আমরা কীভাবে অন্যদের থেকে বড় মস্তিষ্ক পেলাম

প্রাগৈতিহাসিক বুদ্ধিবৃত্তিক বিপ্লব থেকে এই অধুনা যুগ পর্যন্ত পৌঁছুতে পারার পেছনে সবচাইতে বড় যে কারণ সেটি হচ্ছে আমাদের প্রত্যেকের উন্নত এবং অনেক বড় একটি মস্তিষ্ক আছে। আমারা ভাবতে পারি, চিন্তা করতে পারি, উদ্ভাবন করতে পারি এসবের পেছনেই রয়েছে আমাদের এই চমৎকার মস্তিষ্কের ভূমিকা। আমাদের মস্তিস্কের ওজন প্রায় ১.৩৬ কেজি। যা আমাদের শরীরের জন্যে যতটুকু প্রয়োজন ছিল সে তুলনায় প্রায় সাত গুণ বেশি। এবং এতে আছে প্রায় একশো বিলিয়ন নিউরন বা স্নায়ু কোষ। আমাদের প্রাইমেট বর্গের অন্যান্য নিকট আত্মীয় যেমন শিম্পাঞ্জি, গরিলা এদের কিন্তু এত বড় মস্তিষ্ক নেই। শিম্পাঞ্জির মস্তিষ্ক তার শরীরের তুলনায় মাত্র দুই গুণ বড় এবং গরিলার মস্তিষ্ক আমাদের মস্তিষ্কের চাইতেও ছোট। বুদ্ধিবৃত্তিক সংগ্রামে আমরা এতদূর এসেছি তার কারণ আমাদের এই এত বড় একটা মস্তিষ্ক আছে আর আমরা তার যথাযথ ব্যবহার করে যাচ্ছি।

প্রাইমেট বর্গের অন্যান্য সদস্যদের কেন আমাদের মতন বড় আকারের মস্তিষ্ক নেই? সাধারণত শরীরের অন্যান্য অংশের কোষ এর তুলনায় মস্তিষ্ক কোষের শক্তির চাহিদা অনেক বেশি। প্রতি গ্রাম মস্তিষ্ক কোষের শক্তির চাহিদা শরীরের অন্যান্য অংশের প্রতি গ্রাম কোষের চাইতে বেশি। আর বড় আকারের মস্তিষ্কে কোষের সংখ্যাও বেশি। স্বভাবতই তখন শক্তির চাহিদা আরও বেশি হয়ে থাকে। প্রাইমেট বর্গের অন্যান্য সদস্যরা রান্না করা ছাড়াই কাঁচা খাদ্য খায়। যার সবটা এরা পরিপাক করতে পারে না। ফলে গ্রহণ করা খাবারের পরিমাণ অনুযায়ী এরা তেমন শক্তি পায় না। সুতরাং বর্তমানে তাদের মস্তিষ্কে থাকা নিউরন বা স্নায়ু কোষের চাইতে বেশি সংখ্যক নিউরনের শক্তি যুগানো তাদের পক্ষে সম্ভব হয়ে উঠে না। অপর দিকে আধুনিক মানুষ তথা হোমো স্যাপিয়েন্সদের পূর্ব পুরুষেরা রান্না করতে শিখেছিল। ফলে তারা অন্য সদস্যদের সমপরিমাণ খাবার থেকে তুলনামূলক বেশি শক্তি পেত এবং আরও বেশি সংখ্যক নিউরন কোষের শক্তির যোগান দেবার ক্ষমতা ছিল।

একটি নতুন গবেষণা কীভাবে মানুষেরা শিম্পাঞ্জি কিংবা গরিলার থেকে অধিক সংখ্যক নিউরন বিশিষ্ট বড় মস্তিষ্ক লাভ করেছে তার কারণ উদ্ঘাটন করেছে। যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজে অবস্থিত আণবিক জীববিজ্ঞান গবেষণাগার মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিল (এমআরসি) এর একদল গবেষক গবেষণাটি সম্পাদন করে। গবেষণাপত্রটি সেল জার্নালে প্রকাশিত হয়।

প্রথম ছবিটি মানব মস্তিষ্কের অরগানয়েড এর ছবি। এরপর ক্রমে গরিলা এবং শিম্পাঞ্জির অরগানয়েড এর ছবি। ছবিসুত্রঃ ফিজিক্স ডট ওআরজি

তারা ইন-ভিট্রু পদ্ধতিতে মানুষ, শিম্পাঞ্জি, গরিলার মস্তিষ্কের অরগানয়েড তৈরি করেন। অরগানয়েড কে বলা যায় ছোট মস্তিষ্ক। এই জন্যে তারা মানুষ, শিম্পাঞ্জি,  গরিলার প্লুরিপুটেনট স্টেম( pluripotent stem cells)কোষ নমুনা সংগ্রহ করে তিন মাত্রিক বায়োরিঅ্যাক্টর মেশিনে কালচার করেন। এক একটি মস্তিষ্কের অরগানয়েড তৈরি হতে কয়েক মাস সময় লাগতে পারে। গবেষকরা জানায় অন্যান্য বনমানুষ এর চেয়ে মানুষের ব্রেন অরগানয়েড গুলোর বৃদ্ধি অনেক বেশি হয়ে থাকে। গবেষণায় নেতৃত্বে থাকা ডক্টর মেডলিন ল্যানকাস্টার জানান,

অন্যান্য বনমানুষ বা নিকট আত্মীয়দের চাইতে মানুষদের ব্রেন এর প্রধান পার্থক্য হল মানুষের ব্রেন অবিশ্বাস্য রকমের বৃহৎ। এই পার্থক্য এর কারনেই আমরা অন্যদের থেকে আলাদা।

ইন ভিট্রু পদ্ধতিতে অরগনায়েড তৈরি

মস্তিষ্ক গঠন প্রক্রিয়ার প্রথম দিকের নিউরন বা স্নায়ু কোষ গুলো যেসব স্টেম কোষ থেকে তৈরি হয় সেগুলোকে বলা হয় নিউরাল প্রোজেনিটরস বা পূর্বসূরী স্নায়ু কোষ। এই কোষ গুলো প্রথম দিকে সিলিন্ডার আকারের থাকে। এবং তখন তারা খুব সহজেই বিভাজিত হয়ে একই রকমের অপত্য কোষ তৈরি করতে পারে। এই ধাপটা যত দীর্ঘ সময় ধরে চলতে থাকে মস্তিষ্কে নিউরনের সংখ্যা তত বেশি বাড়তে থাকে। প্রোজেনিটরস কোষ গুলো ধীরে ধীরে পরিণত হতে থাকে এবং একটা সময়ে সেগুলো অনেকটা কোন(Cone) আইসক্রিম এর আকার ধারণ করে। তখন এসব কোষের কোষ বিভাজন প্রক্রিয়া মন্থর হয়ে আসে এবং এক সময় বন্ধ হয়ে যায়। ইঁদুরের উপর করা এমন একটি গবেষণায় দেখা যায় ইঁদুরের প্রজেনিটরস কোষ গুলো মাত্র এক ঘণ্টা সময়ের ব্যবধানে কোন আকৃতি ধারন করে এবং এদের বিভাজন প্রক্রিয়া মন্থর হয়ে যায়। বর্তমানে বিজ্ঞানীরা মানুষ, শিম্পাঞ্জি, গরিলার ব্রেন অরগানয়েড গঠন প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করতে পেরেছেন।

পূর্বসূরী কোষ গুলো কোন আকারের ধারন করে। ছবিসুত্রঃ ফিজিক্স ডট ওআরজি

তারা লক্ষ্য করেন শিম্পাঞ্জি, গরিলায় পূর্বসূরী কোষ গুলোর পরিণত হতে প্রায় ৫ দিন সময় নেয়। কিন্তু মানুষ এর ক্ষেত্রে ৭ দিন বা তার বেশি সময়ও লেগে যায়। যে কারণে মানুষের ক্ষেত্রে প্রোজেনিটরস কোষ গুলো আরও বেশি সময় ধরে বিভাজিত হবার সময় পায়। আর তাই অন্যান্যদের তুলনায় মানুষদের মস্তিষ্কে নিউনের সংখ্যাও বেশি হয়ে থাকে। এবং তা সংখ্যায় তিন গুণ বেশি! ডাঃ ল্যানকাস্টার বলেছেন:

“ এটা সত্যি অভিনব যে পূর্বসূরী কোষ গুলোতে ক্ষুদ্র একটা বিবর্তনিয় পরিবর্তন আমাদের মস্তিষ্কের কোষে বিশাল পরিবর্তন এনেছে। আমাদের মানুষ করে তুলেছে”।

এর পেছনে জিনগত কারণ জানবার জন্যে তারা ব্রেন অরগানয়েড গঠনের প্রথম ধাপটির সময় কোন জিন গুলো প্রকট হয় সেগুলো পর্যবেক্ষণ করেন এবং মানুষ, শিম্পাঞ্জি  ও গরিলার মধ্যে তুলনা করে দেখেন। তারা শনাক্ত করেন যে, ‘ZEB2‘ নামের একটি জিন মস্তিষ্ক গঠনের সময় গরিলায় মানুষের অনেক আগে প্রকটিত হয়। গবেষকরা এই জিনটির কার্যক্রম মন্থর করে দিয়ে খেয়াল করেন যে পূর্বসূরি কোষ গুলো পরিণত হতে আরও সময় নেয় এবং তখন এগুলো আরও বেশি বেশি বিভাজিত হতে পারে। অপর দিকে মানুষের মধ্যে এই জিন এর প্রক্রিয়া আরও দ্রুত করে দেখা যায় পূর্বসূরি কোষ গুলো আগের তুলনায় তাড়াতাড়ি পরিণত হয়ে যায় এবং কম বিভাজিত হয়। অর্থাৎ ‘ZEB2’ জিন পূর্বসূরী কোষ গুলোকে তাড়াতাড়ি পরিণতির দিকে নিয়ে যায়। গবেষণাটি সত্যিই অভিনব। অন্তত আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক এত উন্নতির পেছনে সম্ভবত একটা বড় রহস্যের জাল উন্মোচিত করে।

তথ্যসুত্রঃ

লেখাটি 495-বার পড়া হয়েছে।


আলোচনা

Responses

  1. আরাফাত Avatar
    আরাফাত

    আগ্রহোদ্দীপক লেখা। এমনিতে মস্তিষ্কের অররগানয়েড নিয়ে দারুন কিছু গবেষণা চলছে। তোমার লেখা থেকে যেটা জানলাম যে এগুলো বিভাজন থামাতে কত সময় লাগে সেটা বৃদ্ধির নিয়ামক।

  2. ছবিগুলো বাংলায় বেশ ভাল লাগছে। বুঝতে সুবিধা হয়। বরাবরেই মতোই দারুন বাক্যবিন্যাস।

    1. Sujoy Kumar Das Avatar
      Sujoy Kumar Das

      ধন্যবাদ দাদা।

Leave a Reply

ই-মেইলে গ্রাহক হয়ে যান

আপনার ই-মেইলে চলে যাবে নতুন প্রকাশিত লেখার খবর। দৈনিকের বদলে সাপ্তাহিক বা মাসিক ডাইজেস্ট হিসেবেও পরিবর্তন করতে পারেন সাবস্ক্রাইবের পর ।

Join 906 other subscribers