পুরাবংশগতিবিদ্যা আমাদের আদি-পূর্বপুরুষ সম্পর্কে কি বলতে পারে

মানব ইতিহাসের অধিকাংশই প্রাগৈতিহাসিক। পৃথিবীর বুকে  মানুষ যে দুই লক্ষাধিক বছর সময় অতিবাহিত করেছে তার অতি ক্ষুদ্রাংশই লেখনীর মাধ্যমে নথিবদ্ধ হয়েছে। চলমান ভূতাত্ত্বিক যুগ হলোসিনের বারো হাজার বছরের অল্প সময়টুকুতে উষ্ণ আবহাওয়া ও মোটামুটি স্থিতিশীল জলবায়ু কৃষি, শহর, রাষ্ট্র ও সভ্যতার অন্যান্য নির্দেশকের জন্ম দিয়েছে। সে সময়কালের মধ্যেও লেখালেখি নিয়মের ব্যতিক্রম হিসেবেই রয়ে গেছে।

পেশাদার ঐতিহাসিকগণ তাঁদের প্রাগৈতিহাস নিয়ে কাজ করা সহকর্মীদের প্রতি সমবেদনার দৃষ্টি নিক্ষেপ না করে পারেন না। ঐতিহাসিকরা বিস্তৃত নথিপত্র থেকে ইতিহাস উদ্ঘাটনে অভ্যস্থ। অথচ পুরাতত্ত্ববিদদের অপ্রতুল ধ্বংসাবশেষ থেকে ইতিহাস উন্মোচন করতে হয়। প্রাকইতিহাসের বর্ণনায় বিভিন্ন সংস্কৃতির নামকরণ বিভিন্নভাবে করা হয়। হয়তো কবর দেয়ার রীতি অনুযায়ী নাম দেয়া হয় ‘একক কবর রীতি’ কিংবা তীরের ফলার ধরণের মাধ্যমে বলা হয় ‘পাশ্চাত্য বৃন্ত ফলা’ এরকম নামে। এভাবে পুরো সম্প্রদায়কে সঙ্কীর্ণ করে প্রকাশ করা হয় মৃৎশিল্পের ধরণের মাধ্যমে – যেমন ছিদ্রযুক্ত তৈজসপত্র, তন্ত্রীযুক্ত বাসনপত্র কিংবা ফানেল আকারের পানপাত্র দিয়ে। এগুলো মানচিত্রের মধ্যে চিহ্নিত হয় গোলমেলে, অ্যামিবাকৃতির ফুঁটকির মতো।

ইদানিংকালে পুরাতত্ত্ববিদরা সিরামিকের বাসনকোসন, যুদ্ধাস্ত্র আর কবরে প্রাপ্ত জিনিসপত্র থেকে কোন কিছু আন্দাজ করার ক্ষেত্রে বেশ অনিচ্ছুক। ‘পাত্রগুলো মানুষ নয়’ – অন্তত এক প্রজন্ম ধরে তারা এই কথাটি বলছেন। বস্তুগত সংস্কৃতি দিয়ে মানুষের পরিচয় দেয়া যায় না। কোন খননকার্জ থেকে যেসব হস্তনির্মিত বস্তু উদ্ধার করা হয় তা ঐ এলাকায় পুরাকালের মানুষজনের জীবিকা, শেষকৃত্য অনুষ্ঠান ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ সম্পর্কে প্রচুর তথ্য দিতে পারে। কিন্তু এগুলো তাদের ভাষা,  জাতি কিংবা পরিযাণের চিত্র সম্পর্কে বিশ্বাসযোগ্য পথপ্রদর্শক নয়।

দক্ষিণ আফ্রিকার পিনাকল পয়েন্ট গুহায় প্রত্মতাত্ত্বিক খননকার্য চলছে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুগের আগে প্রাগৈতিহাসকে দেখা হতো যুদ্ধ ও বহিঃআক্রমণের ধারাবাহিকতা হিসেবে। প্রাক-সেলটিক ও ইন্দো-আর্যরা ইউরোপ ও এশিয়ার অপ্রস্তুত এলাকায় ভাইকিংদের মতো তীব্রবেগে প্রবেশ করে। আর পাথুরে-নির্মাতারা [১] বিভিন্ন মহাদেশের মধ্যে ইতস্তত বক্রগতিতে ছড়িয়ে পড়ে। অর্থাৎ এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে মানুষের স্রোত বা পরিযাণ প্রাগৈতিহাস তৈরি করেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্রক্রিয়া-নির্ভর চিন্তাধারার মাধ্যমে এই দৃষ্টিভঙ্গিতে বদল আসে। এ চিন্তাধারা সাংস্কৃতিক পরিবর্তনকে আভ্যন্তরীণ অভিযোজন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ব্যাখ্যা করতো। এ দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী বিভিন্ন চিন্তাধারা ও প্রযুক্তি হয়তো একস্থান থেকে অন্যস্থানে ঘুরে বেড়িয়েছে। কিন্তু মানুষজন মোটামুটি একই ছিলো। তবে সম্প্রতি অভিপ্রয়াণের বয়ান আবার ফিরে আসছে। 

দৃষ্টিভঙ্গির এই পরিবর্তনের পেছনে অতীতের ডিএনএ নমুনা বিশ্লেষণের জন্য আবিষ্কৃত নতুন পদ্ধতি অনেকাংশে দায়ী। প্রাগৈতিহাসিক মানুষ ও প্রাণীর ধ্বংসাবশেষের উপর জেনেটিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার ক্ষেত্রে গত পাঁচ বছরে একটি বিপ্লব ঘটে গেছে। প্রাচীন ডিএনএ নিয়ে কাজ করা বেশ কৌশলের ব্যাপার। অতীতের ডিএনএ নমুনা সাধারণত ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে পড়ে। রাসায়নিকভাবে পরিবর্তিত হয়ে আর লক্ষ লক্ষ ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ভগ্নাংশে বিভক্ত হয়ে যায় প্রাচীন ডিএনএ। তবে সাম্প্রতিক সিকোয়েন্সিং প্রযুক্তি হাজার হাজার বছরের ডিএনএ নমুনা থেকে সমগ্র জিনোম সিকোয়েন্স করে ফেলতে পারে। পুরোনো জিনোম সিকোয়েন্স করে যে পরিমাণ উপাত্ত পাওয়া যায় তা কোষ-অভ্যন্তরে থাকা অঙ্গাণু ভিত্তিক পরীক্ষা থেকে প্রাপ্ত উপাত্তের চাইতে বহুগুণ বেশি। এই ধরনের উপাত্ত থেকে বংশগতিবিদরা একক ব্যক্তি ও জনপুঞ্জের মধ্যে বিস্তৃতভাবে তুলনামূলক গবেষণা করতে পারেন। এইসব তুলনার মাধ্যমে সম্প্রতি মানুষের বংশ-লতিকায় নতুন ডালপালা উন্মোচিত হচ্ছে।

২০১০ সালে যখন নিয়ন্ডারথাল জিনোমের প্রথম খসড়াটি প্রকাশিত হয়, তখন দেখা যায় ইউরোপ ও এশিয়ার আধুনিক মানুষ নিয়ন্ডারথালদের সাথে গড়ে দুই শতাংশ ডিএনএ ভাগাভাগি করে নিয়েছে। অর্থাৎ অতীতের কোন এক সময়ে এই দুই প্রজাতী মিলিত হয়েছিলো। সম্ভবত মানুষ যখন আফ্রিকা থেকে বের হয়ে এসে মধ্যপ্রাচ্যের দিকে ছড়িয়ে পড়ছিলো তখন এই মিলন ঘটে। এছাড়া ২০১০ সালেই একটি আঙুলের ডিএনএ নমুনা থেকে একেবারে নতুন ধরনের মানুষের সন্ধান পাওযা যায়। এরা হলো ডেনিসোভান যাদের সাথে এশিয়া ও অস্ট্রেলিয়ায় বসবাসরত মানুষের পূর্বপুরুষের মিল পাওয়া যায়।

আধুনিক মানুষ, হোমো হাইডেলবার্গেনসিস, নিয়ন্ডার্থাল ও ডেনিসোভিয়ান মানুষদের আফ্রিকা থেকে বের হওয়ার পরিযায়ী পথ ও সময়রেখা। সূত্র

প্রগৈতিহাসিক মানুষের পরিযাণ কিভাবে ঘটেছে তা সম্প্রতি পরিস্কারভাবে বোঝা যাচ্ছে। গত অক্টোবরে (২০১৪) সাইবেরিয়াতে ৪৫,০০০ বছর পুরোনো মানুষের পায়ের হাড় থেকে ডিএনএ সংগৃহীত করা হয়েছে। তাতে নিয়ন্ডারথাল ডিএনএর আরো লম্বা খন্ড পাওয়া গেছে। এ নিয়ন্ডারথাল ডিএনএ খন্ড অাধুনিক মানুষে যে গড়পড়তা দৈর্ঘ্যের নিয়ন্ডারথাল খন্ড পাওয়া যায় তার তুলনায় দীর্ঘ। এর চেয়েও দীর্ঘ নিয়ন্ডারথাল ডিএনএ পাওয়া গেছে সে সময় থেকে ১০,০০০ বছর সময় পূর্বে। এ সময়টায় সম্ভবত নিয়ন্ডারথাল ও মানুষ প্রথম জিন লেনদেন করেছে। (এক প্যাক কার্ড শাফল করার কথা কল্পনা করুন – প্রতি প্রজন্মের সাথে সাথে নিয়ন্ডারথাল ক্রোমোজম ছোট থেকে আরো ছোট হয়েছে।) এ বছর (২০১৫) জুনে রোমানিয়া থেকে সংগৃহীত ইউরোপের সবচেয়ে পুরোনো আধুনিক মানুষদের মধ্যে একজনের দাঁতের নমুনা থেকে জিনোম বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এ নমুনাটি ৪০,০০০ বছর পুরোনো, যেখানে আরো দীর্ঘতর নিয়ন্ডারথাল ডিএনএ পাওয়া গেছে। এ দাঁতের মালিকের অতীতে মাত্র চার থেকে ছয় প্রজন্ম পূর্বে একজন নিয়নন্ডারথাল পূর্বসূরী ছিলো।

পুরাকালীন ডিএনএ গবেষণা কত দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে এই গবেষণাগুলো তার একটা ধারণা দেয়। আমরা নিয়ন্ডারথালদের সাথে কোন ডিএনএ ভাগাভাগি করি নি – এরকম একটা অবস্থান থেকে গত পাঁচ বছরে ভিন্নতরর উপলদ্ধিতে পৌঁছেছি। তা হলো একসময় মানুষ ও নিয়ন্ডারথালদের মধ্যে ব্যাপকহারে আন্তঃপ্রজনন প্রচলিত ছিলো। শুধু তাই না, অন্তত একটি ব্যক্তির ক্ষেত্রে এ সময়টি ২০০ বছরের একটি সময়সীমার মধ্যে আটকে ফেলতে পেরেছি।   সময়টি কোন পারিবারিক এলবামের সময়কালের কাছাকাছি। তবে পৌরাণিক ডিএনএ শুধু আমাদের নিকট-মানব আত্মীয়দের নিয়ে গবেষণার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ নয়। পুরাকালীন ডিএনএ নিয়ে গবেষণা আফ্রিকা থেকে মানুষের ছড়িয়ে পড়া সম্পর্কে তথ্য দিচ্ছে, জানাচ্ছে কৃষিচর্চার উদ্ভব ও বিস্তুৃতির কথা, আর আমেরিকায় মানুষ ছড়িয়ে পড়ার কথা। এছাড়াও পৌরাণিক ডিএনএ প্রগৈতিহাসের অন্যতম রহস্য সমাধানে প্রত্মতাত্ত্বিকদের সাহায্য করছে – তা হলো ইন্দোইউরোপিয়দের উদ্ভবের রহস্য।

২.

উইলিয়াম জোনস ছিলেন ওয়েলসের আইনজ্ঞ ও ভাষাতত্ত্ববিদ। তিনি ১৭৮৩ সালে পশ্চিমবঙ্গের সুপ্রীম কোর্টে যোগ দিতে লন্ডন থেকে কলকাতায় আসেন। এখানে পেশাগত কর্তব্যের অংশ হিসেবে তিনি হিন্দু আইনের নিয়মকানুনের সাথে নিজেকে পরিচিত করা শুরু করেন। সেজন্য তিনি সংস্কৃত ভাষা শেখা শুরু করেন। জোনস দ্রুত গৃহশিক্ষক হিসেবে একজন হিন্দু ধর্মের উপর বিশেষজ্ঞ পন্ডিতের শরণাপন্ন হন। পন্ডিতের সহায়তায় তিনি প্রাচীন সংস্কৃত পাঠ্যাংশে মাঝে নিজেকে নিমজ্জিত করেন। তিন বছর পড়াশুনা করার পর জোনস এক চমকপ্রদ সিদ্ধান্তে পৌঁছান। তা হলো ভারতের ধ্রুপদী ভাষা সংস্কৃত ব্যাকরণ ও শব্দভান্ডারের দিক দিয়ে ইউরোপের ধ্রুপদী ভাষা গ্রীক ও ল্যাটিনের সাথে সম্পর্কিত। শুধু তাই না, এই তিনটি ভাষার সবকটিই জার্মানিক, সেল্টিক ও পারস্যের ভাষার সাথে সম্পর্কিত।

পরবর্তীতে অন্যান্য ভাষাবিদরা এই ভাষা পরিবারে অারো নতুন শাখাপ্রশাখা যোগ করেন। এদের মধ্যে স্ল্যাভিক, আলবানিয়ান, আর্মেনিয়ান, বেল্টিকের মতো আধুনিক ভাষা এবং হিট্টাইট ও টোকারিয়ানের মতো বিলুপ্ত ভাষা রয়েছে। যদি এ ভাষাগুলো একে অপরের সাথে সম্পর্কিত হয়, তাহলে যুক্তি অনুসারে দূর ইতিহাসের কোন এক সময়ে এরা সকলেরই একটি সাধারণ পূর্বপুরুষ থেকে উদ্ভুত হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা এই কৌলিক ভাষার নাম দিয়েছে প্রাকইন্দোইউরোপিয় ভাষা। বর্তমানে এই প্রাচীন ভাষা থেকে উদ্ভূত ভাষাসমূহে পৃথিবীর প্রায় তিনশ কোটি মানুষ কথা বলেন। এরা ছড়িয়ে আছে শ্রীলঙ্কা থেকে শুরু করে পর্তুগাল পর্যন্ত। ইংরেজিও একটি ইন্দো-ইউরোপিয় ভাষা, যেমনটা হাঙ্গারিয়ান, বাসাক ও ফিনিসের মতো ইউরোপের প্রায় অন্য সকল ভাষা।

উইলিয়াম জোনস তাঁর আবিষ্কারটি ঘোষণা করার পর  ভাষাবিদ ও ফিলোলজিস্টরা২ অনেক যত্ন ও পরিশ্রম করে প্রাকইন্দোইউরোপিয় ভাষা শুনতে কেমন ছিলো ও এর ব্যাকরণ কিরকম ছিলো বের করেছেন। আমরা এখন সেই প্রাকইন্দোইউরোপিয় ভাষা লিখতেও পারি। এমনকি সে ভাষায় কিছু ছোটগল্পও আছে, যেগুলো ভেড়া, নেকড়ে ও দেবতাদের মতো বিষয়ের উপর নিয়ে লেখা। এজন্য তুলনামূলক পৌরণিক কাহিনী ও পুনর্নির্মিত শব্দভান্ডারের শিক্ষার্থীদের ধন্যবাদ দিতে হয়, যাদের কল্যাণে প্রাকইন্দোইউরোপিয়ানদের জীবনধারা ও তাদের বিশ্বাস সম্পর্কে আমাদের কিছু ধারণা লাভ করেছি। তারা ওক ও বিচ গাছের মধ্যে বসবাস করতো আর মধু ও জল গাঁজিয়ে মদ খেয়ে তৃপ্তি পেত। তারা আকাশে বসবাসরত পিতাকে ধন্যবাদ দিত সন্তানসন্ততি, মোটাতাজা গবাদিপশু আর দ্রুতগামী ঘোড়ার জন্য। তারা হয়তো স্যালমন মাছের সাথেও পরিচিত ছিলো।

ইন্দো-ইউরোপিয় ভাষা পরিবারে “ভাই” শব্দটি যেভাবে বিভিন্ন দেশে বিভিন্নভাবে উচ্চারিত হয়।

তবে দীর্ঘ সময় ধরে প্রাকইন্দোইউরোপিয় ভাষা একটি বিজ্ঞ-অনুমান হিসেবেই রয়ে গেছে। একটি অনুকল্পিত ভাষা, যেটাতে একটি জনগোষ্ঠী কথা বলতো, এটা একটি অনুমানই ছিলো। প্রাকইন্দোইউরোপিয় যেন এক শব্দতাত্ত্বিক কল্পনা, যাদের ভৌতিক স্বভাব হলো সব জায়গাতেই নিজেদের অস্তিত্ব জানান দেয়া। প্রাকইন্দোইউরোপিয়দের উৎস কোথায় ছিলো তা নির্ণয় করতে স্ক্যান্ডিনেভিয়া থেকে শুরু করে তিব্বতের মালভূমি হয়ে উত্তরমেরু ইত্যাদি জায়গার কথা বলা হলেও সাম্প্রতিক দশকগুলোতে বিশেষজ্ঞরা প্রাকইন্দোইউরোপিয়দের উদ্ভবের দুইটি উৎসে ঐক্যমত্যে এসেছেন।

এদের একটি নিয়ে স্পষ্টযুক্তি দেন ব্রিটিশ প্রত্নতত্ত্ববিদ কলিন রেনফ্রিউ। তিনি বলেন ইন্দোইউরোপিয়রা মধ্যপ্রাচ্যের ‘উর্বর চন্দ্ররেখা’ (Fertile Crescent) থেকে উদ্ভূত হয়েছে। এই সংস্করণ অনুযায়ী প্রাকইন্দোইউরোপিয়দের সাফল্যের মূলে ছিলো কৃষির ব্যবহার, যা তাদেরকে চারপাশের শিকারী-সংগ্রাহকদের তুলনায় দীর্ঘমেয়াদী সুবিধা দিয়েছে। এই তত্ত্বানুসারে, প্রাকইন্দোইউরোপিয়দের বিস্তার শুরু হয়েছিল আরো আগে, নব্যপ্রস্তর যুগে, যখন আনাতোলিয়া (এশিয়া মাইনরে তুরস্কে অবস্থিত) থেকে মানুষজন মৃদু-উত্তপ্ত গ্যাসের মতো খুব ধীরে চারপাশে ছড়িয়ে পড়তে আরম্ভ করে।

ইন্দোইউরোপিয়দের উৎপত্তির অন্য তত্ত্বটি স্তেপ অনুকল্প নামে পরিচিত। এটি লিথুনিয়ার প্রত্নতাত্ত্বিক প্রয়াত মার্জিয়া গিমবুটাস কর্তৃক সাথে প্রস্তাবিত আর সম্প্রতি আমেরিকান প্রত্নতাত্ত্বিক ডেভিড ডব্লু অ্যান্থনি কর্তৃক সমর্থিত। এ মত অনুসারে ইন্দোইউরোপীয়রা দক্ষিণ রাশিয়ার স্তেপ সমভূমি থেকে উদ্ভূত হয়ে সেখান থেকে ছড়িয়ে পড়া শুরু করে। ঘোড়া ও চাকার কিভাবে একসাথে জোঁততে হয় তা তারা শিখেছিলো। এটি ছড়িয়ে পড়ার ক্ষেত্রে অন্যতম ভূমিকা রাখে। তাদের ছড়িয়ে পড়ার সময়টা আনাতোলিয়ান তত্ত্বে ধারণাকৃত সময়ের অনেক পরে, পাথর যুগের পরিবর্তে ব্রোঞ্জ যুগ থেকে।

ব্রোঞ্জ তৈরি করতে দুইটি ধাতু লাগে – তামা ও টিন। এর জন্য দরকার দূরবর্তী বাণিজ্যের বিস্তার। মেসোপটোমিয়ার মন্দির-নগর থেকে প্রতিনিধিরা বহু দূরে ছড়িয়ে পড়তো তামা ও টিন যোগাড় করার জন্য। তারা পৌঁছালো আফগানিস্তানের পূর্ব ও রাশিয়ান স্তেপের উত্তরের পথসমূহে। সেসব জায়গা থেকে তারা সম্পদ, সম্পত্তি ও যুদ্ধ সম্পর্কে নতুন নতুন ধ্যান-ধারণার সংস্পর্শে আসে। এ সময় স্তেপের মানুষজন ঘোড়াকে পোষ মানিয়ে ফেলেছিলো। বুনো ঘোড়া দক্ষিণ রাশিয়ার সমভূমির স্থানীয় প্রাণী। তারা জানতো কিভাবে তুষার সরিয়ে ঘাস খাওয়া যায় আর শীতকালে মাংস হিসেবেে ঠিকমতো সঞ্চয় করা যায়। পরবর্তীতে হয়তো কেউ বুঝতে পারলো যে ঘোড়াতে চড়া যায়, আর ঘোড়ায় জোয়াল লাগিয়ে মালগাড়ি ও লাঙল টানানো যায়। ব্রোঞ্জ পৃথিবীকে অনেক বড় করে দেয় – ইউরেশিয়ার ভিন্ন ভিন্ন এলাকাকে বাণিজ্যের জালের সুতায় গেঁথে দেয়। অন্যদিকে ঘোড়া সে বিস্তৃত পৃথিবীকে আবার সংকুচিত করে ফেলে, সাহায্য করে একটি নতুন, ভ্রাম্যমান জীবনযাত্রা তৈরিতে। প্রাকইন্দোইউরোপিয়রা এই প্রবর্তনের সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগী ছিলো।

অানাতোলিয়ান তত্ত্বটির গুণ হচ্ছে এটি আঞ্চলিক বিস্তৃতির পরিষ্কার যুক্তি সরবরাহ করে। এর পেছনে খানিকটা বংশগতির সাক্ষ্যপ্রমাণও আছে। ইউরোপে বংশগতির ভিন্নতা নিয়ে যেসব গবেষণা হয়েছে তাতে দেখা গেছে তুরস্ক থেকে আপনি যত দূরে সরতে থাকবেন, বংশগতির বৈচিত্র্য ততই বাড়তে থাকবে। এই ধরণটি বোধগম্য হয় যদি ধরা হয় ইউরোপের মূল জনপুঞ্জের উদ্ভব হয়েছিলো বালকানসে (দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপিয় অঞ্চল) ও সেখান থেকে তারা ছড়িয়ে পড়েছে। তবে কিছুটা দেরীতে হলেও অধিকতর মতামত স্তেপ সমভূমিতে প্রাকইন্দোইউরোপিয়দের উদ্ভবের দিকে ভারী হয়েছে। বিভিন্ন ধরনের প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ তো আছেই।  ইন্দোইউরোপিয় বিভিন্ন রূপকথায় ঘোড়া নিয়ে এক ধরনের আকর্ষণ লক্ষ্য করা যায়। এর সাথে প্রাকইন্দোইউরোপিয়দের চাকা ও গাড়ির শব্দভান্ডারের মিল লক্ষ্যনীয়। এটি স্তেপ অঞ্চলে ইন্দোইউরোপিয়দের উদ্ভবের বয়ানের সাথে ভালোভাবেই মিলে যায়। স্তেপ অনুকল্পটা সত্য ধরে নিলেও এটা পরিষ্কার না যে ইন্দোইউরোপিয়রা কিভাবে ছড়িয়ে পড়েছিলো। শিক্ষিত-দক্ষ-অভিজাতরা কি নতুন দেশে নতুন সুযোগ একটু একটু করে লুফে নিয়েছিলো? না কি গণঅভিপ্রয়াণের মাধ্যমে এক বিশাল জনগোষ্ঠী এলাকা পরিবর্তন করেছিলো?

৩.

বংশগতিবিদরা এই রহস্যের কিনারা করতে আরম্ভ করেছেন। হার্ভার্ড এবং কোপেনহেগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের দুইটি ভিন্ন দল ইউরোপ ও মধ্য এশিয়া থেকে সংগৃহীত ব্রোঞ্জ যুগের ১৭০টি দেহাবশেষের কঙ্কাল থেকে ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করেছেন। উভয় দলেরই গবেষণাতে দেখা গেছে যে অানুমানিক ২৫০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ সময়ে রাশিয়া থেকে পশ্চিম ইউরোপের দিকে বড়োসড়ো গণদেশান্তর ঘটেছে। ২৫০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের কাছাকাছি সময়ে দক্ষিণ রাশিয়া থেকে আগত ইয়ামানিয়া গোষ্ঠীর পশুপালক মানুষজনের জেনেটিক নিদর্শন জার্মানিতে দেখা দেয়া শুরু করে।

পৃথিবীর সবচেয়ে পুরানো লিখিত সাহিত্য আমরা পাই ব্রোঞ্জ যুগের সময় থেকে। এর মধ্যে গ্রীক ইলিয়াড ও সংস্কৃত ঋগ্বেদ-এর বিষয়বস্তু অনেকটাই যুদ্ধসম্পর্কিত। তাই ইউরোপে ইয়ামানিয়া গোষ্ঠীর লোকজনের আগমনকে সশস্ত্র আক্রমণ বলে মনে করাটা প্রলুব্ধকর মনে হতে পারে। হয়তো যোদ্ধার দল উপমহাদেশ বরাবর লুটপাট করতে করতে পথসম্মুখে যে বাধা পেয়েছে তা পরাভূত করে লম্বা-তীক্ষ্ণ বর্শা ও তলোয়ার সাথে করে ইউরোপে পৌঁছেছে। গিম্বুটাস অন্তত তাই মনে করেন। তাঁর মতে, প্রাকরাশিয়ার কারগান লোকজন (ইউরোপে) পৌঁছানোর সাথে মৃত্য হয় ‘পুরনো ইউরোপের’। ‘পুরনো ইউরোপ’ এখন হারানো সভ্যতা, যারা ছিলো শান্তিকামী, সাম্যবাদী। যারা ছিলো মাতৃদেবীর পূজা করা কৃষক, যারা প্রতিস্থাপিত হয়েছে বিধ্বংসী, মৃত্যুকামী আর সম্পত্তিলোভী পুরুষতান্ত্রিক জনগোষ্ঠী দ্বারা, যারা হয়তো এখনো আমাদের মধ্যে আছে।

তবে ইয়মানিয়া জনগোষ্ঠীর দেশান্তর তো শান্তিপূর্ণও হতে পারে। অ্যান্থনি ইউরোপে প্রাকইন্দোইউরোপিয় ভাষায় কথা বলা মানুষের আবির্ভাবের ব্যাখ্যা দেয়ার জন্য শৃঙ্খল-অভিপ্রয়ান প্রপঞ্চ থেকে ভিন্ন একটি প্রস্তাব উপস্থাপন করেন। শৃঙ্খল-অভিপ্রয়ানে মানুষের চলাচল একটি ধারাবাহিক ক্রমবর্ধনশীল প্রক্রিয়া। হয়তো প্রথমে একদল স্বল্প-সংখ্যক অগ্রদূত নতুন একটি অঞ্চলে পা রাখার মতো জায়গা তৈরি করে নেয়। কল্পনা করুন ইয়ামানিয়া গোষ্ঠীর এক অশ্বপালক স্থানীয় দলপতির অধীনে কাজ খুঁজে নেন। অথবা হয়তো অন্য একজন পশুপালক অব্যবহৃত তৃণভূমির সন্ধান লঅভ করে। যখন তারা সেখানে স্থায়ী ঠিকানা গড়ে বসেন, বাড়িতে তাদের সৌভাগ্যের খবরটাও পাঠান। খুব বেশী সময় অতিবাহিত না হতেই এলাকাটা তাদের আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু দিয়ে ভড়ে যায়। ইন্দোইউরোপিয়ানদের বিস্তারের এই সংস্করণটিতে বর্বর কোনানের(কোনান দ্যা বার্বারিয়ান – কাল্পনিক নায়ক) চেয়ে এলিস  দ্বীপে প্রবাসী আবির্ভাবের মিল বেশি (ইউরোপ থেকে আগত অভিবাসীরা জাহাজে করে যুক্তরাষ্ট্রের এলিস দ্বীপেই ভিড় জমাতেন – অনুবাদক)।

একটি তত্ত্ব বলে এখনকার ইউক্রেনের স্তেপ অঞ্চল থেকে সকল ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষায় কথা বলাদের পূর্বপুরুষ আর্যরা এশিয়া ও ইউরোপে ছড়িয়ে পড়া শুরু করেছিলো। অন্য তত্ত্ব বলে, না, শুরু হয়েছিলো আনাতোলিয়ায়।

বংশগতির উল্লিখিত দুইটি গবেষণা ইউরোপে যে শুধু একটি বড়োসড়ো অভিপ্রয়ানের নিদর্শন পেয়েছে এমন নয়। এরা ব্রোঞ্জ যুগের জনপুঞ্জসমূহের মধ্যে একটি অপ্রত্যাশিত চঞ্চলতা উন্মোচন করেছে। বিশেষ করে তৎকালীন কেন্দ্রীয় এশিয়া ভীষণ পরিবর্তনশীল বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। কোপেনহেগেনে সংঘটিত গবেষণার অন্যতম পরিচালক এসেক উইলাস্লেভ (যিনি একজন বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞানী) আমাকে বলেন এটা তার দেখা “বংশগতির দিক দিয়ে সবচাইতে গতিশীল স্থান”, যেখানে চারটি ভিন্ন ভিন্ন জনপুঞ্জ একে অপরকে প্রতিস্থাপন করেছে। প্রথমদিকে ইউরেশিয়ার এক শিকারী-সংগ্রাহক গোষ্ঠী ককেশাস থেকে আগত জনগোষ্ঠী দিয়ে প্রতিস্থাপিত হয়েছে। তারা আবার বদলে গিয়েছে উত্তর-ইউরোপীয় এবং পরবর্তীতে পূর্ব-এশিয়ান দ্বারা।

নব্যপ্রস্তরযুগীয় ইউরোপিয়ান বংশগতির উপর পরিচালিত অন্যান্য গবেষণার সাথে এই দুইটি গবেষণা দৃঢ়ভাবে নির্দেশ করে যে ইউরোপে কৃষিকাজের বিস্তার ঘটেছিলো মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসা কৃষকের মাধ্যমে। সুইডেনের সবচেয়ে পুরাতন কৃষকরা আধুনিক স্ক্যান্ডিনেভিয়ানের চেয়ে গ্রীক ও সাইপ্রাস-অধিবাসীদের সাথেই বেশি সম্পর্কিত। মধ্যপ্রাচ্য থেকে কৃষকদের আগমন এই মহাদেশের বংশগতির-ধাঁচে (জেনেটিক ফিঙারপ্রিন্ট) গভীর দাগ বসিয়ে দিয়েছে। সারডিনিয়া ও সিসিলিতে এই প্রথম ইউরোপিয় কৃষকদের বংশধর জনপুঞ্জের এক বিশাল অংশ তৈরি করেছে। এদের সাথে টাইরোলিয়ার আল্পস পর্বতের ঠান্ডায় প্রাকৃতিকভাবে মমি হয়ে যাওয়া ওৎজি-র (বরফ-মানব নামেও পরিচিত) সাথেও সম্পর্ক রয়েছে। আল্পসের পর্বতারোহী ওৎজি সম্ভবত প্রথম কৃষক-জনপুঞ্জের সদস্য ছিলেন।

ইউরোপের বর্তমান জনপুঞ্জ যে বেশ কয়েকটি গণদেশান্তর-তরঙ্গের উত্তরাধিকারে তৈরি তা এখন ক্রমাগত স্পষ্টতর হচ্ছে। আমেরিকাতেও একই ধরনের প্রক্রিয়া কাজ করেছে বলে মনে হয়। এ অঞ্চলে সর্বপ্রথম যে প্রাচীন দেহ নমুনার জিনোম সিকোয়েন্স করা হয়েছে সে হলো গ্রিনল্যান্ডের মমি সাক্কাকম্যানের। এ মমিটি একসময় প্রায় চার হাজার বছর আগে পশ্চিম গ্রিনল্যান্ডে বেঁচে ছিলো ও সেখানে মারা গিয়েছিলো। তিনি ডর্সেট নামক একটি প্রাচীন সম্প্রদায়ের সদস্য ছিলেন। ডর্সেট সম্প্রদায়ের নামকরণ করা হয়েছে এদের ব্যবহৃত বিশেষ বৈশিষ্ট্য সম্বলিত হাতিয়ার অনুসারে। এ হাতিয়ারগুলো উত্তর আমেরিকার আর্কটিক অঞ্চলের বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানে পাওয়া যায়। ২০১০ সালে উইলারস্লেভের নের্তৃত্বে একদল ড্যানিশ বিজ্ঞানী সাক্কাক ম্যানের জিনোম সিকোয়েন্স প্রকাশ করেন। তখন এটি আর্কটিকের ইতিহাস সম্পর্কে কিছু বিস্ময়কর উপসংহারে চলে আসে।

সাক্কাক মানবের ডিএনএ থেকে দেখা যায় এরা আধুনিক ইনুইট কিংবা স্থানীয় ন্যাটিভ আমেরিকানের (আধুনিক বা প্রাচীন) সাথে নিকট-সম্পর্কে সম্পর্কিত নয়। বরং এদের নিকটতম আত্মীয়রা পূর্ব সাইবেরিয়াতে বসবাস করতো বলেই মনে হয়। তারমানে অন্তত তিনটি ভিন্ন ঘটনার মাধ্যমে বেরিং প্রণালী অতিক্রম করা হয়েছিলো। প্রত্নতাত্ত্বিক প্রামাণ্য দলিল অনুযায়ী মনে হয় যে ডর্সেটের লোকজন প্রায় ছয় হাজার বছর আগে আর্কটিক অঞ্চলে ঘর বাঁধে। তারা উধাও হয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত প্রায় পাঁচ হাজার বছর ধরে সেখানে প্রায় বিচ্ছিন্ন অবস্থায় বসবাস করে (অন্তত তাদের দক্ষিণদিকের নেটিভ অামেরিকান প্রতিবেশী থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলো)। তাদেরকে প্রতিস্থাপিত করে থুল সংস্কৃতির লোকজন যারা সাইবেরিয়ার প্রান্ত থেকে গ্রিনল্যান্ডে দ্রুতগতিতে সম্প্রসারিত হয়। থুলরা বর্তমান ইনুইট গোষ্ঠীর পূর্বপুরুষ। আমেরিকায় ইউরোপের মতোই বন্দুক ও ইস্পাতের যুগের বহু আগে প্রাচীন পৃথিবীতে দেশান্তর বা অভিপ্রায়ণের পুনরাবৃত্তি হয়েছে।

৪.

পুরাকালীন ডিএনএ পরীক্ষা থেকে দুই আমেরিকা মহাদেশ জনপূর্ণ হওয়ার একই রকম বয়ান পাওয়া যায়। বারো হাজার বছর ধরে উত্তর আমেরিকার সর্বত্র একই প্রযুক্তি দেখা দেয়া শুরু করে। এদের নাম দেয়া হয় ক্লোভিস সংস্কৃতি, যার বিশেষত্ত্ব হলো বর্শার বড় ও সুন্দর তীক্ষ্ন ফলা। নিউ মেক্সিকোর যেখানে প্রথম এদের সন্ধান পাওয়া যায়, সে এলাকা থেকেই এই নামকরণ করা হয়েছে।  প্লেইস্টোসিন পরবর্তী সময়কালে বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে  ম্যামথ ও অন্যান্য জন্তু শিকার করতে এই ক্লোভিস ফলা ব্যবহার করা হতো। এগুলো কয়েকশো বছর ধরে ব্যবহৃত হয়ে আসছিলো, তারপর ম্যামথরা হারিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে এগুলোও উধাও হয়ে গেছ। এ থেকে মনে হয় আমেরিকায় প্রথম এসেছিলো ক্লোভিস জনগোষ্ঠী। লরেন্টাইড বরফ-স্তরের (যা একসময় বর্তমানের কানাডা ও উত্তর-যুক্তরাষ্ট্রের অধিকাংশ ঢেকে রেখেছিলো) বরফ-বিহীন এক করিডোরের মধ্য দিয়ে তারা এসে পড়ে মানবশূণ্য এক মহাদেশে যেখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে অজস্র শিকার। তারা ছড়িয়ে পড়ে খুব দ্রুত আর বড় জন্তু শিকার করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। যখন এসব বড় প্রানী বিলুপ্ত হয়ে গেলো, শিকার করার এই ধরণও হারিয়ে গেলো। তারপর এই জনগোষ্ঠী কয়েকশত দলে বিভক্ত হয়ে পড়লো। এরা বর্তমানের ন্যাটিভ আমেরিকানদের পূর্বপুরুষ।

তবে একেবারে প্রথমদিকের আমেরিকানরা কোনভাবেই ক্লোভিস গোষ্ঠির সদস্য হতে পারে না। গত দুই দশকে উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকায় বেশ কিছু কয়েকটি স্থানে ক্লোভিস গোষ্ঠিরও চেয়ে অন্তত এক হাজার বছর পুরনো পুরাকীর্তির নিদর্শন পাওয়া গেছে। (এদের মধ্যে একটি হলো অরিগনের পেইসলে গুহা যার সনাক্তকরণে প্রাচীন মলের নমুনার ডিএনএ-পরীক্ষার সাহায্য নেয়া হয়েছিলো।) প্রাক-ক্লোভিস পুরাকীর্তির ভৌগলিক ব্যাপ্তি ও ধ্বংসাবশেষ থেকে আমেরিকাতে কিভাবে প্রথম মানুষ এসে পৌঁছালো এ বিষয়ে নতুন কিছু প্রশ্নের সৃষ্টি হয়। এই সমস্যার উৎস সহজেই বোধগম্য। কারণ প্রাক-ক্লোভিস পুরাকীর্তির অন্যতম নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে দক্ষিণ চিলির মন্টেভার্ডেতে। চিলি থেকে বেরিং প্রণালীর দূরত্ব অনেক – বলা যায় দুই আমেরিকা মহাদেশের এক-প্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত।

আমেরিকায় পাওয়া কিছু প্রাচীনতম কঙ্কালের দেহাবশেষ এই রহস্যটি আরো ঘনীভূত করেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে কুখ্যাত উদাহরণটি কেনউইক ম্যানের। ১৯৯৬ সালে কলোম্বিয়া নদীতে হঠাৎ করে এই নয় হাজার বছর পুরনো প্রস্তর-ইন্ডিয়ান কঙ্কালটি পাওয়া যায়। তার কঙ্কাল নিয়ে সরকার, বিজ্ঞানী ও কলম্বিয়ার পাঁচটি অাদিবাসী গোষ্ঠীর মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে আইনী দ্বন্দ্ব চলে আসছিলো – সবাই এ কঙ্কালটিকে নিজেদের বলে দাবী করতে চায়। যে বিজ্ঞানীরা এ কঙ্কালটি পরীক্ষা করেছিলেন তাঁরা বললেন যে এর খুলির অঙ্গসংস্থান মোটেই আধুনিক নেটিভ আমেরিকানদের মতো নয়। বরং খুলির আকার আইনু বা পলিনেশিয়ান বংশধরদের সাথে বেশি মিলে যায়।

এই প্রমাণের উপর ভিত্তি করে প্রথম আমেরিকানের আগমন ও আগমনের সময়ের ব্যাপারে দুইটি প্রধান তত্ত্ব প্রতিদন্দ্বিতা করছে। একটি তত্ত্ব পুরানো ক্লোভাররাই-প্রথম মডেলের অনুরূপ। প্রথমে প্রস্তর-যুগের ইন্ডিয়ানরা সাইবেরিয়া থেকে বেরিং প্রণালীর স্থল-সেতু পাড়ি দিয়ে আমেরিকায় আসে। তারা উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে আর হঠাৎ করে ক্লোভিস সংস্কৃতির জন্ম দেয়ার আগ পর্যন্ত শান্তিপূর্ণভাবে প্রায় এক বা কয়েক হাজার বছর বেঁচে থাকে।

তবে অন্য তত্ত্বটি বলে যে প্রথম আমেরিকানরা স্থল পাড়ি দিয়ে আসে নি। বরং তারা নৌকার মাধ্যমে আমেরিকায় পৌঁছায়। তারা দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের মধ্য দিয়ে রিঙ অব ফায়ার অঞ্চল হয়ে, এক দ্বীপ থেকে অন্য দ্বীপে পাড়ি দিয়ে, কুরিলস থেকে আলেউটিয়ান হয়ে, প্রশান্ত মহাসাগরেের উপকূল বরাবর পাতাগোনিয়া পাড়ি দেয়। এই তত্ত্বটি কেনউইক ও অন্যান্য কয়েকটি খুলির অদ্ভূত অঙ্গসংস্থানের একটি ব্যাখ্যা দেয়। এছাড়াও দক্ষিণ আমেরিকার পশ্চিম সাগরতীরে মানুষের পূর্বআবির্ভাবেরও ব্যাখ্যা দেয়। আমরা প্রত্নতাত্ত্বিক ও বংশগতির পরীক্ষানিরীক্ষা থেকে জানি, অস্ট্রেলিয়ান আদিবাসীরা নৌকা বা ভেলা দিয়ে চল্লিশ হাজার বছর আগে টরেস প্রণালী পাড়ি দিয়েছে অস্ট্রেলিয়ায় পৌঁছানোর জন্য। তারা যদি সমুদ্রের মধ্য দিয়ে ঘুরতে ঘুরতে নতুন স্থল খুঁজে নিতে পারে, তাহলে প্রস্তর-ইন্ডিয়ানরা ত্রিশ হাজার বছর আগে একই রকমের কাজ করতে পারবে না কেন?

আমেরিকাতে মানুষ ছড়িয়ে পড়লো কিভাবে? শুধু এশিয়া থেকে সাইবেরিয়া হয়েই কি মানুষ আমেরিকায় এসেছিলো? সূত্র

প্রশান্ত-সাগরীয় অভিপ্রয়ান অনুকল্পটির পেছনে আকর্ষণীয় যুক্তি রয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত বংশগতির সাক্ষ্য-প্রমাণের মাধ্যমে এটি প্রমাণিত নয়। এই জুনে (২০১৫) কেনউইক ম্যানের জিনোম প্রকাশিত হওয়ার পর দেখা গেল সে আসলে নেটিভ আমেরিকান। তার সাথে আইনু, জাপানিজ কিংবা প্রশান্ত মহাসাগরীয় কোন দ্বীপের পূর্বপুরুষের সাথে কোন সম্পর্ক নেই। এই ফলাফলটি বর্ণগত (রেস) কল্পনায় রঞ্জিত ঝগড়াটে-বিতর্ককে থিতিয়ে দিতে সাহায্য করবে। তবে অন্য একটি দেহ থেকে পাওয়া ডিএনএ নমুনা সম্ভবত আমেরিকায় আবাস গড়ার ইতিহাসে বেশি গুরুত্ববহ।

ক্লোভিস সমাধি থেকে আমাদের একমাত্র নিদর্শন হচ্ছে আন্জিক বালক। তার বয়স দুই বছর। প্রায় বারো হাজার বছর পূর্বে তাকে পশ্চিম মন্টানায় সমাধি দেয়া হয়। শবের সাথে ছিলো ক্লোভিসদের বিভিন্ন হস্তনির্মিত বস্তু। গত বছর আনজিকের জিনোম প্রকাশিত হয়। দেখা যায় তার ডিএনএ প্রায় সকল জীবিত নেটিভ আমেরিকানদের সাথে সম্পর্কিত। অদ্ভুত বিষয় হলো উত্তর আমেরিকায় বসবাস করাীদের চাইতে দক্ষিণ আমেরিকার নেটিভদের সাথে তার মিল বেশি। দক্ষিণ আমেরিকার প্রায় ১০০% নেটিভরা তার বংশধর। অন্য দিকে উত্তর আমেরিকায় এই সংখ্যাটি ৮০%-র মতো।  এ থেকে বোঝা যায় যে যদিও ক্লোভিসরা অধিকাংশ নেটিভ আমেরিকানদের পূর্বপুরুষ। কিন্তু এই মহাদেশে দুইটিতে তাদের আবির্ভাবের কোন এক সময়ে জনপুঞ্জের মধ্যে কোন একটি বটলনেক৩ প্রভাব উত্তর ও দক্ষিণের মধ্যে জিনের প্রবাহ বন্ধ করে দেয়। দক্ষিণ নেটিভ আমেরিকানরা প্রথম প্রস্তর-ইন্ডিয়ানদের সরাসরি বংশধারা সংরক্ষণ করছে। কিন্তু উত্তরে এই যোগসূত্রটি পরবর্তী নতুন মানুষের আগমণের মাধ্যমে খুব ধীরে ধীরে পাতলা হয়েছে। যেমন উদাহরণ হিসেবে আর্কটিকে ইনাক পূর্বপুরুষদের আগমণের কথা উল্লেখ করা যায়।

তুলনামূলক পুরানো দেহাবশেষ থেকে প্রাপ্ত জিন থেকে আমেরিকায় মনুষ্য বসতি গড়ার কাহিনীকে হয়তো সরল গল্প মনে হবে। মনে হতে পারে যে একই ধরনের কোন প্রতিষ্ঠাকালীন জনপুঞ্জ বেরিঞ্জিয়ান বরফে পৌঁছে একটি অক্ষত মহাদেশের মধ্যে দ্রুত ছড়িয়ে গেল। তবে সাম্প্রতিক জিন থেকে বলা গল্পটি আরো জটিল বলে মনে হতে পারে। হার্ভার্ড আর কোপেনহেগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা এই জুলাইতে ঘোষণা দেন যে তারা আমাজনের নেটিভদের সাথে আদিবাসী অস্ট্রেলিয়ান ও পাপুয়া নিউগিনির অধিবাসীদের সাথে একটি সম্পর্ক পেয়েছেন। যদিও সম্পর্কটি অত্যন্ত বিবর্ণ, কিন্তু সুস্পষ্ট।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে আগত জিন কেন আমেরিকার বাকি এলাকায় না ছড়িয়ে শুধু ব্রাজিলের ক্রান্তীয় বাদলবনের মধ্যে আটকে থাকবে? যে গবেষকরা এই আবিষ্কারটি করেছেন তারা ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা প্রস্তাব করেছেন। কোপেনহেগেনের ডেনিস দলটি বলছেন যে অস্ট্রেলিয়ান ডিএনএ আমরিকাতে মোটামুটি সাম্প্রতিক-অতীতে এসে পৌঁছেছে। এ সময়টি আমেরিকায় প্রথম মানুষ আগমণে পরে, কিন্তু ইউরোপিয়ানরা নিউ ওয়ার্ল্ডে পৌঁছানোর আগে। তাদের মতে প্রথমে আলেউশিয়া এবং উত্তর ও মধ্য আমেরিকা হয়ে একটু একটু করে বিভিন্ন ব্যক্তির মধ্যে সংকর-প্রজননের মাধ্যমে এ জিনগুলো ছড়িয়ে পড়ে। অন্যদিকে হার্ভার্ড দলের প্রস্তাবনা হলো এই জিনগুলো আমেরিকাতে এসেছে একটি ‘ভৌতিক’ জনপুঞ্জের মাধ্যমে যার নাম দেয়া হয়েছে ওয়াই (Y)। ওয়াইরা ছিলো আমেরিকাতে বসতি স্থাপন করা আরেকটি অগ্রগামী দলের স্থপতি। এটা যদি সত্য হয় তাহলে হঠাৎ করে বেরিং প্রণালী অতিক্রম করা লোকজনদেরকে বৈচিত্র্যপূর্ণ ও বিশ্বজনীন বলে মনে হয়।

প্রাগৈতিহাস বিষয়ে গবেষণার জন্য পুরা-জিনোমিকস খুবই শক্তিশালী হাতিয়ার। তবে এটি এখনো তার শৈশবে রয়ে আছে। প্রাচীন নমুনার নিউক্লিয় ডিএনএ দিয়ে প্রথম জনপুঞ্জ গবেষণা মাত্র এক মাসের পুরনো, যেখানে নমুনার সংখ্যা একক সংখ্যার স্থানে দশক ঘরের সংখ্যা। এ মুহূর্তে আমাদের কাছে আমেরিকা থেকে মাত্র দুইটি পুরাকালীন-জিনোম রয়েছে। আফ্রিকা, দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ার মতো বিশ্বের অন্যান্য স্থান থেকে আমাদের হয়তো একটি জিনোম নমুনা রয়েছে, বা কোন জিনোমই নেই। এত সামান্য উপাত্ত থেকে প্রাগেতিহাসিক পৃথিবীকে পুরানো-ডিএনএ নমুনার লেন্স দিয়ে দেখাটা অনেকটা ঘুটঘুটে অন্ধকারে হঠাৎ বিদ্যুৎচমকের মধ্যে একটি দৃশ্যপট বোঝার চেষ্টা করার মতোন। আমাদের জন্য অজস্র চমক অপেক্ষা করছে। বর্তমান পরিস্থিতি অনেকটা কার্বন-১৪ ডেটিং এর মাধ্যমে নমুনার বয়স বের করার পদ্ধতি আবিষ্কারের পর প্রত্নতত্ত্ববিদ্যার যে অবস্থা হয়েছিলো, অনেকটা তেমনই। একটি বিপ্লব ঘটতে যাচ্ছে, কিন্তু আমরা এখনো জানিনা এটি কি বয়ে নিয়ে আসবে।

[wpdiscuz-feedback id=”xd2973xaco” question=”মতামত দিন।” opened=”0″] (পুরাবংশগতিবিদ্যা ফাইলোজেনেটিক ট্রি ভিত্তিক পদ্ধতির উপর নির্ভরশীল। এই বিশ্লেষণ প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানতে আগ্রহী?) [/wpdiscuz-feedback]

Aeon এ প্রকাশিত মূল লেখা Origins। জ্যাকব মিকানোস্কি বিজ্ঞান, ইতিহাস ও শিল্প নিয়ে লেখেন। অনুবাদটি আমার বই প্রাণের বিজ্ঞান: সাম্প্রতিক জীববিজ্ঞানের ভাবনা ভাষান্তর (২০১৭) থেকে নেয়া।


[1]        পাথর যুগের মানুষেরা

[2]        ফিলোলজি হলো বিভিন্ন ঐতিহাসিক লিখিত দলিলের সূত্র ধরে ভাষা সম্পর্কিত গবেষণা

[3]        বংশগতিবিদ্যায় বটলনেক বলতে একটি পরিবেশগত ঘটনা (যেমন ভূমিকম্প) বোঝায় যার কারণে কোন প্রজাতির জনপুঞ্জের আকার হঠাৎ করে অনেক কমে যায়।

লেখাটি 247-বার পড়া হয়েছে।

ই-মেইলে গ্রাহক হয়ে যান

আপনার ই-মেইলে চলে যাবে নতুন প্রকাশিত লেখার খবর। দৈনিকের বদলে সাপ্তাহিক বা মাসিক ডাইজেস্ট হিসেবেও পরিবর্তন করতে পারেন সাবস্ক্রাইবের পর ।

Join 908 other subscribers