নিউক্লিক এসিড এর বিবর্তন-১

লেখাটি , বিভাগে প্রকাশিত

জীবদেহ গঠন এবং পরিচালনার জন্যে যে ক’টি জৈব অণু র‍য়েছে সেগুলোর মধ্যে প্রোটিন এবং  নিউক্লিক এসিড কে বলা যায় সবথেকে গুরত্বপূর্ণ। কেননা কেবল এই প্রোটিন এবং নিউক্লিক এসিড মিলে তৈরি হয়ে গিয়েছিল প্রথম প্রাণ। এককোষী জীব কিংবা বহুকোষী জীবদেহ সকল জীব এ প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে অসংখ্য প্রাণরাসায়নিক বিক্রিয়া। এই বৈশিষ্ট্যপূর্ণ বিক্রিয়া গুলো বিভিন্ন জীব প্রজাতি ভেদে বিভন্ন হয়। এগুলোই এক একটা জীব দেহের বৈশিষ্ট্য নিয়ন্ত্রক। তবে প্রায় সকল জীবের মধ্যেই কয়েকটা মৌলিক একই রকমের বিক্রিয়া আছে। যেমন শ্বসন। শ্বসন এর মাধ্যমে একটা জীব খাদ্যবস্তু হতে শক্তি তৈরি করে। এই সকল প্রাণরাসায়নিক বৈশিষ্ট্যের  পেছনে রয়েছে বিভিন্ন প্রোটিন ভূমিকা। বলা যায় প্রোটিনই এইসব বৈশিষ্ট্যের নিয়ন্ত্রক। যেমন হিমোগ্লোবিন প্রোটিন মানুষের রক্তের রং লাল হবার জন্যে দায়ী এবং এটি অক্সিজেন পরিবহনে সহায়তা করে। জীববিজ্ঞানের কেন্দ্রীয় প্রত্যয় বলে যে এক একটা নির্দিষ্ট প্রোটিন তৈরির তথ্য(জিন) সংরক্ষিত থাকে মেসেঞ্জার আরএনএ অণুতে। আর মেসেঞ্জার আরএনএ তৈরি হয়ে থাকে ডিএনএ থেকে। ডিএনএ তৈরি হয় আরেকটা ডিএনএ অণুকে কপি করে অনুলিপন প্রক্রিয়ায়। কিন্তু এই অনুলিপন প্রক্রিয়া সম্পাদন এর জন্যে দরকার হয় কতিপয় এনজাইম এর যেগুলো কিনা সবগুলোই প্রোটিন।

জীববিজ্ঞানের কেন্দ্রীয় প্রত্যয়

সুতরাং দেখা যায় প্রোটিন তৈরি হয় ডিএনএ থেকে আবার ডিএনএ তৈরি করতে দরকার হয় প্রোটিন এর। একটা প্রশ্ন স্বভাবতই জাগে তাহলে কোনটা আগে তৈরি হয়েছে ডিএনএ নাকি প্রোটিন?

আরএনএ আগে তৈরি হয়েছে নাকি ডিএনএঃ

নিউক্লিক এসিড দুই ধরণেরঃ ডিএনএ এবং আরএনএ। প্রথম প্রোটোকোষ সৃষ্টি হয়েছে আরএনএ অণু থেকে। এই তথ্য এসেছে আরএনএ বিশ্ব প্রকল্প (হাইপোথিসিস) থেকে। এই হাইপোথিসিস এর প্রবক্তা কার্ল উয়েস, ফ্রান্সিস ক্রিক এবং লেসাইল অরগেল। প্রতিটি জীবেরই প্রানরাসায়নিক বৈশিষ্ট্য সমূহ সংরক্ষিত থাকে নিউক্লিক এসিড অনুতে। প্রতিটি জীবই কোন না কোন উপায়ে তার অনুরূপ বংশধর সৃষ্টি করে এবং তার প্রাণরাসায়নিক তথ্য সমূহ বংশানুক্রমে স্থানান্তরিত হয়। যেহেতু জৈবিক তথ্য সমূহ নিউক্লিক এসিড অনুতে সংরক্ষিত থাকে তাই নিউক্লিক এসিড অণুই বংশগত বস্তু হিসেবে কাজ করে এবং তথ্য সমূহ বংশানুক্রমে স্থানান্তর করে। বর্তমানে কিছু ভাইরাস ছাড়া প্রায় সকল এককোষী ব্যাকটেরিয়া থেকে বহুকোষী জটিল প্রাণ এ বংশগত বস্তু হিসবে কাজ করে ডিএনএ। কিন্তু যেহেতু ডিএনএ অণু নিজের অনুলিপি তৈরি করতে প্রোটিন এর সাহায্য দরকার সেহেতু প্রথম প্রাণ এর বংশগত বস্তু ডিএনএ হতে পারে না। কেননা তখন ডিএনএ তৈরি এনজাইম বা প্রোটিন সমূহ উপস্থিত ছল না।

ফ্রান্সিস ক্রিক

বাকি থেকে গেল আরএনএ। আরএনএ অণুর নিজের অনুলিপন ক্ষমতা আছে। সেই সাথে আরএনএ অণু জৈবপ্রভাবক (রাইবোজাইম) হিসেবে কাজ করার ক্ষমতা আছে। প্রিবায়োটিক (প্রাণ সৃষ্টির আগে) যুগে কোন একটা আরএনএ অণু নিজেই নিজের অনুলিপি তৈরির বিক্রিয়ায় প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে। অর্থাৎ আরএনএ প্রিতিলিপন এর জন্যে আলাদা প্রোটিন এর দরকার নেই। তাই আরএনএ অণু প্রিবায়োটিক যুগে বংশগত বস্তু হিসেবে ছিল। নিউক্লিক এসিড মূলত নিউক্লিয়টাইডের পলিমার বা চেইন। নাইট্রোজেনঘটিত ক্ষার, অজৈব ফসফেট এবং পাঁচ কার্বন বিশিষ্ট শর্করা মিলে তৈরি হয় নিক্লিয়টাইড অণু। এরকম অসংখ্য নিউক্লিয়টাইড অণু মিলে তৈরি করে নিউক্লিক এসিড। আরএনএ ওয়ার্ল্ড হাইপোথিসিস অনুসারে প্রিবায়োটিক যুগে এইরকম নিউক্লিয়টাইড অণু সাগরের পানিতে মুক্ত অবস্থায় ভাসমান ছিল। নিউক্লিয়টাইড অণুগুলো নিজেদের মধ্যে বন্ধন তৈরি করতে থাকে। আবার ভেঙ্গেও যায়। কারণ স্থায়ী বন্ধন তৈরি করতে যে পরিমাণ শক্তির দরকার ছিল তা ছিল না। এই বন্ধন ভাঙ্গা গড়া চলতে থাকে। এরকমভাবে তৈরি কোন একটা চেইন প্রভাবন ক্ষমতা অর্জন করে। তারপর এটি স্থায়ী চেইন করার জন্যে প্রয়োজনীয় শক্তির পরিমাণ কমিয়ে আনে।যার ফলে নিউক্লিয়টাইডের চেইন গুলো দীর্ঘক্ষণ স্থায়ী হতে থাকে এবং দ্রত আরও নিউক্লিয়টাইড যুক্ত হয়ে চেইন বড় হতে থাকে। এভাবে কোন চেইন ভেঙ্গে যাওয়ার সময়ের তুলনায় দ্রুত তৈরি হতে থাকে। এভাবেই পৃথিবীতে প্রথম আরএনএ অণু তৈরি হয়। প্রাকৃতিক নির্বাচনে টিকে থাকে সেই আরএনএ অণুগুলোই যেগুলো পরবর্তীতে নিজে নিজে নিজের প্রতিলিপি তৈরি ক্ষমতা অর্জন করে। আর সেরকম কোন এক আরএনএ অণু থেকেই তৈরি হয় প্রথম প্রোটো কোষ।

ডিএনএ কি আরএনএ থেকে বিবর্তিত?  

আগেই বলেছি নিউক্লিক এসিড দুই ধরণের। আরএনএ ও ডিএনএ। বলেছিলাম নিউক্লিক এসিড মূলত নিউক্লিয়টাইডস এর চেইন। পেন্টোজ (পাঁচ কার্বন বিশিষ্ট) শর্করা, নাইট্রোজেনঘটিত ক্ষার এবং ফসফেট মিলে তৈরি করে এক একটা নিউক্লিয়টাইডস অণু। আরএনএ এবং ডিএনএ এর গঠনের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। আরএনএ তৈরিতে যেই শর্করাটা ব্যবহৃত হয় এর নাম রাইবোজ এবং ডিএনএ তে সেটি হচ্ছে ডিঅক্সিরাইবোজ। রাইবোজ এবং ডিঅক্সিরাইবোজ উভয়ই পাঁচ কার্বন বিশিষ্ট। তবে পার্থক্য হচ্ছে রাইবোজ এর ২ নং কার্বনে একটি অক্সিজেন পরমাণু আছে কিন্তু  ডিঅক্সিরাইবোজ এ সেটি নেই। আরএনএ তৈরিতে মোট চারটি নাইট্রোজেনাস ক্ষার ব্যবহৃত হয় যথাঃ এডিনিন, গুয়ানিন, সাইটোসিন এবং ইউরাসিল । ডিএনএ তেও প্রথম তিনটি নাইট্রোজেনাস ক্ষার ব্যবহৃত হয় কেবলমাত্র ইউরাসিলটা নেই। ইউরাসিল এর জায়গায় থায়ামিডিন ব্যবহৃত হয়। আরএনএ একটা মাত্র চেইন নিয়ে গঠিত কিন্তু ডিএনএ এর আছে দুইটা চেইন। আরএনএ তৈরিতে ব্যবহৃত নিউক্লিয়টাইডসদের বলা হয় আরএনএনটিপি (রাইবোনিউক্লিয়টাইড ট্রাই ফসফেট)। আর ডিএনএ এর নিউক্লিয়টাইডসদের ডাকা হয় ডিএনটিপি (ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিয়টাইডস ট্রাই ফসফেট)।

নাইট্রোজেনাস ক্ষার

ডিএনএ কে ভাবা যায় আরএনএ এর বিশেষায়িত রুপ হিসেবে। কারণ আরএনএ এর রাইবোজ শর্করা ডিএনএ তে বিজারিত হয়ে হয়েছে ডিঅক্সিরাইবোজ আর ইউরাসিল এর সাথে একটা মিথাইল মূলক যুক্ত হয়ে ডিএনএ তে  এটি থাইমিডিন হয়েছে। আধুনিক কোষগুলোতে রাইবোনিউক্লাইটাইড রিডাকটেজ (আরএনআর) এনজাইম এর প্রভাবে আরএনটিপি হতে ডিএনটিপি গুলো তৈরি হয়। ডিএনএ তৈরির উপাদান গুলো আরএনএ এর গাঠনিক উপাদান গুলো থেকে তৈরি হওয়া প্রিবায়োটিক যুগে আরএনএ হতে ডিএনএ এর বিবর্তনকে ইঙ্গিত দেয়। যদিও এ নিয়ে বিতর্ক আছে। আরএনএ থেকে ডিএনএ বিবর্তনের প্রথম ধাপ হিসেবে বলা যায় আরএনএ থেকে ইউ-ডিএনএ (U-DNA) এর উদ্ভব। ইউ-ডিএনএ তে ইউরাসিল থাকে। এর পেছনে কারণ হিসেবে বলা যায় আরএনআর এনজাইম আরএনএ তে থাকা ইউরাসিল ট্রাই ফসফেট (ইউটিপি) কে সরাসরি বিজারিত করে ডিইউটিপি তৈরি করে। কিন্তু আরএনআর এনজাইম থাইমিডিন ট্রাই ফসফেট (টিটিপি) থেকে সরাসরি ডিটিটিপি তৈরি করতে পারে না। প্রথমে ডিটিএমপি (ডিঅক্সি থাইমিডিন মনো ফসফেট) তৈরি হয় ডিইউএমপি (ডিঅক্সি ইউরাসিল মনোফসফেট) থেকে। এইক্ষেত্রে থাইমিডাইলেট সিন্থেজ নামক একটি এনজাইম প্রভাবক হিসেবে ভুমিকা রাখে। তারপর ডিটিএমপি থেকে ডিটিটিপি তৈরি হয়। এভাবে তৈরি হয় টি-ডিএনএ(T-DNA)। টি-ডিএনএ তে ইউরাসিল থাইমিডিন দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়।

বাকী লেখা পরবর্তী পর্বে থাকবে।

তথ্যসুত্রঃ ১। https://linkmn.gr/AX7ve1

লেখাটি 476-বার পড়া হয়েছে।

ই-মেইলে গ্রাহক হয়ে যান

আপনার ই-মেইলে চলে যাবে নতুন প্রকাশিত লেখার খবর। দৈনিকের বদলে সাপ্তাহিক বা মাসিক ডাইজেস্ট হিসেবেও পরিবর্তন করতে পারেন সাবস্ক্রাইবের পর ।

Join 908 other subscribers