মনে করুন, আপনি আপনার প্রাত্যহিক জীবনের একটি দিন শুরু করতে যাচ্ছেন। আপনি সেলুলোজের তৈরি একটি খাটে ঘুমিয়ে আছেন। বিছানা, বালিশ সবই সেলুলোজের। আপনি ঘুম থেকে উঠলেন। আপনার গায়ে সেলুলোজের পোষাক। আপনি বিছানা ছেড়ে সেলুলোজের মেঝে দিয়ে হেঁটে হাতমুখ ধুয়ে আসলেন। তারপর নাস্তার টেবিলের দিকে এগিয়ে গেলেন যেটা সেলুলোজ নির্মিত। একটা চেয়ার টেনে বসলেন সেটাও সেলুলোজের। তারপর খাবার খেতে গিয়ে দেখলেন খাবারের মধ্যেও সেলুলোজ। খাবার খেয়ে দেয়ালঘড়িতে সময় দেখলেন অফিসে যাওয়ার আর কতটা সময় বাকি আছে এবং হঠাৎ থমকে গেলেন দেয়ালটা সেলুলোজ দিয়ে তৈরি বলে। আপনার অবাক হওয়ার পালা এখনো শেষ হয়নি। আপনি অফিসে যাওয়ার উদ্দেশ্যে তৈরি হবেন, আলমারি থেকে ভয়ে ভয়ে কাপড় বের করে পরতে গিয়ে বুঝতে পারলেন আলমারি আর কাপড় দুটোই সোলুলোজের। আপনার মুখটা আরেকটু ফ্যাকাশে হয়ে গেল। টিসু বের করে মুখের ঘাম মুছলেন। হালকা কম্পিত বোধ করছেন। কারন টিস্যুতেও সেলুলোজ দেখেছেন। ভাবছেন আর অফিসে যাবেন না। এদিকে ড্রাইভার হর্ণ বাজাচ্ছে। আপনি ভাবলেন একটা এ্যাপ্লিকেশন লিখে ড্রাইভারের হাতে দিয়ে দেবেন। যাথরীতি এ্যাপ্লিকেশন লিখতে গিয়ে সেলুলোজের হাতে পড়লেন কারন কাগজটা যে সেলুলোজ। আপনারা যারা লেখাটি পড়ছেন তাদের নিশ্চয়ই সেই লোভী রাজার গল্পের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে যার স্পর্শে সবকিছু সোনায় পরিণত হয়ে গিয়েছিলো।
শুনতে খুব অদ্ভুত মনে হবে কিন্তু এতক্ষণ যা লিখলাম তার অন্তত আশি ভাগ সবার জীবনে প্রতিদিনের জন্যই সত্যি। হ্যাঁ, চারপাশে সেলুলোজ অবলোকন না করে আপনি একটা দিন পার করতে পারবেন না। মনে প্রশ্ন আসবে সবকিছু সেলুলোজ হল কিভাবে? এভাবে-
সেলুলোজ এক প্রকার দৃঢ় রাসায়নিক পলিমার। অনেকগুলো গ্লুকোজ অনু একসাথে যুক্ত হয়ে একটি সেলুলোজ অনু তৈরি হয়। উদ্ভিদের দেহে সেলুলোজ তৈরি হয় প্রাকৃতিক ভাবে। উদ্ভিদের কোষপ্রাচীর সেলুলোজ নির্মিত। অনেকগুলো সেলুলোজ অনু লিগনিন নামক একটি আঠালো পদার্থের মাধ্যমে যুক্ত হয়ে কোষপ্রাচীর তৈরি করে। সেলুলোজের রং সাদা, লিগনিন যুক্ত হয়ে তা বাদামী রং ধারন করে। এই সেলুলোজ নির্মিত কোষপ্রাচীরের জন্যই উদ্ভিদ দৃঢ় হয়। অপরদিকে প্রাণীকোষে কোষপ্রাচীর থাকেনা বলে বলে কোষগুলো নরম, ফলে প্রানীদেহের অধিকাংশ অঙ্গ খুবই নমনীয়। উদ্ভিদ ও প্রাণীকোষের চিত্র দেখলেই এটা পরিষ্কার হবে।
উদ্ভিদের কান্ডের কোষগুলো বেশ লম্বা এবং পরিনত কোষের কোষপ্রাচীর খুব পুরু হয়। এই কোষগুলো একসময় মারা যায় এবং কোষের ভিতরের নরম অংশ পঁচে যায় কিন্তু বাইরের দৃঢ় সেলুলোজ নির্মিত কোষপ্রাচীরটি রয়ে যায়। এই মৃত কোষটি তখন নল সদৃশ হয়ে যায় এবং উদ্ভিদের দেহে পানি এবং খনিজ দ্রব্য পরিবহনে কাজ করে। অনেকগুলো মৃত কোষ পাশাপাশি এবং একটার পর একটা সজ্জিত হয়ে হয়ে উদ্ভিদের পরিবহনতন্ত্র গঠন করে। কচি অবস্থায় পরিবহনতন্ত্রসমূহ গুচ্ছাকারে থাকে এবং গুচ্ছগুলো পরস্পরথেকে পৃথক থাকে।
কচিকান্ড ছিঁড়লে আমরা যে আঁশ(তন্তু বা fibre ও বলা হয়) দেখি তা আসলে এই কোষগুচ্ছই। আর বহুবর্ষজীবি গাছের ক্ষেত্রে এই কোষগুচ্ছগুলো কোষবিভাজনের মাধ্যমে সংখ্যায় বৃদ্ধি পায় এবং কাছাকাছি চেপে আসে। ফলে এদের মধ্যে দৃঢ়তা বৃদ্ধি পায় এবং ক্রমশ কাষ্ঠল অবস্থায় পৌঁছায়। এই ঘন সন্নিবিষ্ট পরিবহনতন্ত্রের সমষ্টিকেই আসলে আমরা কাঠ হিসেবে জানি। তাহলে বুঝতে পারা যাচ্ছে কাঠের অধিকাংশ অংশই হচ্ছে সেলুলোজ আর সেলুলোজের ফাঁকে ফাঁকে থাকে লিগনিন। গাছের বয়স যত বাড়তে থাকে ততই কোষ বিভাজনের মাধ্যমে কান্ড পরিধির দিকে বাড়তে থাকে এবং একেবারের কেন্দ্রের কোষগুলো মরে গিয়ে ফাঁপা হতে থাকে আর কাছাকাছি চেপে আসতে থাকে। অর্থাৎ একেবারে কেন্দ্রের দিকের কোষগুলোই সবচেয়ে পুরনো আর পরিধির দিকের কোষগুলো অপেক্ষাকৃত নতুন থাকে। ভাবলে অবাক হবেন পুরো গাছটির কেবল সামান্য কিছু অংশই জীবিত থাকে আর বাকি অংশ থাকে মৃত। কান্ডের পরিধির দিকে বাঁকলের কিছু অংশ, পাতা, মুকুল এবং মুলের অংশবিশেষ ছাড়া বাকি অংশ আসলে মৃত। কান্ডের একেবারে ভিতরের কোষগুলোগুলোই যেহেতু সবচেয়ে পুরোনো সোগুলোই আগে মারা যায় এবং সেগুলোর ভিতর দিয়েই সবচেয়ে বেশী দিন ধরে পানি ও খনিজপদার্থ প্রবাহিত হয়। এভাবে পরিবহন করতে করতে সেই কোষীয় নলের ভিতরে ট্যানিন, গঁদ, রেজিন প্রভৃতি বস্তু জমা হয় এবং এতে নলের ভিতরটা ভরাট হয়ে যায় কিন্তু এর ফলে সেই অংশের দৃঢ়তা বৃদ্ধি পায় এবং বাদামি থেকে কালচে বর্ণ ধারন করে। আমরা যদি কখনো কোন গাছকে প্রস্থ বরাবর কাটি তাহলে দেখতে পাই যে ভিতরটা কালচে এবং বাইরের দিকটা অপেক্ষাকৃত সাদা।
দৃঢ়তার কারনে কান্ডের ভিতরের অংশই কাঠ হিসেবে বেশি সমাদৃত। এবার আপনি আপনার ঘরের কি কি আসবাব পত্র কাঠ দিয়ে বানানো হয়েছে সেগুলো লিস্ট করে ফেলতে পারেন এবং অনায়াসে সেগুলোকে সেলুলোজ নির্মিত বলতে পারেন। অবশ্য কাঠের মেঝে ও দেয়াল শহরে খুব একটা চোখে না পড়লেও গ্রামে গিয়ে দেখতে পারেন, যরের চালটা পর্যন্ত সেলুলোজ (ছন) দিয়ে বানানো হয়। আর বাঁশের বেড়া? সেটাও সেলুলোজ।
আমরা যেসব পোশাক পরি সেগুলো হয় সরাসরি তুলা থেকে আসে অথবা তুলাকে প্রক্রিয়াজাত করে বানানো হয় (কিছু ব্যাতিক্রম আছে)। সুতি কাপড় বলতে আমরা যা বুঝি তার সম্পূর্নটাই তুলা। এই তুলার প্রায় সম্পূর্নটাই সেলুলোজ। অতএব এটা বলা যেতেই পারে আপনি সেলুলোজ নির্মিত পোশাক পরে আছেন। আর আপনার বিছানা, বালিশ-তোষক সবই ভিতরে বাহিরে সেলুলোজ!
আপনি যেসব খাবার খেয়ে থাকেন তার একটা বড় অংশ আসে উদ্ভিদ থেকে। শাক-সবজি, ফলমূল, ভাত, রুটি, আলু এসবই উদ্ভিজ্জ খাবার। এসব খাবারের প্রত্যেকটিতেই কিছু না কিছু পরিমান সেলুলোজ থাকে। সবচেয়ে বেশী থাকে থাকে শাক-সবজিতে এবং ফলমূলে, আলুতে তারচেয়ে কম এবং ভাত ও রুটিতে সামান্য পরিমানে থাকে। কাজেই আপনি যখন এসব খাবার যখন খাচ্ছেন তখন বেশ খানিকটা সেলুলোজও খাচ্ছেন। তবে মানুষ সেলুলোজ খেয়ে হজম করতে পারে না যদিও তা হজমে সহায়ক। এ কারনে শাক-সবজি ফলমূল ইত্যদি বেশী বেশী করে খাওয়ার জন্য উৎসাহিত করা হয়। অপর দিকে যাবতীয় তৃণভোজী প্রাণী যথা গরু, ছাগল, মহিষ, ভেড়া, হরিন সবারই প্রধান খাদ্য হচ্ছে সেলুলোজ।
এবার আসা যাক কাগজে। কিছু additives ছাড়া কাগজ আসলে পুরোটাই সেলুলোজ। একটু চিন্তা করলেই ধরতে পারবেন কাগজ তৈরি হয় নানা রকম উদ্ভিদ হতে, মন্ড তৈরির মাধ্যমে। এক্ষেত্রে লিগনিন আলাদা করে ফেলা হয় এবং অন্য কোন আঠালো বস্তু যোগ করা হয়। কাগজ এবং সুতি কাপড়ের মধ্যে পার্থক্যের কারন হল কাগজে সেলুলোজের তন্তুগুলো এলোমেলো এবং ছোট ছোট থাকে ফলে আমরা কাগজ টেনে ছিঁড়ে ফেলতে পারি তন্তুগুলোকে না ছিঁড়েই। অপরদিকে সুতি কাপড়ে তন্তুগুলো একই দিয়ে বিন্যাস্ত এবং তুলনামূলকভাবে লম্বা হয়ে অধিক দৃঢ়তা দান করে। ফলে সুতা ছিঁড়তে হলে সেলুলোজ তন্তুটাকেই ছিঁড়ে ফেলতে হবে যা বেশ কঠিন। কাপড়ের ও কাগজের সেলুলোজ তন্তু দেখুন মাইক্রোফটোগ্রাফীতে । (বলতে পারেন তাহলে কাঠ দিয়েতো কাপড় বানানো যেতে পারে চেস্টা করলে, তন্তুগুলোকে একই দিকে বিন্যাস্ত করে। সেই চেষ্টা চলছে আসলে!)
তবে প্রযুক্তি যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে আমরা প্রকৃতির উপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে ফেলছি। ফলে আজকাল সেলুলোজের এত বাড়াবাড়ি কিছুটা কম চোখে পড়বে। বইপত্র,আসবাব, পোশাক, ঘরবাড়ি এসবের জন্য আমরা এখন আরো অনেক কৃত্রিম বস্তুর উপর নির্ভরশীল হয়েছি। এতে আমাদের উপকার-অপকার দুইই হচ্ছে। এসব নিয়ে অন্য কোনোদিন আলোচনা করব।
Leave a Reply