দাবা আবিষ্কারক ও করোনা (অনুজীবের) মহামারী!

উপরোক্ত টাইটেল দেখেই ঘাবড়ে যাবার কিছুই নেই।  স্বভাবতই  প্রথমে অনেকেরই মনে হবে, কি উদ্ভট কথাবার্তা।  একটা হচ্ছে  গণিত (নন-বায়োলজি) সম্পর্কিত আরেকটি হচ্ছে বায়োলজি। আমি করোনা (কিংবা যে সকল অণুজীব) যা কিনা ব্যক্তির সংস্পর্শে ছড়ায় তার সঙ্গে একটু দাবা আবিষ্কারকের ঘটনার সম্পৃক্ত করতে চাই। 


এর জন্যে প্রথমে আমাদের “দাবা-আবিষ্কারের” মজার ঘটানাটি জানা দরকার। দাবা আবিষ্কারের গল্পটা সম্পর্কে প্রথমে আমি আমাদের অণুজীব বিজ্ঞানের স্যার থেকে শুনেছিলাম।  তো হঠাৎ করেই মনে হলো বিষয়টা হয়ত মহামারীকে ব্যাখ্যা করতে সক্ষম হবে। এরপর, Googling করে কিছু তথ্য বের করলাম। তো, এখন দাবার গল্পটা সম্পর্কে আসা যাক।

এখন পর্যন্ত পৃথিবীতে যতগুলো দাবা খেলা হয়েছে তার কোনটার সাথে কোনটার হুবুহু মিল নেই। ঠিক কোথায় সর্বপ্রথম দাবা খেলার উৎপত্তি, সেটি নিয়েও বিতর্কের শেষ নেই। কিছু প্রাচীন আমলের হরফে দাবা খেলার প্রারম্ভিক কাল সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়, পাশাপাশি খেলাটির আদি অস্তিত্বের প্রমাণস্বরূপ কিছু কিছু দাবার গুটিরও হদিশ মেলে। একারণেই, এ নিয়ে জল্পনা-কল্পনা, তত্ত্ব ও মতামতের অভাব নেই। বেশিরভাগ ইতিহাসবিদের ধারণা ভারত, পারস্য কিংবা চীনই দাবার জন্মস্থল। ইউরোপে দাবার যে রূপ অনুপ্রবেশ করে তা আদপে প্রায় ১,৩৫০ বছর আগেই পারস্যে খেলা হতো। এখন,  আসল প্রসঙ্গে আসা যাক। দাবা আবিষ্কারককে নিয়ে একটা পৌরাণিক গল্প আছে।  যা খুব সম্ভবত বিখ্যাত গণিতবিদ “ইয়াকভ পেরেলমান” এর লেখা।

একটা খেলায় যে কত রকম বুদ্ধির চাল দেয়া যায় তা দেখে সে রাজ্যের  রাজা জানতে পারলেন দাবা-নামক খেলার আবিষ্কারক তারই রাজ্যের প্রজা। তিনি খেলাটাতে এতই মজা পেলেন যে, তিনি এ খেলা আবিষ্কারের জন্য আবিষ্কারকে পুরস্কৃত করতে চাইলেন। তিনি আবিষ্কারককে ডেকে এনে বললেন, “বল, কি চাও তুমি? যা চাইবে , তাই দিব।”

কিন্তু, আবিষ্কারক  কিছুই নিতে রাজি হলেন না। রাজার পিড়াপিড়িতে কিছু না চেয়ে আর উপায় নেই।  রাজ্য সভার পন্ডিত মহাদয় রাজাকে উদ্দ্যেশ্য করে বললেন “জাঁহাপানা উনি খুব সম্ভবত কি চাইবেন বুঝতে পারছে না, তাই ওনাকে একদিন ভাবার সময় দিন।” রাজা পন্ডিতের কথা মেনে নিলেন।

পরদিন আবিষ্কার রাজ দরবারে উপস্থিত হলেন। কিন্তু, তিনি এমন এক কথা বললেন তাতে রাজা সহ রাজ্যের সবাই  অবাক ও আশ্চর্য হয়ে গেলেন!

তিনি বললেন দাবা কোটের প্রথম ছক বা ঘরটার জন্য এক দানা গম এবং এর পর প্রতি ঘরের জন্যে পূর্বের ঘরের দ্বিগুন সংখ্যক গম দিয়ে – অর্থাৎ, প্রথম ঘরের জন্য একটি দানা, দ্বিতীয়টির জন্য দুটি, তৃতীয় ছকের জন্য চারটি, চতুর্থ ঘরটির জন্য আটটি, পঞ্চমটার জন্য ১৬টি, ষষ্ঠটির জন্য ৩২টি………” এভাবে যদি রাজা পারেন তবে দাবার ৬৪ ঘরকে পূর্ণ করে দিতে হবে।

রাজা “সামান্য  গম” চাওয়া শুনে খুব  হেসেছিলো। আর কিছুটা লজ্জাবোধ ও করেছিলো।  বললেন- “ দাবার ৬৪টি ছকের জন্যই আপনার ইচ্ছেমত গমের দানা পাবেন। কিন্তু জেনে রাখুন আপনার প্রার্থনাটা ঠিক আমার দেবার ইচ্ছার উপযুক্ত হলো না। এই রকম নগন্য জিনিস চেয়ে আপনি আমাকে অসম্মান করলেন। আপনি চলে যান! আমার ভৃত্যরা আপনার গমের থলি পৌঁছে দেবে।”

খাবার সময় আবিষ্কারের কথা মনে পড়ল রাজার। সেই বেকুব আবিষ্কারক তার নগণ্য পুরষ্কার পেয়ে গেছে কিনা জিজ্ঞেস করলেন তিনি। রাজকে জানানো হলো “জাহাপানা আপনার আদেশ পালন করা হচ্ছে। কতগুলো গমের দানা তিনি পাবেন, তা পন্ডিতগণ হিসেব করছেন।”
রাজা বললেন, “এই সামান্য কতগুলো গমের দানার হিসেব করতে এতো সময় লাগে?”
রাতে শোবার আগে রাজা আবার জিজ্ঞেস করলেন, তাকে তার গমের থলিটি দেয়া হয়েছে কিনা।

এবারও,  রাজা উত্তর পেলেন- “ জাহাপানা আপনার হিসেবকারীরা হিসেব করে যাচ্ছে অক্লান্ত ভাবে, তারা আশা করছেন সকালের আগেই হিসেব করা শেষ হয়ে যাবে।”
রাত্রি শেষ সকাল হল। রাজার সাথে তার প্রধান হিসেবকারীর সাথে দেখা করতে চাইলেন।  রাজা প্রধান হিসেবকারীকে বললেন- “আপনার কথা শোনার আগে জানতে চাচ্ছি তাকে (আবিষ্কারক) তার প্রার্থনা মতো নগণ্য পুরষ্কার কি দেয়া হয়েছে?”
বুড়ো প্রধান হিসেবকারী বললেন, “এই কারণেই তো এত ভোরে আপনার সাথে দেখা করতে এসেছি। তার প্রার্থনা মতো গমের দানার সংখ্যা হিসেব করতে একটানা খেটেছি আমরা। হিসেব টা অনেক বড় হয়ে যাচ্ছে।”
রাজা বললেন, “ যত বড়ই হোক আমার শস্যভান্ডার থেকে দিয়ে দিন।”
বুড়ো প্রধান হিসেবকারী বললেন, “ মহারাজ, তার প্রার্থনা পূর্ণ করা আপনার ক্ষমতার বাইরে। সে যা চেয়েছে তত দানা আপনার গোলায় নেই। আপনার পুরো রাজ্যেও এত দানা নেই। সারা পৃথিবীতেও এত দানা নেই। সুতরাং,  তার প্রার্থনা মতো শস্য দানা দেয়া আপনার ক্ষমতার বাইরে!!!”

রাজা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেন। অবাক বিস্ময়ে হিসেবকারীর কথা শুনছিলেন তিনি।

রাজা জানতে চাইলেন- “কতগুলো দানা?”
-“মহারাজ, সংখ্যাটা ১,৮৪,৪৬,৪০,৭৩,৭০,৯৫,৫১,৬১৫”।

গল্পটা কতখানি সত্য তা নিয়ে সন্দেহ আছে। কিন্তু পুরষ্কারটা যে এই রকম একটা সংখ্যা দাঁড়াবে তা বোঝা কঠিন না। একটু ধর্য্য নিয়ে আমরা হিসেবটা দেখতে পারি। কেননা, প্রতি ঘরে দ্বিগুন এবং দিন শেষে আবার ৬৪ ঘরের সবগুলো সংখ্যায় যোগ করতে হবে। একটু হিসেব করে দেখেন।
প্রথমে, ১ টি + এরপর ২টি + এভাবে ৪+ ৮+১৬+৩২+৬৪+১২৮+২৫৬+৫১২+১,০২৪+২,০৪৮+৪,০৯৬+৮,১৯২+১৬,৩৮৪+….. আমি ১৫টা ঘরের সংখ্যা বের করেছি। বুঝতেই পারছেন কত বড় হবে সংখ্যাটি!

এবার,

আসি- করোনা (Covid-19 disease) প্রসঙ্গে,  এর মহামারীটা এক আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে অপর ব্যক্তিতে সহজেই ছড়িয়ে পড়ে। যা ইতিমধ্যে অনেকেই জানেন। আর, কোন উপসর্গ বা লক্ষণ ছাড়াও ব্যক্তি করোনায় আক্রান্ত থাকতে পারেন। জাপানে যেটা ধরা পড়েছে ইতিমধ্যে।  যা, টেস্ট ছাড়া আর কোন ভাবেই বোঝা সম্ভব নয়।
এখন একজন করোনা আক্রান্ত  অসর্তক মানুষ যে কিনা অরক্ষিত ভাবে মানুষের সাথে মেলামেশা করছে কিংবা ঘুরে বেড়াচ্ছে তার থেকে হোক হাঁচি-কাশি কিংবা আক্রান্ত ব্যক্তির ব্যবহৃত কোন জিনিসপত্র যা, SARS-CoV-2 ভাইরাস সমৃদ্ধ এবং তা থেকে খুব সহজেই সুস্থ মানুষ আক্রান্ত হতে পারে । সে মানুষ থেকে আরো কয়েকজন।  এভাবে এক পরিবার থেকে অপর পরিবার। এভাবে একেকটা বিল্ডিং থেকে পাশের বিল্ডিং, এক সমাজ থেকে অপর সমাজ, এক এলাকা থেকে অপর এলাকা কিংবা এক জেলা থেকে অপর জেলাতে ছড়িয়ে পড়তে পারে। অনুরূপভাবে,  একদেশ থেকে অপর দেশে।
ইংরেজী একটা মুভি আছে – “World War Z”  হয়ত অনেকেই দেখেছেন। সেখানে কিন্তু, কিভাবে একটা ভাইরাস একদেশ থেকে অপরদেশে ছড়িয়ে পড়ে (যাকে মাইক্রোবায়োলজির ভাষায় Pandemic বলা হয়)  এ বিষয়টাই ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। আসল, ব্যাপারটা কিন্তু, এভাবেই চীন থেকে আমেরিকা, জাপান, ইতালি, স্পেন, লন্ডন, ইরান, ভারত এবং বাংলাদেশে যা ছড়িয়ে পড়েছে। এখন, মনে করলাম একজন অসতর্ক মানুষ থেকে মিনিমাম ৩ জন করেই ছড়িয়ে পড়ুক। তাহলে হিসাব করতে পারবেন যদি মানুষ সতর্ক না হয় তবে ১ মাস/ ২ মাস পর তার সংখ্যাটা কত দাড়াবে?? 
দাবাতে আমরা কিন্তু দেখেছি প্রতি ঘরে দ্বিগুন এবং ৬৪ তম ঘরে গিয়ে বিশাল একটা সংখ্যা। একটু চিন্তা করেন,  ১ ব্যক্তি থেকে যদি ৩ জন ছড়ায়। সে প্রত্যেক তিন জন আবার নতুন ৩ জনের নিকট ছড়াবে। অর্থাৎ, হিসাবটা কেমন যাবে?
প্রথমে, ১+৩+৯+২৭+৮১+২৪৩+৭৯২+২,১৮৭+…… মাত্র ৮ টি ধাপে কত হচ্ছে এবার একটু হিসেব করে দেখেন!  অনেকটা দাবার ঘরে গমের দানা পূর্ণ করার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। 
একারনেই যে সকল রোগের ছড়ানো (Transmission)  ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে (person to person) স্থানান্তরিত হয়। তা খুবই ভয়ংকর হতে পারে যদি না মানুষ সময় থাকতে সতর্ক হয়।
হয়ত, কম বয়স্করা ভেবে থাকতে পারেন- যুবকদের মধ্যে মৃত্যুহার কম। কিন্তু, তাদের পরিবারের সবাই কি যুবক! কিংবা, তার আত্নীয়-স্বজন? এছাড়াও, একটা গবেষণাতে দেখা গেছে যেসব কম বয়স্ক রোগীরা করোনা থেকে সেড়ে গেছেন। তাদের শ্বাস-প্রশ্বাসের কাজে নিয়োজিত ফুসফুসের স্থায়ীভাবে আংশিক ক্ষতির সম্ভাবনা থেকে যায়।  সুতরাং, সচেতনতা গ্রহন ছাড়া আমরা কঠিন এক সময়ের মধ্যে পড়তে যাচ্ছি। বহিঃবিশ্বের দিকে চোখ দিলে যা আপনি বুঝতে পারবেন। হয়ত আমি এবং আমরা যারা এ অণুজীববিজ্ঞানে পড়ছি বিষয়টা কিছুটা হলেও অনুধাবণ করতে পারছি।

কিন্তু, সকলে সচেতন না হলে সত্যি শুধু সচেতন মানুষেরা এ বিপদ থেকে হয়ত নিজেদের শেষ রক্ষা করতে পারবে না। তাই, আসুন সতর্ক হই।

লেখাটি 3,427-বার পড়া হয়েছে।


আলোচনা

Responses

  1. খুব সুন্দর লেখা, ভাল লিখেছেন। সময় পেলে আমার ওয়েব সাইট ঘুরে আসবেন। দয়া করে ভিজিট করবেন জীববিজ্ঞান

  2. লেখাটা বেশ ভালো হয়েছে। এমন না অনেক নতুন তথ্য আছে, কিন্তু দাবার গল্পটার সাথে তুলনা করার মাধ্যমে কোভিড-১৯ মহামারী কত দ্রুত ছড়াতে পারে সেটার একটা দারুণ তুলনা পাওয়া গেলো।

Leave a Reply

ই-মেইলে গ্রাহক হয়ে যান

আপনার ই-মেইলে চলে যাবে নতুন প্রকাশিত লেখার খবর। দৈনিকের বদলে সাপ্তাহিক বা মাসিক ডাইজেস্ট হিসেবেও পরিবর্তন করতে পারেন সাবস্ক্রাইবের পর ।

Join 908 other subscribers