দূরের কোনো বস্তুকে বড় করে দেখার যন্ত্রের নাম হচ্ছে দূরবীন। সাধারণত আয়না বা লেন্সের সাহায্যে দূরবীন তৈরি করা হয়। তবে প্রকৃতিতেও কখনও কখনও দূরবীনের দেখা মেলে। কীভাবে তৈরি হয় সেই দূরবীনের?
আলোর করপাসল তত্ত্ব
আদিকালে ধরা হতো আলো হচ্ছে একপ্রকার কণা। এই কণার নাম করপাসল। এই অদৃশ্য কণা সকল উজ্জল বস্তু থেকে বিপুল পরিমাণ বেগ নিয়ে নির্গত হয়। এই কণাকে স্থিতিস্থাপক হিসেবে ধরে নেওয়া হয়। সকল দিকেই এ কণা সমানভাবে, সমান বেগে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে। যদি এদের কোনো বল প্রয়োগ করা না হয়, তবে এরা সরলপথে চলতে থাকে। কিছু করপাসলের আকার বড়ো আর কিছু করপাসলের আকার ছোটো। এই আকারের ভিন্নতার ফলেই নানান রঙের আলো দেখতে পাওয়া যায়। আলোকে এভাবে একটা কণার সাথে তুলনা করে বিজ্ঞানী আইজ্যাক নিউটন তার অপটিকস নামক বইতে একটি তত্ত্ব গঠন করেন। আলো কীভাবে চলাচল করে, কীভাবে আলোর উজ্জ্বলতা বাড়ে-কমে তা নিয়ে দেওয়া এই তত্ত্বের নাম হচ্ছে আলোর কসপাসল তত্ত্ব। এই করপাসল একটি খুবই ক্ষুদ্র ভরবিশিষ্ট কণা। আর ভরবিশিষ্ট কণা মানেই এটি মহাকর্ষ বল দ্বারা প্রভাবিত হবে।
ধরুন, আলোর এই করপাসল একটি নক্ষত্রের কাছ দিয়ে গমন করছে। নিউটনের মহাকর্ষ সূত্র মতে ঐ নক্ষত্র আর করপাসলের মধ্যে একটি আকর্ষণধর্মী বল কাজ করবে। নক্ষত্রের ভর যত বেশি হবে, এই আকর্ষণ বল তত বেশি কাজ করবে। আর নক্ষত্রের যত কাছে দিয়ে করপাসল যাবে, তত বেশি আকর্ষিত হবে। এই আকর্ষনের কারণে আলোক রশ্মি তার সরলরেখা বরাবর গতি বজায় রাখতে পারবে না। সামান্য বেঁকে যাবে মহাকর্ষের প্রভাবে।
আলোর এই বেঁকে যাওয়া নিয়ে পিয়েরে সায়মন ল্যাপ্লাস, হেনরি ক্যাভেন্ডিস ও জন মিশেল কাজ করেন। তাদের মাঝে এই নিয়ে বেশ কয়েকবার চিঠি চালাচালিও হয়েছিল। নিউটনের গতিসূত্র ও মহাকর্ষ সূত্রের নানা প্রভাব হিসাব করে তারা হিসাব করতে সক্ষম হন যে একটি নক্ষত্রের কারণে একটি আলোকরশ্মি কতটুকু বেঁকে যাবে। আলোক রশ্মি যে কোণে বেঁকে যায় তাকে বলা হয় বিচ্যুতি (Deflection) কোণ। যদি $M$ ভরের একটি নক্ষত্রের থেকে $R$ পরিমাণ দূরে দিয়ে একটি আলোক রশ্মি যাওয়ার চেষ্টা করে তাহলে এটি যে কোণে বেঁকে যাবে তা হচ্ছে $$ \alpha = \frac{2GM}{c^2 R} $$
এখানে G হচ্ছে সার্বজনীন মহাকর্ষীয় ধ্রুবক যার মান $6.67 × 10^{-11}$ N m−2 kg−2 এবং $c$ হচ্ছে আলোর বেগ 299792 km s−1। আমাদের নিকটবর্তী নক্ষত্র সূর্যের জন্য হিসাব করলে এই বিচ্যুতি কোনের মান পাওয়া যায় প্রায় 0.875 আর্ক সেকেন্ড। এই কোণকে কখনও কখনও নিউটনের কোণ হিসেবেও ডাকা হয়।
আলোর করপাসল তত্ত্ব বেশ সহজ। এছাড়াও অনেকগুলো পরীক্ষা নিরীক্ষাতেই এর সফলতা পাওয়া যায়। তবে আলোর নানা ঘটনা এই তত্ত্ব দ্বারা ব্যাখ্যা করাও যাচ্ছিল না। যেমন বিজ্ঞানী বয়েল ও হুক আলাদা আলাদাভাবে দেখান যে একটি উত্তল লেন্সকে একটি কাগজে রাখলে কাগজের উপরে গোল গোল ডোরাকাটা রিং-এর আবির্ভাব হয়। কেন এই রিং-এর উৎপত্তি হয় তা করপাসল তত্ত্ব ব্যাখ্যা করতে পারে না। একটি সরু ছিদ্রের মধ্যে দিয়ে যাওয়ার সময় আলো চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। যদি সুক্ষ্ম দুইটি সরু ছিদ্রের পিছনে আলোক রশ্মি রাখা হয় তাহলে অপর প্রান্তে ডোরাকাটা দাগের ছায়া লক্ষ্য করা যায়। কেন এমন হয় তা কোনোভাবেই ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয় নি আলোর করপাসল তত্ত্বের মাধ্যমে। তাই আমাদের দরকার পড়ে আলোর করপাসল তত্ত্বের থেকেও সফল একটি তত্ত্বের।
আলোর নতুন তত্ত্ব
আইজ্যাক নিউটনের পর ওলন্দাজ বিজ্ঞানী ক্রিশ্চিয়ান হাইগেনস আলোর নতুন একটি তত্ত্ব নিয়ে আবির্ভূত হন। তিনি বলেন আলো আসলে এক প্রকার তরঙ্গ। এটি তরঙ্গাকারে চলাচল করে। যদি দুইটি ছিদ্র দিয়ে দুইটি ভিন্ন ভিন্ন আলোর তরঙ্গ যায় তাহলে তাদের উপরিপাতন ঘটে। উপরিপাতনে যদি এরা সমদশায় মিলিত হয়, তাহলে একটি উজ্জ্বল ডোরার সৃষ্টি হয়। যদি এরা বিপরীত দশায় মিলিত হয়, তাহলে একটি অন্ধকার ডোরার সৃষ্টি হয়। এই উজ্জ্বল অন্ধকার ডোরা তৈরির পরীক্ষাটি পরবর্তীতে আবার ফিরে আসে বিজ্ঞানী থমাস ইয়ং-এর দ্বি চির পরীক্ষার মাধ্যমে এবং সেই পরীক্ষার ফলাফল বিশ্লেষণ করেই ভিত্তি গড়ে উঠে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের।
আলোর করপাসল তত্ত্ব যেসব ঘটনা ব্যাখ্যা করতে পারছিল না, সেসব ঘটনা আলোর এই নতুন তরঙ্গ তত্ত্বের সাহায্যে খুব সহজেই ব্যাখ্যা করা যাচ্ছিল। কিন্তু এই তত্ত্বেরও একটি সীমাবদ্ধতা রয়ে গেল। বিজ্ঞানীরা যখন আলোর এই তরঙ্গ তত্ত্বের প্রস্তাবনা করেন, তখন তারা ভাবছিলেন ‘তরঙ্গ চলতে একটি মাধ্যমের প্রয়োজন। আলোক তরঙ্গ কোন মাধ্যমে চলে?’ তখন হাইগেনস লুমিনিফেরাস ইথার নামে একটি কাল্পনিক মাধ্যমের মধ্যে দিয়ে আলোক তরঙ্গ চলাচল করে এমনটা ধরে নেন। পরবর্তীতে বিজ্ঞানী হাইনরিখ হার্জ ও জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে দেখাতে সমর্থ হন যে আলো আসলে একটি তাড়িৎ-চৌম্বক তরঙ্গ। এটি চলতে কোনো মাধ্যমের প্রয়োজন পড়ে না। শুন্য মাধ্যমে এটি 299792458 m/s বেগে চলাচল করে।
আইনস্টাইনের আলো
১৮৮৭ সালে জার্মান পদার্থবিজ্ঞানী হাইনরিখ হার্জ লক্ষ্য করেন, যদি একটি দস্তার পাতের উপর যথেষ্ট শক্তিসম্পন্ন অতিবেগুনি রশ্মি নিক্ষেপ করা হয় তাহলে পাত থেকে কিছু পরিমাণ ইলেকট্রন বিচ্ছুরণ ঘটে। এই ঘটনাকে ফটো ইলেকট্রিক ইফেক্ট বলা হয়। কেন এই ইলেকট্রন বিচ্ছুরণ হয় তার ব্যাখ্যা হার্জের কাছে ছিল না। এছাড়াও আলোর তরঙ্গ তত্ত্ব দিয়ে সফলভাবে এই ইফেক্ট ঘটার কারণ ব্যাখ্যা করা সম্ভব হচ্ছিল না।
১৯০৫ সালে বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন বলেন, আলো আসলে কণা ধর্ম এবং তরঙ্গ ধর্ম উভয়ই প্রকাশ করতে পারে। আলোর মত এসব কণা যে আসলেই কণা ধর্ম ও তরঙ্গ ধর্ম উভয়ই একইসাথে প্রদর্শন করতে পারবে তার একটি গাণিতিক ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছিলেন লুই ডি ব্রগলি। একই সাথে কণা আবার একই সাথে তরঙ্গ বিষয়টি কিছুটা উদ্ভট শোনালেও, বাস্তবে আসলে এমনই হয়। প্রত্যেক বস্তুরই কণা ধর্ম ও তরঙ্গ ধর্ম একই সাথে অবস্থান করে। তবে যার ভর বেশি সে তার কণা ধর্ম তত বেশি প্রভাব দেখাতে সক্ষম হয়। ইলেকট্রন কিংবা আলোর কণাগুলোর ভর অতি নগন্য বলে এদের তরঙ্গ ধর্মটি মূখ্য প্রভাব বিস্তার করে। তবে এরা একই সাথে কণার মতোও আচরণ করতে পারবে।
পরবর্তীতে আলোর এই উভয় ধর্ম বিবেচনা করে বিজ্ঞানী আইনস্টাইন তার আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্ব প্রকাশ করেন। তখন তিনি পুনরায় হিসেব করেন একটি ভারী বস্তুর জন্য আলো কী পরিমাণ বেঁকে যায়। তার গাণিতিক হিসাব বলে, ক্ল্যাসিক্যালি যেই পরিমাণ বিচ্যুতি কোণ তৈরি হওয়ার কথা, বাস্তবে আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্বনুসারে তার দ্বিগুণ বিচ্যুতি হবে। সেক্ষেত্রে সূর্যের পৃষ্ঠের কোনো কণার জন্য বিচ্যুতি কোণ হবে 1.75 আর্ক সেকেন্ড।
লেন্স ও ছবি
একটি উত্তল লেন্স এর একপাশে যদি কোনো একটি বস্তু রাখা হয় তাহলে লেন্সের অপরপাশে ঐ বস্তুর একটি ছবি তৈরি হয়। মূলত আলো এসে বস্তুতে পড়ে এবং বস্তুর বিভিন্ন অংশের সাথে বাধা পেয়ে সেই আলোক রশ্মি প্রতিফলিত হয়। সেই আলোক রশ্মি আবার উত্তল লেন্সের মধ্য দিয়ে যায়। উত্তল লেন্স এর আশেপাশের পরিবেশের তুলনায় অধিক ‘ঘন’ হয়।
লেন্সের এই তুলনামূলক ঘন হওয়ার কারণে এটি আলোকরশ্মিগুলোকে একটি নির্দিষ্ট বিন্দুতে ফোকাস করতে পারে। ঐ লেন্সের ফোকাসকৃত আলোকরশ্মিগুলো দিয়েই তৈরি হয় বস্তুর ছবি। লক্ষ্য করুন, এখানে ছবি তৈরির ক্ষেত্রে মূল প্রক্রিয়া হচ্ছে আলোকরশ্মিগুলোকে বাঁকিয়ে ফোকাস করা। লেন্স আলোকরশ্মি বাঁকাতে পারে বলে এটি দিয়ে ছবি তৈরি করা যায়।
একটি বিষয় এবার কল্পনা করুন। কোনো একটি কোয়াসার থেকে অনেক আলোকরশ্মি ছড়িয়ে পড়ছে। আর আমরা পৃথিবীতে বসে আছি। পৃথিবী আর কোয়াসারের মাঝে অনেক ভারী একটি নক্ষত্র আছে। এই ভারী নক্ষত্র আমাদের পূর্বের আলোচনা মোতাবেক কোয়াসার থেকে আসা আলোকে বাঁকিয়ে ফেলতে পারবে। এই বেঁকে যাওয়া আলো আমাদের পৃথিবীতে ঐ কোয়াসারের একটি প্রতিচ্ছবি তৈরি করে। উপরের চিত্রে মূল বস্তুর জায়গায় কোয়াসার, লেন্সের জায়গায় ভারী নক্ষত্র কল্পনা করলে বুঝবেন কোয়াসারের যে ছবিটি তৈরি হচ্ছে তা আমাদের পৃথিবীর অবস্থানে। এভাবে মহাকাশের কোনো বস্তুর সাহায্যে আলোকে বাঁকিয়ে দিয়ে ছবি তৈরির প্রক্রিয়াকে কেতাবি ভাষায় বলা হয় গ্র্যাভিটেশনাল ল্যান্সিং।
আপেক্ষিকতার সাধারণ সূত্রের সাহায্যে হিসাব করে দেখানো যায় যদি দূরবর্তী কোনো বস্তু, লেন্সিং করতে সক্ষম এমন নক্ষত্র ও আমাদের পৃথিবী একই সরলরেখায় থাকে তাহলে পৃথিবী থেকে ঐ বস্তুকে একটি রিং-এর মত দেখাবে। এই রিং-কে আইনস্টাইনের রিং বলা হয়। আর যদি বস্তু, লেন্স ও পৃথিবী একই সরলরেখায় না থাকে তাহলে ঐ বস্তুকে দুইবার বা চারবার দেখা যাবে। কোনো একটি বস্তুকে এভাবে লেন্সের মাধ্যমে দেখলে যদি তার চারটি ছবি তৈরি হয় তাহলে তাকে আইনস্টাইনের ক্রস নামেও ডাকা হয়।
প্রকৃতির দূরবীন
উপরে আমরা যাই আলোচনা করলাম সবই খাতা কলমে সীমাবদ্ধ না কি প্রকৃতিতেও এর অস্তিত্ব আছে তা দেখার জন্যই ১৯৭০-এর দশকে মাঠে নামেন বিজ্ঞানীদের একটি দল। অবশেষে ১৯৭৯ সালে প্রথমবারের মত অস্তিত্ব মিলে গ্র্যাভিটেশনাল লেন্সিং ইফেক্ট এর। একটি নক্ষত্রের ভর খুব কম হওয়ায় এটি যথেষ্ট পরিমাণে আলো সবসময় বাঁকাতে পারে না। তাই অধিকাংশ সময় একটি গ্যালাক্সি বা কোয়াসার এই লেন্স হিসেবে কাজ করে।
উপরের চিত্রের কেন্দ্রে দুইটি আলাদা আলাদা গ্যালাক্সি রয়েছে। এই গ্যালাক্সিগুলোর পিছনের কোনো এক জায়গায়, বহুদূরে অবস্থান করছে একটি কোয়াসার। কোয়াসার, গ্যালাক্সিদ্বয় ও আমাদের পৃথিবী একই সরলরেখায় নেই। ফলে গ্র্যাভিটেশনাল লেন্সিং ইফেক্টের কারণে কোয়াসার থেকে আসা আলো বেঁকে যাচ্ছে। বেঁকে যাওয়া আলো আমাদের পৃথিবীতে এসে কোয়াসারের চারটি ছবি তৈরি করছে। এছাড়াও লেন্সিং এর কারণে একটি বৃত্তের মত বস্তুও দেখা যাচ্ছে। এই চিত্রটি হাবল স্পেস টেলিস্কোপের সাহায্যে ২০০৯ সালে তোলা হয়েছিল। গ্যালাক্সিদ্বয়ের পিছনে অবস্থান করছে 2M1310-1714 নামের একটি কোয়াসার।
গ্র্যাভিটেশনাল লেন্সিং ইফেক্টের মাধ্যমে একটি গ্যালাক্সির মধ্যে ভর কীভাবে বিন্যস্ত আছে তা জানতে পারি। লেন্স যেমন একটি ছোট বস্তুকে বিবর্ধিত করে দেখতে আমাদেরকে সহায়তা করে, তেমনি লেন্সিং ইফেক্টের সাহায্যেও দেখতে খুবই ক্ষুদ্র একটি বস্তুকে বিবর্ধিত করে দেখা সম্ভব। সাম্প্রতিক সময়ে ডার্ক ম্যাটারের অস্তিত্ব নির্ণয়ের নানা গবেষণা করতেও এই ইফেক্ট নিয়ে কাজ করা হচ্ছে। আশা করা যায়, খুব শীঘ্রই প্রকৃতির আরো নানা রহস্য সমাধানে ভূমিকা রেখে যাবে প্রকৃতিতে তৈরি হওয়া এই দূরবীন।
তথ্যসূত্র
- Meneghetti, M. (2021). Introduction to Gravitational Lensing: With Python Examples (Vol. 956). Springer Nature.
- Hubble Sees Cosmic Quintuple. NASA.
Leave a Reply