জীববিজ্ঞানের জন্যে ভালবাসা ( বিবর্তনের ডানায় উড্ডয়নের ইতিকথা)

লিখেছেন

লেখাটি , বিভাগে প্রকাশিত

আমরা আসলে এমন একটা পৃথিবীতে বাস করি যেখানে বিস্ময়ের উপকরণের কমতি নেই। অসম্ভব বৈচিত্র্যের আধার সমুদ্রের তলদেশে কি অসাধারণ প্রাণিবৈচিত্র্য। অমেরুদন্ডী থেকে মেরুদন্ডী- বিচিত্রতার কমতি নেই একটুও। কিন্তু এই অসম্ভব বিস্ময়কর প্রাণস্পন্দনের কতগুলিই বা আমরা নিজের চোখে দেখেছি! কখনও দেখেছি ন্যাশনাল জিওগ্রাফিতে কিংবা কখনও বা ডিসকভারির পাতায়। কিন্তু আমরা যেমন বায়ুসমুদ্রে ডুবে থেকেও ভুলে যাই বায়ুর সমুদ্রের কথা, তেমনিই আমাদের প্রতিদিনের বিস্ময়কর প্রাণচাঞ্চল্য, প্রাণস্পন্দন – সবকিছুই বিস্ময়ের উপকরণ। নিজের দেহের দিকে তাকালেই আমরা সেটি উপলব্ধি করতে পারব । আর এসকল বৈচিত্র্যের পেছনে ব্যখ্যা আর যুক্তি খুঁজতে আমরা যখন যাই, তখন আমাদের শরণাপন্ন হতে হয় বিবর্তনমূলক জীবনবিজ্ঞানের।

বিজ্ঞানী থিওডসিয়াস ডবঝানস্কি বলেছিলেন- “বিবর্তনের আলোয় না দেখলে জীববিজ্ঞানের কোন কিছুরই আর অস্তিত্ব থাকে না।” আর প্রকৃত অর্থেই জীববিজ্ঞানের অন্তর্গত প্রতিটি আলোচনার পেছনে যৌক্তিক ব্যখ্যা খুঁজতে গেলে আমাদের আলোচনাটিকে বিবর্তনবাদের উপরেই দাঁড় করিয়ে নিতে হয়।

আচ্ছা সে যাক। আমরা সবাই হয়ত আমাজনের গহীন অরণ্যে গিয়ে জীববিজ্ঞানের বিস্ময়, প্রকৃতির বিস্ময়কে প্রত্যক্ষ করতে পারব না। কিন্তু একটু চিন্তা করে যদি দেখি আমরা ঘরের একটু বাইরে গেলেই প্রত্যক্ষ করব বিস্ময়কর প্রাণের উপকরণ।আমরা কখনই কলোসাল স্কুইড (Scientific name: Mesonychoteuthis hamiltoni) মাছের বাস্কেটবল আকৃতির চোখ দেখতে পারব না। নারহাল তিমির পঙ্খীরাজ ঘোড়ার মত শৃংগও আমরা হয়ত শুধু ছবিতেই দেখব।তবে খুব দূরে আমাদের যেতে হবে না যদি আমরা উড়ন্ত ডাইনোসর দেখতে চাই! আজকে থেকে মাত্র কিছু দিন আগে পর্যন্ত আমরা তাদের ডাকে ঘুম থেকে জাগতাম।

আসলে আমরা আজকে যে পাখি দেখি মানে এই উড়তে সক্ষম আধুনিক পাখি যে উড়তে অক্ষম ক্ষুদ্রাকৃতির coelurosaurian theropod থেকে বিবর্তিত হয়েছে, এটা অনেকেই জানেন না। তবে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে আমরা এত পাখি দেখতে পাই যে তাদের ডাইনসোরীয় ঐতিহ্য আর তাদের পুচ্ছদেশকে পাশাপাশি অবলোকন করতে আমাদের কোন সমস্যা হয় না।

এবার দেখি এ উপযোজনটি কিরূপে হয়-  আসন্ন বাতাসের মুখে টিকে থাকার জন্য উড়ার কাজে ব্যবহৃত পালকগুলো অপ্রতিসম হয়ে থাকে- পালকের সম্মুখ প্রান্তটা চিকন ও শক্ত হয় এবং পশ্চাৎভাগটা লম্বা ও নমনীয় হয়। পাখি তার পাখাকে একটু কাত করলেই ভাসমান অবস্থায় উড্ডয়নের জন্য বায়ু প্রবাহটা যেভাবে উপযোজিত করা দরকার ঠিক সেভাবেই করে।

হ্যাঁ, এটি উড়োজাহাজের উড্ডয়নের সাথে কিছুটা সদৃশ হলেও পাখিদের ক্ষেত্রে বেশ কিছুটা পার্থক্য রয়েছে কিন্তু। উড়োজাহাজের পাখা একইভাবে বায়ুপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করলেও পাখির পাখা ওই ধাতব বস্তুর চেয়ে অনেক অনেক বেশি জটিল। পালকের একটা কেন্দ্রীয় দন্ড থেকে অনেকগুলো চিকন কাঁটা বিস্তৃত হয়, প্রত্যেকটি কাঁটার মধ্যে থাকে আরও ছোট ছোট কাঁটা, অনেকটা গাছের ডালের শাখা-প্রশাখার মত। প্রত্যেকটা কাঁটার সাথে থাকে একটা করে আঁকড়ি বা hook। এই আঁকড়িগুলো যখন আশেপাশের কাঁটাগুলোর আঁকড়িগুলোকে আঁকড়ে ধরে, তখন তারা খুবই হালকা কিন্তু শক্ত একটা জাল সৃষ্টি করে। পাখি যখন ঠোঁট দিয়ে তার পালক পরিস্কার করে, তখন কাঁটাগুলো আলাদা হয়ে আবার ঠিকই আগের অবস্থানে ফিরে আসে।

আর্কিওপ্টেরিক্সের কথায় আসি –

আর্কিওপটেরিক্স
আর্কিওপটেরিক্স

চার্লস রবার্ট ডারউইনের অরিজিন অব স্পিসিজ প্রকাশের মাত্র দু’ বছর পর জার্মানীর এক পাথর খনির শ্রমিক এক কোটি পঞ্চাশ লাখ বছরের পুরনো কাকের আকৃতির একটি জীবাশ্ম আবিস্কার করেন। এটির পাখির মত পালকযুক্ত পাখা থাকলেও ডাইনোসরের মত দাঁত ছিল, তিনটি নখযুক্ত আঙ্গুল, একটা অস্থিযুক্ত লেজ সহ ডাইনোসরদের সাথে অনেক শরীরতাত্ত্বিক সাদৃশ্য ছিল। এর নাম Archaeopteryx। জার্মানীতে পাওয়া এই “পাখি” এর জীবাশ্ম এই লাইনে একদম প্রথম, এর পরে একই প্রজাতির আরও অনেক জীবাশ্ম পাওয়া গিয়েছে।আরকিওপটেরিক্সের জীবাশ্মটি উড্ডয়নক্ষমতার বিবর্তনের ক্রান্তিলগ্নের চিত্রধারণ করেছে। বিজ্ঞানীরা এখন পর্যন্ত এর চেয়েও কোন প্রাচীন “পাখি” খুজে পাননি। বিজ্ঞানীরা আগে পালকের উৎপত্তি সম্পর্কে জানার জন্য সরীসৃপদের আঁশ নিয়ে গবেষণা করতেন, সরীসৃপরা পাখিদের নিকটতম আত্মীয় কিনা! পালকের মত শল্কও মসৃণ, তাই বিজ্ঞানীরা ধারণা করে নিয়েছিলেন যে পাখির পূর্বপুরুষের শল্ক হয়ত প্রজন্মান্তরে বিস্তৃত হয়েছিল। পরে হয়ত এই শ্লকগুলোর প্রান্তগুলো তন্তুসার হয়ে বিভক্ত হয়ে পৃথিবীর প্রথম পালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল। একে উড্ডয়নের জন্য অভিযোজন হিসেবে দেখার পেছনে যুক্তিও আছে। ধরে নেই, পাখির পূর্বপুরুষরা শল্কযুক্ত, ক্ষুদ্রাকৃতির চতুষ্পদী সরীসৃপ যারা গাছ থেকে গাছে লাফিয়ে দিন কাটাতো। তাদের শল্কগুলো যদি ধীরে ধীরে বিস্তৃত হত, তবে তারা ধুম করে নিচে না পড়ে একটু একটু করে ভেসে ভেসে তাদের পূর্বের অবস্থানের থেকে একটু দূরে গিয়ে অবতরণ করত। বলাই বাহুল্য, এই সুবিধা যাদের ছিল না তাদের লাফালাফি করার সময় নিচে পড়ে গিয়ে মৃত্যবরণ করার সম্ভাবনা অনেক বেশি ছিল। একই সাথে যদি তাদের হাতগুলো বিবর্তিত হয়ে পাখার জন্ম দিত, তাহলে তো সোনায় সোহাগা! উড্ডয়নক্ষমতার বিবর্তন হয়ত পাখার বিবর্তনের সমকালীন ছিল।
উড্ডয়নক্ষমতার বিবর্তনের এই হাইপোথিসিস সত্তুরের দশকে প্রথম প্রস্তাব করা হয়েছিল যখন ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবাশ্মবিদ জন অস্ট্রম পাখিদের অস্থি কাঠামোর সাথে Tyrannosaurus rex এবং Velociraptor ডায়নোসরের জীবাশ্মের অদ্ভুত মিল লক্ষ করেছিলেন। তবে তাদের অনেক বড় পা, ছোট হাত এবং লম্বা ও মজবুত লেজ ছিল, যা গাছে লাফালাফি করার প্রাণীদের শরীর কাঠামোয় একদম বেমানান। অন্য জীবাশ্মবিদরা দাবি করেছিলেন যে পক্ষীকূল ডায়নোসর থেকে বিবর্তিত হয়নি, বরং এই দু’টো দলের একটা সাধারণ পূর্বপুরুষ ছিল। ১৯৯৬ সালে চীনা জীবাশ্মবিদরা অস্ট্রমের অনুকল্পের সমর্থনে বিষ্ময়কর প্রমাণ পেলেন। জীবাশ্মটি ছিল এক কোটি পঁচিশ লাখ বছরের পুরনো Sinosauropteryx। এই জীবাশ্মটির একটি অবাক করা বৈশিষ্ট্য হল যে অসংখ্য লম্বা ও ফাঁপা সূত্র বা filament এর পৃষ্ঠদেশ এবং লেজকে আবৃত করে রেখেছিল। একটি স্থলচর থেরোপডের গায়ে আসলেই প্রাচীন পালকের অস্তিত্ব পাওয়া গিয়েছিল, একারণে ধারণা করা হয়েছিল যে পালকের উদ্ভবের সাথে হয়ত উড্ডয়নের বিবর্তনের কোন সম্পর্ক ছিল না। এর পরই জীবাশ্মবিদরা একটার পর একটা পালকযুক্ত থেরোপড আবিস্কার করতে লাগলেন। এতগুলো জীবাশ্ম পেয়ে তাঁরা পালকের একটি দীর্ঘ ইতিহাস তৈরী করতে নেমে পড়লেন। একদম প্রথমেই এসেছিল ফিলামেন্ট। এরপর এসেছিল বিভিন্ন প্রকার পালক- কারও কারও পালক ছিল আজকের পাখিদের মত তুলতুলে, কারও কারওরটা ছিল প্রতিসমভাবে সাজানো কাঁটাসমষ্টি। অন্য কিছু থেরোপডের ছিল ফিতার মত ফিলামেন্ট, যা আর বর্তমানে দেখা যায় না।

এই লম্বা, ফাঁপা ফিলামেন্টগুলো একটা নতুন প্রশ্ন উত্থাপন করল- যদি এরা আসলেই পালক হয়ে থাকে, তবে এরা শল্ক থেকে বিবর্তিত হল কেমনে? বর্তমান যুগে এখনও সুতোর মত ফিলামেন্টওয়ালা থেরোপড পাওয়া যায়- তারা হল পাখিদের বাচ্চা। পক্ষীছানাদের শরীরে পালকগুলো প্রথমে ছোট ছোট লোম হিসেবে বেড়ে ওঠে, পরে এগুলো জটিলতর আকৃতি ধারণ করে। পাখিদের ভ্রুণে এই লোমগুলো “প্ল্যাকোড” নামক এক প্রকার চর্মকোষ থেকে উদ্ভূত হয়। এই প্ল্যাকোডের উপর দ্রুত বর্ধনশীল একটি কোষচক্র একটি সিলিন্ডার আকৃতির প্রাচীর গড়ে তুলে,এগুলোই পরে লোম হয়। সরীসৃপেরও প্ল্যাকোড রয়েছে, তবে ভ্রুণ অবস্থায় প্রত্যেকটি প্ল্যাকোড এমন কিছু জিন সক্রিয় করে যার ফলে প্ল্যাকোডের পিছনের দিকের চর্মকোষগুলো বড় হয়ে শল্ক সৃষ্টি করে। ’৯০ এর দশকে ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের রিচার্ড প্রুম এবং কানেকটিকাট বিশ্ববিদ্যালয়ের এলান ব্রাশ প্রস্তাব করেন যে জেনেটিক কোডের একটা সামান্য পরিবর্তনের ফলে হয়ত চর্মকোষগুলো অনুভূমিক রেখায় বৃদ্ধি না পেয়ে উল্লম্ব রেখায় বেড়ে উঠতে শুরু করে, যার ফলে শল্করা পরে পালকে বিবর্তিত হয়েছিল। অর্থাৎ, পালক আসলে একই বাদ্যযন্ত্রে ভিন্নভাবে বাজানো একটি সঙ্গীত। একবার ফিলামেন্ট তৈরী হলে সামান্য কিছু পরিবর্তনের মাধ্যমে জটিল জটিল সব পালকের উদ্ভব ঘটা অস্বাভাবিক কিছু না।

আরেকটা চমকপ্রদ সম্ভাবনাও আছে। পাখি, ডাইনোসর আর টেরোসরদের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠতম জীবিত আত্মীয় হল কুমিররা। এই শল্কযুক্ত প্রাণীগুলোর গায়ে পালক না থাকলেও দেখা গিয়েছে যে শল্ক ও পালকের জিনের মাঝে নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে, তাই ২ কোটি ৫০ বছর আগে কুমিরের পূর্বপুরুষের দেহে পালক পাওয়া গেলেও আমরা আশ্চর্য হব না। কিছু কিছু বিজ্ঞানী মনে করেন কুমিররা কিভাবে তাদের পালক হারালো এটাই বড় প্রশ্ন, শুধু পাখিদের পালক নিয়ে পড়ে থাকলে হবে না। পালক যদি প্রথমে উড়াউড়ির জন্য বিবর্তিত না হয়ে থাকে, তাহলে তাদের আর কি কি উপযোগীতা থাকতে পারে? কিছু জীবাশ্মবিদ অন্তরণের(insulation) প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। দেহের অগ্রভাগের অঙ্গগুলো নীড়ের উপর ছড়িয়ে রাখা অবস্থায় অনেক থেরোপড আবিস্কৃত হয়েছে, খুব সম্ভবত তারা তাদের পালক ব্যবহার করে সন্তানদের ছায়া দিচ্ছিল।

সাম্প্রতিককালে জনপ্রিয়তা পাওয়া আরেকটা অনুকল্প হল যে পালকের উদ্ভবের পেছনে নিজেকে প্রদর্শন করার প্রবনতার ভূমিকা থাকতে পারে। বর্তমান যুগের পাখিদের পালকের রঙের বাহার দেখে মুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই। ময়ূরের মত পাখি তাদের বাহারি পালক উন্মোচন করে বিপরীত লিঙ্গকে আকর্ষণ করে। এই অনুকল্পের গ্রহনযোগ্যতা অনেকাংশে বৃদ্ধি পেল যখন ২০০৯ সালে বিজ্ঞানীরা ময়ূরের পালকগুলোকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা শুরু করলেন। তাঁরা পালকগুলোর মধ্যে মেলানোজম নামক কিছু অনুবীক্ষণিক স্থলী(sac) দেখতে পেলেন যার সাথে অন্য সব পাখির রঙিন পালকের জন্য দায়ী অরগানেলের(কোষের ভেতরের কিছু ছোট্ট জিনিস যা একটি সুনির্দিষ্ট কাজ সম্পাদন করে) সম্পর্ক রয়েছে। এই মেলানোজমগুলো এত ভালভাবে সংরক্ষিত যে বিজ্ঞানীরা খুব সহজেই বিলুপ্ত ডায়নোসরদের পালকের রঙ খুজে বের করতে পারেন।Sinosauropteryx এর লেজের লাল ও সাদা রঙের ডোরাকাটা ছিল। এই প্রজাতির পুরুষরা হয়ত তাদের লেজ নাচিয়ে নারীদের আকর্ষণ করার চেষ্টা করত, অথবা জেব্রাদের মত তাদের ডোরাকাটা ব্যবহার করে শত্রু আর মিত্রের মধ্যে পার্থক্য করত।

পালকের কাজ যাই হোক, একটি বিশেষ গোত্রের ডাইনোসর তাদেরকে উড্ডয়নের কাজে ব্যবহার করার কয়েক লক্ষ বছর আগে থেকেই তারা অস্তিত্বশীল ছিল। জীবাশ্মবিদরা বর্তমানে পালকের এই পরিবর্তন নিয়ে গবেষণা করছেন। সাম্প্রতিককালে ১ কোটি ৫০ বছরের পুরনো একটি জীবাশ্ম পাওয়া গিয়েছে, নাম তারAnchiornis.

Anchiornis
Anchiornis

পাখিটি আকারে মুরগির মত, তার হাতের পালকে ছিল সাদা-কাল অংশ আর মাথায় ছিল একটি লালচে পালকের মুকুট। উড্ডয়ন কাজে ব্যবহৃত পালকের সাথে Anchiornis এর পালকের বেশ সাদৃশ্য ছিল, কিন্তু সেগুলো বর্তমান যুগের পাখিদের পালকের মত প্রতিসম ছিল না। বলাই বাহুল্য, তার উড্ডয়ন ক্ষমতা বেশ কম ছিল। তার পুচ্ছ এদিক দিয়ে দুর্বল হলেও সংখ্যার দিক দিয়ে ছিল সবল। হাত, পা থেকে শুরু করে পদাঙ্গুলিতেও তার পালক ছিল। ময়ূরের মত যৌন নির্বাচনের ফলেই হয়ত তাদের এই দশা হয়েছিল। এরকম নজরকাড়া পুচ্ছরাজি বিপরীত লিঙ্গের পাশাপাশি শিকারীদেরকেও মুগ্ধ করত(!), যেমনটা ময়ূরের ক্ষেত্রে দেখা যায়। তবে বেইজিংয়ের Institute of Vertebrate Paleontology and Paleoanthropology এর কলিন সালিভান ও তাঁর সহকর্মীরা দেখিয়েছেন যে Anchiornis এই বিপত্তি মোকাবেলা করতে পেরেছিল। আধুনিক পাখিদের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কযুক্ত থেরোপডদের কব্জিতে একটা কীলকের মত হাড় ছিল যার ফলে তারা তাদের হাত শরীরের পাশে ভাঁজ করে রাখতে পারত, এর ফলে তাদের হাতের পালকগুলো মাটির সংস্পর্শে আসত না। আধুনিক পাখিরা উপরের দিকে পাখা সঞ্চালন করার সময় একই রকম একটি হাড় ব্যবহার করে। সুলিভানের গবেষণা সঠিক হলে প্রমাণিত হবে যে উড্ডয়নের জন্য এই গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যটি পাখার উদ্ভবের আগেই বিবর্তিত হয়েছিল। বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞানীরা একে বলেন এগজাপটেশন(exaptation)- অর্থাৎ, পুরনো কোন অঙ্গকে নতুন কাজে ব্যবহার করা। এখন মনে হচ্ছে উড্ডয়নের লক্ষ লক্ষ বছর আগেই একের পর এই পরিবর্তনটা কিভাবে ঘটেছিল, সেটা নিয়ে এখনও অনেক বিতর্ক রয়েছে। কিছু কিছু বিজ্ঞানী মনে করেন যে পালকযুক্ত ডাইনোসররা স্থলে থেকে পাখা ঝাপটিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে একসময় উড়ার ক্ষমতা অর্জন করেছিল, কিন্তু অনেকে এই অনুকল্পের বিরুদ্ধে যুক্তি দেখান যে Anchiornis এর পায়ের “পাখাগুলো” উড়ার জন্য তো দূরের কথা, স্রেফ দৌড়ের জন্যই প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করত। এই গবেষকরা প্রমাণ করার চেষ্টা করছেন যে প্রাচীন পক্ষীকূল গাছ থেকে গাছে লাফিয়ে বেড়াত, তাদের পালক ব্যবহার করে তারা বাতাসে কিছুক্ষণের জন্য হলেও ভাসতে পারত। এভাবেই তারা কোটি কোটি বছর ধরে আধুনিক পক্ষীকুলে বিবর্তিত হয়েছিল।

University of Montana-Missoula এর কেন ডায়াল মনে করেন, এই দু’টো অনুকল্পেরই সঠিক হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু হবে না। ডায়াল দেখিয়েছেন যে অনেক পাখির শাবকরা শিকারীর হাত থেকে বাঁচার জন্য গাছের গুড়ির মত উচু জায়গায় দৌড়ে ওঠার সময় তাদের অতি ক্ষুদ্র পাখাগুলো ঝাপটিয়ে উত্তোলন শক্তি(traction) সঞ্চয় করার চেষ্টা করে। তারা যদি গুড়ি বেয়ে উঠতে নাও পারে, পাখা ঝাপটানোর কারণে তারা অন্তত নিরাপদে ভূমিতে অবতরন করতে পারে। শাবকটি যখন প্রাপ্তবয়স্ক হয়, এই নিয়ন্ত্রিত অবতরনই তখন পরিপূর্ণ উড্ডয়ন ক্ষমতায় রুপ নেয়। ডায়াল মনে করেন, পাখি শাবকের এই বড় হওয়ার মধ্যেই উড্ডয়ন ক্ষমতার বিবর্তনের রহস্য লুকিয়ে আছে।

জীববিজ্ঞানের বাইরের অনেকেই মনে করেন উড্ডয়ন ক্ষমতার বুঝি কোন ব্যাখ্যা নেই। আরেকটু বিস্তারিত বলতে কি, অনেকেই মনে করেন যে বিবর্তনমূলক জীববিজ্ঞান বুঝি অজানা প্রশ্নের ভারে ভারাক্রান্ত, যেন বিজ্ঞানের এই শাখার কাছে কোন প্রশ্নেরই কোন উত্তর নেই। আসলে বিজ্ঞানের এই অসাধারণ শাখাটিতে প্রশ্নের চেয়ে সম্ভাব্য উত্তরের সংখ্যাটাই বেশি, কোনটা সঠিক উত্তর সেটা প্রমাণ করাই আসল চ্যালেঞ্জ। বিবর্তনমূলক জীববিজ্ঞানের অন্যসব ক্ষেত্রের মত এক্ষেত্রেও সমস্যাটা আসলে ঠিক উলটো- আলোচ্য রহস্যের পেছনে এত বেশি সম্ভাব্য ব্যাখ্যা রয়েছে যে সঠিক উত্তরটি ভবিষ্যদ্বাণীর সাথে সাথে আমাদের সময়ের প্রবহমানতার দিকে তাকিয়ে থাকতে হয় ।

রেফারেন্স ইনফরমেশন-
১) Andrea Thompson (2008-07-08). “Feather Fossils Could Yield Dinosaur Colors“. LiveScience. Retrieved 2009-08-29
২) Li, Q., Gao, K.-Q., Vinther, J., Shawkey, M.D., Clarke, J.A., D’Alba, L., Meng, Q., Briggs, D.E.G. and Prum, R.O. “Plumage color patterns of an extinct dinosaur.” Science, 327(5971): 1369 – 1372. doi:10.1126/science.1186290 PMID 20133521
৩) Matthew J Greenwold and Roger H Sawyer, Genomic organization and molecular phylogenies of the beta (β) keratin multigene family in the chicken (Gallus gallus) and zebra finch (Taeniopygia guttata): implications for feather evolution, BMC Evol Biol. 2010; 10: 148. Published online 2010 May 18. doi: 10.1186/1471-2148-10-148

লেখাটি 508-বার পড়া হয়েছে।


আলোচনা

Responses

  1. এই লেখাটা আগেই পড়ে ফেলেছিলাম। কিপিটাপ! জোরসে সিরিজ লিখতে থাকো। লেখাতে আরও চিত্র থাকলে ভালো হতো, প্রাসঙ্গিক কিছু চিত্র দেয়া যেতো। ইয়ে বাপু, তুমি এত কম কম লিখছ কেন? একদমই লেখা পাই না। প্রতি মাসে অন্তত দুইটা লিখ, তাহলেও তো চলে যায়।

    1. Atonu Chakrabortty Avatar
      Atonu Chakrabortty

      আহেম! অলস মানুষ তো! লিখব এখন থেকে।

  2. দারুণ একটা বিষয় ধরেছো। পাখিদের ওড়া নিয়ে মোটামুটি অনেক কিছুই জানলাম এখান থেকে। একটা সাইডনোট রাখি, পৃথিবীতে প্রাণের ইতিহাসে উড্ডয়ন কিন্তু একাধিকবার বিবর্তিত হয়েছে। পতঙ্গ, পাখি আর বাদুড়ের ওড়ার বিবর্তন ভিন্ন পথে হয়েেছে।

    1. Atonu Chakrabortty Avatar
      Atonu Chakrabortty

      হ্যাঁ দাদা। এটাকে আরেকটু বিস্তারিত করার ইচ্ছে আছে। তখন আরেকটু ক্লিয়ার করতে পারবো।
      ধন্যবাদ দাদা। আপনার পরামর্শ মন্তব্য আমার জন্যে খুব ইন্সপায়ারিং!

  3. সিরিজের প্রথম লেখাটি পড়েই আপনার ভক্ত হয়ে গিয়েছি, অনেক লেখাটির অপেক্ষা করেছিলাম। অনেক কিছু জানলাম। আরো দুইবার পড়বো ভাবছি।

Leave a Reply

ই-মেইলে গ্রাহক হয়ে যান

আপনার ই-মেইলে চলে যাবে নতুন প্রকাশিত লেখার খবর। দৈনিকের বদলে সাপ্তাহিক বা মাসিক ডাইজেস্ট হিসেবেও পরিবর্তন করতে পারেন সাবস্ক্রাইবের পর ।

Join 908 other subscribers