একথা আমরা সবাই জানি যে মানুষ অভ্যাসের দাস। আমরা যদি নিজেদের জীবনের দিকে তাকাই, তাহলে নিশ্চয়ই খুঁজে পাবো কিছু না কিছু ভালো অভ্যাস যা আমাদের উপকার করছে আর কিছু খারাপ অভ্যাস, যা আমাদের ক্ষতি করছে। আবার আমরা নিজেরাই হয়তো চেষ্টা করেছি নতুন কোন অভ্যাস গড়ে তুলতে, কিংবা বাজে কোন অভ্যাস থেকে মুক্তি পেতে। হয়তো পেরেছি, হয়তো পারিনি। কখনো কি ভেবেছি? কিছু কিছু চেষ্টায় লাভ হলেও কেন কিছু কিছু চেষ্টা বৃথা গেছে? কখনো কি নিজেদের অভ্যাসগুলো ভালো কিংবা খারাপ সেই পার্থক্য না দেখে ছকে ফেলে এদের মধ্যেকার প্যাটার্ন খুঁজতে গেছি? কখনো কি আসলেই ‘অভ্যাস’, যার আমরা দাস সেই বিষয়টা নিয়ে খুব করে ভেবেছি? নাকি মেনেই নিয়েছি এই দাসত্ব থেকে বের হবার উপায় নেই।
আপনি আমি না ভাবলেও অনেকেই ভাবে। অনেক গুরুত্বপূর্ণ মানুষেরা ভাবে। ফরচুন ৫০০ কোম্পানিগুলোর হর্তাকর্তারা শুধু ভাবেনই না, মোটা অংকের টাকা ঢালেন প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে অভ্যাস নিয়ে গবেষণা করতে। করে বলেই কেউ কেউ সুদূর মেনলো পার্ক, ক্যালিফোর্নিয়াতে বসে বসে আপনার দৈনন্দিন জীবনে তাদের জন্য উপকারী অভ্যাস গড়ে দিতে পারে। আর আমি আপনি, আমাদের দেহ ও মনের উপর ৯০ % নিয়ন্ত্রণ দাবী করেও পারিনা।
![](https://i0.wp.com/bigganblog.org/wp-content/uploads/2021/03/eugene_pauly.jpg?resize=260%2C260&ssl=1)
এই লেখাটিতে একজন মানুষের গল্প বলবো। তার নাম ইউজিন পলি। বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্রগুলোতে E.P. হিসেবেই যাকে লেখা হয়। স্মৃতিভ্রংশ(Amnesia) আক্রান্ত যত কেস আছে তার মধ্যে খ্যাতির দিক দিয়ে তিনি দ্বিতীয়। তবে ইউজিনের জীবনের ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো তার এবং তার পরিবারের জন্য দুঃখজনক, কিন্তু সেই সাথে বৈপ্লবিক পরিবর্তন বয়ে এনেছে স্মৃতি ও অভ্যাস নিয়ে আমাদের চিন্তা ধারায়।
তখন ১৯৯৩ সাল। ৭০ বছর বয়স্ক, অবসরপ্রাপ্ত ল্যাব টেকনিশিয়ান ইউজিন পলি ও তার স্ত্রী বেভারলি এক সন্ধ্যায় ডিনার করছিলেন। সবকিছুই ঠিকঠাক ছিল, যখন বেভারলি জানালেন যে পরের দিন তাদের সন্তান মাইকেল দেখা করতে আসছে তখন ইউজিন একটু উটভট আচরণ দেখালেন। তিনি যেন মনে করতে পারছিলেন না যে তাদের কোন সন্তান আছে। এটা নিয়ে বেভারলি বেশি ঘেঁটেছিলেন কি না জানা যায়নি।
পরেরদিন ইউজিন বমি এবং পেটে ব্যথা নিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন। ২৪ ঘণ্টায় তার পানিশূন্যতা মারাত্মক আকার ধারণ করলে শঙ্কিত বেভারলি তাকে হাসপাতালে নিয়ে ছুটলেন। ইউজিনের দেহের তাপমাত্রা বাড়তে বাড়তে ১০৫ ডিগ্রি ফারেনহাইটে ঠেকল আর তার হলুদাভ ঘামে ভিজে যাচ্ছিলো শুভ্র বিছানার চাদর। ইউজিন বিকারগ্রস্ত ও হিংস্র হয়ে পড়লে তাকে শান্ত রাখা কঠিন হয়ে যায়। বহু কষ্টে সিডেটিভ দিয়ে ডাক্তাররা তার মেরুদণ্ডের ভেতর নিডল ঢুকিয়ে কয়েক ফোটা সেরেব্রোস্পাইনাল ফ্লুইড সংগ্রহ করেন।
পরীক্ষা করে দেখা যায় ইউজিন ভাইরাল এনসেফালাইটিসে আক্রান্ত। এনসেফালাইটিস ঘটায় এক প্রায় নিরীহ ভাইরাস হার্পিস সিমপ্লেক্স যারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই জ্বর-ঠোসা কিংবা ত্বকের ফুসকুড়ি বেশি ক্ষতি করতে পারেনা। কিন্তু অত্যন্ত বিরল হলেও এই ভাইরাস যদি রক্তে ভেসে ভেসে মাথায় পৌঁছে ব্লাড ব্রেইন ব্যারিয়ার ভেদ করে মগজে প্রবেশ করে এবং তারপর সুস্বাদু ব্রেইন টিস্যু খেতে থাকে। যেই টিস্যুতে আমাদের ভাবনা, স্মৃতি, স্বপ্ন, দক্ষতা… আমাদের সবকিছুই যেখানে অবস্থান করে।
যদিও ডাক্তাররা তার সুস্থ হয়ে ফিরে আসা সম্পর্কে সন্দিহান ছিলেন কিন্ত উচ্চ মাত্রার এন্টিভাইরাল প্রয়োগ করে ভাইরাসের সংক্রমণ রুখে দিয়ে বিস্তার ঠেকানো গেলো। কিন্তু যেই ক্ষতি ইতোমধ্যে হয়ে গিয়েছে তা আর ফেরানো যায়নি। ব্রেইন স্ক্যানে ধরা পরে মগজের মধ্যভাগে এক অশুভ ছায়া। ক্র্যানিয়াম এবং স্পাইনাল কলাম যেখানে মিলিত হয় সেখানের অনেকটুকু টিস্যু ভাইরাস ধ্বংস করে দিয়েছে।
যখন তার জ্ঞান ফিরল তখন ইউজিন বেশ দুর্বল, তার কথা জড়িয়ে যাচ্ছিলো, মনে হচ্ছিলো শ্বাস নিতেও যেন তার কষ্ট হচ্ছে । তবে আস্তে আস্তে অবস্থা ভালো হলো। তিনি স্বাভাবিক মানুষের মতই চলাফেরা করতে শুরু করলেন। কিন্তু, তিনি বুঝতে পারছিলেন না সপ্তাহের কোন দিন, কিংবা ডাক্তার ও নার্সদের নাম বারবার বলার পরও তাদের নাম মনে রাখতে পারছিলেন না। এমনকি তাদের সাথে যে পরিচয় হয়েছে সেটাও তার স্মৃতিতে নেই।
![](https://i0.wp.com/bigganblog.org/wp-content/uploads/2021/03/cure_reward.png?resize=335%2C205&ssl=1)
বাড়িতে নিয়ে আসার পর আরও অদ্ভুত সমস্যা দেখা গেলো। ইউজিন তার বন্ধুদের কথা ভুলে গেছেন। তিনি কথোপকথন চালিয়ে নিতে পারছিলেন না। কোন কোন সকালে তার ঘুম ভেঙ্গে যেত। তিনি উঠে রান্নাঘরে গিয়ে বেকন আর ডিম খেতেন। তারপর আবার বিছানায় শুয়ে মাথা চাদরের নিচে ঢুকিয়ে রেডিও চালিয়ে দিতেন। কিছু সময় পর তিনি আবার একই ভাবে রান্নাঘরে গিয়ে বেকন আর ডিম খেয়ে বিছানায় গিয়ে চাদরে মাথা মুড়ে রেডিও শুনতেন। একই কাজ এভাবে বেশ কয়েকবার চলতো।
ঘটনায় শঙ্কিত হয়ে পড়েন বেভারলি। তিনি ইউজিনকে নিয়ে ছুটলেন বিশেষজ্ঞদের কাছে। তার মধ্যে একজন হলেন ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, স্যান ডিয়াগোর প্রফেসর ল্যারি স্কুইর। এই বিজ্ঞানীর তখন ৩ দশকের কাজ করার অভিজ্ঞতা স্মৃতির নিউরো এনাটমি নিয়ে। তার আগ্রহ ছিলও কিভাবে মগজ বিভিন্ন ঘটনা ধারণ করে। ইউজিন পলিকে নিয়ে ল্যারি স্কুইরের কাজ অচিরেই তার নিজের কাছে এবং শত শত অন্য বিজ্ঞানীদের কাছে জ্ঞানের নতুন দুয়ারের উন্মোচন করেছিল যে ‘অভ্যাস’ জিনিসটা কত শক্তিশালী, আর কতটা গভীরে অভ্যাসের অনুরণন। স্কুইরের কাজ এটাই প্রমাণ করেছিলো, এমন কেউ যে কিনা নিজের নাম/বয়সের মতো তথ্যও মনে রাখতে পারেনা সেও জটিল কোন অভ্যাস গড়ে তুলতে পারে।
যাই হোক, স্কুইর ইউজিনের সাথে কথাবার্তা শুরু করলেন তার যুবক বয়সের কথা জানতে চেয়ে। তিনি স্বাভাবিকভাবেই বলে গেলেন সেন্ট্রাল ক্যালিফোর্নিয়ার যে শহরে তিনি বড় হয়েছেন তার কথা। মার্চেন্ট মেরিন থাকার সময়ে অস্ট্রেলিয়ায় সফরের কথা। তিনি তার জীবনের বেশিরভাগই মনে করতে পারছেন যেগুলো ১৯৬০ এর আগে ঘটেছিল। যখন স্কয়ার এর পরের কোন সময়ের কথা জানতে চাচ্ছিলেন তখন ইউজিন বিনয়ের সাথে বলছিলেন “দুঃখিত, সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো মনে করতে আমার সমস্যা হয়।”
প্রফেসর তার বুদ্ধিমত্তার কিছু পরীক্ষা নিলেন, দেখা গেল তিনি সেসবে বেশ ভালোই করলেন। যেসব স্বাভাবিক অভ্যাস অনেক আগেই গড়ে উঠেছিলো সেসবও তার মধ্যে ভালোভাবেই ছিলও। যেমন স্কুইর যখন তাকে পানির গ্লাস এগিয়ে দিলেন, তিনি ধন্যবাদ দিয়েছিলেন। প্রফেসর যখন ইউজিনের কোন উত্তরে খুশি হয়ে প্রশংসা করছিলেন তিনিও প্রতিউত্তরে প্রশংসা করছিলেন। নতুন কারো সাথে দেখা হলে তিনি নিজেই আগে পরিচয় দিয়ে দিনটি কেমন কাটল জিজ্ঞেস করছিলেন। কিন্তু স্কুইর যখন তাকে একটা সংখ্যার সিরিজ মুখস্থ করতে দিচ্ছিলেন, অথবা ঘরের বাইরের হলওয়ের স্কেচ আঁকতে বলছিলেন, তা তিনি পারছিলেন না। আসলে নতুন কোন তথ্যই তার মাথায় মিনিট খানেকের বেশি থাকতো-না।
সবচেয়ে দুঃখজনক যে তার অসুস্থতা কিংবা হাসপাতালে থাকা সংক্রান্ত কিছুই মনে নেই। আসলে তার নিজের যে মানসিক প্রতিচ্ছবি ছিলও তাতে কোন অসুস্থতা , এমনেশিয়া সংক্রান্ত তথ্য নেই। সেকারণে তার সমস্যা কি সেটাও তিনি কোনদিন বুঝতে পারেননি। তিনি সবসময় নিজেকে সুস্থই ভাবতেন। আর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি ভেবে গেছেন যে তার বয়স ৬০ বছর, যদিও তিনি আক্রান্তই হয়েছিলেন ৭০ বছর বয়সে।
মাস খানেক পর ইউজিন ও বেভারলি তাদের থাকার জায়গা বদলিয়ে স্যান ডিয়াগোতে চলে আসেন। সেসময় প্রায়ই প্রফেসর স্কুইর তথ্য নিতে সেই বাসায় যেতেন। একদিন স্কুইর ইউজিনকে বললেন তাদের নতুন বাসার কোন ঘর কোথায় আছে সেটার একটা ব্লু-প্রিন্ট এঁকে দিতে। তিনি সেটা করতে পারলেন না। এরপর স্কুইর তার কম্পিউটারে কাজে মন দিলেন। ইউজিন তখন উঠে গিয়ে বাথরুমে গেলেন। সেখান থেকে ফ্ল্যাশের শব্দও এলো। কাজ সেরে টাওয়েলে হাত মুছে তিনি ফিরেও এলেন স্কয়ারের পাশে। সেই সময়ে কেউই ভাবেনি যে মানুষটা তার বাসার কোন ঘর কোথায় আছে সেটা এঁকে দেখাতে পারেনা কিন্তু একা একাই বাথরুম করে আসতে পারছেন কোন সমস্যা ছাড়াই। এরকম এবং কাছাকাছি ধরনের আরও কিছু জিজ্ঞাসাই এর পরে এমন কিছু আবিষ্কারের রাস্তা খুলে দিয়েছিলো যার মাধ্যমে অভ্যাসের শক্তি সম্পর্কে বুঝতে পেরেছি।
স্যান ডিয়াগোতে আসার প্রথম কয়েক সপ্তাহ বেভারলি নিজেই ইউজিনকে দুইবেলা করে হাটতে নিয়ে যেতেন। ডাক্তারদের নির্দেশনা ছিলও যে তার চলাফেরা, এক্সারসাইজের দরকার । তাছাড়া ঘরে থাকলে বারবার একই প্রশ্ন করে করে তিনি বেভারলিকে পাগল করে দিতেন। যেহেতু তিনি সবই কয়েক মিনিটের মধ্যে ভুলে যান, তাই সবসময় বাইরে তার সঙ্গী কেউ একজন থাকতে হবে। নয়তো তিনি হারিয়ে গেলে হয়তো আর খুঁজে পাওয়া সম্ভব হবেনা। কিন্তু এক সকালে বেভারলি তৈরি হবার সময়েই ইউজিন বেরিয়ে যান একাই। টের পেয়ে বেভারলির মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। তিনি পাগলের মত এখানে এখানে খুঁজে যখন পেলেন না তখন পুলিশকে জানিয়ে ক্লান্ত হয়ে ঘরে ফিরলেন। দেখা গেল ইউজিন ঘরে বসে আছেন, তার সামনে টেবিলে একটা পাইন-কোন রাখা।
পরবর্তীতে বুঝা গেল যে ইউজিনের যদিও ধারনা নেই তিনি কোথায় থাকেন, তারা বাড়ি কোনটি। কিন্তু বেভারলির সাথে সকাল বিকাল হাটতে হাটতে তার অভ্যাস দাড়িয়ে গেছে যার মাধ্যমে তিনি অবচেতন ভাবেই চিনে চিনে হেটে আসতে পারেন। বেভারলি যদিও তাকে নিষেধ করেছিলেন একা বাইরে না যেতে, কিন্তু সেটা মেনে নিয়ে মনে রাখা সম্ভব হতোনা। তিনি ভুলে যেতেন আর বেরিয়ে পড়তেন। শুরুতে কিছুদিন বেভারলি অনুসরণ করতেন যেন তিনি হারিয়ে না যান। পরে দেখা গেল না, তিনি আসলেই একা চলাফেরা করতে পারছেন। কখনো কখনো পাইন কোন, ফল, পাথর এসব নিয়ে আসতেন একদিন ওয়ালেট আরেকদিন কুকুরছানাও ঘরে এনেছিলেন। কিন্তু তার স্মরণেই নেই সেসব কোথায় পেয়েছিলেন।
এই ঘটনাগুলো শোনার পর প্রফেসর স্কুইর একদিন তার সঙ্গীদের সাথে করে নিয়ে এলেন। হাটার সময় হলে ইউজিন তাদের একজনের সাথে হাটতে বের হলেন যার ওই এলাকার পথঘাট সম্পর্কে কোন ধারনা নেই। ইউজিন নিজেই পথ দেখিয়ে ঘুরে আসলেন। যখন বাসার কাছাকাছি চলে এসেছেন তখন সেই বিজ্ঞানী জানতে চাইলেন কোনটা ইউজিনের বাসা, ইউজিন সেটা বলতে পারলেন না। কিন্তু হাটতে হাটতে একদম ঠিক জায়গাতেই পৌঁছালেন। কিংবা ঘরের ভেতর যখন জিজ্ঞেস করা হল রান্নাঘর কোনদিকে সেটাও তিনি বলতে পারলেন না। তবে মজার বিষয় হচ্ছে, যখন জিজ্ঞেস করা হল ক্ষুধা লাগলে তিনি কি করতেন। দেখা গেলো তিনি উঠে গিয়ে রান্না ঘরে জার থেকে খাবার বের করে নিয়ে এলেন।
এরকম আরও কিছু ঘটনার পর আর বুঝতে বাকী রইলোনা যে ইউজিনের মস্তিষ্ক যদিও সচেতনভাবে কোন নতুন তথ্য গ্রহণ করছেনা কিন্তু অবচেতন ভাবে তা ঠিকই করছে এবং ব্যবহার করছে। এরপর বেশ কিছু এক্সপেরিমেন্টের মাধ্যমে এটা প্রমাণ করা গেলো, যা বিজ্ঞানী মহলে মস্তিষ্কের কর্মপ্রক্রিয়া সম্পর্কে ধারনাগুলো নতুন করে ভাবতে বাধ্য করে। সবাই জানতে পারলেন যে একটা বিষয়ে কোন কিছু শেখা এবং সিদ্ধান্তগ্রহণ সম্পর্কে সবকিছু ভুলে গেলেও সেই অনুযায়ী অবচেতনে সিদ্ধান্ত গ্রহণ সম্ভব। ইউজিন এবং স্কুইর আমাদের দেখালেন যে স্মৃতি এবং বোধের সাথে সাথে অভ্যাসও আমাদের আমাদের আচরণের মূল ভিত্তি গঠন করে। আমাদের হয়তো মনে না-ও থাকতে পারে কিভাবে বা কি কারণে কোন একটা অভ্যাস আমরা গড়ে তুলেছি, কিন্তু একবার সেগুলো নিউরনে সংরক্ষিত হয়ে গেলে, তা আমাদের আচরণকে প্রভাবিত করে, আমাদের অজান্তেই।
ইউজিনকে নিয়ে স্কুইরের গবেষণাপত্রটি প্রকাশ হবার পরে অভ্যাস গঠনের বিজ্ঞান পরিণত হল গুরুত্বপূর্ণ চর্চার বিষয়ে। ডিউক, হার্ভার্ড, প্রিন্সটনের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি প্রোক্টর এন্ড গ্যাম্বল, গুগল , মাইক্রোসফট সহ বড় বড় প্রতিষ্ঠানে কর্মরত বিজ্ঞানীরা অভ্যাসের নিউরোলজি এবং সাইকোলজি, এর শক্তি ও দুর্বলতা , কিভাবে অভ্যাস তৈরি হয় এবং নিজেদের কাজে লাগানো যায় সেসব বুঝতে শ্রম দেয়া শুরু করলেন।
সব অভ্যাসেই তিনটা স্তর আছে। Cue-Routine-Reward। গবেষকরা জানতে পারলেন Cue হতে পারে যেকোনো কিছুই। হতে পারে সেটা টসটসে ক্যান্ডি বার, টেলিভিশনের বিজ্ঞাপন, কোন বিশেষ জায়গা, দিনের কোন একটি সময়, আবেগ, চিন্তার ক্রম কিংবা বিশেষ কোন মানুষের সাহচর্য। Routine হতে পারে প্রার্থনার মতো জটিল কিংবা বাটন চাপার মতো সহজ কোন কাজ। আবার Reward ও হতে পারে কোন খাবার বা রাসায়নিক যেটা দেহে বিশেষ অনুভূতি সৃষ্টি করে, কিংবা গর্ব অথবা আত্মতুষ্টির মতো আবাগীয় প্রণোদনা।
পরবর্তী প্রতিটা এক্সপেরিমেন্টই ইউজিনের সাথে স্কুইরের আবিষ্কার প্রতিধ্বনিত হয়েছে। অভ্যাস অনেক শক্তিশালী, কিন্তু বেশ সূক্ষ্ণ। তারা আমাদের সচেতনতার বাইরে তৈরি হতে পারে, অথবা সুচারুভাবে সাজিয়ে নেয়া যেতে পারে। অভ্যাস আমাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে প্রতীয়মান হতে পারলেও তার ভেতরের অংশগুলো নাড়াচাড়া করে গতিপ্রকৃতি বদলে দেয়া সম্ভব। যতটা আমরা ভাবছি তারচেয়েও জোরালো ভাবে আমাদের জীবন অভ্যাস দিয়ে নিয়ন্ত্রিত, তারা এতটাই আগ্রাসী যে আমাদের মগজ বাকী সবকিছু, এমনকি কমন সেন্স বাদ দিয়ে হলেও এদের মেনে চলে।
![](https://i0.wp.com/bigganblog.org/wp-content/uploads/2017/06/habit-motivation.jpeg?resize=1024%2C682&ssl=1)
আক্রান্ত হবার ৭ বছর পর, ২০০০ সালে ইউজিনের জীবনে একধরনের ভারসাম্য আসে। তিনি প্রতিদিন সকালে হাটতে যেতেন। যা ভালো লাগতো খেতেন, কখনো কখনো দিনে ৬ বারও তার আহার হয়ে যেতো। ডাক্তার তার স্বাস্থ্যের কথা চিন্তা করে খাদ্যাভ্যাস নিয়ন্ত্রণের পরামর্শ দিলেও কাজ হয়নি। হবে কিভাবে? কেউ নিষেধ করলেও তো তা তিনি কয়েক মিনিট পরই ভুলে যেতেন। তার স্ত্রী স্কুইরের সাথে পরামর্শ করে চেষ্টা করতেন সবজি জাতীয় খাবার রুটিনে ঢুকাতে। ইউজিনের দেহ বৃদ্ধ হলেও তিনি নিজেকে ভাবতেন ২০ বছর কম বয়সী। তাই চলাফেরায় যতটা সাবধানতা দরকার, তা তিনি আনতে পারেননি। তার স্বাস্থ্য ভালো রাখার নানা রকম চেষ্টা করা হলেও তা খারাপ হতে থাকে। এক সকালে প্রচণ্ড বুকে ব্যথা নিয়ে তিনি চিৎকার করতে থাকেন। হাসপাতালে নেয়ার পর বোঝা গেল তা ছিলও ছোটখাটো একটা হার্ট অ্যাটাক।
তাৎক্ষনিক চিকিৎসায় যখন ব্যথা সেরে গেলো তখন তিনি বার বার বিছানা ছেড়ে উঠে যেতে চাইলেন। দেহের সাথে যুক্ত প্রোব গুলো খুলে ফেলতে চাইলেন যাতে তিনি উপুড় হয়ে ঘুমাতে পারেন। ডাক্তার এবং নার্সদের অনুনয়, বিনয়, হুমকি কিছুতেই কাজ হচ্ছিলোনা। এক সময় তার মেয়ে বুদ্ধি দিলেন যে যদি তার স্থির থাকাকে প্রশংসা করা হয়, কিংবা বুঝানো হয় তিনি ডাক্তারদের সহায়তা করে বেশ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন তাহলে কাজ হতে পারে। হ্যাঁ, তাতে কাজ হয়েছিলো। এর পরের কয়েকদিন নার্সরা তাকে যেটাই বলতেন সেটাই ইউজিন শুনতেন। কিছুদিন পরে তিনি সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরলেন।
২০০৮ সালে আরেক অঘটন ঘটলো। ফায়ারপ্লেসের পাশে রাখা খড়িতে হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়ে কোমর ভেঙ্গে গেলো। তাকে আবার হাসপাতালে যাওয়া লাগলো। স্কুইর এবং তার দল চিন্তিত হলেন, যে ইউজিন হয়তো হাসপাতালে নিজেকে একা দেখে ভয় পেয়ে উত্তেজিত হয়ে যেতে পারেন। তাই তারা বিছানার পাশে তার কি হয়েছিলো, কিভাবে হয়েছিলো এসব সম্পর্কে নোট রাখতেন। তবে এবার ইউজিন বেশ শান্ত থাকলেন। তিনি যে সবকিছু সবসময় বুঝবেন না, এতে হয়তো তার মন অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলো। বেভারলি তখন প্রতিদিন যেতেন হাসপাতালে। তিনি বলেন ‘তাকে বলতাম আমি কতটা ভালোবাসি। আমাদের জীবন কত সুন্দর। পরিবারের অন্যদের ছবি দেখাতাম। তাকে জানাতাম সবাই তাকে কত পছন্দ করে। আমাদের ৫৭ বছরের বিবাহিত জীবনে ৪২ বছর ছিলও স্বাভাবিক। কখনো কখনো এটা খুব কষ্টকর হয়ে যেতো, আমি পুরনো ইউজিনকে ফিরে পেতে চাইতাম। কিন্তু, অন্তত সে আনন্দে আছে ভেবে শান্তি পেতাম।’
এক বিকেলে তার মেয়ে ক্যারোল আসলেন দেখা করতে। উনি ইউজিনকে সাথে নিয়ে হাসপাতালের লনে বেড়াতে গেলেন। অনেক্ষন ঘুরাঘুরি, গল্পসল্প করার পর সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছিলো দেখে ক্যারল ইউজিনকে ভেতরে নেবার প্রস্তুতি শুরু করলেন। তখন ইউজিন আচমকা বলে বসলেন ‘তোমার মতো মেয়ে পেয়ে আমি ভাগ্যবান’। একথা শুনে ক্যারল হতবাক হয়ে যান। তার বাবা শেষ কবে এত মিষ্টি করে কিছু বলেছিলেন তা তো তিনি ভুলেই গিয়েছিলেন।
সেই রাতে যখন একটা বাজে তখন বেভারলির ফোন বেজে উঠে। ওপাশ থেকে জানানো হল ইউজিন চিরতরে বিদায় নিয়েছেন, তার বিদায়ে বিজ্ঞানীমহল মর্মাহত, ইউজিনকে নিয়ে গবেষণা, তার ব্রেইন স্ক্যান, তার জীবন যাপন বহু বিজ্ঞানীকে উপকৃত করেছে এবং করবে। বেভারলি বলেন ‘বিজ্ঞানে ইউজিনের অবদান তাকে গর্বিত করে। আমাদের বিয়ের পরপরই ইউজিন বলেছিল যে সে জীবনে অর্থপূর্ণ কিছু করতে চায়, এবং সে তা করেছিলো। কিন্তু আফসোস, সে কোনদিন তা জানতেও পারেনি।’
Charles Duhigg রচিত The Power of Habit থেকে অনুপ্রাণিত
Leave a Reply