গাছেও কি ক্যান্সার হতে পারে?

গাছেও কি ক্যান্সার হতে পারে? কিংবা হলেও তা কতটা মারাত্মক?

যুগ্মভাবে লিখেছেন মোঃ সানজিদ আহমেদ ও অর্ণব কান্তি পাল

প্রথমেই আমাদের জানতে হবে ক্যান্সার কী? ক্যান্সার হচ্ছে যেকোনো ধরনের কোষের অনিয়ন্ত্রিত বৃদ্ধি পাওয়া তা হতে পারে সেই জীবের জন্য উপকারী কিংবা অপকারী। প্রাণীর ক্ষেত্রে বর্তমান বিশ্বে একটি ভয়ংকর মরণব্যাধি (বিশেষ করে মানুষের ক্ষেত্রে) হল ক্যান্সার। কিন্তু উদ্ভিদের ক্ষেত্রে তা সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি বিষয়।

সাধারণত প্রাণীর ক্ষেত্রে দেখা যায় শরীরের যেকোনো একটি অংশে একটি টিউমার সৃষ্টি হয়। তারপর এই টিউমার আকারে বৃদ্ধি পেতে থাকে অর্থাৎ বারবার কোষ বিভাজনের মাধ্যমে কোষের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে থাকে এবং শরীরের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়ে। একসময় সেটি ক্যান্সারে পরিণত হয়।

প্রাণীতে ক্যান্সার কীভাবে ছড়ায়?

প্রাণীদেহে ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়ার প্রক্রিয়াকে বলে মেটাস্ট্যাসিস। যেখানে ক্যান্সার সৃষ্টি হয় সেখান থেকে রক্তনালী কিংবা লিম্ফনালীর মাধ্যমে শরীরের বিভিন্ন স্থানে যেমন- হাড়, যকৃত কিংবা ফুস্ফুসে ছড়িয়ে পড়ে। এরপর কোনো একসময় দেখা যায় যে শরীরের ক্যান্সার আক্রান্ত অঙ্গ নষ্ট হয়ে যায় এবং প্রাণীটির মৃত্যু ঘটে। প্রাণীর মতো উদ্ভিদে ক্যান্সার বা টিউমার এক অংশ থেকে আরেক অংশে ছড়ায় না অর্থাৎ মেটাস্ট্যাসিস হয় না।

দুটি কারনে উদ্ভিদে ক্যান্সার ছড়াতে পারে না।

১। উদ্ভিদের কোষ প্রাচীর।
২। প্রাণীর মত উদ্ভিদের পরিবহন তন্ত্র না থাকা।

১। উদ্ভিদের কোষের বাইরে শক্ত এবং পুরু কোষ প্রাচীর থাকার কারণে উদ্ভিদের কোষগুলো চলাচল করতে পারে না। তাই উদ্ভিদের কোথাও টিউমার হলেও সেটা উদ্ভিদ দেহের বিভিন্ন স্থানে ছড়াতে পারে না।
২।উদ্ভিদে পরিবহনতন্ত্র থাকলেও প্রাণীর মত নেই। প্রাণীর পরিবহনতন্ত্র জীবিত, সজীব এবং কর্মক্ষম কোষ দিয়ে গঠিত। অপরদিকে উদ্ভিদে তা মৃত কোষ দ্বারা গঠিত এবং সেটি শুধু পুষ্টি পরিবহনেই সক্ষম। প্রানির মত কোষ পরিবহন হয় না।

এসব কারনে উদ্ভিদে ক্যান্সার ছড়াতে পারে না। উদ্ভিদে সৃষ্ট টিউমারটি উদ্ভিদ নিজের মত করে অভিযোজন করে নেয় এবং সেটা উদ্ভিদের একটি অংশ হয়ে যায়। এতে করে উদ্ভিদ মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে যায়। তবে কখনো কখনো উদ্ভিদের মৃত্যুও হতে পারে। যদি নাও হয় কোষ গুলো তাদের টটিপটেন্সি হারিয়ে ফেলে ( বলে রাখা প্রয়োজন টটিপটেন্সি হচ্ছে প্রতিটি কোষের সেই বৈশিষ্ট্য যেটা থেকে নতুন উদ্ভিদ হবার ক্ষমতা থাকে )। উদ্ভিদের ঐ অংশগুলো তার জৈবিক কার্যাবলি হারিয়ে মৃত হয়ে যায়।

প্রাণীদেহের কোনো অঙ্গে ক্যান্সার হলে একসময় প্রাণীটি মৃত্যুমুখে পতিত হয়। কিন্তু উদ্ভিদের কোনো একটি অংশে টিউমার হলে উদ্ভিদের শুধুমাত্র ঐ অংশ মরে গেলেও উদ্ভিদটি জীবিত থাকে।

এবার আসি উদ্ভিদে কী ধরনের টিউমার হতে পারে?

উদ্ভিদে দুই ধরনের টিউমার হতে পারে।

১। গল (GALL)
২। বার্ল(BURL)

গল:

গল হচ্ছে উদ্ভিদের পাতা, ডালপালা, মূল অথবা যেকোনো অংশের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি। গল সাধারণত ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক বা কীটপতঙ্গের আক্রমনের ফলে হয়। গল দেখতে গলাকার, নব আকৃতির অথবা আঁচিলের মত হতে পারে। সাধারণত ক্রাউন গল উদ্ভিদে সবচেয়ে বেশি বিশেষ করে নগ্নবীজী এবং দ্বিবীজপত্রী আবৃতবীজী উদ্ভিদে বেশি দেখা যায়। উদ্ভিদের এই ক্রাউন গল রোগ এবং এর কারণ সম্পর্কে সর্বপ্রথম ধারণা দেন বিজ্ঞানী আরউইন এফ. স্মিথ (Erwin F. Smith)। এটি Agrobacterium tumefaciens ব্যাকটেরিয়ার দ্বারা হয়ে থাকে যা মাটিতে বাস করে। যেহেতু এটি মাটিতে থাকে তাই প্রথমিকভাবে এটি মূলে আক্রমণ করে।

চিত্র-১: উদ্ভিদের মূলের ক্রাউন গল বা টিউমার। সূত্র

Agrobacterium tumefaciens ব্যাকটেরিয়া উদ্ভিদের যেকোনো ক্ষত অংশে আক্রমণ করে থাকে। একবার যদি এই ক্রাউন গল হয়ে যায় এরপর ব্যাকটেরিয়ার সাহায্য ছাড়াই এটি বৃদ্ধি পেতে থাকে। যখন উদ্ভিদ এই ব্যাকটেরিয়া দ্বারা আক্রান্ত হয় তখন আক্রান্ত কোষের পাশের কোষগুলো ক্রমাগত বিভাজিত এবং বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হতে থাকে এবং এই বৃদ্ধি হয়ে থাকে অনিয়ন্ত্রিতভাবে অর্থাৎ কোষ বিভাজন নিয়ন্ত্রন পদ্ধতি তখন সেই কোষগুলোর ক্ষেত্রে আর কার্যকরী হয় না। এর ফলাফল হিসেবে উদ্ভিদের ঐ অংশে টিউমার সৃষ্টি হয় যা আমরা ক্রাউন গল হিসেবে জানি।

এত সব অসুবিধা থাকলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে টিউমার কোষ উপকারী বিশেষ করে টিস্যু কালচার করতে। টিস্যু কালচার বলতে সাধারণত উদ্ভিদের কোন একটি অংশ ( এক্সপ্ল্যান্ট )  নিয়ে উপযুক্ত পরিবেশ এবং বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান সরবরাহের মাধ্যমে ধাপে ধাপে সম্পূর্ণ উদ্ভিদ বানানোকে বুঝানো হয়। এর একটি উল্লেখযোগ্য ধাপ হচ্ছে ক্যালাস ( অবিচ্ছিন্ন টিস্যুমণ্ড ) তৈরি করা। সাধারণত উদ্ভিদের মেরিস্টেম টিস্যু ব্যাতীত অন্য এক্সপ্ল্যান্ট থেকে ক্যালাস তৈরির জন্য আবাদ মাধ্যমে নির্দিষ্ট মাত্রায় উদ্ভিদ হরমোন অক্সিন এবং সাইটোকাইনিন প্রদান করতে হয়। কারণ এই দুটি হরমোন উদ্ভিদের প্রধান দুটি বৃদ্ধিকারক হরমোন এবং এগুলো মেরিস্টেম টিস্যুতেই তৈরি হয়। কিন্তু টিউমার কোষ থেকে ক্যালাস তৈরির জন্য আবাদ মাধ্যমে অক্সিন ও সাইটোকাইনিন যোগ করতে হয় না কারণ টিউমার কোষ নিজেরার এ দুটি হরমোন তৈরি করতে পারে। তাছাড়াও সাধারণ কোষের থেকে টিউমার কোষ থেকে কম সময়ের মধ্যে ক্যালাস পাওয়া যায়।

এখন প্রশ্ন থাকতে পারে যে টিউমার কোষ থেকে ক্যালাস তৈরি করে সেখান থেকে উদ্ভিদ বানানো কতটা যুক্তিযুক্ত এবং এটা ক্ষতিকর কিনা?

এর উত্তর হচ্ছে যে এই পদ্ধতিটি সম্পূর্ণ নিরাপদ। কারণ টিউমার কোষ যখন উদ্ভিদ থেকে আলাদা করা হয় তখন তার টিউমার তৈরির বৈশিষ্ট্য আর থাকে না আর উদ্ভিদে টিউমার তৈরি শুরু করার জন্য একটা পরোক্ষ মাধ্যম লাগে যেমন- ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, ছত্রাক বা কোনো কীটপতঙ্গ।

এছাড়াও কিছু ফ্রেঞ্চ বিজ্ঞানীদের দেওয়া তথ্য থেকে জানা যায় যে টিউমার কোষ কিছু নোভেল এমিনো এসিড তৈরি করতে পারে যা সাধারণত উদ্ভিদ দেহে তৈরি হয় না। এই ধরণের এমিনো এসিডের মধ্যে অন্যতম হল- দুটি প্রধান ওপাইন(Opine)

  1. অক্টোপাইন (Octopine)        
  2. নোপালাইন (Nopaline)

টিউমার কোষ সাধারণত এই বৈশিষ্ট্যগুলো পেয়ে থাকে আক্রমণকৃত ব্যাকটেরিয়ার প্লাসমিড থেকে।

বার্ল:

বার্ল হচ্ছে উদ্ভিদের বিভিন্ন অংশে বিশেষ করে কান্ডে স্ফীত অংশ যা টিস্যু দ্বারা গঠিত। এটাকে ক্যালাস টিস্যু বলা হয়। এটি গোলাকার, প্যাঁচানো, ভাঁজকৃত হতে পারে। সাধারণত উদ্ভিদ বিভিন্ন প্রাকৃতিক ক্ষত যেমন- রোগ, কীটপতঙ্গ দ্বারা আক্রমণ, উদ্ভিদের ছাঁটাই করা অংশে বার্ল তৈরি করে। উদ্ভিদের কুঁড়ি থেকে বার্ল তৈরি হয়।

এটিকে মানুষের নন-ম্যালিগ্ন্যান্ট টিউমার এর সাথে তুলনা করা যেতে পারে। (বলে রাখা প্রয়োজন যে নন- ম্যালিগ্ন্যান্ট টিউমার এর কারনে মানুষের মৃত্যু হয় না)। কারণ এই টিউমার উদ্ভিদের জন্য ক্ষতিকর নয়।

বার্ল এ উদ্ভিদের একই জেনেটিক উপাদান থাকে অর্থাৎ একই জিনগত বৈশিষ্ট্য বহন করে। বার্ল উদ্ভিদের ক্ষত এর বিরুদ্ধে তৈরি হওয়া টিস্যু। ঐসব স্থানে উদ্ভিদকে সুরক্ষা দেবার জন্যই বার্লের তৈরি হয়। তবে উদ্ভিদের বার্ল কেটে ফেললে সেখানে আবার রোগ সৃষ্টি হতে পারে বা ঐ স্থান আবার আক্রমণ হবার সম্ভাবনা থাকে; সর্বোপরি উদ্ভিদের ক্ষতি হতে পারে।

উদাহরণঃ যেকোনো বৃক্ষ জাতীয় গাছ গুলোর যে অংশ কেটে নেওয়া হয় সেসব স্থানে বার্ল দেখা যেতে পারে। একটি কেটে ফেলা বৃক্ষ জাতীয় উদ্ভিদের বার্ল থেকে নতুন উদ্ভিদ সৃষ্টি হতে পারে।

চিত্র-২: উদ্ভিদে তৈরি হওয়া বার্ল। সূত্র

পরিশেষে বলা যায় যে, গাছে সরাসরি ক্যান্সার না হলেও টিউমার তৈরি হয়। সেটা কিছু কিছু ক্ষেত্রে উপকারীও হতে পারে। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই টিউমার হলে গাছের মৃত্যু হয় না।

উৎসসমূহঃ

১। https://organicplantcarellc.com/what-is-a-burl
২। The nature of disease in plants by Robert P. Scheffer.
৩। https://www.mortonarb.org/trees-plants/tree-and-plant-advice/help-pests/plant-galls
৪। https://link.springer.com/article/10.1007/BF02860827

লেখাটি 314-বার পড়া হয়েছে।


আলোচনা

Responses

  1. ভিন্নধর্মী টপিক। ভাল লেগেছে।

    1. Arnob Kanti Paul Avatar
      Arnob Kanti Paul

      ধন্যবাদ। <3

  2. কান্তি আর সানজিদ, গুড জব।
    ভাষাগত (লেখ্যরীতি, বানান, যতি চিহ্ন) বেশ কিছু সমস্যা রয়ে গেছে। সময় করে ওগুলো ঠিক করে দিস। পুরো লেখায় লেখার ঢঙ একরকম থাকলে ভালো হতো। অনেক জায়গায় মনে হচ্ছে ভাষার ব্যবহার খুব বিধিবিৎ, অনেক জায়গায় আবার কিছুটা আটপৌরে ধরণের।
    প্যারা শুরু করবার সময় একটা অঙ্কুশ বা প্রসঙ্গ বাক্য দিয়ে শুরু করলে পাঠকের পড়তে সুবিধা হয়। বিজ্ঞান নিয়ে লিখবার সময় উইকিপিডিয়ার মত উৎসগুলোকে তথ্যসূত্রে যোগ না করাই ভালো। তথ্যসূত্র লিখবারও নির্দিষ্ট নিয়ম আছে। পরের বার লিখতে গেলে, এগুলো একটু মাথায় রাখিস।

    1. Arnob Kanti Paul Avatar
      Arnob Kanti Paul

      অনেক অনেক ধন্যবাদ ভাই। এত সুন্দর করে বুঝিয়ে দেবার জন্য। আপনার কথাগুলো আমাদের কাছে বিশাল প্রাপ্তি। পরের বার থেকে সবগুলো বিষয় মাথায় রাখার চেষ্টা করবো ভাই <3

Leave a Reply

ই-মেইলে গ্রাহক হয়ে যান

আপনার ই-মেইলে চলে যাবে নতুন প্রকাশিত লেখার খবর। দৈনিকের বদলে সাপ্তাহিক বা মাসিক ডাইজেস্ট হিসেবেও পরিবর্তন করতে পারেন সাবস্ক্রাইবের পর ।

Join 906 other subscribers