প্রথম পর্বের পর..
অপার রহস্যের হাতছানি অনন্ত মহাশূন্যে মানবজাতি ইতোমধ্যেই প্রেরণ করতে শুরু করেছে একের পর এক ছোট ছোট প্রাণী। যাদের কেউ কেউ আবার সফলতার সাথে ঘুরেও এসেছে। দেখে এসেছে অন্ধকার ও আলোকের রোমাঞ্চকর জগৎ। কুড়িয়ে এনেছে একগাদা চাঞ্চল্যকর নিদর্শন। এসব নিদর্শন বিশ্লেষণে গবেষকগণ শুরু করেছেন অন্বেষণ। প্রসারিত করছেন নিজেদের জ্ঞানের পরিসর।
আর তাই মহাকাশ অভিযানের এ যাত্রা থেমে থাকেনি। ভাটা পড়েনি অপার রহস্যে মোড়ানো অসীম মহাকাশে প্রাণী প্রেরণের অনবদ্য কর্মযজ্ঞে। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বৃদ্ধি পেতে থাকে তা। প্রেরণ হতে থাকে একের পর এক বৈচিত্র্যময় প্রাণ। প্রথম পর্বে আলোচিত প্রাণীদের পর মহাকাশে পরবর্তীতে আরও পাঠানো হয়েছে একঝাঁক প্রাণ।
দ্বিতীয় পর্বের আজকের আয়োজনে চলুন জেনে আসা যাক মহাকাশ জয়ের অদম্য অভিযাত্রী আরও কিছু পোকামাকড় ও পশুপাখিদের গল্প।
![](https://i0.wp.com/bigganblog.org/wp-content/uploads/2024/03/2.png?resize=1000%2C667&ssl=1)
আবেল ও বেকার
দুঃসাহসী বানর আলবার্টের পর মার্কিন মহাকাশ গবেষকেরা মহাশূন্যে আবারও বানর প্রেরণে ইচ্ছে পোষণ করেন। আঁটঘাট বেঁধে নেমেও পড়েন অভিযান সম্পন্নে। নির্বাচন করেন দু’টি ভিন্ন প্রজাতির বানর। আবেল ও বেকার। আবেল ছিল রেসাস প্রজাতির বানর। আর বেকার ম্যাকাও গোত্রের। যদিও তাদের ভেতর বিদ্যমান ছিল যথেষ্ট সাদৃশ্য।
গবেষকেরা আমেরিকার কানসাস অঞ্চল থেকে আবেলকে সংগ্রহ করেন। বেকার নিয়ে আসেন সুদূর দক্ষিণ আমেরিকার পেরু অঞ্চল থেকে। দুর্গম পেরুর নির্জন বনে ছিল বেকারের বাস। শারীরিক চেকআপ, উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দান ও অভিযানের সকল প্রস্তুতি সেরে ২৮ মে ১৯৫৯ সালে তাদেরকে রকেটে চড়ানো হয়। প্রায় ৫৬৩ কিলোমিটার মহাজাগতিক পথ পরিভ্রমণ শেষে নিরাপদে ভূপৃষ্ঠে অবতরণ করে তারা।
যদিও মহাকাশ যাত্রার সংক্ষিপ্ত এ সময়ে আবেলের শরীরে দেখা দেয় জটিলতা। করা হয় ছোট্ট একটি সার্জারি। তবে চার দিনের মাথায় মারা যায় সে। তার মৃত্যুর পর সঙ্গী বানর বেকার জীবিত ছিল প্রায় ২৪ বছর পর্যন্ত। যা তার প্রজাতির বানরদের মধ্যে সর্বোচ্চ।
![](https://i0.wp.com/bigganblog.org/wp-content/uploads/2024/03/3.jpeg?resize=1024%2C744&ssl=1)
খরগোশ
২ জুলাই ১৯৫৯ সাল। সোভিয়েত ইউনিয়নের মহাকাশ বিজ্ঞানীরা এবার মহাকাশে প্রেরণ করবে একত্রে দুটি কুকুর। এদের সঙ্গে যাবে শান্তশিষ্ট প্রকৃতির নির্মল এক খরগোশও। যার নাম মারফুশা। কুকুর অতভ্যাজনিয়া (সাহসিকতা) আর স্নেঝিঙ্কা (তুষারকন্যা)-র সঙ্গে মহাকাশযানের ছোট্ট কুঠুরীতে তার অভিযোজন কেমন হবে সেটিই পরখ করা বিজ্ঞানীদের উদ্দেশ্য।
যথারীতি নির্ধারিত দিনে রকেট গ্রাউন্ড থেকে মহাকাশে উড়ে গেলো তাদের বহনকারী রকেটটি। মহাশূন্য দর্শন শেষে সফল অবতরণ করে ভূপৃষ্ঠে। এমন যুগান্তকারী কাজের সম্মানস্বরূপ তৎকালীন রোমানিয়ান ডাকটিকিটে ছাপানো হয় তাদের ছবি। যেখানে দেখানো হয়, ছোট্ট দু’টি কুকুরের পাশে উবু হয়ে বসে থাকা এক খরগোশের প্রতিচ্ছবি।
![](https://i0.wp.com/bigganblog.org/wp-content/uploads/2024/03/4.png?resize=1000%2C800&ssl=1)
বেল্কা ও স্টেলকা
পৃথিবীর কক্ষপথ পরিভ্রমণকারী প্রথম কুকুরের স্বীকৃতি পেয়েছিল লাইকা। কিন্তু জানেন কী- কক্ষপথ পরিভ্রমণ শেষে জীবিত ফিরে আসা কুকুর কারা ছিল? হ্যাঁ, তারা ছিল বেল্কা ও স্টেলকা। ১৯ আগস্ট ১৯৬০ সালে নভোযান স্পুটনিক-৫ এ চড়িয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন তাদেরকে মহাকাশে পাঠায়। সেখানে পুরো ১দিন তারা পরিভ্রমণ করে পৃথিবীর কক্ষপথ।
তাদের সাথে আরও ছিল ৪৪টি ইঁদুর, ফলের মাছি ও খরগোশ। সফল অভিযান শেষে পৃথিবীতে ফিরে আসার কয়েকমাস পর ছোট্ট স্টেলকা জন্ম দেয় ছয়টি নাদুসনুদুস ছানার। এদের মধ্য থেকে একটি ছানাকে সোভিয়েত নেতা নিকিতা ক্রুশ্চেভ উপহার হিসেবে তুলে দেন তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির হাতে। কেনেডিও অনেকদিন সযতনে আগলে রাখে তাকে।
![](https://i0.wp.com/bigganblog.org/wp-content/uploads/2024/03/5.png?resize=1000%2C565&ssl=1)
কচ্ছপ
ছোটবেলায় কচ্ছপ ও খরগোশের দৌড় প্রতিযোগিতার গল্পটা পড়েছেন নিশ্চয়ই। যেখানে কচ্ছপ তার নিরবচ্ছিন্ন অগ্রযাত্রায় হার মানায় দ্রুতগতির খরগোশকেও। শুধু গল্পেই নয়। বাস্তবিক জীবনে, মহাকাশের রোমাঞ্চকর মহাযাত্রায়ও কচ্ছপ দেখিয়েছে নিজের সক্ষমতা। পালন করেছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।
১৫ সেপ্টেম্বর ১৯৬৮ সাল। চলছে চাঁদের বুকে মানুষ প্রেরণের তোড়জোড়। তারই সূত্র ধরে সোভিয়েত ইউনিয়ন জোন্ড-৫ নভোযানে করে প্রেরণ করে একজোড়া কচ্ছপ। প্রথমবারের মতো পৃথিবীর প্রাণী হিসেবে তারা চাঁদকে প্রদক্ষিণ করে। সুস্থ-সবলভাবে ৭ দিন পর ফিরে আসে ধরণীর বুকে।
প্রাণী দু’টির সঙ্গে পাঠানো হয়েছিল মাটি, উদ্ভিদের বীজ ও কিছু জীবন্ত ব্যাকটেরিয়া। ফিরে আসার সময় ক্যাপসুলটিকে কাজাখস্তানে অবতরণ করার কথা থাকলেও এটি নিজের অবস্থান থেকে সরে যায়। আছড়ে পড়ে ভারত মহাসাগরে। সেখান থেকেই তাদেরকে জীবিত উদ্ধার করা হয়। তাদের ওজন হ্রাস পেয়েছিল ১০ শতাংশ।
![](https://i0.wp.com/bigganblog.org/wp-content/uploads/2024/03/6-2.png?resize=1000%2C667&ssl=1)
শিম্পাঞ্জি
মানব শরীরের ফুসফুস, লিভার ও ডিএনএ-র সঙ্গে ব্যাপক সাদৃশ্য রয়েছে শিম্পাঞ্জির। তাই মহাকাশে মানুষ প্রেরণের পূর্ব কর্মসূচি হিসেবে প্রেরণ করা হয় হ্যাম নামের এক শিম্পাঞ্জিকে। উদ্দেশ্য- মহাকাশের অজানা পরিবেশে ফুসফুস ও লিভারের কার্যক্রম সচল থাকে কি-না সেটি পরীক্ষা করা।
৩১ জানুয়ারি ১৯৬১ সাল। হ্যামকে তুলে দেওয়া হয় নভোযানে। যার নেতৃত্বে ছিল মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা। হ্যাম সুস্থভাবে পৃথিবীতে ফিরে এসেছিল। তার এমন দুঃসাহসী কাজ কিছুদিন পর আমেরিকান নভোচারী অ্যালান শেপার্ডকে ব্যাপক সহায়তা করেছিল মহাকাশ জয়ে।
![](https://i0.wp.com/bigganblog.org/wp-content/uploads/2024/03/6-1.png?resize=1000%2C800&ssl=1)
বিড়াল
মহাকাশ গবেষণায় অন্যদের মতো এবার হাত বাড়িয়েছে ফ্রান্সও। অন্যদের মতো তারাও মহাকাশে প্রেরণ করতে যাচ্ছে একটি বিড়াল। নাম তার ফেলিক্স। তৎকালীন অত্যাধুনিক নভোযান ভেরোনিক-এ করে সে পাড়ি জমাবে অনিন্দ্য সুন্দর মহাকাশে। কিন্তু, ঘটলো এক বিপত্তি। রকেট উৎক্ষেপণের আগমুহূর্তে পালিয়ে যায় ফেলিক্স।
তার এমন কর্মকাণ্ডে ক্ষুব্ধ হয়ে বিজ্ঞানীরা অন্য আরেকটি বিড়ালকে মহাকাশে প্রেরণ করেন। এর নাম ফেলিসিট। যার মাথায় বসানো হয় ছোট্ট একটি ইলেক্ট্রোড। প্রায় ২৫০ কিলোমিটার উচ্চতায় পৌঁছেছিল সে। ফিরে এসেছিল নিরাপদে পৃথিবীতে। কিন্তু মাস দুয়েকের মাথায় গবেষণার উদ্দেশ্যে তাকে হত্যা করা হয়। কেটে দেখা হয় তার অন্ত্র, পেট ও মস্তিষ্ক।
![](https://i0.wp.com/bigganblog.org/wp-content/uploads/2024/03/7.jpeg?resize=1000%2C663&ssl=1)
মাকড়সা
১৯৬৯ সালের পরবর্তী সময়। মানবজাতি ইতোমধ্যেই জয় করে ফেলেছে মহাবিশ্বের রহস্যময়তা। তুলে এনেছে গতিপ্রকৃতি। তবুও থেমে থাকেনি মহাকাশে প্রাণী পাঠানোর সিদ্ধান্ত। ১৯৭৩ সালের ২৮ জুলাই মার্কিন গবেষকগণ স্কাইল্যাব নভোযানে করে মহাকাশে প্রেরণ করে ছোট্ট দু’টি মাকড়সা।
আমেরিকার ম্যাসাচুসেটস অঙ্গরাজ্যের হাইস্কুল ছাত্র জুডিথ মাইলস প্রস্তাব করেন মহাকাশে মাকড়সা প্রেরণের। বিষয়টি নাসাকে আকৃষ্ট করে। সিদ্ধান্ত হয়, সেখানকার ভরশুন্য পরিবেশে তারা জাল বুনতে পারে কি-না পরখ করে দেখার। আর তাই পাশের মনোরম ফুলবাগান থেকে সংগ্রহ করা হয় দু’টি মেয়ে মাকড়সা। আনিতা ও অ্যারাবেলা।
মহাকাশে পৌঁছানোর পর তারা দু’জনেই সেখানে জাল বুনতে সক্ষম হয়েছিল। যেগুলো দেখতে হয়েছিল পৃথিবীতে বুনা জালের চেয়েও নিখুঁত। গবেষণাটি প্রাণীর মোটর প্রক্রিয়ার উপর মাইক্রোগ্র্যাভিটির প্রভাব সম্পর্কে প্রদান করেছে সম্যক ধারণা।
![](https://i0.wp.com/bigganblog.org/wp-content/uploads/2024/03/8.png?resize=1000%2C800&ssl=1)
সাগরতলের টারডিগ্রেড
জলের ভাল্লুক নামে পরিচিত টারডিগ্রেড মূলত একধরণের অমেরুদণ্ডী প্রাণী। সাগরের নীল জলরাশিতে তাদের বসবাস। অক্সিজেনের স্বল্পতা, ক্ষতিকর বিকিরণ, হিমশীতল ঠাণ্ডা ও ডিহাইড্রেশনের মতো যেকোনো পরিস্থিতিতে তারা অভিযোজন করতে সক্ষম।
২০০৭ সালে তাদেরকে মহাকাশযানে করে মহাশূন্যে পাঠানো হয়। সেখানে নভোযানের বাইরে আবদ্ধ স্থানে তারা কাটিয়েছিল ১০দিন। যার প্রভাবে তারা শুকিয়ে গিয়েছিল কিছুটা। যদিও পৃথিবীতে ফিরে আসার পর আবারও সুস্বাস্থ্য ফিরে পায়। বিজ্ঞানীরা দেখতে পান, মহাজাগতিক ক্ষতিকর রশ্মি তাদের খুব বেশি ক্ষতি করতে পারে নি।
![](https://i0.wp.com/bigganblog.org/wp-content/uploads/2024/03/9.jpeg?resize=1024%2C576&ssl=1)
পরিসমাপ্তি
মহাশূন্যে অবুঝ প্রাণীদের পাঠানো নিয়ে কিছুকাল পূর্বে সৃষ্টি হয়েছিল তুমুল বিতর্ক। তৈরি হয়েছিল নীতি-নৈতিকতার প্রশ্ন। যদিও এ সবকিছু ছাপিয়ে মহাকাশ গবেষণায় প্রাণীদের বীরত্বপূর্ণ অবদান হয়ে থাকবে চির স্মরণীয়। যাদের কারণে নভোচারী ও মহাকাশ বিজ্ঞানীরা রহস্যে আবৃত সে পরিবেশ সম্পর্কে পূর্বানুমান করতে পেরেছেন। সফলভাবে অবতরণ করেছেন চন্দ্রপৃষ্ঠে। ভবিষ্যতে পৌঁছে যাবেন আরও দূরের কোনো গ্রহ-উপগ্রহে। নভোচারী এসব প্রাণীদের কথা তাই শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করা হোক। মহাকালের অমলিন খেরোখাতায় লিপিবদ্ধ থাকুক তাদের নাম।
তথ্যসূত্র:
• Animal in space – SPACE.com
• A Brief History of Animals in Space – NASA
• 10 animals that have been to space – DISCOVER Wildlife
• What was the first animal sent into space? – Royal Museum Greenwich.
Leave a Reply