“সুন্দর” এর কাটাকুটি: নন্দন স্নায়ু-বিজ্ঞান

উপরের ছবি দুইটির মধ্যে মিল কোথায় বলুন তো ?

দুইটা ছবি দুই ধরনের, প্রথমটি লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চির আঁকা খুব বিখ্যাত পোর্ট্রেট মোনালিসা আর দ্বিতীয়টি জোসেফ ডন্ডেলিঞ্জা এর ক্যামেরা দিয়ে তোলা পুরষ্কার প্রাপ্ত একটা ল্যান্ডস্কেপ । 

দৃশ্যত কোন মিল না থাকলেও এদের মধ্যে একটা বড় মিল হল, দুইটা ছবিই বেশ সুন্দর । আপনাকে যদি প্রশ্ন করা হয়, কেন সুন্দর এগুলো? আপনি উত্তরে হয়ত বলবেন নিখুঁত আকুনি, রং, আকর্ষনীয়তা বা অন্যকিছু । 

কিন্তু যদি প্রশ্ন করা হয়  “সৌন্দর্য” কি ? 

একটু বিষম হয়ত খেয়েই বসবেন তখন । খুবই সহজ একটা  প্রশ্ন, আবার কিন্তু খুব জটিলও । তবে, নিশ্চিন্ত  থাকুন এর উত্তর দিতে গিয়ে শুধু আপনিই নন বড় বড় বিজ্ঞানীরাও হিমশিম খাচ্ছেন। অথচ ভেবে দেখুন প্রতিদিনই আমরা এই সৌন্দর্যকে অনুভব করছি নানা ভাবে ।

নিউরোএস্থেটিকস বা নন্দন স্নায়ু বিজ্ঞান কি বলছে ?

সৌন্দর্যকে বুঝতে গিয়ে বিজ্ঞানের আস্ত একটা শাখা তৈরি হয়েছে, যার কাজ সৌন্দর্য কিভাবে কাজ করে আর এর পেছনে আমাদের মস্তিষ্কের ভেতর কি ঘটছে তা উদ্ঘাটন করা। শাখাটির নাম নিউরোএস্থেটিকস, বাংলায় এর নাম হবে “নন্দন স্নায়ু-বিজ্ঞান” । গবেষণায় মানুষের এই সৌন্দর্য বোধের খুব চমৎকার কিছু বিষয় উঠে এসেছে । আমাদের মস্তিষ্কের কিছু অংশ রয়েছে যেগুলু উদ্দীপিত হয়ে আমাদেরকে বলে দেয় কোন কিছু সুন্দর নাকি কুৎসিত । আপনি যখন উপড়ের ছবি দুটো দেখছেন আপনার মস্তিষ্কের প্রধানত দুইটি অংশে রক্তপ্রবাহ বেড়ে গেছে এবং ঐখানের স্নায়ুগুলু উদ্দীপিত হয়েছে, আর সেগুলুর উদ্দীপনের মাত্রা ঠিক করে দিয়েছে এটা আপনার কাছে সুন্দর লাগছে নাকি লাগছে না । নিচের ছবিতে সংক্ষেপে তুলে ধরা হল ।

এতো গেল মস্তিষ্কের ভেতরের কথা কিন্তু ঠিক কোন বিষয়গুলু আমাদের মধ্যে এই সৌন্দর্য বোধের উদ্দীপনা দেয় ? বিজ্ঞানীরা এর উত্তর খুঁজতে স্নায়ু বিদ্যার পাশাপাশি মনোবিদ্যা , বিবর্তন বিদ্যা আর পুরাতত্ত্ব বিদ্যার সাহায্য নিলেন। সে বিষয়ক বিভিন্ন গবেষণার যা বেরিয়ে আসল সেটা কে সহজ করলে বলা যায়,

খন কোন কিছুর  রং, আকার, আকৃতি , নকশা বা অনুপাত কোনভাবে আমাদের কাছে আকর্ষনীয় মনে হয়, আমাদের মস্তিষ্কের নির্দিষ্ট অংশগুলুতে একধরনের আলোড়ন তুলে ; তখন আমরা একে সুন্দর ভাবি । ”

সৌন্দর্যের বয়স কত ?

সৌন্দর্য এমন একটা মানব অনুভূতি যা আমাদের সাথে আছে লক্ষ লক্ষ বছর ধরে । যতগুলো আদিম সভ্যতা আবিষ্কার হয়েছে তার সবগুলোতেই রয়েছে জ্যামিতিক সৌন্দর্য বোধের ছাপ ।সময়ের সাথে সাথে সৌন্দর্যের  গতি বিভিন্ন দিকে মোড় নিলেও আবর্তিত হয়েছে একই মৌলিক বিষয় গুলোর মধ্য দিয়ে। আদিম স্থাপনা আর ব্যবহৃত বস্তু গুলোতে জ্যামিতিক আকার, আকৃতি, প্রতিসাম্যতা, আনুপাতিক নকশা আর সোনালী অনুপাত বা গোল্ডেন রেশিও বেশ লক্ষণীয়। এমনকি মানব সভ্যতার একদম সূচনা লগ্নে বানানো সবচেয়ে আদি সরঞ্জাম গুলোতেও প্রতিসাম্যতা পাওয়া গেছে । মাটির নীচ থেকে আবিষ্কৃত সবচেয়ে আদিম কুঠার এর আকৃতি প্রতিসাম্য বৃষ্টির ফোঁটার মতন । কুঠারের এই আকার যে খুব কার্যকর তা কিন্তু নয়, তার পরও দীর্ঘ সময় সাপেক্ষ পাথরে পাথর ঘষে কেন  ঠিক এই আকারটাই দেওয়া হতো তা নিয়ে বিজ্ঞানীরা পুরুপুরি নিশ্চিত না হলেও সৌন্দর্য বোধ একটা খুবসম্ভব কারন। এখানে জ্যামেতিক আকার বা অনুপাত মেন চলা বিভিন্ন সময়ের কয়েকটি ঐতিহাসিক নিদর্শনের ছবি দেওয়া হল। 

*প্রতিসাম্যতা: সমান ভাগ্যে ভাগ করা যায় এমন। 

*গোল্ডেন রেশিও : এক ধরনের বিশেষ সর্পিলাকৃতি যা অনেকটা ফিবোনাক্কি ধারা মেনে চলে । 

সৌন্দর্যবোধ এলো কোথা থেকে ?

সৌন্দর্যের সম্ভাব্য উৎপত্তি হয়েছে আদিম মানুষের বিরূপ প্রাকৃতিক পরিবেশে খাপ খাইয়ে নেওয়ার প্রচেষ্টা থেকে । যেই আকার, আকৃতি, রং আর অনুপাতগুলো মানুষের তৈরি সুন্দর শিল্প, স্থাপনা বা বস্তুতে পাওয়া যায় তার সবগুলুই প্রকৃতি থেকে অনুপ্রাণিত । জ্যামিতিক অনুপাত বা  নকশা প্রকৃতিতে অসংখ্য। যেমন, শামুকের খোলসে গোল্ডেন রেশিও , ফুলের পাপড়ি, গাছ , প্রজাপতি, মাছ এমনকি গরু মহিষের শিং এ ও  পাওয়া যায় প্রতিসাম্যতা । এগুলো চিনতে পারা হয়ত আদিম মানুষের জন্য অতি প্রয়োজনীয়  ছিল । প্রতিসম গম গাছ একটা ভাল খাবারের উৎস হলেও আগা বিকৃত গম গাছ থেকে খাবার না জোটার সম্ভাবনাই বেশি, চারকোনা সমান দাঁত ওয়ালা মহিষ নিরাপদ মাংসের উৎস আর অসমান বড় দাঁত ওয়ালা নেকড়ে জীবনের জন্য হুমকি, আকাশের মেঘের রং দেখে বুঝতে পারা বৃষ্টি আসবে কিনা, সমুদ্রের ঢেউয়ের আকার দেখে বুঝতে পারা মাছ ধরা কতটা নিরাপদ; এই ধরনের দক্ষতা গুলো বাড়িয়ে দিয়েছিল আদিম মানুষের বেচে থাকার সম্ভাব্যতা। আকার, আকৃতি, রং বা অনুপাত আদিম মানুষের পরিবেশ যাচাই করার সহজ উপায় দেখিয়েছে, দিয়েছে দ্রুত বিপদ সনাক্ত করার ক্ষমতা । নিরাপত্তা আর পুষ্টির চিহ্ন আমাদের কে ভাল অনুভূতি দেয় । যেই জিনিসগুলো আদিম মানুষকে কে নিরাপত্তা আর পুষ্টির মাধ্যমে বেঁচে থাকতে সাহায্য করেছে সেগুলো মানব মস্তিষ্কের আনন্দ উৎপাদন কেন্দ্রকে বারবার সক্রিয় করে হয়ে গেছে স্থায়ী আনন্দ প্রভাবক। হয়তো আমাদের এই সৌন্দর্য বোধ সেই আকার, রং, অনুপাত বা প্রতিসাম্যতা চেনার দক্ষতা থেকেই বিবর্তিত হয়েছে। 

সৌন্দর্য বোধ কি অন্তর্নিহিত?

সৌন্দর্য বোধ আমাদের অনেক গভীরে পৌঁছে গেছে। এটা এখন আমাদের একটা সহজাত প্রবৃত্তি । অনেক সময় আমাদের মস্তিষ্ক ঠিকঠাক কাজ না করলেও এই বোধ ঠিকই জাগ্রত থাকে । গবেষণায় উঠে এসেছে, আমাদের স্মৃতি শক্তির সাথে সৌন্দর্য চেতনার তেমন কোন সম্পর্ক নেই । ধরুন ছোটবেলায় আপনার কাছে যতগুলো খেলনা ছিল তার মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর লাগতো হাল্কা বাদামি রঙয়ের একটা খেলনা ঘোড়া । তারপর আপনি বড় হলেন , বুড়ো হলেন, তারপর ডিমেনশিয়া হয়ে  সব স্মৃতি ভুলে গেলেন, এমন কি আপনার পরিবারের কাউকে চিনতে পর্যন্ত পারেন না । এ অবস্থায় আপনাকে যদি অনেকগুলো খেলনা ঘোড়া দেখিয়ে জিজ্ঞেস করা হয় এগুলোর মধ্যে কোনটা সবচেয়ে সুন্দর, আপনি কিন্তু ঠিক ঠিক সেই বাদামি রঙের ঘোড়াটাই বের করবেন। যুক্তরাষ্ট্রের স্নায়ু বিজ্ঞানী ড. আন্দ্রেয়া আর তার দল আলঝাইমার রোগীদের উপর এই ধরনের একটা গবেষণা চালান । গবেষণায় এক গ্রুপে সুস্থ মানুষ আর এক গ্রুপে আলঝাইমার রোগীদের নেওয়া হয় । এর পর দুই গ্রুপকেই বিভিন্ন ধরনের পেইন্টিং এর কতগুলো পোস্টকার্ড দিয়ে বলা হয় সৌন্দর্য অনুযায়ী কার্ডগুলো সাজাতে । তারপর দুই সপ্তাহ বিরতি দিয়ে আবার এই কাজটি করতে বলা হল । আলঝাইমার এর রোগীরা ততদিনে সব ভুলে গেছে । কিন্তু দেখা গেল সুস্থ মানুষের গ্রুপ মতন এলঝাইমার রোগীর গ্রুপও সেই কার্ডগুলোকে ঠিক একই ভাবেই সাজাতে পারছে। অর্থাৎ আলঝাইমার রোগী কোন এক অদ্ভুত ভাবে ঠিকই জানেন তার কি পছন্দ বা কি পছন্দ না, যদিও পছন্দের কোন স্মৃতিই তার মধ্যে আর নেই ।  

কেন সৌন্দর্য চাই ?

আমাদের এই বিস্ময়কর সৌন্দর্য প্রবৃত্তি অনেকটা আমাদের অজান্তেই কাজ করে চলছে। সকালে ঘুম থেকে উঠে চায়ের কাঁপে সুর্যের আলোর প্রতিফলন, ইন্সটাগ্রামে দেখা কোন ল্যান্ডস্কেপ ছবি, ফেসবুকে দেখা কারো চেহারা, রাস্তার পাশে জ্বলজ্বল করা একটা ছোট্ট ফুল, বা রাতে ঘরে ফেরার পথে একঝাক আকাশের তারা, এই সব কিছুতেই আমরা সৌন্দর্য খুঁজে পাই । আমাদের জীবনে এই প্রবৃত্তির বিকাশ ঘটানোর বিশেষ প্রয়োজন আছে । আধুনিক যুগে এসে আমরা প্রকৃতি থেকে নিজেদের অনেক দূরে সরিয়ে নিয়ে এসেছি। প্রয়োজনীয়তা, কার্যকারিতা আর অর্থের কথা ভেবে সৌন্দর্যের প্রতি এখন আর কারো খেয়াল নেই। চোখের খুললেই দেখা যায় একই ধরনের সারি সারি একঘেয়ে বিল্ডিং, নিষ্প্রাণ অফিসপাড়া আর এলোমেলো দোকানপাট । গবেষণায় পাওয়া গেছে, এধরনের দৃষ্টির একঘেয়ামী সহজেই মনে বিরক্তি আর অস্বস্থির সঞ্চার করে, এতে বাড়তে পারে মানসিক চাপ আর রক্তচাপ । উল্টো দিকে, সুন্দর বাড়ি বা প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখলে আত্মবিশ্বাস বাড়ে, রক্তচাপ স্বাভাবিক হয় । আমাদের শরীর আর মস্তিষ্ক আমাদের চারপাশের সৌন্দর্যের প্রতি সক্রিয়ভাবে প্রতিক্রিয়া দেখায় । আমাদের আশেপাশের পরিবেশকে যদি আমরা সুন্দর রাখতে পারি তবে সেটা আমাদের মানসিক দক্ষতা আর সৃজনশীলতাকে বাড়িয়ে দেয়। এক জরিপে দেখা গেছে, যেই শহর এর পরিবেশ যত বেশি সুন্দর সেই শহরের মানুষজন তত বেশি সুখী, জীবন নিয়ে তত বেশি তৃপ্ত । আমরা সুন্দরের বিকাশ শুরু করতে পারি নিজের ঘর থেকেই । ঘরটা গুছিয়ে ফেলুন, যেই টেবিলে বসে পরাশুনা করেন সেটা সাজিয়ে ফেলুন দেখবেন আপনার মনোযোগ আর দক্ষতা বেড়ে যাচ্ছে ।

নিঃসন্দেহে সৌন্দর্য বোধ মানুষকে অন্যান্য প্রাণী থেকে অনন্য করেছে । তবে, এই বোধ যে শুধু মানুষেই আছে অন্য প্রাণিতে নেই তা কিন্তু নয় । তাদের এই বোধটা হয়ত অন্য ধরনের। সে বিষয় নিয়ে জানার অনেক কিছু এখনো বাকি । সৌন্দর্য গবেষণায় সামনে যে আরো অনেক নতুন নতুন তাকলাগানো তথ্য পাওয়া যাবে এ অনেকটাই সুনিশ্চিত । 

লেখাটি 249-বার পড়া হয়েছে।

ই-মেইলে গ্রাহক হয়ে যান

আপনার ই-মেইলে চলে যাবে নতুন প্রকাশিত লেখার খবর। দৈনিকের বদলে সাপ্তাহিক বা মাসিক ডাইজেস্ট হিসেবেও পরিবর্তন করতে পারেন সাবস্ক্রাইবের পর ।

Join 908 other subscribers