প্রকৃতিতে এমন বেশ কিছু প্রাণী রয়েছে যারা ছদ্মবেশ ধারণ করতে সক্ষম। প্রাণীরা সাধারণত ছদ্মবেশ ধারণ করে থাকে শত্রুপক্ষ থেকে নিজেকে লুকানোর উদ্দেশ্যে। তবে শুধু প্রাণীই নয়, এমন অনেক উদ্ভিদও পাওয়া যায় যারা মানুষের কাছ থেকে নিজেকে আড়াল করতে ছদ্মবেশ ধারণ করে।
যদিও উদ্ভিদের ছদ্মবেশ ধারণ করার ব্যাপারে খুব বেশী তথ্য নেই। তবে এক গবেষণায় দেখা গিয়েছে, ছদ্মবেশী উদ্ভিদগুলো তাদের ছদ্মবেশ ধারণ করার জন্য প্রাণীদের মত একই পদ্ধতিগুলো ব্যবহার করে থাকে। উদ্ভিদ এবং প্রাণী উভয়েরই ছদ্মবেশ ধারণ করার পদ্ধতির উদাহরণগুলির মধ্যে রয়েছে:
- পটভূমির সাথে মিল — তাদের আবাসস্থলের রঙ বা আকৃতির সাথে মিশে যাওয়া।
- বিঘ্নিত রঙ — এমন চিহ্ন বা রঙ ধারণ করে যা অবাস্তব প্রান্ত এবং সীমানার উপস্থিতি তৈরি করে, যার ফলে সত্যিকারের রূপরেখাটি দেখতে পাওয়া যায় না।
- মাসক্রেড — ভিন্ন রকম রূপ ধারণ করা। সাধারণত কোনো শিকারী উপেক্ষা করতে পারে এমন কিছুর রূপ ধারণ করা, যেমন একটি পাথর।
- সজ্জা — পরিবেশ থেকে উপাদান সংগ্রহ করে নিজেদের সজ্জা পরিবর্তন করে। উদাহরণস্বরূপ, কিছু উপকূলীয় গাছগুলি তাদের চটচটে গ্রন্থিযুক্ত ট্রাইকোমগুলির কারণে বালি দ্বারা আচ্ছাদিত হয়, যার ফলে তাঁরা তেমন দৃশ্যমান হয় না।
ছদ্মবেশী প্রাণীর মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হল ‘ডাইং পয়জন ডার্ট ফ্রগ’ (Dyeing Poison Dart Frog) যা বৈজ্ঞানিকভাবে ডেনড্রব্যাটস টিঙ্কটোরিয়াস (Dendrobates tinctorius) নামে পরিচিত। এই ব্যাঙগুলো তাদের মরণাত্নক বিষ এবং উজ্জ্বল রঙের জন্য বিশেষভাবে পরিচিত। যদিও এই ব্যাঙ গুলো তাদের শিকারিকে সাবধান করতে বিভিন্ন রঙ ধারণ করে থাকে, কিন্তু তার চেয়েও বেশী এই রঙগুলো ছদ্মবেশের কাজে লাগে।
তবে প্রাণীদের চেয়ে উদ্ভিদের ছদ্মবেশী ক্ষমতা অনেকাংশে কম। তার কারণ হচ্ছে উদ্ভিদের অতিপ্রয়োজনীয় একটি উপাদান ক্লোরোফিল যা সবুজ রঙের। গবেষকরা মনে করেন এর কারণে উদ্ভিদের পক্ষে অন্য কোন রঙ ধারণ করাটা কিছুটা অসুবিধে হতে পারে — অর্থাৎ ছদ্মবেশ ধারণ করাটা তাদের পক্ষে ব্যয়বহুল হতে পারে।
কুন্মিং ইনস্টিটিউট অফ বোটানি (চাইনিজ একাডেমি অফ সায়েন্সেস) এবং এক্সেটর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীদের একটি গবেষণায় দেখা গেছে ফ্রিটিলারিয়া দেলাভায়ি (Fritillaria delavayi) নামক একটি উদ্ভিদ যা চাইনিজ ঔষধে ব্যবহার করা হয়, এটি এমনভাবে বিকশিত হয়ে উঠেছে যে এটি মানুষের কাছে অদৃশ্য রূপ নিতে পারে। বিজ্ঞানীরা ধারণা করেন যে, উদ্ভিদের এই প্রজাতিটি ছদ্মবেশ ধারণ করতে সক্ষম এবং মানুষের দ্বারা এই প্রজাতির ছদ্মবেশী বৈশিষ্ট বিকশিত হচ্ছে। এমন অনেক গাছই রয়েছে যারা তৃণভোজী প্রাণীদের কাছ থেকে নিজেদের লুকানোর জন্য ছদ্মবেশ ধারন করে থাকে এবং তারা প্রাণীদের মত করেই ছদ্মবেশ ধারণ করে। এই উদ্ভিদের ক্ষেত্রেও এমনটিই বিবেচনা করা হয়েছিল। তবে এই গবেষণায় দেখা যায় যে মানুষের কার্যকলাপের প্রভাবে উদ্ভিদের ছদ্মবেশী বৈশিষ্ট্য বিকশিত হচ্ছে। হতে পারে মানুষের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে অন্যান্য উদ্ভিদেরও কিছু প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা বিকশিত হয়েছে যা আমাদের নিতান্তই অজানা। এক্সেটর বিশ্ববিদ্যালয়ের পেনারিন ক্যাম্পাসের ইকোলজি অ্যান্ড কনজারভেশন কেন্দ্রের অধ্যাপক মার্টিন স্টিভেনসের মতে, মানুষ কোন বন্য জীবের রঙ বৈচিত্রের বিকাশে কি রকম প্রভাব ফেলতে পারে তা আসলেই বিস্ময়কর।
উদ্ভিদের ছদ্মবেশের ব্যাপারে তেমন কোন গবেষণা হয়নি। এই একই গবেষক দলের আরেকটি গবেষণা থেকে উদ্ভিদের ছদ্মবেশের ব্যাপারে তথ্য পাওয়া গিয়েছে। উদ্ভিদ যে বিভিন্ন উপায়ে নিজের রঙ পরিবর্তন করে পরিবেশের সাথে মিশে গিয়ে ছদ্মবেশ ধারণ করে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। উদ্ভিদ প্রায় প্রাণীর মত করে একই উপায় ছদ্মবেশ ধারণ করে। কখনও রঙ বদলায়, কখনও কোন বস্তুর যেমন ইট-পাথরের রূপ ধারণ করে, কখনও আবার ধুলোবালির আবরণে নিজেকে ঢেকে নেয়। প্রাণীরা বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই রঙ পরিবর্তনের মাধ্যমে ছদ্মবেশ ধারণ করে থাকে। ডাইয়িং পয়জন ডার্ট ফ্রগ নামক ব্যাঙটি যেমন তার গায়ের রঙ দ্বারা শিকারীকে সতর্ক করে দেয়, তেমনি এই রঙ দ্বারাই ব্যাঙটি আবার ছদ্মবেশ ধারণ করে থাকে। এই প্রক্রিয়াটি খুব নিখুঁতভাবে সম্পন্ন হয়ে থাকে। নির্দিষ্ট দূরত্ব থেকে ব্যাঙটির গায়ের এই রঙ শিকারীর কাছে ছদ্মবেশ হলেও, নিজ প্রজাতির আরেকটি সদস্যের কাছে সে অত্যন্ত স্পষ্ট।
তবে উদ্ভিদের ক্ষেত্রে এই ভিন্ন রূপ ধারণ করতে অনেকটা সময় লাগে। প্রাণীর মত দ্রুত এটা হয় না। উদ্ভিদের ছদ্মবেশ ধারণ করার বড় একটি সীমাবদ্ধতা তাদের ক্লোরোফিল। উদ্ভিদ চাইলেই যে কোন রঙ ধারণ করতে পারে না যা ছদ্মবেশী প্রাণীরা সহজেই পারে।
এই গবেষণা অঞ্চলের স্থানীয়দের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে জানা গেছে যে উদ্ভিদগুলোর মাঝে এই ছদ্মবেশী প্রভাব ওই অঞ্চলে শস্য উত্তোলন হার অনুযায়ী বিকশিত হয়েছে। অর্থাৎ, যে স্থানে শস্য উত্তোলন হার বেশী, সেখানে এই বৈশিষ্ট বেশী বিকশিত হয়েছে। তার মানে দাড়ায় যে, উদ্ভিদ মানুষের কাছ থেকে নিজেকে লুকানোর চেষ্টা করছে।
কুন্মিং ইনস্টিটিউট অফ বোটানি এর অধ্যাপক হ্যাং সুন এর মতে, বাণিজ্যিকভাবে ফসল তোলার ব্যাপারটি উদ্ভিদের বিকাশে প্রকৃতির চেয়েও বেশী প্রভাব ফেলে। বর্তমান পৃথিবীতে জীববৈচিত্র্যের অবস্থা প্রাকৃতিকভাবে এবং মনুষ্যভাবে উভয়ভাবেই নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। তবে মানুষের কাছ থেকে উদ্ভিদের অদৃশ্য হয়ে থাকার ব্যাপারটি সত্যিই বিস্ময়কর।
তথ্যসুত্রঃ
Leave a Reply