লেজার ফিজিক্সে হাতেখড়ি

লেখাটি বিভাগে প্রকাশিত

সাধারণ টর্চলাইট এবং লেজার। একটি জায়গায় এদের দুইজনের মিল বেশ লক্ষণীয়। এরা উভয়েই উৎপন্ন করে আলো। কিন্তু সেই আলোর প্রকৃতিতে রয়েছে যোজন যোজন পার্থক্য। বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য লেজার থেকে উৎপন্ন আলোকে সাধারণ আলো থেকে আলাদা করেছে। যেমনঃ সাধারণ আলো পথ চলতে চলতে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু লেজার রশ্মি একই সরলরেখা বরাবর সোজা চলতে থাকে। অর্থাৎ, ছড়ায় না। আবার, লেজার রশ্মির তীব্রতা সাধারণ আলোর চেয়ে অনেক বেশি হতে পারে। সাধারণ আলো যেখানে সাতটি বর্ণের আলোর সমন্বয়ে গঠিত, সেখানে লেজার রশ্মি মনোক্রোমাটিক বা এক বর্ণী। অর্থাৎ, এতে শুধুমাত্র একটি তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোর অস্তিত্ব থাকে। এই বৈশিষ্ট্যগুলো লেজার রশ্মিকে করেছে অনন্য। আধুনিক বিশ্বের নানান প্রযুক্তির অস্তিত্ব এদের ছাড়া কল্পনাও করা যায় না। প্রিয় পাঠক, চলুন জেনে আসি লেজার রশ্মির আদ্যোপান্ত। 

পরমাণুঃ আলো তৈরির কারখানা

নানান উপায়ে আলো উৎপাদন করা সম্ভব। সবচেয়ে পরিচিত পদ্ধতির নাম হল টেম্পারেচার রেডিয়েশন। এই পদ্ধতিতে কোন বস্তুকে উত্তপ্ত করা হয়। এতে করে সেই বস্তু থেকে সকল রঙের আলো নির্গত হতে পারে। তবে সব বর্ণের আলো সমান পরিমাণে নির্গত হবে না। সেটি নির্ভর করবে বস্তুটিকে উত্তপ্ত করার মাত্রার উপরে। অর্থাৎ, বস্তুর সর্বোচ্চ তাপমাত্রার উপর। তাপমাত্রা কম হলে আমরা আলাদা কোন আলো দেখতে পাবো না। কারণ তখন বস্তু বিকিরণ করবে অবলোহিত রশ্মি (ইনফ্রারেড)। যদি উত্তপ্ত করার মাত্রা ক্রমান্বয়ে বাড়ানো হয়, তাহলে প্রথমে আমরা বস্তু থেকে লাল বর্ণের আলো বিকিরিত হতে দেখবো। তারপর হলুদ এবং সর্বশেষে সাদা। সাধারণ বৈদ্যুতিক বাতিগুলোতে টাংস্টেনের তারকে পর্যাপ্ত পরিমাণ উত্তপ্ত করার মাধ্যমে এভাবেই পাওয়া যায় সাদা আলো।

সাদা আলোর পরিবর্তে প্রয়োজন মাফিক যে কোন নির্দিষ্ট বর্ণের আলোও উৎপাদন করা সম্ভব। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে সোডিয়াম ল্যাম্পের কথা। এর থেকে পাওয়া যায় শুধুমাত্র হলুদ আলো। ল্যাম্পগুলোর কার্যপ্রণালী বেশ সরল। ল্যাম্পের মধ্যে থাকা সোডিয়ামের মধ্যে দিয়ে তড়িৎ প্রবাহিত করা হয়। এতে করে সোডিয়াম পরমাণুর সাথে ইলেকট্রনের সংঘর্ষ হয়। যার প্রভাবে পরমাণুগুলো ভারসাম্য অবস্থা থেকে বিচ্যুত হয়। গতিশীল ইলেকট্রনের শক্তি পরমাণুর মধ্যে স্থানান্তরের কারণেই এমনটা হয়। এই ঘটনার ফলাফলস্বরূপ সোডিয়াম পরমাণুতে থাকা ইলেকট্রনগুলো নির্দিষ্ট পরিমাণ শক্তি শোষণ করে কক্ষপথের ভূমি শক্তিস্তর থেকে লাফ দিয়ে উপরের স্তরে চলে যায়। পরবর্তীতে এই উত্তেজিত ইলেকট্রনগুলো ফোটন হিসেবে অতিরিক্ত শক্তি ছেড়ে দিয়ে পুনরায় স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। নির্দিষ্ট শক্তির ফোটনগুলোই আমাদের চোখে হলুদ আলো হিসেবে ধরা দেয়।

শক্তিস্তরগুলোর মাঝে ইলেকট্রন এর চলাচল

ফোটন হিসেবে ইলেকট্রনের ছেড়ে দেয়া শক্তির মান ভূমি স্তর এবং উপরের শক্তিস্তরের মধ্যকার শক্তির পার্থক্যের সমান। পরমাণুভেদে এই শক্তির পার্থক্যের মান তারতম্য হতে পারে। অর্থাৎ, সোডিয়াম পরমাণুর পরিবর্তে অন্য পরমাণু ব্যবহার করলে ইলেকট্রনের স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসার সময়ে নির্গত ফোটনের শক্তি ভিন্ন হবে। আমরা জানি যে, ফোটনের শক্তির সাথে এর কম্পাঙ্কের সমানুপাতিক সম্পর্ক। বেশি শক্তির ফোটনের কম্পাঙ্ক বেশি। আবার, কম শক্তির ফোটনের কম্পাঙ্ক কম। তাই অন্য পরমাণু ব্যবহার করলে ফোটনের শক্তির কম বেশির মাধ্যমে কম্পাঙ্ক কম বেশি হবে এবং আলোর বর্ণও পরিবর্তন হয়ে যাবে।   

দশা পার্থক্য

সোডিয়াম ল্যাম্পে উৎপন্ন সকল ফোটন থেকে পাওয়া যায় হলুদ বর্ণের আলো। অর্থাৎ, ফোটনগুলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য একই। কিন্তু এদের মধ্যকার দশা পার্থক্যে থাকে বিস্তর ব্যবধান। প্রিয় পাঠক, দশা পার্থক্য সম্পর্কে কি জানা আছে আপনার? যদি ভুলে গিয়ে থাকেন, তাহলে একটু মনে করিয়ে দেয়া যাক। তরঙ্গ সঞ্চারণকারী কোন কণার যে কোন মুহূর্তে গতির সম্যক অবস্থানের নাম দশা। আরো সহজ করে বললে, ঠিক কোথায় তরঙ্গের বিস্তারের সর্বোচ্চ বা সর্বনিম্ন মান পাওয়া যাবে তা নির্দেশক রাশির নাম দশা। যখন সম্পূর্ণ একই দশার দুইটি তরঙ্গ একে অন্যের উপর আপতিত হয় তখন তাদের মধ্যে গঠনমূলক ব্যতিচার ঘটে। অর্থাৎ, উৎপন্ন নতুন্ন তরঙ্গের বিস্তারের সর্বোচ্চ এবং সর্বনিম্ন মান বৃদ্ধি পায়। অন্যদিকে, সম্পূর্ণ বিপরীত দশার তরঙ্গ পরস্পরের উপর আপতিত হলে প্রাপ্ত নতুন তরঙ্গের বিস্তার হয় শুন্য। অর্থাৎ, তরঙ্গগুলো একে অন্যকে নিস্ক্রিয় করে দেয়। একে বলা হয় ধ্বংসাত্মক ব্যতিচার। নিচের ছবিতে বিষয়টি দেখানো হয়েছে।

গঠনমূলক ব্যতিচার এবং ধ্বংসাত্মক ব্যতিচার

সোডিয়াম ল্যাম্পের মধ্যে সকল ধরণের দশা বিশিষ্ট ফোটন পাওয়া যায়। এতে করে সেখানে ক্রমাগত গঠনমূলক এবং ধ্বংসাত্মক ব্যতিচার সংঘটিত হতে থাকে। ফলশ্রুতিতে সোডিয়াম ল্যাম্পের মাধ্যমে একবর্ণী আলো পাওয়া গেলেও সেগুলোর তীব্রতা খুব বেশি হয় না। এখন যদি কোনভাবে সবগুলো অথবা সিংহভাগ ফোটনকে একই দশা সম্পন্ন করা সম্ভব হয়, তাহলে কেমন হত? সেই ক্ষেত্রে আমরা যেই আলো পেতাম সেটাই হতো লেজার রশ্মি।

লেজার তৈরির মূলনীতি

সাধারণ আলোর উৎস এবং লেজারের মধ্যে মূল পার্থক্য হলো একই দশার ফোটন উৎপাদনের সক্ষমতা। লেজারের মাধ্যমে উৎপন্ন আলোতে ফোটনগুলো সব একই দশায় থাকে। এতে করে সাধারণ আলোর চেয়ে ক্ষমতা এবং তীব্রতা বেড়ে যায় বহুগুণে। এখন প্রশ্ন হল যে, বিজ্ঞানীরা কিভাবে ফোটনগুলোকে একই দশা সম্পন্ন করতে সমর্থ হলেন?

যখন কোন ইলেকট্রন পরমাণুতে ভূমি শক্তিস্তরে থাকে তখন সেটি কোন শক্তি শোষণ বা বিকিরণ না করে নিউক্লিয়াসকে কেন্দ্র করে ঘুরতে থাকে। যদি সেটি নির্দিষ্ট পরিমাণ শক্তি শোষণ করে, তাহলে লাফ দিয়ে উপরের স্তরে চলে যায়। এই ঘটনার নাম শোষণ (Absorption)। সেখানে খুব অল্প সময় থাকার পরে এরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে আবার আগের জায়গায় ফিরে আসে। এই ঘটনার নাম স্বতঃস্ফূর্ত নিঃসরণ (Spontaneous Emission) । এভাবে উৎপন্ন ফোটনগুলোর দশা সমান হয় না। তবে যদি আমরা কোনভাবে উপরের শক্তিস্তর থেকে ইলেকট্রনকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে আসতে না দিয়ে, অন্য একটি ফোটন ব্যবহার করে জোর করে নিচে নামিয়ে আনতে পারি, তাহলে একটি আশ্চার্যজনক ব্যাপার ঘটে।

জোর করে নিচে নামানোর জন্য যে ফোটনটি ব্যবহার করা হচ্ছে এবং ইলেকট্রন নিচের শক্তিস্তরে নামার মাধ্যমে যেই ফোটনকে নির্গত করে, তারা উভয়েই একই দশায় থাকে। এই সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটির নাম স্টিমুলেটেড ইমিশন (Stimulated Emission)। অর্থাৎ, এই প্রক্রিয়ায় প্রথমে স্বাভাবিক নিয়মেই ইলেকট্রন বাইরে থেকে আসা শক্তি গ্রহণ করে উপরের শক্তিস্তরে যাবে। তারপর নিচে নেমে আসার আগেই অন্য একটি ফোটন দিয়ে সেই ইলেকট্রনকে ধাক্কা দিলে সেটি জোরপূর্বক নিচে নেমে আসবে। এভাবে পাওয়া যাবে দুইটি সমদশার ফোটন। এরা পার্শ্ববর্তী পরমাণুর ইলেকট্রনে একই প্রক্রিয়ার পুনরাবৃত্তি করলে পাওয়া যাবে মোট চারটি সমদশার ফোটন। এভাবে চলতেই থাকলে এক সময় পাওয়া যাবে কোটি কোটি ফোটনের স্রোত। যাদের সবাই একই দশার। আর এভাবেই পাওয়া যাবে লেজার রশ্মি। এটাই লেজার রশ্মি তৈরি গুপ্তকথা। নিচের ছবিটিতে বিষয়টি দেখানো হয়েছে।

স্টিমুলেটেড ইমিশন

স্টিমুলেটেড ইমিশনের মাধ্যমে লেজার রশ্মি তৈরি আইডিয়াটি সর্বপ্রথম আসে আলবার্ট আইন্সটাইনের কাছে থেকে। ১৯১৭ সালে প্রকাশিত ‘অন দি কোয়ান্টাম থিওরি অব রেডিয়েশন’ গবেষণাপত্রে এর বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছিলেন তিনি। পরবর্তীতে এই তত্ত্বকে কাজে লাগিয়ে লেজারকে বাস্তবে রূপ দেন পদার্থবিজ্ঞানী চার্লস হার্ড টাউনস এবং থিওডর হ্যারোল্ড ম্যাইম্যান।

ভালো কথা, লেজার (LASER) এর পুর্ণরূপ Light Amplification by Stimulated Emission of Radiation

অ্যাকটিভ মিডিয়াম

উপরের বর্ণনা করা মূলনীতি অনুসারে লেজার রশ্মি পেতে হলে আমাদের প্রথমেই প্রয়োজন হবে একটি বিশেষ মাধ্যম। যাতে স্টিমুলেটেড ইমিশন হতে পারে। সেই মাধ্যমকেই ডাকা হয় অ্যাকটিভ মিডিয়াম নামে। এদের প্রধান বৈশিষ্ট্য হল যে, এতে ইলেকট্রনগুলো শক্তি শোষণ করে উত্তেজিত হয়ে উপরের শক্তিস্তরে আসার পরে সেখানে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি সময় ধরে অবস্থান করে। এতে করে স্টিমুলেটেড ইমিশন সংঘটিত হতে পারে। আসলে “উচ্চ শক্তিস্তরে ইলেকট্রন বেশি সময় ধরে অবস্থান করে”- কথাটি সম্পূর্ণ সঠিক নয়। অ্যাকটিভ মিডিয়ামগুলোতে ভূমি শক্তিস্তর এবং উচ্চ শক্তিস্তরের মাঝে আরেকটি স্তর থাকে। যার নাম মেটাস্ট্যাবল স্টেট। সেখানেই বেশি সময় ধরে অবস্থান করে উত্তেজিত ইলেকট্রনগুলো। নিচের ছবিতে বিষয়টি দেখানো হয়েছে।

মেটাস্ট্যাবল স্টেট  

যে প্রক্রিয়ায় ভূমি শক্তিস্তরে থাকা ইলেকট্রনগুলোকে উচ্চ শক্তিস্তরে পাঠানো হয় তার নাম পাম্পিং। বিভিন্ন পদ্ধতিতে পাম্পিং করা হয়। যেমনঃ অপটিক্যাল পাম্পিং, ইলেকট্রিক্যাল পাম্পিং, কেমিক্যাল পাম্পিং ইত্যাদি। অপটিক্যাল পাম্পিং প্রক্রিয়ায় আলোর উৎস (ফোটন) ব্যবহার করে ইলেকট্রনকে উপরের স্তরে পাঠানো হয়। ইলেকট্রিক্যাল পাম্পিংয়ে ব্যবহার করা হয় ইলেকট্রন এবং কেমিক্যাল পাম্পিংয়ে রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে ইলেকট্রনকে উত্তেজিত করা হয়।

পাম্পিং এর পরে ইলেকট্রনগুলো উচ্চ শক্তিস্তরে (E3) প্রায় ১০-৭ সেকেন্ড ধরে অবস্থান করে। তারপর সেটি খুব সামান্য পরিমাণ শক্তি ছেড়ে দিয়ে চলে আসে মেটাস্ট্যাবল স্টেটে। এই সময়ে কোন ফোটন নিঃসারিত হয় না। ফোটনবিহীন এই শক্তি ছেড়ে দেয়ার প্রক্রিয়ার নাম নন রেডিয়েটিভ ট্রানজিশন। মেটাস্ট্যাবল স্টেটে ইলেকট্রন প্রায় ১০-৩ সেকেন্ড ধরে অবস্থান করতে পারে। ভূমি শক্তিস্তরে পাম্পিং অব্যাহত থাকলে খুব দ্রুতই এই স্তরে ইলেকট্রনের সংখ্যা বাড়তে থাকে। এমন এক সময় আসে যখন ভূমি শক্তিস্তরে ইলেকট্রনের সংখ্যার (N1) চেয়ে মেটাস্ট্যাবল স্টেটে ইলেকট্রনের সংখ্যা (N2) বেড়ে যায়। এই ব্যতিক্রমি ঘটনার নাম পপুলেশন ইনভার্সন। পরবর্তীতে মেটাস্ট্যাবল স্টেট থেকে ভূমি শক্তিস্তরে স্টিমুলেটেড ইমিশনের মাধ্যমে পাওয়া যায় সমদশা সম্পন্ন দুইটি ফোটন। সেগুলো পার্শ্ববর্তী পরমাণুর মেটাস্ট্যাবল স্টেটে থাকা ইলেকট্রনের সাথে একই প্রক্রিয়ার পুনরাবৃত্তি করে।

অ্যাকটিভ মিডিয়ামকে দুইটি আয়না দিয়ে ঘিরে রাখা হয়। এতে করে উৎপন্ন ফোটনগুলো আয়নাতে বার বার প্রতিফলিত হয়ে গঠনমূলক ব্যাতিচারের মাধ্যমে অ্যামপ্লিফাই হয়। আর এভাবেই পাওয়া যায় শক্তিশালী ফোটনের স্রোত তথা লেজার রশ্মি। অ্যাকটিভ মিডিয়ামকে ঘিরে রাখা আয়নাগুলোর যে কোন একটির মধ্যে একটি সরু ছিদ্র থাকে। সেই ছিদ্র দিয়ে উৎপন্ন লেজার রশ্মিকে বাইরে বাইরে নিয়ে আসা হয়। অনেক লেজারে আয়নাতে ছিদ্র রাখার পরিবর্তে সেটিকে অর্ধ স্বচ্ছ করে বানানো হয়।

লেজার ডিভাইস

পপুলেশন ইনভার্সন

প্রিয় পাঠক, উপরের আপনাকে পপুলেশন ইনভার্সনের সাথে হালকা পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়েছে। এবার একটু গভীরে যাওয়া যাক। এটি এমন এক অবস্থা যাতে উচ্চ শক্তিস্তরে উত্তেজিত ইলেকট্রনের সংখ্যা নিচের শক্তিস্তরের স্বাভাবিক ইলেকট্রনের চেয়ে বেশি হয়। যদি কোন পরমাণুতে কেবল দুইটি শক্তিস্তর থাকে, তাহলে এটি অর্জন করা সম্ভব নয়। কারণ নিচের শক্তিস্তর থেকে সর্বোচ্চ ৫০% ইলেকট্রনকে উপরে নিয়ে আসা সম্ভব। বাকিগুলোকে উপরে আনার আগেই স্বতঃস্ফূর্ত নিঃসরণের মাধ্যমে উত্তেজিত ইলেকট্রনগুলো নিচে নেমে চলে আসে। তবে যদি দুইটি শক্তিস্তরের মাঝে আরেকটি অস্থায়ী স্তর থাকে (মেটস্ট্যাবল স্টেট), তাহলেই কেবলমাত্র পপুলেশন ইনভার্সন অর্জন করা যাবে।

পাঠকের মনে এতক্ষনে নিশ্চয়ই একটি প্রশ্নের উদয় হয়েছে। কেন পপুলেশন ইনভার্সন নিয়ে আমরা এত কথা বলছি। লেজার রশ্মি উৎপাদনের ক্ষেত্রে এটা কি খুব প্রয়োজনীয়? কারণ এই প্রক্রিয়া ছাড়াও তো স্টিমুলেটেড ইমিশনের মাধ্যমে সমদশার ফোটন পাওয়ার কথা। ঠিক ধরেছেন পাঠক। আপনার চিন্তায় কোন ভুল লেই। তবে একটি বিষয় আপনার দৃষ্টি এড়িয়ে গিয়েছে। ব্যাখ্যা করে বলছি।

আমরা জানি যে, স্টিমুলেটেড ইমিশন হতে হলে মেটাস্ট্যাবল স্টেটে থাকা ইলেকট্রনকে ধাক্কা দিতে হয়ে ফোটন দিয়ে। এতে উৎপন্ন সমদশার দুইটি ফোটন অন্য পরমাণুর মেটাস্ট্যাবল স্টেটে থাকা ইলেকট্রনকে গিয়ে ধাক্কা দিয়ে প্রক্রিয়ার পুনরাবৃত্তি করে। কিন্তু সমস্যা হল যে, অন্য পরমাণুতে স্বাভাবিক অবস্থা এবং উত্তেজিত অবস্থা, উভয় ধরণের ইলেকট্রনই থাকে। তাই সমদশার ফোটনগুলো যে সব সময় উত্তেজিত ইলেকট্রনকেই ধাক্কা দিবে তা নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়। যদি তারা স্বাভাবিক অবস্থার ইলেকট্রনকে ধাক্কা দেয়, তাহলে সেই ইলেকট্রন লাফ দিয়ে উপরের স্তরে চলে যাবে। অর্থাৎ, শোষণ (Absorption) প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে। এতে করে সমদশার ফোটনগুলো অপচয় হবে। সম্ভাব্যতার বিচারে এই ঘটনা ঘটার মান ৫০%। অর্থাৎ, ফোটন এক হয় স্টিমুলেটেড ইমিশনে অংশ নেবে অথবা শোষণে অংশ নেবে। যদি পরমাণুতে ভূমি শক্তিস্তরে স্বাভাবিক অবস্থার ইলেকট্রনের সংখ্যা বেশি থাকে, তাহলে অপচয়ের স্বীকার হওয়া ফোটনের সংখ্যা বেশি হবে। ফলশ্রুতিতে লেজার রশ্মি উৎপাদন বাঁধাগ্রস্থ হবে। তবে যদি আমরা পপুলেশন ইনভার্সন অর্জন করতে পারি, তাহলে স্টিমুলেটেড ইমিশনের মাত্রা অনেক বেশি হবে। সেজন্যই পপুলেশন ইনভার্সন এতো প্রয়োজনীয়।

হরেক রকম লেজার

অ্যাকটিভ মিডিয়ামের উপরে নির্ভর করে উৎপন্ন লেজার রশ্মির বর্ণ এবং তরঙ্গদৈর্ঘ্য। লেজার রশ্মির তরঙ্গদৈর্ঘ্য যে শুধুমাত্র দৃশ্যমান আলোর সীমাতে থাকবে এমনটা নয়। অন্য তাড়িতচৌম্বক তরঙ্গের সীমার মধ্যেও থাকতে পারে। তবে সেই লেজার রশ্মিগুলো হবে অদৃশ্য।

অ্যাকটিভ মিডিয়ামের উপর নির্ভর করে লেজারকে মোটামুটি চার ভাগে ভাগ করা যায়। সেগুলো হলঃ

  • সলিড স্টেট লেজার
  • গ্যাস লেজার
  • লিকুইড লেজার
  • সেমিকন্ডাক্টর লেজার

সলিড স্টেট লেজারে অ্যাকটিভ মিডিয়াম হিসেবে ব্যবহার করা হয় কঠিন পদার্থকে। স্যাফায়ার (Al2O3), রুবি ইত্যাদি এদের উদাহরণ। সর্বপ্রথম ১৯৬০ সালে আমেরিকান পদার্থবিদ থিওডোর মাইম্যান রুবি পাথরের রডকে অ্যাকটিভ মিডিয়াম হিসেবে ব্যবহার করে তৈরি করেন লাল রঙের দৃশ্যমান আলোর লেজার রশ্মি। এই ধরণের লেজারের প্রচলন এখনও আছে।

গ্যাস লেজারে অ্যাকটিভ মিডিয়াম থাকে গ্যাসীয় অবস্থায়। কয়েক ধরণের গ্যাসের মিশ্রণের মাধমের তৈরি করা হয় এদের। ব্যবহৃত গ্যাসের নাম অনুসারে এই ধরণের লেজারের নামকরণ করা হয়। যেমনঃ হিলিয়াম-নিয়ন লেজার, আর্গন লেজার, কার্বন ডাই অক্সাইড লেজার, কার্বন মনোক্সাইড লেজার ইত্যাদি।

লিকুইড লেজারে অ্যাকটিভ মিডিয়াম থাকে তরল অবস্থায়। ডাই (রঞ্জক পদার্থ) লেজার এদের উৎকৃষ্ট উদাহরণ। দ্রাবকের সাথে জৈব রঞ্জকের সংমিশ্রণে তৈরি করা হয় অ্যাকটিভ মিডিয়াম। এদের মাধ্যমে পাওয়া লেজার রশ্মির তরঙ্গদৈর্ঘ্য অতি বেগুনি রশ্মি এবং অবলোহিত রশ্মির সীমার কাছাকাছি। ১৯৬৬ সালে সর্বপ্রথম এদের তৈরি করা হয়। সবার শেষে রয়েছে সেমিকন্ডাক্টর লেজারগুলো। এরা বেশ সস্তা এবং আকারে ছোট। এতে সেমিকন্ডাক্টরের p-n জাংশনকে অ্যাকটিভ মিডিয়াম ব্যবহার করা হয়।  

ব্যবহার

লেজারের ব্যবহার বলে শেষ করা যাবে না। আধুনিক বিশ্বের সিংহভাগ প্রযুক্তিতে এদের সরব উপস্থিতি রয়েছে। ব্যতিক্রমী কয়েকটি উদাহরণ দিয়ে আজকের আলোচনা শেষ করা যাক। দূরত্ব পরিমাপের অন্যতম অনুষঙ্গ লেজার। স্বল্প দূরত্ব পরিমাপের পাশাপাশি দীর্ঘ দূরত্ব পরিমাপেও অত্যন্ত কার্যকর এরা। পৃথিবী থেকে চাঁদের মধ্যকার দূরত্ব পরিমাপ করা যায় লেজার ব্যবহার করে। ১৯৬৯ সালের জুলাইয়ে চন্দ্র বিজয়ের সময়ে নভোচারীরা চাঁদের পৃষ্ঠে কিছু আয়না রেখে আসেন। সেগুলো আজও সেখানে রয়েছে অক্ষত অবস্থায়। পৃথিবী থেকে উচ্চ শক্তির লেজার রশ্মি নিক্ষেপ করলে সেই আয়নাগুলোতে প্রতিফলিত হয়ে তা আবার পৃথিবীতে ফেরত আসে। এদের যাওয়া আসার সময় পরিমাপের মাধ্যমে খুব সূক্ষ্মভাবে পরিমাপ করা যায় পৃথিবী থেকে চাঁদের দূরত্ব।

 ভিন্ন ভিন্ন রঙের লেজার রশ্মি যেমন হতে পারে, তেমনি হতে পারে ভিন্ন ভিন্ন তীব্রতার লেজার রশ্মি। এদের প্রত্যেকের আলাদা ব্যবহারিক প্রয়োগ রয়েছে। উচ্চ ক্ষমতার লেজার দিয়ে কৃত্রিমভাবে নিউক্লিয়ার ফিউশন বিক্রিয়া ঘটানো সম্ভব। পাশাপাশি এদেরকে অস্ত্র হিসেবেও ব্যবহার করা যায়। বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক গবেষণাতেও এদের প্রয়োজনীয়তা সীমাহীন।

লেজারের আরেকটি চমকপ্রদ ব্যবহার রয়েছে। এদেরকে কৃত্রিম নক্ষত্রের আলো হিসেবে ব্যবহার করা যায়। আমারা জানি যে, দূরবর্তী নক্ষত্র থেকে আসা আলো পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের মধ্যে দিয়ে আসার সময়ে এর প্রভাবে কিছুটা বেঁকে যায়। এতে করে আধুনিক অ্যাস্ট্রোফটোগ্রাফির মাধ্যমেও সূক্ষ্মভাবে নক্ষত্রগুলোর অবস্থান নির্ধারণ করা সম্ভব হয় না। লেজার রশ্মি ব্যবহার করে বায়ুমন্ডলের প্রভাবে সংঘটিত হওয়া বিকৃতির মাত্রা পরিমাপ করা সম্ভব।

পার্লা লেজার

চিলিতে অবস্থিত ইউরোপিয়ান সাউদার্ন অবজারভেটরিতে থাকা পার্লা লেজার ব্যবহার করে প্রায় ৯০ কিলোমিটার পর্যন্ত বায়ুমণ্ডলের টার্বুলেন্সের কারণে সংঘটিত বিকৃতির মাত্রা পরিমাপ করা যায়।  

তথ্যসুত্রঃ

লেখাটি 628-বার পড়া হয়েছে।

ই-মেইলে গ্রাহক হয়ে যান

আপনার ই-মেইলে চলে যাবে নতুন প্রকাশিত লেখার খবর। দৈনিকের বদলে সাপ্তাহিক বা মাসিক ডাইজেস্ট হিসেবেও পরিবর্তন করতে পারেন সাবস্ক্রাইবের পর ।