২০১০। এ বছরটিকে অনায়াসে বিজ্ঞানের অগ্রগতির বছর বলা যেতে পারে। কারন ২০১০ এর পুরো বছরটাই ছিলো বিজ্ঞানের জগতে ঘটনাবহুল। এ বছর ইতিহাসে স্থান করে নেওয়ার মত বেশ কিছু আবিষ্কার যেমন হয়েছে তেমনি নতুন নতুন প্রশ্ন ও চ্যালেন্জের মুখোমুখিও দাঁড় করিয়ে দিয়েছে আমাদেরকে। আমাদের দেশের বিজ্ঞানীরাও এ বছর প্রচুর অবদান রেখেছেন। বিগত বছরের এমনই কিছু গুরুত্বপূর্ণ ও তাক লাগানো আবিষ্কার ও ঘটনা নিয়ে আজকের আয়োজন।
১. কৃত্রিম প্রাণ আবিষ্কার: কৃত্রিম প্রাণ আবিষ্কারের ঘটনাটি একাই হুলস্থূল ফেলে দেবার জন্য যথেষ্ট। মে মাসে বিজ্ঞানী ক্রেইগ ভেন্টর ও তার সহকর্মীরা প্রথমবারের মত নিজে নিজে বংশবৃদ্ধির করতে পারে এমন ক্ষমতা সম্পন্ন কোষ তৈরি করে সাড়া ফেলে দেন। তাঁরা ল্যাবরেটরীতে কৃত্রিমভাবে একটি পূর্ণাঙ্গ ব্যক্টেরিয়া ডি.এন.এ তৈরি করে সেটি অন্য একটি ব্যক্টেরিয়ার কোষ দেহে প্রবেশ করিয়ে দেন এবং লক্ষ্য করেন ব্যক্টেরিয়াটি সংখ্যায় বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং তাঁদের উদ্ভাবিত ডি.এন.এ টি এক প্রজন্ম থেকে বংশ বৃদ্ধির মাধ্যমে অন্য প্রজন্মে গমন করছে।
২. লেড আয়ন সংঘর্ষ: সার্নের বিজ্ঞানীরা নভেম্বর মাসে প্রথমবারের মত দুটি লেড বা সীসার আয়নের ঝাঁকের মধ্যে সংঘর্ষ ঘটাতে সক্ষম হন। এই সংঘর্ষের ফলে বিগ ব্যাং এর পরবর্তী অতি ক্ষুদ্র সময়ের (এক সেকেন্ডের বিলিয়ন বিলিয়ন বিলিয়ন ভাগের এক ভাগ) মধ্যে মহাবিশ্বের অবস্থা কেমন ছিল সেই সম্বন্ধে ধারনা লাভ করেন। যদিও এই পরীক্ষার প্রধান উদ্দেশ্য ছিলো সংঘর্ষের মাধ্যমে পরমানুর মূল কণিকা হিগস বোসন উদ্ভাবন। হিগস না পাওয়া গেলেও এ পরীক্ষা থেকে প্রাপ্তিও কম নয়। তাছাড়া এই পরীক্ষারই ধারাবাহিকতায় এ বছর আরো কিছু পরীক্ষা চালানোর সুযোগ তৈরি হয়েছে।
৩. এন্টি-ম্যাটার তৈরি: এ বছরই প্রথমবারের মত এন্টি ম্যাটার বা প্রতি পদার্থ তৈরি ও সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়েছে। এন্টি-ম্যাটার হলো স্বাভাবিক পদার্থের বিপরীত বস্তু, যা সমপরিমান স্বাভাবিক পদার্থের সংস্পর্শে এলে উভয়েই বিলুপ্ত হয়ে যায় এবং বিপুল পরিমান শক্তি উৎপন্ন হয়। ধারনা করা হয় মহবিশ্ব সৃষ্টির প্রথম দিকে পদার্থ ও প্রতি-পদার্থ তৈরি হয়েছিলো। এর মধ্যে প্রতি-পদার্থ, পদার্থের সংস্পর্শে এসে সম্পূর্ণ নিশ্চিন্হ হয়ে যায়, কিন্তু স্বাভাবিক বা দৃশ্যমান পদার্থ কিছুটা বেশী তৈরি হওয়ায় সেই অতিরিক্ত পদার্থ ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পায় এবং সমগ্র মহাবিশ্ব তৈরি করে।
৪. প্রাণের উদ্ভবকালীন পরিবেশ: বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন প্রাণের উদ্ভব ঘটেছিলো বিষাক্ত আর্সেনিকের উপস্থিতিতে। শুধু তাই নয় প্রথম দিকে জীবের বংশবৃদ্ধিও হয়েছিলো আর্সেনিকের সহায়তায়। জীবের শক্তি উৎপাদনে ফরফরাস একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বস্তু। বর্তমানে সকল জীবদেহে শক্তি উৎপাদনে ফসফরাস অপরিহার্য। আর্সেনিক, ফসফরাসেরই সমগোত্রীয় একটি পদার্থ যা সৃষ্টির শুরুতে ফসফরাসের বিকল্পরূপে জীবদেহে আবির্ভূত হয়।
৫. কৃত্রিম ফুসফুস ও কিডনী: কৃত্রিম অঙ্গ তৈরি ও সংযোজন এখনো সায়েন্স ফিকশনের বিষয় হলেও এবছর এ বিষয়ে খুব বড় অগ্রগতি হয়েছে। গবেষকরা ইঁদুরের ফুসফুসের প্রায় ৯৫% কাজ করতে সক্ষম একটি ফুসফুস কৃত্রিমভাবে তৈরি করতে সক্ষম হন। তাঁরা আশা করছেন খুব শিঘ্রই মানুষের দেহে প্রতিস্থাপনের উপযোগী ফুসফুস তৈরি করতে পারবেন। বিশেষ করে ফুসফুসের ক্যন্সারে আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য কৃত্রিম ফুসফুস অত্যন্ত সহায়ক হবে। অপর দিকে কৃত্রিম কিডনী আবিষ্কার করেছেন বাংলাদেশি বিজ্ঞানী শুভ রায়। তাঁর মতে কৃত্রিম কিডনি আসল অঙ্গের মতোই কাজ করতে সক্ষম৷ অর্থাৎ রক্তের বিষাক্ত পদার্থ ছাঁকা থেকে শুরু করে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ ও ভিটামিন ডি তৈরি, সব কাজই করতে পারবে এই কৃত্রিম কিডনি। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি ও তাঁর আরো চল্লিশজন সহকর্মী কৃত্রিম কিডনী তৈরিতে অংশ নেন।
৬. ম্যালেরিয়া প্রতিরোধক মশা: যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক মশার মধ্যে ম্যালেরিয়া প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করেছেন। এই মশা ম্যালেরিয়া ছড়ানোতো বন্ধ করবেই, নিজেরা এই জীবানুর বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহন করবে। এ মশা পরিবেশে ছেড়ে দেওয়া হলে তা অন্যান্য রোগ সৃষ্টিকারী মশার চেয়ে বেশী প্রতিরোধক্ষম হবে। ফলে কয়েক বছরের মধ্য এই মশা অন্য মশাগুলোর স্থান দখল করে ফেলবে। প্রতি বছর লাখ লাখ মানুষ ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়। এ ধরনের মশা ম্যালেরিয়া প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা রাখবে বলে গবেষকরা আশা করছেন।
৭. পরিবেশ বান্ধব নবায়নযোগ্য শক্তি: নবায়নযোগ্য শক্তি উৎপাদন ও ব্যবহার উপযোগী করায় ২০১০ সালে বেশ কিছু অগ্রগতি লক্ষ্য করা গেছে। বাংলাদেশের বিজ্ঞানী ড. জামাল উদ্দিন সবচেয়ে বেশী হারে রূপান্তরযোগ্য সৌর কোষ আবিষ্কার করেছেন। তার উদ্ভাবিত কোষ ৪৩.৪% সূর্যালোককে বিদ্যুতে রূপান্তরিত করতে পারে। এর আগে এই হার ছিলো ৩০% এর কাছাকাছি। এছাড়াও এ বছর শক্তি উৎপাদনে প্রচুর নতুন নতুন প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা হয়েছে। এবছরই প্রথম সৌর চালিত উড়োজাহাজ তৈরি হয়েছে যা একটানা ২৭ঘন্টা আকাশে উড়েছে। পাশাপাশি বিশ্বজুড়ে বড় বড় শহর ও স্থাপনায় সৌর, বায়ু, সমুদ্রস্রোত, এবং আবর্জনা ব্যবহার করে নতুন নতুন শক্তি উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে।
এসব ছাড়াও উল্ল্যেখ করার মত আরো অনেক আবিষ্কার ১০১০ সালে হয়েছে। জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে; শনি গ্রহের উপগ্রহ টাইটানে বরফের আগ্নেয়গিরি ও অপর একটি উপগ্রহে তরল পানি আবিষ্কৃত হয়েছে। ছায়াপথের বিশাল অংশ জুড়ে জায়ান্ট বাবল, মহাশূণ্যে মহা-আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরন, দ্বি-নাক্ষত্রিক সৌরজগৎ ব্যবস্থার অস্থিতিশীলতা (যে সব সৌরজগৎ দুটি তারা নিয়ে গঠিত সেসব ব্যবস্থায় গ্রহগুলোর মধ্যে সংঘর্ষ হবে, কিংবা গ্রহগুলোর পরিবেশে এত দ্রূত পরিবর্তন ঘটবে যে সেখানে প্রাণের উদ্ভব হওয়া সম্ভব হবে না) এবং কিছু কিছু নক্ষত্রের ভর পূর্বের চেয়ে আরো যথার্থ ভাবে পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে। পরিবহন ও প্রযুক্তিগত দিক থেকে প্রচুর আবিষ্কার রয়েছে যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো বৈদ্যুতিক গাড়ি, জেটপ্যাক, স্ট্র্যাডেলিং বাস, শিক্ষাদানকারী রোবট, স্মার্টফোন, থ্রিডি টিভি প্রভৃতি। চিকিৎসা ক্ষেত্রে কিছু বড় অগ্রগতির কথা পূর্বে আলোচনা করা হয়েছে। তাছাড়া হাঁটা-চলায় অক্ষম ব্যক্তিদের জন্য ই-লেগ তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশের বিজ্ঞানী ড. মাকুসুদুল আলম আরো কিছু বাংলাদেশী বিজ্ঞানীর সাথে মিলে পাটের জিনোম সিকোয়েন্স আবিষ্কার করেছেন।
স্থানাভাবে আরো অনেক আবিষ্কারের কথা আলোচনা করা গেলো না। এদের মধ্যে অনেকগুলো হয়তো এ বছর ব্যপক সাড়া তৈরি করবে। আশা করি এ বছর বিজ্ঞান আমাদের আরো অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যাবে আর গত বছরের মত এ বছরও আমাদের দেশের বিজ্ঞানীরা সারা পৃথিবীজুড়ে আলোচিত হবেন। বিজ্ঞানের অগ্রগতি এবং মানব কল্যানে এর প্রয়োগ কামনা করে আজকের আলোচনা এখানেই শেষ করছি।
(লেখাটি খবর-দার বিজ্ঞান ত্রৈমাসিক জানুয়ারি সংখ্যায় এবং লেখকের ব্যক্তিগত ব্লগে প্রকাশিত।)
Leave a Reply