সামুদ্রিক জঞ্জাল: আমাদের করণীয়

আমাদের নিত্যব্যবহার্য দ্রব্যাদি যেগুলো আবর্জনা হিসেবে সমুদ্রে কিংবা বিশাল জলাশয়ে আশ্রয় করে নেয় সেগুলোই সামুদ্রিক আবর্জনা নামে পরিচিত। বিভিন্ন ভাবে মানব সৃষ্ট এই জঞ্জালগুলো জলাশয়ে যেতে পারে। সমুদ্রসৈকতে কিংবা নৌকা থেকে ছুড়ে দেয়া আবর্জনার মাধ্যমে, সামুদ্রিক স্থাপনা থেকে, ঘুর্ণঝড়ের তান্ডব থেকে সৃষ্ট ধ্বংসস্তুপের মাধ্যমে, নদী বা খালের মাধ্যমে বাহিত হয়েও জঞ্জাল জমতে পারে। মাঝে মাঝে বাতাসের মাধ্যমেও হালকা ও অপচনশীল বস্তু উড়ে গিয়ে জলাশয়ে পড়তে পারে।

সামুদ্রিক জঞ্জালের একটা বিরাট অংশ প্লাস্টিকের আবর্জনা। এছাড়া আছে কাচের তৈরি বোতল ও অন্যান্য সরঞ্জাম, অ্যালুমিনিয়াম ও ধাতব কৌটা প্রভৃতি। প্লাস্টিকের আবর্জনা সামুদ্রিক পরিবেশের নানা ভাবে ক্ষতি করে থাকে। এই বস্তুগুলো সাধারণত পচনশীল নয় এবং দীর্ঘদিন ধরে ক্রমান্বয়ে জমে জমে সমুদ্রের জঞ্জালের পরিমান বৃদ্ধি করে। প্লাস্টিকের ব্যাগগুলো দ্বারা সামুদ্রিক কচ্ছপ জাতীয় প্রাণীগুলো বিভ্রান্ত হয়। সেগুলোকে তারা অনেক সময় জেলীফিস মনে করে এবং খেয়ে ফেলে। তাছাড়া প্লাস্টিকের তৈরি বিভিন্ন ফিতা, রিং জাতীয় বস্তুতে সামুদ্রিক পাখি ও অন্যান্য প্রানী জড়িয়ে গিয়ে মারা যায়।

হাওয়াই উপকূলে জমে থাকা জঞ্জাল

বর্তমানে তথাকথিত যেই পচনশীল প্লাস্টিক পাওয়া যায় সেগুলোও সমুদ্রের পানিতে অনেক সময় পচে না, কারন এগুলোর পচার জন্য অপেক্ষাকৃত উচ্চতাপমাত্রা প্রয়োজন। সামুদ্রিক পানি অপেক্ষাকৃত শীতল হওয়ায় এগুলো সাধারণত অপচনশীল অবস্থায় থেকে যায়। বরং এই প্লাস্টিক পণ্যগুলো ছোট ছোট কণায় বিভক্ত হয়ে যায় যেগুলো আকারে ০.৩ থেকে ৫ মিলিমিটার হয়ে থাকে।এই ছোট প্লাস্টিক কণাগুলোকে শস্য মনে করে অনেক সামুদ্রিক প্রাণী খেয়ে ফেলে ফলে তারা পুস্টি থেকে বঞ্চিত হয়। পানির উপরিপৃষ্ঠে ভাসমান থাকা অবস্থায় এই প্লাস্টিক কণিকাগুলো সুর্যালোক প্রবেশে বাধা দেয় ফলস্রুতিতে সামাদ্রিক শৈবাল উৎপাদনে বাধা সৃষ্টি হয়। সামুদ্রিক শৈবাল সমুদ্রের বাস্তুসংস্থানের অত্যাবশ্যকীয় উপাদান।

এছাড়া প্লাস্টিক যখন ভাঙতে ভাঙতে ছোট হতে থাকে তখন এরা বিভিন্ন প্রকার রাসায়নিক বস্তু পানিতে ছাড়তে থাকে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল বিসফেনল এ (BPA). বিসফেনল এ প্রানী দেহের প্রজননতন্ত্রের ক্ষতিসাধন করে এবং স্বাভাবিক বংশবৃদ্ধিতে বাধা সৃষ্টি করে।কয়েক প্রজন্মে বিসফেনল এ এর প্রভাবে ভায়াবহ সমস্যা তৈরি হতে পারে। এর প্রভাবে মাছের উৎপাদন বহুলাংশে হ্রাস পেতে পারে যা সামুদ্রিক বাস্তুসংস্থানের পাশাপাশি মানুষের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডেও প্রভাব তৈরি করবে।

পরিত্যাক্ত জালে জড়িয়ে যাওয়া কচ্ছপ

সামুদ্রিক জঞ্জালের আরেকটি বড় উৎস মাছ ধরার সরঞ্জামাদি। এর মধ্যে অন্যতম মাছধরার জাল এবং বিভিন্ন রকমের দড়ি যেগুলো পরিত্যক্ত অবস্থায়ও মাছ এবং অন্যান্য প্রাণী আটকে ফেলে সামুদ্রিক প্রাণের সংখ্যা কমিয়ে দিচ্ছে। এমনকি সামুদ্রিক পাখিরাও এইসব জাল থেকে মুক্ত নয়।

জঞ্জালে আটকে মৃত সামুদ্রিক পাখি এলবাট্রস

সামুদ্রিক জঞ্জালসমূহের জড়ো হওয়ার প্রবণতা সবচেয়ে বেশী থাকে ঘুর্ণীস্রোত এলাকায়। এই স্রোতগুলো সাধারণত তৈরি হয় বায়ুপ্রবাহ এবং পৃথিবীর ঘুর্ণনের কারনে। এই স্রোতের তাড়নায় জঞ্জালসমূহ এই ঘুর্নীগুলোর কেন্দ্রবিন্দুতে পৌঁছায়। যেকোনো ঘুর্ণীর কেন্দ্রে প্রবলতা সবচেয়ে কম থাকে এবং এই কারনে কেন্দ্রে গিয়ে এই অবর্জনাসমূহ স্থিতিশীল হয়। একেকটি ঘুর্ণীর কেন্দ্রতে অবস্থিত এই জঞ্জালের সংগ্রহকে বলা যায় জঞ্জাল স্তুপ (garbage patch)। সারা বিশ্বের সমুদ্রগুলোতে এই রকম বেশ কিছু জঞ্জালস্তুপ সনাক্ত করা হয়েছে। এই স্তুপগুলো কিন্তু শুধুমাত্র ভাসমান বিভিন্ন পরিত্যাক্ত সরঞ্জামাদিই নয় বরং এদের এক বিরাট অংশই হচ্ছে শস্যদানার মত ক্ষুদ্রাকৃতির প্লাস্টিকের কণা যেগুলো অনেকসময় খালি চোখে দেখা যায় না। সমুদ্রিক জঞ্জালের মোট পরিমান কতটা হতে পারে তা এখনো সনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। এমনকি কৃত্রিম উপগ্রহের মাধ্যমেও খুব ভালোভাবে এই জঞ্জালগুলোর ছবি নেওয়া যায় না। তাছাড়া সব জঞ্জাল ভাসমান অবস্থাতেও থাকে না।

আমাদের করণীয়:

সামুদ্রিক জঞ্জাল পরিষ্কার করা খুব সহজসাধ্য কাজ নয়। আগেই যেমনটা উল্ল্যেখ করা হয়েছে, জঞ্জালসমূহের একটি বিরাট অংশ হল অতিক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণা। এই ধরনের বস্তু একটা বিশাল এলাকা থেকে ছেঁকে তোলা দুঃসাধ্য কাজ। তাছাড়া এভাবে ছাঁকতে গেলে জঞ্জালের সাথে অনেক সামুদ্রিক প্রাণেরও বিনাশ ঘটবে যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। এছাড়া যদিও বা জঞ্জাল পরিষ্কার করার মতো ‘ছাঁকনি’ তৈরি করা যায় তথাপি এই পদ্ধতিতে যে সময়ের প্রয়োজন হবে তা বাস্তবসম্মত নয়। তাছাড়া যে জঞ্জালসমূহ সমুদ্রের গভীরে চলে গেছে সেগুলো এভাবে কখনোই তোলা যাবে না।

এসব সমস্যার কারনে পরিবেশবিদগণ সমুদ্রে জঞ্জাল নিষ্কাশনে প্রতিরোধের উপর গুরুত্ব দিচ্ছেন, এতে করে ইতিমধ্যেই যে পরিমান জঞ্জাল ডাম্পিং করা হয়েছে তা হয়তো তোলা যাবে না কিন্তু আরো বেশী জঞ্জাল যাতে করে সমুদ্রে না যেতে পারে সেই ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এই নিমিত্তে পরিবেশবাদী সংগঠন, গবেষকগণ কাজ করে যাচ্ছেন। তাঁরা সাধারণ মানুষকে সচেতন করার পাশাপাশি জঞ্জাল প্রতিরোধে আইন প্রণয়নের জন্য বিভিন্ন দেশের সরকারগুলোকে প্রভাবিত করার জন্য প্রচারনা চালিয়ে যাচ্ছেন।

এই সমস্যা সমাধান করার জন্য প্রত্যেকটি মানুষকে ব্যক্তিগত ভাবে এগিয়ে আসতে হবে। ব্যক্তিগত সচেতনতা ছাড়া শুধু আইন প্রণয়নের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করা যাবে না। আমরা যখন সমুদ্র সৈকতে বেড়াতে যাব তখন কিছুই ফেলে আসব না, কিংবা নৌকা থেকে কিছুই ফেলব না এই মানসিকতাটুকু মনে লালন করতে হবে। তাছাড়া মনে রাখতে হবে ভুমিতে থাকা অবস্থায়ও যথাযথা ভাবে আবর্জনা ডাম্পিং না করলে তা ফলশ্রুতিতে সমুদ্রে গিয়ে পড়তে পারে। এর বাইরেও আরেকটি বিষয় মেনে চলতে হবে যেটি বর্তমান বিশ্বে বেশ আলোচিত ও সমাদ্রিত। তা হচ্ছে 3R: reduce, reuse, recycle. অর্থাৎ যতটা সম্ভব ব্যবহার কমনো, একই জিনিসের বারংবার ব্যবহার এবং ব্যাবহার অযোগ্য জিনিস থেকে পুণরুৎপাদন। এটা শুধু সামুদ্রিক জঞ্জালের ক্ষেত্রে নয় বরং সারা পৃথিবীর পরিবেশগত সুস্থতার জন্য অপরিহার্য। পৃথিবীকে আরো দুই-এক প্রজন্মের জন্য বাসযোগ্য রাখতে হলে এর কোনো বিকল্প নেই।

ইমতিয়াজ আহমেদ
পোস্টডক্টরাল গবেষক: Green Nanomaterials Research Center Kyungpook National University Republic of Korea.