প্রকৃতি রহস্য করতে ভালোবাসে। কিন্তু তার সেই রহস্য আমাদের কাছে মাঝে মধ্যেই জটিল মনে হয়। কিন্তু যখন আমরা একটু গভীর ভাবে দেখি তখন বুঝতে পারি যে প্রকৃতি রহস্য পছন্দ করলেও জটিলতায় মোটেও পছন্দ করে না। তার সব কিছুই অনেক সরল-সোজা। তাই বিজ্ঞানীরাও প্রকৃতির সবকিছুকে একটা সহজ তত্ত্ব দিয়ে প্রকাশ করার জন্য খোঁজ করছেন ‘সবকিছুর তত্ত্ব’ বা ‘The theory of everything’. যাই হোক, আজ আমরা আলোচনা করব প্রকৃতির সেই রহস্যময়তার ব্যাপারে কিন্তু সেটা অনেক সহজ রহস্য। আমরা মাঝে মাঝেই প্রকৃতিতে বিভিন্ন প্যাটার্ন খুজে পাই। এর মধ্যে কিছু বিখ্যাত হল গোল্ডেন রেশিও বা সোনালীঅনুপাত আর ফিবোনাক্কি রাশিমালা। এই দুটো বিষয়ই অনেক সহজ। আমাদের আশে পাশের অনেক কিছুতেই দেখা মিলে এই দুই রাশির। কিন্তু সবথেকে সহজ, রহস্যময়, অনন্য আর সুন্দররাশি হল ‘ফ্রাক্টাল’!
ফ্রাক্টাল কি? এর জন্ম কিভাবে? এর আবিস্কারক কে? শব্দটা কোথা থেকে আসল সেটা পরে আলোচনা করা যাবে। এখন আমরা দেখব আমাদের দৈনন্দিন সহজ জীবন থেকে জটিল জীবনে এই ফ্রাক্টাল কিভাবে কাজ করে আর এর ব্যাবহার কিভাবে আমাদের জীবনকে সহজ করেছে।
প্রকৃতিতে নিদর্শনঃ-
- একেবারে ক্ষুদ্র ভাইরাসের গঠন থেকে শুরু করে মহাকাশের সবকিছুতেই এই ফ্রাক্টাল লক্ষ করা যায়।
- আমাদের জীবনের সবখানেই ফ্রাক্টাল অদৃশ্য ভাবে কাজ করছে। আমাদের নিউরনের গঠন, শিরা-উপশিরা, কিডনী, ফুসফুস, রক্তজালিকা, হৃদপিণ্ডের ছন্দ এমনকি আমাদের চিন্তা ভাবনাও ফ্রাক্টাল এর নিয়ম অনুযায়ী কাজ করে।
- আমরা যদি কোন গাছের দিকে তাকাই তাহলে তার পুরোটুকুতেই দেখতে পাব ফ্রাক্টালের সমাহার। একটা বড়গাছের মূল কান্ড, এর শাখা-প্রশাখা, পাতা ও এর শিরা-উপশিরা এবং গাছের মূলের শিকরের গঠনেও ফ্রাক্টাল চোখে পরে।
- প্রকৃতির দুর্যোগগুলোও ফ্রাক্টাল মেনে চলে। আমরা ঘূর্ণিঝড়ে, সুনামিতে, বিদ্যুৎ চমকে এবং মেঘের মধ্যেও ফ্রাক্টাল দেখতে পাই।
- একটা জঙ্গলের ছোটগাছ আর বড় গাছের আকৃতিতে রয়েছে এই রহস্যময় ফ্রাক্টাল। ফুলের গঠনে, পুস্পমঞ্জুরির সম্পূর্ণটাতেই, শামুকের আকারে, মঙ্গা পিড়িত এলাকার মাটির ফাটলে ফ্রাক্টাল দৃশ্যমান।
- মরুভুমী, সাগরেরঢেউ, পাহাড়ের গঠনে ফ্রাক্টাল দেখা যায়।
- কোষের বিভাজ এমনকিপ্রাকৃতিক নিরাবাচনও ফ্রাক্টাল রাশিকে নির্দেশ করে।
- দৃশ্যমান মহাবিশ্বের মানচিত্রে, গ্যালাক্সির মানচিত্রে সবখানেই শুধু সধু ফ্রাক্টাল।
- তুষারের আকৃতিতে এই ফ্রাক্টালের সবথেকে সুন্দর নিদর্শন পাওয়া যায়। মাকড়সার জালেও ফ্রাক্টাল রয়েছে।
- বরফের ফাটলে,সমুদ্র তীরে ফ্রাক্টাল লক্ষ করা যায়।
ব্যাবহারঃ-
এতক্ষণ আলোচনা করালাম প্রকৃতিতে ফ্রাক্টালের অস্তিত্ব সম্পর্কে। আলোচনায় ব্যাবহার করা উদাহরণের বাইরে আরো অনেক জায়গাতেই আমরা ফ্রাক্টালের বৈশিষ্ট্য দেখতে পাই। এখন দেখা যাক আমাদের জীবনে ফ্রাক্টাল কি কাজে লাগে।
- আমাদের দেখা মুভি আর গেমসের গ্রাফিক্স ফ্রাক্টালের কথা ছাড়া ভাবাই যায় না। ফ্রাক্টাল জ্যামিতি ব্যাবহার করে বর্তমানে গ্রাফিক্স আরো উন্নত করা সম্ভব হয়েছে। গ্রাফিক্সের একটা বিষয়হল মসৃণতা। ছবি যত মসৃণ হবে সেটা তত বেশি জীবন্ত মনে হবে। আগে ছবি হাতে একে এক বিশেষ প্রযুক্তি ব্যাবহার করে মসৃণ করা হত। আর এখন ফ্রাক্টাল জ্যামিতি ব্যাবহার হয়। আমরা হলিউডের মুভি স্টার ওয়ার্স বা স্টার ট্রেক আর কল অফ ডিউটি বা বর্তমানের হাই-রেজ্যুলেশনের গেম দেখলেই বুঝতে পারব যে দিনে দিনে গ্রাফিক্স আরো বেশি জীবন্তহয়ে উঠছে। এসবই ফ্রাক্টালের অবদান।
- থ্রিডি সিমুলেশন তৈরিতে ফ্রাক্টাল জ্যামিতির ব্যাবহার করা সফটওয়্যার ছাড়া অন্য কোন বিকল্প নেই। এই জ্যামিতি ব্যাবহার করেই সহজ ভাবে কিছু ইউক্লিডিয়ান আকৃতির মাদ্ধমেই একটা জটিল আকৃতি গঠন করে ফেলা যায়।
- চিকিৎসা ক্ষেত্রে রোগ নির্ণয়য়ের ক্ষেত্রে ফ্রাক্টালের অবদান অনস্বীকার্য। হার্টের ব্লক, ক্যান্সার, মস্তিস্কের সমস্যা সহজভাবেই শুধুমাত্র আলট্রাসাউন্ড ব্যাবহার করেই কোন প্রকার ঝুঁকিছাড়া নির্ণয় করা যায়।
- ফ্রাক্টালের ব্যাবহার আমাদের ব্যাবহার করা ইলেক্ট্রিক ডিভাইসের আকার ছোট করতে কাজে লাগানো হয়েছে। যেমন ধরুন বর্তমানে একটা মোবাইল বা ল্যাপটপ ডিভাইসে একসাথে ব্লুটুথ, ওয়াই-ফাই, ইন্টারনেট ব্যাবহার করতে হয়। কিন্তু প্রত্যেকটা নেটওয়ার্কের জন্য আলাদা আলাদা ফ্রিকোয়েন্সি ব্যাবহার করা হয়। তাই একটা মোবাইল বা ল্যাপটপ ডিভাইসে অনেকগুলো রিসিভারের প্রয়োজন হয়। এখন যদি ঐ ডিভাইসে অনেকগুলো রিসিভার লাগানো হয় তাহলেসেই ডিভাইস আর বহনযোগ্য থাকে না। এই সমস্যা ফ্রাক্টাল জ্যামিতির মাধ্যমে দূর করাযায়।
- ফ্রাক্টাল জ্যামিতি ব্যাবহার করে একেবারেই সহজভাবে একটা বৃহৎ অরণ্য কতখানি অক্সিজেন দেয় আর কতখানি কার্বন ডাই-অক্সাইড শুষে নেয় তা জানা যায়।
- একটা বিশাল প্রাণী আর একটা ক্ষুদ্র প্রাণী যেমন নীল তিমি আর ভাইরাসের জন্য কতখানি শক্তি প্রয়োজন তা এই ফ্রাক্টাল জ্যামিতির মাধ্যমে নির্ণয় করা যায়।
- ফ্রাক্টাল জ্যামিতির নির্দেশ মতে দেখা যায় যে মানুষের হৃদপিণ্ডের কম্পনের সাথে পাহাড়ের ল্যান্ডস্কেপ ছবির সাদৃশ্য রয়েছে।
এতক্ষণ অনেক কথা হল ফ্রাক্টাল নিয়ে। আসুন এবার জানি আসলে কি এই ফ্রাক্টাল আর ফ্রাক্টাল জ্যামিতি? সহজভাবে যদি এক কথায় বলি তাহলে ফ্রাক্টাল হল ০.৫ বা অর্ধেক। আরো একটু ভালো করে যদি বলি তাহলে বলা যায়, আপনি যদি ১ কিমি দূর থেকে কোন বস্তু দেখেন তাহলে এর আকৃতি মনে করুন ত্রিভুজের মত দেখলেন। এখন আপনি যদি ২X জুম করেন তাহলেও যদি দেখেন যে এর ভেতরে আরো একটা ত্রিভুজ আকৃতি দেখা যাচ্ছে তাহলে সেটা হবে ফ্রাক্টাল। আসলে এরা হল স্ব-প্রতিরুপি। এদের কখনো কখনো ‘অসমিরকম জটিল’ বলে অভিহিত করা হয়। মূলত কোন বস্তুকে বিভিন্ন স্কেল থেকে দেখলে যদি একে একইরকম দেখা যায় তাহলে তাকে ফ্রাক্টাল বলে অভিহিত করা যায়। ফ্রাক্টাল শব্দটি ফ্রাক্টাস বা ফ্রাকচার শব্দথেকে এসেছে। এর অর্থ হল ‘ভাঙ্গা’ বা ‘চিড় ধরা’। যদিও এটা একটা সেট তবে জ্যামিতিক বস্তু বলাই বেশি যুক্তিযুক্ত। বেনোয়া মানডেলব্রট নামক এক বিজ্ঞানী এই জ্যামিতিক বস্তুর এরুপ নামকরন করেন ১৯৭৫ সালে। মূলত ১৭ শতকের দিকে বিজ্ঞানীরা প্রকৃতিতে এই আকার লক্ষকরেন, আর তখন থেকেই অনেক বিজ্ঞানী কাজ করে চলেছেন এ নিয়ে। অনেকে মনে করেন এটা হল প্রকৃতির লূকানো মাত্রা বা আকার। হয়ত এর মধ্যেই লুকানো আছে সৃষ্টির কোন রহস্য বা মহাবিশ্বের আকার আর মাল্টিভারসের ধারনা। এসব উন্মোচন করা এখন শুধু সময়ের ব্যাপার।
আসুন কিছু ফ্রাক্টালের নমুনা দেখে নেই…
Leave a Reply