“কয়লা ধুলে ময়লা যায় না” বলে একটা কথা প্রচলিত আছে। স্পষ্টতই কয়লাকে চরম অবজ্ঞা করে ময়লার সাথে তুলনা করা হয়েছে। কিন্তু প্রকৃত ঘটনা হল এই যে পানির তো কয়লাকে ধোয়ার কোন যোগ্যতা নেইই বরং কয়লা যে পানি দিয়ে ধোয়া হয় সেই পানিটাই পরিস্কার হয়ে যায়!

খুব অদ্ভুত মনে হচ্ছে কি কথাটাকে? ভাবছেন পুরোপুরি উল্টো কথা বলছি? মোটেই না। কাঠকয়লা নিয়ে আজ কিছু কথা বলব। কথাগুলো বলা শেষ হলে আপনি নিজেই বুঝতে পারবেন এতদিন যা শুনেছেন সেটাই বরং উল্টো। সম্প্রতি সারা বিশ্বে কাঠকয়লা নিয়ে এমন আলোড়ন উঠছে যে কাঠকয়লাই হতে পারে মানুষের ভারে ভারাক্রান্ত পৃথিবীর জন্য পরিত্রানের হাতিয়ার।
কাঠকয়লা বহু গুণে গুনান্বিত। তবে এর গুণাগুণ বুঝতে হলে এর গঠন সম্পর্কে কিছুটা অবগত হওয়া জরুরী। আমরা সবাই জানি কাঠকয়লা পাওয়া যায় কাঠ থেকে। কাঠ পোড়ালে কয়লা হয়ে যায়। কয়লাকে পোড়ানো হলে সেটা ছাইয়ে পরিণত হয়। অর্থাৎ কাঠের অসম্পূর্ণ দহনে কয়লা পাওয়া যেতে পারে। কাঠ মূলত সেলুলোজ। সেলুলোজ হল কার্বন, অক্সিজেন এবং হাইড্রোজেনের সংযোগে তৈরি একধরনের লম্বা চেইন বিশিষ্ট পলিমার। কয়লা মূলত কার্বন। সেলুলোজকে যখন বাতাসে পোড়ানো হয় তখন সেলুলোজের কার্বন ও হাইড্রোজেন বাতাসের অক্সিজেনের সাথে বিক্রিয়া করে কার্বন-ডাই অক্সাইড ও পানি তৈরি করে উড়ে চলে যায়। সেলুলোজকে পুরোপুরি পুড়তে দেয়া না হলে তার বেশ খানিকটা কার্বন রয়ে যায় এবং সেটাই আমরা কয়লা হিসেবে পাই। কাঠ এমনিতেই বেশ ফাঁপা। কাঠের ফাঁক-ফোকর গুলো এত ছোট যে সেগুলোকে আলাদাভাবে বোঝা যায় না। সেটাকে পুড়িয়ে কয়লায় পরিণত করা হলে আরো ফাঁপা হয়ে যায়। খনি থেকে উত্তোলিত কয়লা এবং কাঠকয়লার মধ্যে এটা একটা উল্ল্যেখযোগ্য পার্থক্য। খনি থেকে উত্তোলিত কয়লা ফাঁপা হয়না। আর ফাঁপা হওয়ার কারনেই কাঠকয়লা অর্জন করেছে কিছু মনিমান্বিত গুণ।
একটা বস্তকে যতই ভাঙ্গা হয় ততই তার আয়তনের তুলনায় পৃষ্ঠতলের পরিমান বাড়তে থাকে। উদাহরন স্বরূপ, একটা ইটে ছয়টি তল থাকে এবং সেই ছয়টি তলের একটি নির্দিষ্ট ক্ষেত্রফল থাকে। যদি ইটটিকে মাঝ বরাবর ভাঙ্গা হয় তাহলে তার আয়তন একই থাকে কিন্তু ভাঙ্গা অংশে দুটি নতুন তল সৃষ্টি হয়ে পৃষ্ঠতলের ক্ষেত্রফল বাড়িয়ে দেয়। এভাবে যতবার ভাঙ্গা হবে ততবারই নতুন নতুন পৃষ্ঠ তৈরি হবে এবং ক্ষেত্রফল বাড়তে থাকবে। নিচের ছবিটি একটু মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করুন।
কাঠকয়লার ভেতরটা যেহেতু অনেক ছোট ছোট ছিদ্র যুক্ত সেহেতু এর পৃষ্ঠতলের ক্ষেত্রফল অত্যাধিক বেশী থাকে। বিরক্ত হবেনা দয়া করে। এই কথাগুলো বলার প্রয়োজন ছিলো। এবার বলছি কাঠকয়লার আসল ক্ষমতা কি। সেটা হলো কাঠকয়লার পরিশোষন প্রবণতা। কাঠকয়লা নানাবিধ রাসায়নিক পদার্থকে এর পৃষ্ঠে শোষণ করতে পারে। আর অল্প জায়গার মধ্যে যেহেতু অনেকটা পৃষ্ঠ থাকে সেকারনে ছোট একটুকরো কয়লার শোষন ক্ষমতাও থাকে অনেক বেশী। নানাবিধ প্রক্রিয়াকরনের মাধ্যমে এই পৃষ্ঠতল তথা পরিশোষন ক্ষমতা অনেক বাড়ানো যেতে পারে। এই প্রক্রিয়াকৃত কয়লাকে বলা হয় ‘অ্যাক্টিভেটেড কার্বন’ । এক পাউন্ড অ্যাক্টিভেটেড কার্বনে প্রায় এক একর পরিশোষনক্ষম পৃষ্ঠ থাকতে পারে!
অ্যাক্টিভেটেড কার্বনকে মানব কল্যাণে বহুবিধ পদ্ধতিতে ব্যবহার করা যায়। মাটিতে এই কার্বন মিশিয়ে মাটির উর্বরতা বহুগুণ বাড়ানো যায়। এ প্রসঙ্গে বলা যেতে পারে, আমাজন এলাকা পৃথিবীর সবচেয়ে উর্বর শস্যক্ষেত্র হিসেবে সুপরিচিত। একারনে আমাজন নদী-তটের কালো মাটিকে ‘কালো সোনা’ নামে ডাকা হয়। সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা আমাজন তটের উর্বরতার রহস্য বের করেছেন। তাঁরা জানতে পেরেছেন প্রায় ১৫০০ বছর আগে আমাজনের চাষীরা মাটিতে প্রাণী ও উদ্ভিদ পোড়ানো কয়লা মিশিয়ে চাষ করতেন যার ফলে আজ এত বছর পরও এই জমির মাটি এতটা উর্বর! কাঠকয়লার রয়েছে জমির উর্বরতা বৃদ্ধির এক অভাবনীয় ক্ষমতা যা হাজার হাজার বছর স্থায়ী হতে পারে। গবেষকরা দেখেছেন মাটিতে মাত্র ১% কয়লা মেশালেই মাটির উর্বরতা উল্ল্যেখযোগ্য পরিমান বৃদ্ধি পায়। বেশ কিছু উপকারী ব্যাক্টেরিয়া কার্বন পৃষ্ঠে দ্রুত বংশবিস্তার করার মাধ্যমে উর্বরা শক্তি বাড়িয়ে থাকে। মাটিতে কয়লা মিশিয়ে এভাবে জৈব উপাদান বৃদ্ধি করা যেতে পারে। এছাড়াও, জমিতে ব্যবহৃত রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ক্ষতিকর প্রভাব কয়লার মাধ্যমে দূর করা সম্ভব। কয়লা মাটি ও পানি থেকে অতিরিক্ত কীটনাশক শুষে নিয়ে পরিবেশ রক্ষায় বিশাল ভূমিকা রাখতে পারে। শুধু তাই নয়, মাটিতে কার্বন ব্যবহার করলে তা বাতাস থেকে কার্বন ডাইঅক্সাইড শোষন করে নিতে পারে ২৩% পর্যন্ত। এই কার্বন-ডাইঅক্সাইডই গ্রীন হাউস ইফেক্টের মাধ্যমে পরিবেশের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। অদূর ভবিষ্যতে বর্ধিত জনগোষ্ঠীর খাদ্য যোগানো ও পরিবেশ রক্ষায় আমাদের হয়তো কয়লার উপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল হতে হবে।
অ্যাক্টিভেটেড কার্বনের আছে কার্যকর পানি শোধন ক্ষমতা। এটা পানি থেকে যাবতীয় দূষনকারী পদার্থ শোষন করে নিতে পারে। এটাকে ফিল্টার হিসেবে ব্যবহার করে পানি থেকে ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ এবং জীবানু দূর করা যেতে পারে। এর মাধ্যমে সারা পৃথিবী জুড়ে বিশুদ্ধ পানির অভাব দূর করা সম্ভব। যুদ্ধ ক্ষেত্রে সৈন্যরা পানির উৎস হিসেবে যে life saver bottle ব্যবহার করে তাতে বিশুদ্ধকারক হিসেবে অ্যাক্টিভেটেড কার্বন থাকে।
কাঠকয়লা পশু খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা যায়। গবেষনায় দেখা গেছে বাঁশ থেকে উৎপন্ন কাঠকয়লা গবাদি পশুর খাদ্যের সাথে ১-২% মিশিয়ে খাওয়ানো হলে পশুর স্বাস্থ্যের উন্নতি হয় এবং সেই সাথে দুধ ও মাংসের উৎপাদন বাড়ে। এছাড়া গবাদি পশুর বেশ কিছু রোগ-বালাই ও এর মাধ্যমে প্রতিরোধ করা যায়।
রোগমুক্তির ক্ষেত্রে কাঠকয়লার রয়েছে বিশেষ কিছু ক্ষমতা। বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসায় অ্যাক্টিভেটেড কার্বন ব্যবহার করা যেতে পারে। তাৎক্ষনিক ভাবে বিষাক্রান্ত ব্যাক্তিকে অ্যাক্টিভেটেড কার্বনের মাধ্যমে পাকস্থলি থেকে যাবতীয় বিষ শুষে নিয়ে বিষমুক্ত করা যায়। এক গবেষণায় দেখা গেছে কাঠকয়লা মানবদেহের কোলেস্টেরল কমাতে সাহায্য করে। এছাড়া অন্ত্রের এসিডিটি কমাতে, মাতলামি রোধে, গর্ভাবস্থায় কোলেস্টোসিস রোধে, কাটা-ছেঁড়ায় সংক্রমন রোধে, ব্যাথা উপশমে, রক্ত পরিশোধনে ও কাঠকয়লার ভুমিকা রয়েছে বলে কিছু গবেষণায় দেখা গেছে। তবে এসব ব্যাপারে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরী। সবরকমের বিষক্রিয়ায় এই ব্যবস্থা কাজে নাও আসতে পারে। তাই স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে কিছু করা ঠিক হবে না।

গবেষনাগারে ও শিল্পকারখানায় অ্যাক্টিভেটেড কার্বনের রয়েছে বহুবিধ ব্যবহার। এটা বিভিন্ন রকম জৈব যৌগ, পিগমেন্ট এবং অন্যান্য রাসায়নিক পদার্থ বিশুদ্ধিকরনে ব্যবহার করা হয়। কিছু কিছু রাসায়নিক বিক্রিয়ায় প্রভাবক হিসেবেও অ্যাক্টিভেটেড কার্বন ব্যবহৃত হয়।
কাঠকয়লা দিয়ে পেন্সিল, কালি, রং প্রভৃতি শিক্ষা উপকরনসহ বিভিন্ন চিত্রাংকন সামগ্রী প্রস্তুত করা হয়।

সম্প্রতি বাতাস বিশুদ্ধকরনের ক্ষেত্রে কাঠকয়লার জনপ্রিয়তা ব্যপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। কাঠকয়লা শুধু বাতাস থেকে ছোট ছোট ধূলিকণাই দূর করে না বরং দূর্গন্ধও দূর করে অত্যন্ত কার্যকর ভাবে। কল-কারখানার চিমনিতে সঠিক পদ্ধতিতে কাঠকয়লা ব্যবহার করে পরিবেশ দূষন রোধে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া যায়।
একথা বলা যেতে পারে যে, একবিংশ শতাব্দীতে মানবসৃষ্ট বিপর্যয় থেকে কাঠকয়লা আমাদের অনেকাংশে সুরক্ষা দিতে পারে। কাঠকয়লা নিয়ে আরো প্রচুর গবেষণা হওয়া জরুরী। কাঠকয়লা অত্যন্ত সহজলভ্য পদার্থ। এর যথাযথ ব্যবহারে আমাদের দেশ সহ সারা পৃথিবীর মানুষ উপকৃত হতে পারে। সারা পৃথিবী জুড়েই এখন বড় বড় সমস্যা বিশুদ্ধ পানি, বাতাস, পরিবেশ, খাদ্য নিরাপত্তা সবকিছুই কাঠকয়লার যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে সমাধান করা সম্ভবপর হতে পারে। আমাদেশ দেশে এই সমস্যাগুলো আরো প্রকট। আশা করব এসব ব্যপারে আমাদের সবার খুব শিঘ্রই বোধোদয় হবে।
Leave a Reply