বাংলাদেশের বিজ্ঞান আন্দোলনের চারযুগ

লিখেছেন

লেখাটি বিভাগে প্রকাশিত

১৯৭৮ সালের কথা। বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় বিজ্ঞান সপ্তাহ উপলক্ষে রাজধানী ঢাকায় আয়োজিত কেন্দ্রীয় অনুষ্ঠানে একটি আলোচনা সভায় আলোচ্য বিষয় ছিল ’আমাদের সমাজ দেহে বিজ্ঞান প্রবেশ করছে না কেন?’ তারপর পার হয়েছে চল্লিশ বছর। এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে সমাজ দেহে কতটা বিজ্ঞান প্রবেশ করেছে- বাংলাদেশের বিজ্ঞান আন্দোলনের চিত্র আঁকতে গিয়ে অবধারিতভাবে এই প্রশ্ন এসেই যায়।

Nil Sagor: "বছরের দীর্ঘতম দিনে অনুসন্ধিৎসু চক্রের প্রকল্প প্রদর্শনী"

বিজ্ঞানসম্মত দৃষ্টিভঙ্গি ও মনোভাব এক হতে বহুর মধ্যে ছড়িয়ে দেয়ার নামই বিজ্ঞান আন্দোলন। এটি গড়ে তোলার মাধ্যমগুলোর মধ্যে রয়েছে দেশময় বিজ্ঞান ভিত্তিক ক্লাব সংগঠন প্রতিষ্ঠান, প্রকাশনা, আয়োজন। ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর বিজ্ঞান আন্দোলন দানা বাধতে থাকে। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পরপরই যেসব দাবী জোরালো হয়ে ওঠে সেসবের মধ্যে অন্যতম ছিলো আমাদের সমাজে ধর্মীয় কুসংস্কার ও মোহ যে অনর্থ ঘটিয়েছে তার হাত থেকে মুক্ত, সচ্ছল ও সমৃদ্ধ অর্থনৈতিক জীবনের নিশ্চয়তা বিধানের জন্য দেশের জনগণের মধ্যে বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের ব্যাপক বিস্তার ঘটাতে হবে। দেশগঠনের স্বপ্নকে বুকে ধারণ করে সারা দেশের মানুষের মধ্যে বিজ্ঞানবোধের বিকাশ, প্রশ্নশীলতা, বস্তুনিষ্ঠ চিন্তার উৎকর্ষ সাধনের প্রয়োজনীয়তা সেসময় কিছু মানুষ অনুভব করেছিলেন। এই মানুষদের মধ্যে ছিলেন শিক্ষার্থী, শিক্ষক, প্রকৌশলী, গবেষক, চিকিৎসক। সেই ধারাবাহিকতায় ও বিশেষ সামাজিক প্রয়োজনে দুএক বছরের মধ্যে কিশোর-তরুণদের প্রচেষ্টায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে গড়ে উঠে বেশকিছু বিজ্ঞান ক্লাব। এদের মধ্যে ছিলো অনুসন্ধানী, অনুসন্ধিৎসু চক্র, স্পুটনিক, চট্টগ্রামের কলকন্ঠ, খুলনার বেতাগা বিজ্ঞান সমিতি। এসময় খেলাঘরের মতো নামকরা শিশুকিশোর সংগঠন গুরুত্বের সাথে বিজ্ঞান ভিত্তিক কর্মসূচী গ্রহণ করে। ১৯৭৮ সালে সরকারী উদ্দ্যোগে দেশে প্রথম জাতীয় বিজ্ঞান সপ্তাহ অনুষ্ঠিত হয়। এই বিজ্ঞান সপ্তাহ দেশের কিশোর তরুণদের মধ্যে উৎসাহ সৃষ্টি ও বিজ্ঞানক্লাবধর্মী তৎপরতায় এক নতুন মাত্রা যোগ করে। কেননা এর আগে নিজ নিজ পরিসরে অনেকে সক্রিয় থাকলেও বিজ্ঞান সপ্তাহের কর্মসূচীর মাধ্যমে বিজ্ঞান ক্লাব কর্মীদের পরষ্পরের কাছাকাছি আসা ও ভাব বিনিময়ের ক্ষেত্র সৃষ্টি হয়। পত্রপত্রিকায় এ নিয়ে লেখালেখি বিজ্ঞানক্লাব বা সংঘকে আরো ব্যাপক মানুষের কাছে গুরুত্ববহ করে তুলতে থাকে। বিজ্ঞান সপ্তাহগুলোতে বিজ্ঞান মেলার পাশাপাশি আলোচনা, ক্ষুদে বিজ্ঞানী ও বিজ্ঞানৎসাহী শিক্ষক প্রতিনিধিদের সাথে উদ্যোক্তাদের সমাবেশ ও মতবিনিময়, বিজ্ঞান কর্মশিবির, বিজ্ঞানীমহলের সাথে সংযোগ ইত্যাদি ধরনের কর্মপ্রয়াস এসময় লক্ষ্য করা যায়। তখন নতুন নতুন অজস্র বিজ্ঞান ক্লাব দেশের আনাচে কানাচে গড়ে উঠতে থাকে। বিজ্ঞান ক্লাবগুলো প্রকল্প তৈরির পাশাপাশি জরীপ-সমীক্ষা সংগ্রহ, বিজ্ঞান অভিযান, স্থানীয় সমস্যা সমাধানে কার্যক্রম, সহজ লভ্য উপকরণ ব্যবহার করে লাগসই প্রযুক্তি নির্মাণ, শিক্ষা উপকরণ তৈরি, বিজ্ঞান সভা, বিজ্ঞানকে সমাজে জনপ্রিয়করণের মত বিচিত্র সব কর্মকান্ডে নিয়োজিত ছিলো। বিভিন্ন দলিলপত্র বলছে সেসময় দেশে প্রায় চারশ বিজ্ঞান ক্লাব নানাভাবে সক্রিয় ছিলো। এসব কর্মকান্ডের বিস্তারিত বিবরণ বিধৃত আছে বাংলাদেশ বিজ্ঞানী ও বিজ্ঞানজীবী সমিতি প্রকাশিত ’বিজ্ঞান ক্লাব’ শীর্ষক বইতে। দেশের বিজ্ঞানী, শিক্ষক, গবেষক, প্রযুক্তিবিদ এবং সমাজসেবকদের অনেকে এসব ক্লাবের পৃষ্ঠপোষকতায় এগিয়ে আসেন। তাগিদবোধের জায়গা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষক শিক্ষকতার পাশাপাশি স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে বিজ্ঞান ক্লাব কর্মীদের সার্বিক বিকাশে সময় দিতেন, ক্লাস নিতেন। আশির দশকে কিছু সময় দেশের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যাবিভাগের সচিবের দায়িত্বে ছিলেন বিজ্ঞান লেখক ও শিক্ষাবিদ ড.আবদুল্লাহ আল-মুতী শরফুদ্দীন। তিনি ও তাঁর মত গোটাকয়েক বিজ্ঞানোৎসাহী ব্যক্তিত্ব তখন দেশের বিজ্ঞান আন্দোলনে নেতৃস্থানীয় ভূমিকা রাখেন। বিজ্ঞান ক্লাবধর্মী তৎপরতার পাশাপাশি আশির দশকে সমাজে বিজ্ঞান মনষ্কতা সৃষ্টির মাধ্যমে বিজ্ঞান সংস্কৃতি গড়ে তোলার একধরনের সাংগঠনিক প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যায়। অধ্যাপক আবদুল জব্বার, অধ্যাপক জহুরল হক, ড. আবদুল্লাহ আল-মুতী শরফুদ্দীন, অধ্যাপক এ আর খান, অধ্যাপক আলী আসগর, শ্রী সন্তোষ গুপ্ত, জনাব নওয়াজেশ আহমদ, সাংস্কৃতিক সংগঠক ওয়াহিদুল হক, অধ্যাপক আবদুল হালিম প্রমুখ বিজ্ঞান সংস্কৃতি পরিষদের মাধ্যমে চিন্তাচর্চায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

নব্বইর দশকে দেশে নানা ধরনের প্রযুক্তির বিস্তৃতি একদিকে বৃদ্ধি পেতে থাকে অপরদিকে বিজ্ঞান আন্দোলন ভিত্তিক কর্মতৎপরতায় দেখা যেতে থাকে ভাটার লক্ষণ। দুএকটি ব্যতিক্রম ছাড়া সাধারণভাবে বিজ্ঞান ক্লাবের কার্যক্রম প্রকল্প ভিত্তিক ও বিজ্ঞান মেলা কেন্দ্রীক হয়ে পড়ে। আর্থসামাজিক প্রতিবন্ধকতা, বিজ্ঞান ক্লাবগুলোর অভ্যন্তরীণ সাংগঠনিক দুর্বলতা, বিচ্ছিন্নভাবে কর্মকান্ড পরিচালনার কারণে এক সময়ের বিজ্ঞান আন্দোলনের প্রবল ধারা ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে আসতে থাকে। সরকারী পর্যায়ের নানা অবহেলা, বাজেট হ্রাস পাওয়ার কারণে কেবলমাত্র বিজ্ঞান মেলা ভিত্তিক জাতীয় বিজ্ঞান সপ্তাহ ক্রমশ পরিণত হয়ে আসতে থাকে এক আনুষ্ঠানিকতায়। এর সরাসরি প্রভাব পড়ে দেশের বিজ্ঞান ক্লাবগুলোর উপর। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের পদক্ষেপ হিসেবে ১৯৯৯ সালে গঠিত হয় সাইন্স ক্লাব এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (স্ক্যাব) নামের একটি প্লাটফর্ম। এই কাঠামোর মাধ্যমে দেশের বিজ্ঞান ক্লাবগুলোকে এক ছাতার তলে এনে বিজ্ঞান চর্চা ও বিজ্ঞান ক্লাবগুলোর স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে যৌথ কর্মসূচী নেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়। স্ক্যাবের স্বল্পকাল সক্রিয় কার্যক্রমের মধ্যে বেশ কিছু উদ্যোগ তাৎপর্যপূর্ণ ছিলো। এরমধ্যে একটি ছিলো ২৮ মে কে বিজ্ঞান দিবস হিসেবে পালন ও এর আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির দাবী উত্থাপন [খ্রীষ্টপূর্ব ৫৮৫, ২৮ মে তারিখে তুরষ্কের মিলেটাস শহরে থ্যালিস সূর্যগ্রহণের সংঘটিত হবার যৌক্তিক ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। জানিয়েছিলেন সূর্যগ্রহণের সাথে দেবতা বা অপদেবতার কোন সম্পর্ক নেই]। জাতিসংঘ তখনো পর্যন্ত বছরের কোন দিনকে বিজ্ঞান দিবস ঘোষণা করেনি। এছাড়া স্ক্যাবের অপর আরেকটি কর্মসূচী ছিলো বিজ্ঞান ক্লাবগুলোর অনুদান বন্ধ রেখে লোক দেখানো বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সপ্তাহ পালনের সরকারী অনুষ্ঠান বর্জনের কর্মসূচী। নেতৃস্থানীয় তরুণ সংগঠকরা ব্যস্ত হয়ে পড়ায় ও নতুন কেউ এগিয়ে না আসার কারণে স্ক্যাব বেশিদিন সক্রিয় থাকতে পারেনি।

দেশের অনেক বিজ্ঞানামোদীর চাওয়া একটি চলমান বিজ্ঞান জাদুঘরের স্বপ্নপূরণ হয় ২০০৩ সালে এসে। অনুসন্ধিৎসু চক্র ও বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণ সমিতি যৌথভাবে বাংলাদেশের প্রথম ভ্রাম্যমাণ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করে। শহর থেকে প্রত্যন্ত অঞ্চলে ভ্রাম্যমাণ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘরের উদ্যোগে বেশ কয়েকটি বিজ্ঞান উৎসব শিক্ষার্থীদের মধ্যে সাড়া ফেলে। অনেক বিলম্বে হলেও খুব সম্প্রতি দেশের জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘরের সংযুক্ত মিউজু বাসের মাধ্যমে আয়োজিত ভ্রাম্যমাণ বিজ্ঞান প্রদর্শনী শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণে ভূমিকা রাখছে। ২০০৩ সাল থেকে করপোরেট পৃষ্ঠপোষকতায় বেসরকারীভাবে নিয়মিত জাতীয় গণিত অলিম্পিয়াডের আয়োজন গণিত নিয়ে কিছু শহুরে শিক্ষার্থীদের মধ্যে এক ধরনের উচ্ছ্বাস সৃষ্টি করতে সমর্থ হচ্ছে। এই তালিকায় পরে আরো যোগ হয়েছে বিভিন্ন বিষয় ভিত্তিক অলিম্পয়াড। ২০০৯ সালে পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণকে উপলক্ষ করে সাধারণজনকে বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহী করে তুলতে ব্যাপকমাত্রায় প্রচারণা ও বিভিন্ন কর্মসূচীর সাংগঠনিক প্রয়াস দেখা যায়। এই সময়গুলোর মধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানভিত্তিক বিভিন্ন বিজ্ঞান ক্লাব গড়ে উঠতে থাকে। কিছু বিজ্ঞান ক্লাব নিয়মিতভাবে করপোরেট সহযোগিতায় বিভিন্ন ইংরেজী নামে বিজ্ঞান উৎসব আয়োজন করছে। তবে এসব বিজ্ঞান ক্লাবের মিলের জায়গাটি হচ্ছে এই ক্লাবগুলোর কর্মকান্ড বছরে একটি বিজ্ঞান উৎসব আয়োজন ও কেবলমাত্র বিজ্ঞান মেলাকে সামনে রেখে প্রজেক্ট নির্মাণের মধ্যে গন্ডিবদ্ধ থাকা। নব্বইয়ের দশকে যে সাড়ে চারশ বিজ্ঞান ক্লাবের অন্তিত্ব ছিলো এসময়ে এসে সেসব ক্লাবের বেশির ভাগ যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো। নতুন কিছু ব্যক্তিকেন্দ্রিক অপ্রাতিষ্ঠানিক বিজ্ঞান ক্লাব সৃষ্টি হলেও তাদের কর্মকান্ড বছরের একটি জাতীয় বিজ্ঞান সপ্তাহে অংশগ্রহণ বা প্রকল্প নির্মাণ ভিত্তিক কর্মকান্ডের মধ্যে সীমাবদ্ধ। এই ধারার বাইরে নব্বই দশকের শেষের দিক থেকে বিজ্ঞান চেতনা পরিষদ ও আরো পরে বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণ সমিতি, বিজ্ঞান আন্দোলন মঞ্চ নিজ নিজ পরিসরে একভাবে বিজ্ঞান চর্চা করছে। আর পুরনো সংগঠনগুলোর মধ্যে কেবল অনুসন্ধিৎসু চক্র আজো নিরবিচ্ছিন্নভাবে বিজ্ঞান ভিত্তিক তৎপরতা ও বিজ্ঞানের জনমুখীকরণে সক্রিয় রয়েছে। বাংলাদেশের রয়েছে একটিমাত্র জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘর। জনসাধারণের মধ্যে বিজ্ঞান সচেতনতা সৃষ্টি, বিজ্ঞান শিক্ষার প্রসার ও দেশে বিজ্ঞান ক্লাবের নিবন্ধন প্রদান ও দেখভালের দায়িত্বপ্রাপ্ত এই সরকারী প্রতিষ্ঠানটি তার প্রতিষ্ঠার পঞ্চাশ বছরের সময়কালে সামর্থের কিয়দাংশও ব্যবহার করেনি।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে জাতীয় সংস্কৃতির অঙ্গ হিসেবে না দেখে শুধু প্রয়োজনীয় ভোগের সামগ্রী উৎপাদনের কৌশল হিসেবে দেখার একটি অসুস্থা প্রবণতা দেশের নীতি নির্ধারক মহলে দেখা যায়। বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানমনষ্কতাকে উপেক্ষা করে তথ্যপ্রযুক্তি নিয়ে একটা হুজুগও লক্ষ্যণীয়। আর অধিকাংশ বিজ্ঞান ক্লাবেই এখন শুধুমাত্র প্রযুক্তি চর্চা করা হয়। এই প্রযুক্তি চর্চাও ঘটে বিজ্ঞান মেলা বা কোন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকে সামনে রেখে। বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি গঠন, বিজ্ঞানের নিকট সমাজের যে চাহিদা আছে তা পূরণ, চারপাশের সমাজে বিজ্ঞান চর্চার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর প্রতি কোন পর্যায়েই ভ্রুক্ষেপ নেই। সরকারী অনাগ্রহের পাশাপাশি দেশের বিজ্ঞানী, শিক্ষক, গবেষকরা এই অবস্থার পরিবর্তনে সক্রিয়তা দেখাননি। অথচ যে পৃথিবীতে আমরা বাস করি তাকে ভালোভাবে বুঝতে, সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও সমস্যা সমাধানে বিজ্ঞানমনষ্কতা খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিজ্ঞানসম্মত দৃষ্টিভঙ্গি অনিশ্চিত নিয়ন্ত্রণহীন পরিস্থিতিতে মানুষের অসহায়তাবোধ ও উদ্বেগকে প্রশমিত করতে সাহায্য করে। সত্য অসত্য, উচিত অনুচিতকে যাচাই করে নেয়ার পথ দেখায়। সীমাবদ্ধতা, গ্লানি থাকলে মানুষ তাকে নিয়তি হিসেবে মেনে না নিয়ে তাকে অতিক্রম করার চেষ্টা করে। মানুষ যখন প্রশ্ন করে জানতে পারে কোন ঘটনা কেন হয়, কী করলে কী ফল পাওয়া যায়, তখন কেউ তাকে প্রতারণা করতে পারেনা। তখন কোন চিকিৎসা পদ্ধতি উপযুক্ত- ঝাড়ফুঁক নাকি চিকিৎসকের শরণাপন্ন হবে বা কোন খাবার স্বাস্থ্যসম্মত কিংবা সরকার গৃহীত কোন উন্নয়ন কর্মকান্ড টেকসই কিনা এরকম বিবিধ বিষয়ে মানুষ যৌক্তিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে। সেটি হয়নি বলেই আমরা দেখবো দৈনন্দিন জীবনে অযৌক্তিক আচরণ ও বিভ্রান্তিকর জীবনবোধের প্রাধান্য। আমরা যখন বলছি দেশ এখন থ্রিজি থেকে ফোরজি যুগে প্রবেশ করেছে, মহাকাশে ন্যানোস্যাটেলাইট প্রেরণ করতে পারছি বলে ঢেকুড় তুলছি তখন যুদ্ধাপরাধীর দণ্ডপ্রাপ্ত জামাতে ইসলামীর এক শীর্ষনেতার মুখ চাঁদে দেখা গেছে- এই উদ্ভট কথা বলে এক ধরনের নৈরাজ্য সৃষ্টির অপপ্রয়াসের সুযোগ পায় একটি গোষ্ঠী। চন্দ্র বা সূর্যগ্রহণের সময় গর্ভবতী মাকে না খাইয়ে রাখা বা রোগ নিবারণে ঝাড়ফুঁকে বিশ্বাস রাখার মতো বিভিন্ন ঘটনা আমাদের সমাজে একটা উল্লেখযোগ্য অংশে বিরাজমান। এছাড়া বিজ্ঞানে উচ্চ শিক্ষিত মানুষের মধ্যেও নানা পিছু টানা অযৌক্তিক ধ্যান ধারণা লালনের নজির নেহায়েৎ কম নয়। পত্রপত্রিকাগুলোতে নিয়মিত রাশিফল প্রকাশের মাধ্যমে একটি অবৈজ্ঞানিক বিষয়কে পৃষ্ঠপোষকতা করতে দেখা যায়। অথচ দুএক ব্যতিক্রম ছাড়া সেখানে বিজ্ঞান বিষয়ক কোন পাতার বরাদ্দ নেই। বেতার ও বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে বিজ্ঞান সম্পর্কিত অনুষ্ঠানের শতকরা হার অত্যন্ত অল্প বা নেই বললেই চলে। কিন্তু আধুনিক কালের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পর্কিত জ্ঞান ও চিন্তা-ভাবনার প্রসার এবং সামাজিক স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গির জন্ম দেয়ার স্বার্থে প্রচার মাধ্যমগুলোর উচিত অবৈজ্ঞানিক অনুষ্ঠান-খবর-বিজ্ঞাপন বন্ধ করা এবং বিজ্ঞান বিষয়ক আয়োজন বাড়ানো। তপন চক্রবর্তী রচিত ’শতবর্ষে বাঙালীর বিজ্ঞান চর্চা’ গ্রন্থ থেকে জানা যায় আশির দশকে বাংলাদেশ থেকে প্রায় পঁচিশটির মতো বিজ্ঞান পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে নিয়মিত প্রকাশনার সংখ্যা ছিল প্রায় ১০-১৫। ২০১৭ সালে এসে বিজ্ঞান পত্রিকা প্রকাশের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫-৬ টি। যার মধ্যে নিয়মিত ২-৩টি। সরকারী বেসরকারী পৃষ্ঠপোষকতা না থাকা, সুষ্ঠু তত্ত্বাবধানের অভাব ও লেখক স্বল্পতা এই অবস্থার কারণ বলে মনে হয়। হাতেগোণা নিয়মিত পত্রিকাগুলোতে বিজ্ঞানের তত্ত্ব ও তথ্যের দিকে মনোযোগ থাকলেও বিজ্ঞানসম্মত দৃষ্টিভঙ্গি গঠনের বিষয়টি তেমন একটা গুরুত্ব পায়না।

আর্থসামাজিক নানাবিধ কারণে আমাদের দেশে বিজ্ঞান চর্চার তেমন কোন শক্তিশালী ঐতিহ্য গড়ে ওঠেনি। রাষ্ট্রীয় আনুকুল্য সরাসরি না পেলেও ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত এবং কোন কোন ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক চেষ্টায় দেশে বিজ্ঞানচর্চার সুষ্ঠু বাতাবরণ সৃষ্টির চেষ্টা হয়েছে। বিজ্ঞান আন্দোলন যেটুকুও বা হয়েছে তার ধারাবাহিকতা রক্ষা করা যায়নি। বিজ্ঞান ক্লাব ও বিজ্ঞানসেবী প্রতিষ্ঠানগুলোর শেকড়পর্যায়ের জন্য বিজ্ঞানচর্চা করতে না পারার ব্যর্থতাও রয়েছে। সেই সাথে রয়েছে আনুষ্ঠানিক বিজ্ঞান শিক্ষার হতাশাব্যঞ্জক চিত্র। আমাদের বিজ্ঞান পাঠ্যসূচি, বিজ্ঞান-শিক্ষার বৈশিষ্ট্য, বিজ্ঞান-শিক্ষার পদ্ধতি ও মূল্যায়ন পদ্ধতি বর্তমান সময়ের বিজ্ঞান শিক্ষার মূল উদ্দেশ্যের সহিত যথাযথভাবে সঙ্গতিপূণ নয়। কথিত ’উন্নত’ সিলেবাসের চাপ ও ফলাফলমুখী পড়াশোনার কারণে দেশের নবীন শিক্ষার্থীদের এমন অবস্থা যে মুক্ত চিন্তা করতে, নির্দোষ শখের জিনিস নিয়ে মেতে উঠতে তাদের মনে কোন সাড়া পায়না। তাদেরকে প্রশ্ন করতে উৎসাহিত করা হয়না। জিপিএ পাঁচ বা সার্টিফিকেট অর্জনই যেন শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হয়ে দাড়িয়েছে। আর এসব কিছুর অবশ্যম্ভাবী নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে আমাদের সমাজে, অর্থনীতিতে, রাজনীতিতে। কোন সমাজে বিজ্ঞান কিভাবে, কতটুকু প্রসার লাভ করবে তা নির্ভর করে সেখানকার অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থার উপর; সেই সমাজে কোন দর্শন প্রাধান্য বিস্তার করে আছে তার উপর। কোন কিছুই পরস্পর হতে বিচ্ছিন্ন নয়। দেশের বিজ্ঞান আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে গেলে এই বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়েই কর্মপন্থা নির্ধারণ করতে হবে। লেখার একদম প্রারম্ভে যে প্রশ্নটি তোলা হয়েছিল ’আমাদের সমাজ দেহে বিজ্ঞান প্রবেশ করছে না কেন’? এর উত্তরটি তাই খুঁজতে হবে বাংলাদেশের বিজ্ঞান আন্দোলনের কর্মপ্রবাহ থেকেই। দেশে বিজ্ঞানের চটকদার বিষয় বা প্রযুক্তির চর্চার প্রতি পক্ষপাত থাকবে নাকি মানুষের চারপাশ ও জীবন ঘনিষ্ঠ বিজ্ঞান চর্চার অগ্রাধিকার থাকবে আজকে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবার সময়ে এসেছে। দেশের বিজ্ঞান নিয়ে যারা ভাবিত হন, বাঞ্চিত পরিবর্তনের আকাঙ্খা পোষণ করেন তাঁদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে আত্ম উপলব্ধিতে এনে ড.জহুরল হক- আবদুল্লাহ আল-মুতী প্রমুখদের কর্মদর্শনের সাথে নৈকট্য স্থাপন করে সক্রিয় হতে হবে। সাধারণজনের জীবনের সাথে সম্পর্কিত বিজ্ঞানচর্চাই পারে এদেশের বিজ্ঞান আন্দোলনের ধারাকে বলিষ্ঠ ও শক্তিশালী করতে।■

তথ্যঋণ:
১. বিজ্ঞান ক্লাব, ড.মুহাম্মদ ইব্রাহীম সম্পাদিত, বাংলাদেশ বিজ্ঞানী ও বিজ্ঞানজীবী সমিতি, ১৯৭৯
২. বাংলাদেশে বিজ্ঞানচিন্তা, আবদুল্লাহ আল-মুতী সম্পাদিত,মুক্তধারা, ১৯৮৮
৩.২৮ মে বিজ্ঞান দিবস ২০০০, সাইন্স ক্লাব এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ প্রকাশিত স্যুভেনির, ২০০০
৪. লুব্ধক, জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘর প্রতিষ্ঠার ৫০ বছর স্যুভেনির, জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘর, ২০১৭
৫. আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, সার্ধশততম জন্মবর্ষ উপলক্ষে প্রকাশিত স্যুভেনির, বিজ্ঞান সং®কৃতি পরিষদ, ২০১১
৬. বিজ্ঞান শিক্ষা:বাংলাদেশ, শাহজাহান তপন, বাংলা একাডেমী, ১৯৮৫
৭. শতবর্ষে বাঙালীর বিজ্ঞান চর্চা, তপন চক্রবর্তী, বাংলা একাডেমী, ২০০১।

[লেখাটি ত্রৈমাসিক নতুন দিগন্ত পত্রিকার জানুৃয়ারি-মার্চ ২০১৯ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে।
লেখাটির ইংরেজী সংষ্করণের লিঙ্ক: http://www.newagebd.net/article/32109/four-decades-of-science-movement-in-bangladesh]

লেখাটি 405-বার পড়া হয়েছে।

ই-মেইলে গ্রাহক হয়ে যান

আপনার ই-মেইলে চলে যাবে নতুন প্রকাশিত লেখার খবর। দৈনিকের বদলে সাপ্তাহিক বা মাসিক ডাইজেস্ট হিসেবেও পরিবর্তন করতে পারেন সাবস্ক্রাইবের পর ।

Join 908 other subscribers