লার্জ হেড্রন কোলাইডার: একবিংশ শতাব্দীর শুরুতেই বিজ্ঞান জগতে বড় চমক


পৃথিবীর বুকে ক্ষুদ্র বিগব্যাঙ ঘটানোর সফল পরীক্ষা চালিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। এ পরীক্ষার ফলে সৌর কেন্দ্রের চাইতেও দশ লক্ষ গুণ বেশি তাপমাত্রা তৈরি হয় । এ পরীক্ষায় বিজ্ঞানীরা আয়নিত সীসা (লেড) কণার বিপরীতমুখী স্রোতের মধ্যে তীব্র গতিতে সংঘর্ষ ঘটান। এর ফলে প্রায় দশ লক্ষ কোটি ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি তাপমাত্রা সৃষ্টি হয়। তৈরি হয় কোয়ার্ক আর গ্লুয়নের প্লাজমা অবস্থা। এই অবস্থায় তারা পারস্পারিক আকর্ষণ থেকে মুক্ত থাকে। এই প্লাজমা অবস্থাকে পর্যবেক্ষণ করে বিজ্ঞানীরা আশা করছেন তাঁরা সবল বল নিয়ে আরো জানতে পারবেন। কৃত্রিম বিগ ব্যাঙ থেকে মহাবিশ্ব সৃষ্টির ইতিহাস এবং মহাবিশ্ব সৃষ্টির পর এর তাৎক্ষণিক অবস্থা সম্বন্ধে ধারনা লাভ করবেন। এই গবেষণা চালানো হয় লার্জ হেড্রন কোলাইডারে।

Hadron Collider Smashes its First Atoms | The Takeaway | WNYC Studios

হেড্রন বলতে বোঝানো হয় কোয়র্ক দ্বারা গঠিত কণিকা। আর কোলাইডার হচ্ছে যেখানে সংঘর্ষ ঘটানো হয়। লার্জ হেড্রন কোলাইডার হচ্ছে এযাবৎ কালের সবচেয়ে বড় কোলাইডার যেখানে একধিক হেড্রনের মধ্যে সংযর্ষ ঘটানোর মাধ্যমে পরমানুর মধ্যস্থিত অতিসূক্ষ তথ্য সংগ্রহ করা হয়। পরবর্তিতে এ তথ্য বিশ্লেষণ করে পরমানুর অভ্যন্তরীন গঠন তথা এই মহাবিশ্বের গঠন ও উৎপত্তি নির্ণয়ের চেষ্টা করা হয়।

২০০৯ সালে সার্ন কর্তৃক লার্জ হেড্রন কোলাইডার বা খঐঈ নির্মান করা হয়। এর অবস্থান ফ্রান্স ও সুইজারল্যান্ডের সীমান্তবর্তী এলাকায় ভূ-পৃষ্ঠ থেকে ১৭৫ গভীরে একটি ডিম্বাকৃতির সুড়ঙ্গের ভেতর। এই সুড়ঙ্গটি ৩.৮ মিটার চওড়া এবং এর পরিধি ২৭ কিলোমিটার। এই সুড়ঙ্গটিকে পরস্পর বিপরীত দিক থেকে আগত দুটি হেড্রনের (প্রোটন, নিউট্রন, নিউক্লিয়াস প্রভৃতি) মধ্যে সংঘর্ষ ঘটনোর মত উপযোগী করে তৈরি করা হয়েছে। এ কাজের জন্য এতে ব্যবহার করা হয়েছে ১২৩২ টি দ্বিমেরু(dipole) চুম্বক, ৩৯২টি চতুর্মেরু(quadrupole) চুম্বক, ১৬০০ অতিপরিবাহী (superconductor) চুম্বক। গতিশীল কণিকাগুলোকে নির্দিষ্ট পথে ধরে রাখা এবং প্রচন্ড গতির (আলোর গতির কাছাকাছি) সঞ্চার করাই এই চুম্বকগুলোর কাজ। অতিপরিবাহী চুম্বকগুলো খুবই নিন্ম তাপমাত্রায় কাজ করে। এই নিন্ম তাপমাত্রা সৃষ্টির জন্য এতে ব্যবহার করা হয় ৯৬ টন তরল হিলিয়াম। দুই একদিন অন্তর এতে প্রোটন কণিকার প্রবাহ চালিয়ে সচল রাখা হয়। এসময় একেকটি কণিকা এতটা গতি প্রাপ্ত হয় যে সেটি প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ১১০০০ বার সুড়ঙ্গটিকে ঘুরে আসতে পারে। প্রকৃত উচ্চ গতি অর্জনের পূর্বে প্রতিটি কণিকা গুচ্ছকে বিভিন্ন ধাপে ধীরে ধীরে গতি বৃদ্ধি করা হয়। সংঘর্ষের ফলাফল পর্যবেক্ষণের জন্য খঐঈ তে ৬টি ডিটেক্টর রয়েছে। এই ডিটেক্টরগুলো পরমানুর মূল কণিকার অভ্যন্তরীন বিভিন্ন খুঁটিনাটি পরিবর্তন পর্যবেক্ষন করতে পারে।

লার্জ হেড্রন কোলাইডার মূলত তৈরি করা হয়েছে পদার্থ বিজ্ঞানের কিছু মৌলিক সমস্যার উত্তর খোঁজার জন্য। মৌলিক বস্তুকনার মিথষ্ক্রিয়ায় অন্তর্ভূক্ত বলের প্রকৃতি, স্থান ও কালের বিস্তারিত কাঠামো, কোয়ান্টাম মেকানিক্স ও আপেক্ষিকতার মধ্যে সম্পর্ক এ ব্যপারগুলো পদার্থবিদদের কাছে অস্পষ্ট। তাঁরা আশা করছেন, উচ্ছগতির নিউক্লিয়াসের মধ্যে সংঘর্ষের ফলে পূর্বে অনুমিত হিগস বোসন কণিকার উদ্ভব হবে যার ফলে মৌলিক বস্তুকনার মিথষ্ক্রিয়ায় অন্তর্ভূক্ত বলের প্রকৃতি এবং মহাবিশ্ব সম্পর্কে বিভিন্ন রকম অনুমানের সত্যতা নিরূপিত হবে। হিগস্ বোসন হচ্ছে বোসন শ্রেনীর একটি কণিকা। বোসন কণিকাকে পদার্থের মধ্যবর্তী ভরের উপস্থিতির জন্য দায়ী বিবেচনা করা হয় (বোসন কণিকার নামকরণ বাঙালি বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসুর নামানুসারে করা হয়েছে)। হিগস বোসন কণিকার উপস্থিতি সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারলে মৌলিক বলগুলোর মধ্য সম্পর্ক স্থাপন করা সম্ভব হবে যার ফলে মহাবিশ্বের অনেক অজানা তথ্য ও ইতিহাস উদ্ঘটিত হবে।

European physicists boldly take small step toward 100-kilometer-long atom  smasher | Science | AAAS

২০০৮ সালের ১০ই সেপ্টেম্বর প্রথম পরীক্ষাটি চালানো হয়। এই দিন একগুচ্ছ প্রোটন কাণিকাকে সুড়ঙ্গের ভিতর ছুঁড়ে দেয়া হয় এবং তা সফলভাবে সুড়ঙ্গ প্রদক্ষিণ করে। এই পরীক্ষাটি বেশ কয়েকবার করা হয়। ১৯শে সেপ্টেম্বর প্রায় শ’খানের চুম্বকে ত্রুটি দেখা দেয় এবং ৬ টনের মত তরল হিলিয়াম সুড়ঙ্গ থেকে নির্গত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। এর প্রতিক্রিয়ায় খঐঈ অচল হয়ে পড়ে এবং সাময়িকভাবে যাবতীয় কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। ২০০৯ সালেরও প্রায় পুরোটাই এর মেরামতের কাজে চলে যায়। সব ঠিকঠাক করে ২০০৯ এর ৮ই নভেম্বর থেকে ৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত আয়নিত লেড পরমানুর প্রবাহ চালানো হয়। প্রথমে অল্প গতিতে প্রবাহিত করা হলেও ধীরে ধীরে গতি বাড়িয়ে আলোর গতির কাছাকাছি নেওয়া হয়। তখনো পর্যন্ত সংঘর্ষ চালানো হয় নি। ৩০শে মার্চ ২০১০ প্রথম বারের মত দুটি বিপরীতমূখী প্রোটনগুচ্ছের মধ্য সংঘর্ষ ঘটানো হয়। তবে লার্জ হেড্রন কলিডারের পরীক্ষা নিয়ে সাধারন মানুষের মধ্য কিছু ভয় ভীতি কাজ করছে। অনেকের আশংকা উচ্চ গতির সংঘর্ষের ফলে স্থায়ী কৃষ্ঞবিবর তৈরি হতে পারে যা সারা পৃথিবীর ধ্বংসের কারন হতে পারে যদিও সার্নের বিশেষজ্ঞরা এই আশংকা অমূলক বলে পরিত্যগ করেছেন।

অবশেষে গত ৮ই নভেম্বর ২০১০ এ প্রথমবারের মত দুটি লেড আয়নগুচ্ছের মধ্যে সংঘর্ষ ঘটানো হয় যাতে বিগ ব্যাঙ এর কয়েক মাইক্রোসেকেন্ডের মধ্যে সৃষ্ট পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় বলে বিজ্ঞানীরা ধারনা করছেন। এই পরীক্ষায় দশ লক্ষ কোটি ডিগ্রি সেলসিয়াসেরও বেশি তাপমাত্রা সৃষ্ট হয়, যা থেকে বিজ্ঞানীরা ধারনা করেন বিগব্যাঙ এ পরমুহূর্তে মহাবিশ্ব ছিলো উত্তপ্ত তরলের মত। এই পরীক্ষায় প্রাপ্ত তথ্য নিয় এখন বিশ্লেষন চলছে। যা থেকে হয়ত আরো অনেক প্রশ্নের সমাধান পাওয়া যাবে।

LHC কে আরো উন্নত করে পরবর্তী পরীক্ষায় বিজ্ঞানীরা প্রোটন কণিকাকে দীর্ঘদিন প্রায় আলোর গতিতে সংঘর্ষ করাবেন এবং বহুল প্রতীক্ষীত হিগস্ বোসন উদ্ভাবনের চেষ্টা করবেন। একেকটি হিগস পেতে (যদি পাওয়া যায়) কয়েক ঘন্টা সময় লাগতে পারে। সে ক্ষেত্রে দুই বছরের মধ্যে পর্যবেক্ষণ করার মত যথেষ্ট পরিমান কণিকা পাওয়া যাবে। যার ফলে মহাবিশ্বের আরো অনেক অজানা তথ্য বেরিয়ে আসবে।


ইমতিয়াজ আহমেদ Avatar

মন্তব্য

  1. শুভ রহমান Avatar

    ছবি একটি পোস্টকে আগ্রহোদ্দীপক করে তোলে। যেমন ছিলো কাঠ কয়লা নিয়ে পোস্টটি।

    1. imteazahmed Avatar

      ছবিগুলো সামুতে ব্যবহার করলে আশা করি আপত্তি করবে না।

  2. শুভ রহমান Avatar

    ফন্টের এই অবস্থা কেন? আমি ঠিক করতে পারছি না। অনুগ্রহ করে এডিটরে আবার মুল টেক্সট টি কপি পেস্ট করুন। তারপর আমি ফন্টের সাইজ ঠিক করার চেষ্টা করবো।

    1. শুভ রহমান Avatar

      অবশেষে ফন্ট ঠিক করেছি! ওফ, প্রথমে আপনার মূল পোস্টটাই ডিলেট হয়ে গিয়েছিলো! আপনি মেইলে এটাচ করে পাঠিয়েছিলেন বলে রক্ষা!! :০ 🙂
      লেখা ভালো হয়েছে। জরুরী ছিলো এই লেখাটা ব্লগে দেয়া।
      অনুগ্রহ করে এই লেখাটা পড়ুন – কি ভাবে ওয়ার্ডপ্রেসে বাংলা ফন্ট বড় করবেন
      http://madscienceblog.wordpress.com/2009/09/11/how-to-increase-bangla-font-size-in-wordpress-blog-wordpress-tips/

  3. অনামিকা Avatar
    অনামিকা

    ভাইয়া এইসব বুঝি না। কঠিন। সোজা করে লেখেন। নাইলে কিন্তু পড়বো না।

    1. imteazahmed Avatar

      LHC সম্বন্ধে বুঝতে হলে ফিজিক্স এর কিছুটা জ্ঞান থাকা জরুরী। এর চেয়ে সহজ ভাষায় লিখতে গেলে পুরো বিষয়টি অস্পষ্ট হয়ে যেতে পারে। তবে সময় নিয়ে একাধিকবার পড়লে ধীরে ধীরে পুরো ব্যাপারটি পরিষ্কার হয়ে আসবে।

মন্তব্য লিখুন