পরমাণুর আভ্যন্তরীন মহাবিশ্বে ভ্রমণ-১৯

internet connection school technology
Photo by Tara Winstead on Pexels.com

অধ্যায়-৪ : নিউক্লিয়াস

অনুচ্ছেদ-২: ধনাত্মক চার্জযুক্ত কণিকা
নিউক্লিয়াস একটি পরমাণুর মোট ভরের শতকরা ৯৯.৯৪৫ ভাগ থেকে ৯৯.৯৭৫ ভাগ ধারন করে। এই কারনে নিউক্লিয়াস নিয়ে গবেষণা করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রকৃতপক্ষে, আপনি বলতে পারেন নিউক্লিয়াসই হলো আসলে পরমাণু। ঊনিশ শতকে পরমাণু সম্বন্ধে ভাবা হতো যে এর প্রায় সম্পূর্ণই ফাঁকা; কিংবা এর অভ্যন্তরভাব অত্যন্ত অকিঞ্চিৎকর ইলেক্ট্রন কণা/তরঙ্গ দিয়ে পূর্ণ। নিউক্লিয়াসই হয়তোবা সেই ক্ষুদ্র, গোলাকার এবং প্রকৃত বস্তু যা লুসিপ্পাস এবং ডোমোক্রিটাস কল্পনা করেছিলেন। বিশাল ভরযুক্ততা সত্ত্বেও নিউক্লিয়াসের আকার অত্যন্ত ক্ষূদ্র এবং তা হচ্ছে একটি পরমাণুর ব্যাসের একলক্ষ ভাগের একভাগ। এই কারনে একে ইলেক্ট্রনের মতোই পরমাণুর আভ্যন্তরীন একটি কণিকা হিসেবেই ধরা হয়।
নিউক্লিয়াসে অবশ্যই ধনাত্মক চার্জ থাকতে হবে এবং এর পরিমান হতে হবে একটি নির্দিষ্ট পরমাণুতে প্রাপ্ত সবগুলো ইলেক্ট্রনের ঋনত্মক চার্জকে প্রশমিত করার মতো যথেষ্ট। অবশ্য ধনাত্মক চার্জযুক্ত পরমাণুর আভ্যন্তরীন কণিকার ইতিহাস রাদারফোর্ডের মাধ্যমে শুরু হয়নি।
ক্যাথোড রশ্মি যিনি আবিষ্কার করেছিলেন, সেই গোল্ডস্টেইন ক্যাথোড রশ্মির বিপরীত দিকে কোনো বিকিরণ প্রবাহিত হয় কিনা তা খুঁজে দেখার চেষ্টা করেছিলেন। তবে তিনি এ্যানেড থেকে নিঃসৃত হয় এমন কোনো বিকিরণ খুঁজে পান নি। তবে ১৮৮৬ সালে তিনি এমন এক ধরনের ক্যাথোড প্রস্তুত করতে সক্ষম হলেন যা নিজেই আগের রশ্মিটির বিপরীত দিকে বিকিরণ পাঠাতে পারে। এই সক্ষমতা তৈরির জন্য তিনি এমন একটি ক্যাথেড ব্যবহার করলেন যা ছিদ্রযুক্ত এবং ছোট ছোট গর্ত (কিংবা চ্যানেল) বিশিষ্ট। যখন বায়ুশূন্য একটি আবদ্ধ টিউবের মাঝামাঝি এই ধরনের ক্যাথোড স্থাপন করা হয় এবং একটি বিদ্যুৎপ্রবাহ এদের মধ্য দিয়ে চালানো হয় তখন ক্যাথোড রশ্মি উৎপন্ন হয়। অবশ্য ধনাত্মক চার্জবিশিষ্ট বিকিরণ যা ক্যাথোডের কাছাকাছি উৎপন্ন হয় তা বিপরীত দিকে প্রবাহিত হয়।
গোল্ডস্টেইন যথাযথভাবে এই ঘটনাই পর্যবেক্ষণ করলেন এবং এই নতুন ধরনের বিকিরণকে KANALSTRAHLEN বলে ডাকলেন জার্মান ভাষায় যার অর্থ হচ্ছে “চ্যানেল রশ্মি”। অবশ্য অযথার্থভাবে ইংরেজিতে একে ‘CANAL RAY’ নাম দেওয়া হয়। ১৮৯৫ সালে পেরিন একটি বস্তুর মধ্যে এ ধরনের কিছু ক্যানাল রশ্মি সঞ্চয় করলেন। তিনি এদের গমন পথে বস্তুটিকে স্থাপন করলেন এবং দেখলেন বস্তুটি কিছুটা ধনাত্মক চার্জ প্রাপ্ত হয়েছে। এই কারনে ১৯০৭ সালে জে.জে. থমসন এদেরকে ধনাত্মক রশ্মি ডাকা যেতে পারে বলে প্রস্তাব করলেন।
১৮৯৮ সালে ওইয়েন এদেরকে চৌম্বক এবং তড়িৎক্ষেত্রের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত করলেন। তিনি দেখলেন ধনত্মক রশ্মির এই কণিকাগুলো ইলেক্ট্রনের চেয়ে অনেক অনেক বেশি ভরবিশিষ্ট। তাদের ভর প্রায় পরমাণুর কাছাকাছি। পাশাপাশি এই ধনাত্মক রশ্মির কণিকার ভর বায়ুশূন্য টিউবে যে সামান্য গ্যাস অবশিষ্ট রয়ে যায় তার উপর নির্ভর করে। যদি এই গ্যাস অবশেষ হাইড্রোজেন হয় তাহলে তার ভর হয় হাইড্রোজেন এটমের মত, যদি অক্সিজেন হয় তাহলে তাদের ভর হয় অক্সিজেন এটমের মতো এবং একই ভাবে অন্যান্য ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
রাদারফোর্ডের মূল নিউক্লিয়াস তত্ত্ব যখন সার্বিকভাবে গৃহীত হলো তখন সাথে সাথেই বোঝা গেলো যে এই ধনাত্মক কণিকাগুলো আসলে কি। ক্যাথোড রশ্মির উপদান দ্রুতগামী ইলেক্ট্রনসমূহ বায়ুশূন্য টিউবে অবশিষ্ট হাইড্রোজেন, অক্সিজেন, নাইট্রোজেন ও অন্য যেকোনো পরমাণুর সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। ইলেক্ট্রনগুলো পারমানবিক নিউক্লিয়াসগুলোকে স্থানচ্যুত করার জন্য যথেষ্ট ভারী নয় এবং কদাচিৎই সেগুলো এদেরকে আঘাত করে। তবে তারা ইলেক্ট্রনকে ধাক্কা দিয়ে পরমাণু থেকে বের করে দিতে পারে। ইলেক্ট্রন হারিয়ে পরমাণুগুলোতে অবশিষ্ট থাকে নিউক্লিয়াস, যা ধনাত্মক চার্জ বহন করে এবং তাই তারা ঋনাত্মক ক্যাথোড রশ্মির বিপরীত দিকে গমন করে।
১৯০৩ সালে রাদারফোর্ড শনাক্তকরলেন যে আলফা কণিকার ধর্মসমূহের সাথে ধনাত্মক রশ্মির কণিকাগুলোর খুব মিল রয়েছে। ১৯০৮ সালের মধ্যে তিনি পুরোপুরি নিশ্চিত হয়ে গেলেন যে একটি আলফা কণিকার ভর একটি হিলিয়াম পরমাণুর ভরের প্রায় সমান। তার কাছে মনে হলো আলফা কণিকা এবং হিলিয়াম নিউক্লিয়াসের মধ্যে কোনো সম্পর্ক নিশ্চয়ই আছে, কেননা ইউরেনিয়ামের খনিজ, যা থেকে আলফা কণিকা নিঃসৃত হয় তা সবসময়ই কিছু পরিমান হিলিয়াম ধারন করে। ১৯০৯ সালে রাদারফোর্ড দুই দেয়াল বিশিষ্ট একটি কাচের নলে কিছু তেজষ্ক্রিয় পরমাণু রাখলেন। ভিতরের কাচের দেয়ালটি যথেষ্ট পাতলা ছিলো কিন্তু বাইরের দেয়ালটি ছিলো বেশ মোটা। দুই দেয়ালে মাঝের অংশটি ছিলো বায়ুশুন্য।
তেজষ্ক্রিয় পদার্থ কর্তৃক নিঃসৃত আলফাকণিকাগুলো সাহজেই আভ্যন্তরীন দেয়ালটি ভেদ করে যেতে পারত কিন্তু বহিঃস্থ মোটা দেয়ালটি পার হতে পারত না। ফলে আলফা কণিকাগুলো দুই দেয়ালের মধ্যবর্তী স্থানে আটকা পড়ছে বলেই মনে হলো। কয়েকদিনের বিকিরণের পর দুই দেয়ালের মাঝে যথেষ্ট পরিমানে আলফাকণিকা জমে যায় যা পরীক্ষা করে দেখা সম্ভব; এবং যখন এদেরকে পরীক্ষা করে দেখা হলো তখন হিলিয়াম শনাক্ত হলো। এখান থেকে এই বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে গেলো যে আলফা কণিকা হচ্ছে হিলিয়াম নিউক্লিয়াস। অন্যান্য ধনাত্মক রশ্মিগুলোও অন্যান্য পরমাণুর নিউক্লিয়াস হিসেবে সব্যাস্ত হলো।
ধনাত্মক রশ্মির কণিকাগুলোর সাথে ইলেক্ট্রনের যে পার্থক্য ছিলো তাদের মধ্যে একটি হলো প্রতিটি ইলেক্ট্রনের ভর এবং বৈদ্যুতিক চার্জ একই ছিলো কিন্তু ধনাত্মক কণিকাগুলোর ভর এবং বৈদ্যুতিক চার্জের মধ্যে ভিন্নতা ছিলো। স্বাভাবিকভাবেই পদার্থবিদগণ চিন্তা করতে লাগলেন যে এই ধনাত্মক চার্জযুক্ত কণিকাগুলোকে কোনোভাবে আরো ক্ষূদ্রভাগে ভাগ করা যায় কিনা যাতে ছোট হতে হতে একটি ক্ষুদ্র ধনাত্মক চার্জযুক্ত কণিকা পাওয়া যায় যা ইলেক্ট্রনের চেয়ে বড় হবে না।
রাদারফোর্ড এদের মধ্যে একজন ছিলেন যিনি এই ধরনের একটি ‘ধনাত্মক ইলেক্ট্রন’ এর খোঁজে ছিলেন কিন্তু তিনি শেষ পর্যন্ত পান নি। সবচেয়ে ছোট যে ধনাত্মক চার্জযুক্ত কণিকা তিনি পেলেন তা হচ্ছে একটি হাইড্রোজেন পরমাণুর ভরের সমান এবং নিশ্চিতভাবেই এটি একটি হাইড্রোজেন নিউক্লিয়াস হবে। ১৯১৪ সালে রাদারফোর্ড সিদ্ধান্ত নিলেন যে এই কণিকাটিই প্রকৃতিতে বিদ্যমান সম্ভাব্য সবচেয়ে ছোট ধনাত্মক কণিকা। এতে যে পরিমাণ ধনাত্মক চার্জ রয়েছে তা পুরোপুরি ইলেক্ট্রনের চার্জের সমান (যদিও এতে ঋনাত্মক ইলেক্ট্রনের বিপরীতধরনের ধনাত্মক চার্জ রয়েছে), কিন্তু ভর রয়েছে, যা এখন আমরা জানি, ইলেক্ট্রনের ১৮৩৬.১১ গুণ বেশি। রাদারফোর্ড এই ক্ষূদ্রতম ধনাত্মক রশ্মির কণিকাটিকে নাম দিলেন প্রোটন, গ্রীক ভাষায় যার অর্থ হচ্ছে ‘প্রথম’, কেননা এই কণিকাগুলোকে ভরের ক্রমানুসারের সাজালে এই কণিকাটিই সবার প্রথমে বসে।
(সবগুলো পর্ব একত্রে)
 

ইমতিয়াজ আহমেদ
পোস্টডক্টরাল গবেষক: Green Nanomaterials Research Center Kyungpook National University Republic of Korea.