ঘুরে আসি সিঙ্গুলারিটি

লেখাটি , বিভাগে প্রকাশিত

চলুন এক দুই মিনিটের জন্য আমরা স্থানকালের মধ্য দিয়ে ভ্রমণ করি। কল্পনা করুন আমরা মহাকাশে ঘুরে বেড়াচ্ছি, নক্ষত্র দেখছি, গ্যালাক্সিকে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছি। ঠিক এমন সময় হঠাৎ কোনো এক অদৃশ্য শক্তি আমাদের টেনে নিতে লাগলো। আমরা শক্তির উৎসের যতো কাছাকাছি যাচ্ছি ততই আমাদের গতি বেড়ে যাচ্ছে। একসময় আমরা এতো দ্রুত চলতে লাগলাম যে সময়ের গতিও আমাদের কাছে ধীর হয়ে যেতে লাগলো। আমরা ভীষণ ভারি হয়ে পড়ছি, তবুও কোনো কিছুই আমাদের ঠেকাতে পারছে না, আমরা ছুটে চলছি কৃষ্ণগহ্বরের দিকে ৷ আরও চলতে থাকলে আমরা দেখতো পাবো একটা কালো কেন্দ্রের চারদিকে উজ্জ্বল আলোর ধারা ঘুরছে। এটা হলো ঘটনা দিগন্ত। এটাকে অতিক্রম করলে মহাকর্ষ এতোটাই শক্তিশালী হয় যে আলোও তার থেকে রেহাই পায় না৷

আমাদের ভ্রমণ এখানেই শেষ করতে হবে। শারীরিক ধকলের কথা নাহয় বাদই দিলাম, এই বিন্দুর বাইরে কি আছে তা আমাদের কল্পনার বাইরে। আমাদের মহাবিশ্ব বোঝার উপায় মূলত দুইটা – বড় স্কেলের বস্তুর জন্য আপেক্ষিক তত্ত্ব এবং ছোট স্কেলের বস্তুর জন্য কোয়ান্টাম বলবিদ্যা। বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন আপেক্ষিক তত্ত্ব দিয়েছেন। এটা বস্তুর উপর মহাকর্ষের প্রভাব ব্যাখ্যা করে। এটা সময়কে চতুর্থ মাত্রা হিসেবে বিবেচনা করে৷ সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্ব কিছু ঘটনার দারুণ ব্যাখ্যা দেয় যেমনঃ ভারী বস্তুর কাছে স্থানকালের বেঁকে যাওয়া, গতিশীল বস্তুর সময় ধীরগতিতে চলা, বৃহৎ আকারের  বস্তুর গতিপ্রকৃতি ইত্যাদি ৷ একটা পর্যায় পর্যন্ত এটা সবকিছু সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে। অণু-পরমাণু সাধারণ বস্তুর চেয়ে ভিন্ন নিয়মে চলে। এগুলোর আচরণ ব্যাখ্যার জন্য কোয়ান্টাম বলবিদ্যার প্রয়োজন।  কোয়ান্টাম বলবিদ্যা আপাতদৃষ্টিতে অদ্ভূত কিছু নিয়মে চলে যেমন- পরমাণু একই সাথে দুই জায়গায় থাকতে পারে, এনট্যাঙ্গলে আবদ্ধ দুইটা কণা অনেক দূরে থেকেও একই সাথে তথ্য বিনিময় করতে পারে, কণার অবস্থান আর ভরবেগ একসাথে জানা সম্ভব হয়না ইত্যাদি। 

এখন আমরা এমন এক জায়গায় পৌঁছে গিয়েছি যেখানে আপেক্ষিক তত্ত্ব আর কোয়ান্টাম বলবিদ্যার মিলন ঘটে। কিন্তু কিভাবে হয় সেটা আমরা জানি না। এই দুইটা তত্ত্বের একত্রিত হওয়াটাকে ব্যাখ্যা করাই আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেন্জ। আপেক্ষিক তত্ত্ব ও কোয়ান্টাম বলবিদ্যা দুটোই তাদের নিজেদের ফিল্ডে দারুণ কাজ করে। কিন্তু দুটোকে একত্রে ভাবতে গেলেই ঘটে বিপত্তি, যেমনঃ কৃষ্ণ গহ্বরের কেন্দ্রে কি ঘটছে তা ব্যাখ্যা করা৷ সাধারণ আপেক্ষিকতা থেকে জানা যায় কৃষ্ণহ্বরের অস্তিত্ব আছে । কৃষ্ণগহ্বরের কেন্দ্রের মতো এত ক্ষুদ্র জায়গায় কাজ করছে ভীষণ শক্তিশালী মহাকর্ষ ক্ষেত্র। তাই সেখানে প্রকৃতপক্ষে  কি ঘটছে তা আমাদের জানার উপায় নেই। 

কৃষ্ণগহ্বরের ভেতর স্থান-কাল মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়। সিঙ্গুলারিটির ভেতর মিলন ঘটে আপেক্ষিক তত্ত্ব আর কোয়ান্টাম বলবিদ্যার।

আপেক্ষিক তত্ত্ব আর কোয়ান্টাম তত্ত্বকে একসুতায় বাঁধা যাবে কি করে?  

যাইহোক কিছুটা আশার আলো দেখা যাচ্ছে। সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা একটা আইডিয়ার হদিস দিয়েছেন যা কোয়ান্টাম বলবিদ্যাকেও সাধারণ আপেক্ষিকতার মতো বুঝতে সাহায্য করবে। আইডিয়াটা বলছে  কয়েকটি পরীক্ষার মাধ্যমে একটা একত্রিত তত্ত্ব বা থিওরি অব এভরিথিং পাওয়া সম্ভব। প্রথমেই ভাবা যাক,  কোয়ান্টাম গ্রাভিটি থিওরির কথা। এই তত্ত্ব সাধারণ আপেক্ষিকতা থেকে আইডিয়া নিয়ে সেগুলো কোয়ান্টাম বলবিদ্যায় বসানোর চেষ্টা করা হয় যেমনঃ স্থানকাল। এই তত্ত্বের দুইটা ব্যাখ্যা আছে।  একটা ব্যাখ্যায় মহাকর্ষক্ষেত্রকে তড়িৎচৌম্বকীয় ক্ষেত্রের মতোই ধরা হয়৷ মনে করা হয় ফোটন যেমনভাবে তড়িৎচৌম্বকীয় মিথষ্ক্রিয়া বহন করে তেমন করে গ্রাভিটন নামের তাত্ত্বিককণা মহাকার্ষের মিথষ্ক্রিয়াকে বহন করে৷ কিন্তু গ্রাভিটনের এই মিথষ্ক্রিয়া এতোটাই দূর্বল যে এটাকে শনাক্ত করা খুবই কঠিন৷ 

পদার্থবিদ লাজোস ডিয়োসি
নোবেলজয়ী পদার্থবিদ রজার পেনরোজ

পদার্থবিদ লাজোস ডিয়োসি আর রজার পেনরোজ, দুজনই কোয়ান্টাম বলবিদ্যায় বিশেষ অবদান রেখেছেন। সত্তর-আশির দশকে তাঁরা একটা হাইপোথিসিস দেন। তাঁদের মতে মহাকর্ষক্ষেত্র কোয়ান্টাম সুপারপজিশনে থাকতে পারে না। কারণ এতে করে পরমাণুর তরঙ্গ ফাংশন ভেঙে পড়ে। আবার এই হাইপোথিসিসেরই আরেকটি ব্যাখ্যায়, কোয়ান্টাম সুপারপজিশনকে আপেক্ষিক তত্ত্বের স্থানকালের বক্রতার মতো করে ভাবা হয়৷ এরপর আসে সবচেয়ে শক্তিশালী হাইপোথিসিস- স্ট্রিং থিওরি৷ এটা বলে পদার্থ ইলেকট্রন, প্রোটন, কোয়ার্ক দিয়ে গঠিত নয় বরং অতিক্ষুদ্র কম্পনশীল তার দিয়ে গঠিত৷ তারের কম্পনকেই আমরা কণা হিসেবে দেখি। সমস্যা হলো এটা ব্যাখ্যার জন্য অতিরিক্ত মাত্রার প্রয়োজন হয়, যা পরীক্ষা করে প্রমাণ করার উপায় নেই। এটা বলা ভুল হবে না যে, গাণিতিক অসঙ্গতি এবং পরীক্ষার সক্ষমতার অভাবে কোয়ান্টাম বলবিদ্যা আর আপেক্ষিকতা একত্রিত করার প্রতিটা হাইপোথিসিসই ব্যর্থ। 

আমরা যদি এখন একটু অন্যভাবে ভাবার চেষ্টা করি তাহলে কেমন হয় । এবারে আপেক্ষিকতা থেকে আইডিয়া নিয়ে কোয়ান্টাম বলবিদ্যায় বসানোর বদলে কোয়ান্টাম বলবিদ্যার সময়ের ধারণাকেই পাল্টানো যাক। আপেক্ষিকতায় সময় এবং স্থান একসাথে সংযুক্ত। গতি বা মহাকর্ষের উপর নির্ভর করে এটা বেঁকে যেতে পারে, প্রসারিত হতে পারে। কোয়ান্টাম বলবিদ্যায় সময় পুরোপুরি স্থির এবং পৃথক সত্ত্বা।   

কোয়ান্টাম জগতের সবচেয়ে অদ্ভুত ঘটনা হলো কোয়ান্টাম এনটেঙ্গলমেন্ট। এটা বলে যে ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত দুটি কণার মধ্যকার দুরত্ব কয়েক বিলিয়ন আলোক-বছর হলেও কোয়ান্টাম এনটেঙ্গলমেন্টের কারণে তাদের একটির পরিবর্তন অন্যটিকে প্রভাবিত করবে। শুধু স্থান নয় সময়ের পার্থক্যেও এই ঘটনা ঘটতে পারে। অর্থাৎ কিছু ক্ষেত্রে পরমাণুর ভবিষ্যতে ঘটা কোনো ঘটনাও তাকে প্রভাবিত করতে পারে। বিষয়টা ভারী অদ্ভুত।  এর মানে হচ্ছে কোয়ান্টাম বলবিদ্যায় আমরা সময়কে যেমটা স্থির ভাবি তেমনটা হয়তো সঠিক নয়৷  এটা ব্যাখ্যার জন্য অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ভ্লাতকো ভেদরাল আর জোনাথন জোনস  এবং সিঙ্গাপুর ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির অধ্যাপক জো ফিতজিনমস মিলে একটি বিকল্পধারার গাণিতিক মডেল দেন। এখানে কোয়ান্টাম জগতের বস্তুকে নিদিষ্ট সময়ে নিদিষ্ট স্থানে ব্যাখ্যা করার বদলে পুরো স্থানকাল জুড়ে একবারে ব্যাখ্যা করা হয়। এতে মৌলিক বলবিদ্যা ঠিকই থাকে শুধুমাত্র কণার অবস্থান বলার সময় অমুক সময়ে এই অবস্থানে আছে এটা বলার বদলে বলবো কণাটি অমুক স্থানকালে আছে। তাহলে আপেক্ষিক তত্ত্বের মতো কোয়ান্টাম বলবিদ্যাতেও সময় আপেক্ষিক হয়ে গেল। 

জো ফিতজিনমস
জোনাথন জোনস

ইতালির ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব মেট্রোলজি রিসার্চ সংস্থায় মার্কো জেনেভিস এর নেতৃত্বাধীন একদল বিজ্ঞানী ফোটন এর পোলারাইজেশন প্রতি নজর দেন।  এতে দেখা যায় ফোটন স্থানের মধ্য দিলে চললে তড়িৎ চৌম্বকীয় ক্ষেত্রের স্পন্দন হয়। আবার ২০২১ সালে অক্সফোর্ডের পদার্থবিদ জোনাথন জোনস এক পরীক্ষার কথা প্রকাশ করেন। সেখানে একই আইডিয়া বর্ণনা করা হয় কণার নিউক্লিয়ার স্পিন নামক কোয়ান্টাম বৈশিষ্ট্য দিয়ে। দুইটা পরীক্ষার সবচেয়ে কঠিন কাজ ছিলো পোলারাইজেশন বা নিউক্লিয়ার স্পিন পরিমাপ করা এবং তা হিসাবের সাথে মিলিয়ে দেখা। এসব পরীক্ষা বলে দেয় স্থানকাল ব্যবহার করে সহজেই যেকোনো কিছুর হিসাবনিকাশ করা সম্ভব। কোয়ান্টাম বলবিদ্যার এই ব্যাখ্যা এখনকার আদর্শ কোয়ান্টাম বলবিদ্যার বিকল্প হতে পারে৷ 

কোয়ান্টাম বলবিদ্যাতে যেমন কণার অবস্থান ও ভরবেগ একই সাথে জানতে পারি না এমনও হতে পারে যে স্থান ও সময়ের মধ্যেও এইরকম অনিশ্চয়তা আছে৷ যদি এটা সত্য হয় তাহলে কৃষ্ণগহ্বরের কেন্দ্রে স্থানকাল এতোই ক্ষুদ্র হয়ে যাবে যে স্থান এবং সময়কে আর আলাদা করা যাবে না। এখন আমরা তাহলে হাইপোথিসিসটি পরীক্ষা করে দেখার কথা ভাবতে পারি। আমরা যেভাবে কণার অবস্থান এবং ভরবেগের অনিশ্চয়তার পরীক্ষা করি অনেকটা তেমনভাবেই সময় এবং কালের অনিশ্চয়তা নির্ণয় করতে হবে। কিন্তু সমস্যা হলো মিনিট স্কেলে স্থান ও সময় এর অনিশ্চয়তা নির্ণয় করার প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বর্তমান সময়ে আমাদের নেই। তবে এই প্রযুক্তি দ্রুতই উন্নত হচ্ছে, হয়তো ভবিষ্যতে এটা পরীক্ষা করা সম্ভব হবে৷ 

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার আঁকা কোয়ান্টাম এনটেঙ্গেলমেন্টে সংযুক্ত দুইটি কণা

বিষয়টা হলো যদি সত্যিই কৃষ্ণগহ্বরের কেন্দ্রে স্থান ও সময়কে আলাদা করা না যায় তাহলে স্থান ও কালের মান শূণ্যের কাছাকাছি চলে যাবে। আবার স্থান এবং সময় যেহেতু একইসাথে শূণ্য হতে পারে না তাই কোয়ান্টাম বলবিদ্যার অনিশ্চয়তা নীতি স্থান এবং সময়কে এক হতে বাধা দিবে। এটার ব্যাখ্যা দেওয়ার প্রতিবন্ধতা অতিক্রম করতে পারলেই আমরা সাধারণ আপেক্ষিকতা ও কোয়ান্টাম বলবিদ্যাকে একত্রিত করতে পারবো। স্থান কাল এক হয়ে গেলে তাত্ত্বিকভাবে একটি সময়ের লুপের সৃষ্টি হয় যেটা দিয়ে অতীতে যাওয়া সম্ভব। আপেক্ষিকতত্ত্ব দিয়ে এটাকে ব্যাখ্যা করা গেলেও কোয়ান্টাম বলবিদ্যায় এটা সম্ভব নয় বলে পদার্থবিদরা আপাতত এটাকে বাতিল করে দিয়েছেন। 

একটা ঘটনা কল্পনা করা যাক। কোয়ান্টাম এনটেঙ্গেলমেন্টে সংযুক্ত দুইটি কণার একটি এই সময়ের লুপের মধ্য দিয়ে গেল। ফলে একটি কণা থেকে আবার দুটি ভিন্ন সময়ের কণা সৃষ্টি হলো যারা বয়সে ছোট-বড়।  এখন সমস্যা হলো এই দুইটা কপিই যে কণাটি সময় ভ্রমণ করেনি সেটির সাথে সর্বোচ্চ এনটেঙ্গলমেন্টে থাকবে চাইবে। প্রথাগত কোয়ান্টাম বলবিদ্যা দিয়ে এটা ব্যাখ্যা করা সম্ভব না। কিন্তু কোয়ান্টাম স্থানকাল হাইপোথিসিস দিয়ে সহজেই এটার ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব। সেটা কিভাবে? সময় ভ্রমণ করা কণার কপি দুইটা সময়ের সাথে এনটেঙ্গলমেন্টে আছে। আপাতত আমাদের নতুন পাওয়া থিওরি অব এভরিথিং দিয়ে ব্লাকহোলের ভেতরে যাওয়ার কাল্পনিক যাত্রা এখানেই সমাপ্ত। হয়তবা ব্ল্যাকহোলের কেন্দ্রে গেলে আমরা অতীতে যাওয়ার রাস্তা খুঁজে পাবো৷

তথ্যসূত্রঃ Into the singularity

লেখাটি 181-বার পড়া হয়েছে।


আলোচনা

Response

  1. এই ধরনের লেখাগুলো পড়তে আমার অনেক ভাল লাগে। এবং লেখাটি খুব সুন্দর মানসন্মত হইছে

Leave a Reply

ই-মেইলে গ্রাহক হয়ে যান

আপনার ই-মেইলে চলে যাবে নতুন প্রকাশিত লেখার খবর। দৈনিকের বদলে সাপ্তাহিক বা মাসিক ডাইজেস্ট হিসেবেও পরিবর্তন করতে পারেন সাবস্ক্রাইবের পর ।

Join 897 other subscribers