ত-জমাট প্রক্রিয়া কাজ করে। রক্ত-জমাট প্রক্রিয়া সাধারণত ত্বকের অংশে হয়। রক্তনালীতেই এই রক্ত-জমাট হতে পারে। খুব বেশি পরিমাণ প্লাটিলেট জমে গেলে অভ্যন্তরে জমাট বাধে। এই জমাট বাধা হার্ট এটাকের জন্য দায়ী।
সূত্রঃ [ডিসকভার ম্যাগাজিন থেকে ভাবানুবাদকৃত] http://discovermagazine.com/galleries/2015/jan-feb/science-beautiful
ছবিগুলো সুন্দর।
The pictures are really beautiful and creates curiosity about the mystery of human body what is actually not mystery but pure science.
ধন্যবাদ। মানবদেহে ঘটে যাওয়া রহস্যময় কার্যপ্রণালী দেখে আমি বারবার অবাক হই।
কোন ছবি কোন অণুবীক্ষণ পদ্ধতি ব্যবহার করে কত ম্যাগনিফিকেশান এ তোলা সেটা জানা গেলে আরও ভাল হত।
Great! 🙂 Thanks a lot to the writer of this article.
আপনার অনুভূতি শেয়ার করার জন্য আপনাকেও ধন্যবাদ।
সুন্দর ছবি 🙂