শুরুতেই আপনাদের একটা ছোট্ট গল্প বলি। গল্পের সূচনা প্রায় আড়াই হাজার বছর আগের রোমান পুরাণে। এক সময়ের ছোট্ট শহর আলবা লঙ্গার সিংহাসনে রাজত্ব করতেন নুমিটর। কিন্তু রাজনীতির, সিংহাসনের খেলায় যেমন প্রায়ই দেখা যায়, তেমনই এক চেনা চক্রান্তে তাঁর ছোট ভাই আমুলিয়াস ক্ষমতা দখল করে বসেন। নুমিটরকে হত্যা করে এবং তাঁর কন্যা রিয়া সিলভিয়াকে ‘ভেস্টাল ভার্জিন’ হিসেবে উৎসর্গ করে রাজবংশের উত্তরাধিকারের পথ রুদ্ধ করতে চান তিনি।
কিন্তু গল্প মোড় নেয় যুদ্ধের দেবতা মার্সের আবির্ভাবে। রিয়া সিলভিয়া গর্ভবতী হয়ে পড়েন এবং জন্ম দেন যমজ দুই পুত্রের– রমুলাস ও রেমাস। রাজা আমুলিয়াস তাদের হত্যা করতে চাইলেও ভাগ্য বা প্রকৃতির হাতে তারা রক্ষা পায়। কিংবদন্তী বলে, দুই ভাইকে নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হলে, এক নেকড়ে মা তাদের উদ্ধার করে ও মানুষ করে তোলে। বড় হয়ে তারা নিজেদের প্রকৃত পরিচয় জানে, আমুলিয়াসকে পরাজিত করে রাজত্ব পুনরুদ্ধার করে। এবং রমুলাস, ইতিহাসে নিজের নাম লেখায় প্রাচীন রোম নগরীর প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে।
অবশ্য, এটি কেবল এক কিংবদন্তী। কিন্তু এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে এক বাস্তব জগতের প্রাণীর নাম– ডায়ার ওল্ফ বা ডায়ার নেকড়ে। কেন সে আলোচনায় পরে আসছি।
যারা ডায়ার নেকড়ে চেনেন না, তাদের জন্য দু’ কথা খরচ করা যাক। ডায়ার নেকড়ে (Aenocyon dirus) আমেরিকা মহাদেশে একসময় ঘুরে বেড়ানো একটি বিলুপ্ত ক্যানিড প্রজাতি, যা প্লাইস্টোসিন যুগের শেষভাগ এবং হলোসিন যুগের শুরুতে (প্রায় ১,২৫,০০০ থেকে ১০,০০০ বছর আগে) বসবাস করত। এই প্রজাতিটির নামকরণ করা হয় ১৮৫৮ সালে, প্রথম জীবাশ্ম আবিষ্কারের চার বছর পরে। বর্তমানে এর দুটি উপপ্রজাতিকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে: Aenocyon dirus guildayi এবং Aenocyon dirus dirus। ডায়ার নেকড়ের সবচেয়ে বড় জীবাশ্ম সংগ্রহ পাওয়া গেছে লস অ্যাঞ্জেলেসের র্যাঞ্চো লা ব্রেয়া টার পিটস-এ। লোক সাহিত্যে এই নেকড়েটিকে বিখ্যাত করেছে জে আর আর মার্টিনের জনপ্রিয় উপন্যাস সিরিজ ‘দ্য সং অব আইস এন্ড ফায়ার’। সে উপন্যাসের গল্পে হাউজ অব স্টার্কের প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হতো এ প্রাণি এবং নেড স্টার্কের প্রতিটি সন্তানের অনুগত থাকতো একটা করে ডায়ার নেকড়ে। ডায়ার নেকড়ে দেখতে আধুনিক ধূসর নেকড়ের মতো হলেও এরা ছিলো আরও বড় আকারের, গাঢ় রঙের মোটা লোমে ঢাকা, এবং ছিল শক্তিশালী চোয়াল ও দানবীয় দাঁতের অধিকারী। বরফ যুগের বাইসন, ঘোড়া, এমনকি ম্যামথের মতো বিশালাকৃতির প্রাণীও শিকার করত এরা। ধারণা করা হয়, আজ থেকে প্রায় ১০,০০০ বছর আগে এই প্রজাতির বিলুপ্তি ঘটে।
কিন্তু ঘটনা হচ্ছে, ঠিক ২০২৫ সালের ৮ এপ্রিল, যুক্তরাষ্ট্রের ডালাসভিত্তিক বায়োটেক কোম্পানি Colossal Biosciences ঘোষণা দেয়, তারা সফলভাবে তিনটি ডায়ার নেকড়ে-প্রতিরূপ নেকড়ের জন্ম দিতে সক্ষম হয়েছে। তাদের নাম দেওয়া হয় যথাক্রমে—রমুলাস, রেমাস এবং খালেসি। এবার বুঝতে পেরেছেন কেন শুরুতেই কেন আপনাকে রমুলাস আর রেমাসের কিংবদন্তী শোনালাম?
এ প্রবন্ধটি পড়ার পূর্বেই খুব সম্ভবত আপনি ডায়ার নেকড়ের ফিরে আসার খবরটি জানতে পেরেছেন। চলুন, আপনার আপনার কিছু কৌতূহল দূর করি এখানে। কীভাবে ফিরিয়ে আনা হলো এদের? আদতেই কি ডায়ার নেকড়েরা ফিরে এসেছে? যদি না এসে থাকে, তাহলে এই নেকড়ে শাবক রমুলাস, রেমাস এবং খালেসি এরা কারা?
আদতেই কি ফিরে এসেছে ডায়ার নেকড়ে?
যারা ভাবছেন ডায়ার নেকড়ে, অর্থাৎ Aenocyon dirus কেই ফিরিয়ে আনা হয়েছে, তারা ভুল ভাবছেন। এই নতুন নেকড়ে শাবকগুলো হচ্ছে গ্রে ওল্ফ তথা ধূসর নেকড়েরই সম্পাদিত জিনের একটি ফলাফল। মানে এই নেকড়ে শাবক গুলো আসলে জেনেটিক্যালি এবং টেক্সোনমিক্যালি ধূসর নেকড়েই, অর্থাৎ ওরা Canis lupus-ই Aenocyon dirus না। ডায়ার নেকড়ে আমরা ফিরিয়ে আনতে পারি নি। তাহলে কেনই বা আমরা ফিরিয়ে আনার খবর দিলাম? এ ব্যাপারে পরিস্কার হতে আপনাকে আরও সামনে যেতে হবে।
কেন ফিরিয়ে আনতে পারি নি তাদের?
এ প্রশ্নের উত্তর দিতে হলে আমাদের একটু পিছিয়ে যেতে হবে। আপনারা অনেকেই হয়তো ১৯৯৬ সালে ক্লোন করা প্রথম স্তন্যপায়ী প্রাণী ‘ডলি’ ভেড়ার নাম শুনেছেন। ডলির ক্লোনিং প্রক্রিয়াটা শুনতে যতটা জটিল মনে হয়, আদতে তা তেমন ছিল না। ব্যাপারটা এমন—প্রথমে দাতার শরীর থেকে একটি কোষ সংগ্রহ করা হয়। এরপর সেই কোষের নিউক্লিয়াস (যেখানে সব জিনগত তথ্য থাকে) বের করে, সেটি একই প্রজাতির, মনে রাখবেন একই প্রজাতির একটি ডিম্বাণুর মধ্যে প্রতিস্থাপন করা হয়। এরপর কৃত্রিমভাবে নিষিক্ত সেই ডিম্বাণু রাখা হয় একটি ‘সারোগেট মা’-এর গর্ভে। কয়েক মাস পর জন্ম নেয় একদম দাতার মতো দেখতে একটি ক্লোন।
তবে, যখন আমরা বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া প্রাণীদের ফিরিয়ে আনার কথা বলি, তখন বিষয়টা আরও কিছু ধাপে জটিল হয়ে যায়—কারণ সেখানে প্রজাতির অস্তিত্বই নেই, আর ডিএনএ-টাও অনেক সময় খণ্ডিত বা অসম্পূর্ণ থাকে। যার ফলে, ক্লোনিং এর মাধ্যমে পুরোপুরিভাবে সেই হারিয়ে যাওয়া প্রজাতিটিকে আর ফিরিয়ে আনা যায় না। সামনে এ নিয়ে আরও বিস্তারিত বলবো। এবার প্রশ্ন আসতে পারে, তাহলে কেন দাবী করা হচ্ছে যে ডায়ার নেকড়ে কে ফিরিয়ে আনা হয়েছে?
যা ফিরিয়ে আনা হয়েছে, তা আসলে কী?
কলোসাল বায়োসায়েন্সের বিজ্ঞানীরা প্রথমে ডায়ার নেকড়ের ১৩,০০০ বছর পুরনো ফসিলের দাঁত আর ৭২,০০০ বছরের পুরনো খুলি থেকে ডিএনএ সংগ্রহ করেন। সেখান থেকে ১৪টি জিনের মধ্যে ২০টির মতো গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য খুঁজে পান তাঁরা, যেগুলো ধূসর নেকড়ের (gray wolf) তুলনায় ডায়ার নেকড়েকে একেবারেই আলাদা করে তোলে। যেমন — ওদের দৈত্যাকার গড়ন, সাদা ঘন লোম, প্রশস্ত কপাল, ভয়ংকর দাঁত, আর ভয়াল গর্জন। এই বৈশিষ্ট্যগুলোর পেছনে যেসব নির্দিষ্ট জিন কাজ করে, সেগুলো চিহ্নিত করেই শুরু হয় আসল খেলা।
এরপর বিজ্ঞানীরা ধূসর নেকড়ের শরীর থেকে কিছু টিস্যু সংগ্রহ করেন এবং তাতে CRISPR-Cas9 প্রযুক্তির মাধ্যমে জিন কাটাকাটি শুরু করেন। এই ক্রিসপার প্রযুক্তিটা আসলে কী? খুব অল্প করে, সহজ ভাষায় বলি। বিজ্ঞানীরা একে বলেন “জেনেটিক কাঁচি”, কারণ এর কাজটাই হলো, ডিএনএর ভেতর নির্দিষ্ট জায়গায় কাটাকাটি করে সেখানে নতুন কিছু বসানো।
একটা সহজ উদাহরণ দিলে বুঝতে সুবিধা হবে। ধরুন, আপনার একটা ওয়ার্ড ডকুমেন্টে ভুল বানান ঠিক করতে আপনি কি করেন? একটা “কাট” (Ctrl+X), আর তারপর “পেস্ট” (Ctrl+V)। CRISPR ঠিক সেই কাজটাই করে জীবের জিনগত তথ্যের ওপর। যেখানে দরকার, সেখানে কেটে পুরোনো অংশ বাদ দিয়ে নতুন, প্রয়োজনীয় জিন বসিয়ে দেয়। আর এই পুরো প্রক্রিয়াই চলে একদম সুনির্দিষ্টভাবে—যেন জিনগত সার্জারির এক নিখুঁত ভার্সন।
এই “জিন সম্পাদনা” প্রযুক্তি ব্যবহার করে ধূসর নেকড়ের ডিএনএ-তে ধীরে ধীরে ঢুকিয়ে দেন ডায়ার নেকড়ের সেই ১৪টি জিনগত বৈশিষ্ট্য। সহজ শোনালেও, এই কাজটা রীতিমতো তনুমেঘে বজ্রপাত ঘটানোর মতো। কারণ জিন সম্পাদনার সময় একটি ভুল মানেই মারাত্মক জেনেটিক বিপর্যয়। যেমন—ডায়ার নেকড়ের তিনটি রঙ-নিয়ন্ত্রণকারী জিন ধূসর নেকড়ের শরীরে গেলে অন্ধত্ব বা বধিরতা ডেকে আনতে পারে। ফলে বিজ্ঞানীদের প্রতিটি ধাপে অবলম্বন করতে হয়েছে চূড়ান্ত সতর্কতা।
সব ঠিকঠাক হলে, সম্পাদিত কোষ থেকে নিউক্লিয়াস বের করে ধূসর নেকড়ের ডিম্বাণুতে প্রতিস্থাপন করা হয়। এরপর সেই নিষিক্ত কোষগুলো ক্লোন করে স্থানান্তরিত করা হয় কুকুরের গর্ভে। কলোসাল বায়োসায়েন্সের গবেষকরা জানিয়েছেন, এক্ষেত্রে সারোগেট মা-কুকুর ব্যবহার করা হয়েছে। অনেকেই প্রশ্ন করেন যে, নেকড়ে ফিরিয়ে আনার কাজে কুকুরের গর্ভে কেন রাখা হয়েছে? ধূসর নেকড়ের গর্ভে নয় কেন?
প্রথমত, ধূসর নেকড়ে একটি বন্য প্রাণী। তাদের আটকানো, টেমে রাখা বা গর্ভধারণে ব্যবহার করা অত্যন্ত কঠিন। তারা সহজে স্ট্রেসে চলে যায়, আগ্রাসী হয়ে পড়ে এবং চিকিৎসা বা গবেষণার পরিবেশে মানিয়ে নিতে পারে না। এদিকে ডোমেস্টিক কুকুর অনেকটাই সহনশীল, পরিচিত ও নিয়ন্ত্রণযোগ্য। দ্বিতীয়ত, জেনেটিক মিল—ধূসর নেকড়ে ও কুকুরের ডিএনএ-র ৯৯.৯৯% মিলে যায়। তারা মূলত একই প্রজাতির ভিন্ন রূপ। তাই কুকুরের গর্ভাশয় ডায়ার নেকড়ে জেনেটিক মোডিফাইড ভ্রূণের জন্য বেশ উপযোগী পরিবেশ তৈরি করতে পারে। তাদের গর্ভকালীন সময়, শরীরের গঠন, এমনকি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও মিল আছে।
সব প্রস্তুতি শেষে ৬৫ দিন পর জন্ম নেয় দুইটি প্রাগৈতিহাসিক ছোট্ট দৈত্য। তাদের নাম রাখা হয় রমুলাস এবং রেমাস (জন্ম: অক্টোবর ২০২৪), রোমান পুরাণের সেই দুই ভাইয়ের নামে যারা নেকড়ের দুধে মানুষ হয়েছিল। পরে, তাদের পাশে এসে হাজির হয় আরেকটি শাবক, যার নাম খালেসি (জন্ম: জানুয়ারি ২০২৫)।
তাহলে হিসেবটা দাঁড়ায় কী?
এই নতুন নেকড়ে ছানাগুলো আসলে ডায়ার নেকড়ে (Aenocyon dirus) নয়—ওরা ধূসর নেকড়ে, মানে Canis lupus। আমরা পুরো ডায়ার ওল্ফ ফিরিয়ে আনতে পারিনি, বরং শুধু তার কিছু জেনেটিক বৈশিষ্ট্য নকল বা ‘মিমিক’ করেছি ধূসর নেকড়ের ডিএনএ-তে। সত্যিকারের ডায়ার নেকড়ে আজকের দিনের ধূসর নেকড়ে, মানে Canis lupus এর বেশ কাছের আত্মীয়। নীচের ছবিটি থেকে লক্ষ করুন।

কিন্তু কেন? কেন আমরা একেবারে আসল ডায়ার নেকড়ে কে ফিরিয়ে আনতে পারলাম না?
খুলে বলি। এর সবচেয়ে বড় সীমাবদ্ধতা হলো, এখনো পর্যন্ত ডায়ার নেকড়ের সম্পূর্ণ জিনোম সিকোয়েন্স বা পূর্ণাঙ্গ ডিএনএ মানচিত্র আমাদের হাতে নেই। আসলে, সেই জিনোম পুরোপুরি পুনর্গঠন করাও প্রায় অসম্ভব। ধরুন কোনোরকমে জিনোম পাওয়া গেলেও, কার্যকর কোনো জীবন্ত কোষ তো নেই—সেই জিনোম আমরা কোথায় বসাবো? কোন ডিম্বাণুতে রাখবো? আর জেনেটিক কোড ছাড়া তো শুধু ডিএনএ দিয়ে প্রাণী তৈরি হয় না—এর জন্য দরকার হয় সুনির্দিষ্ট এপিজেনেটিক তথ্য, যা ডায়ার নেকড়ের ক্ষেত্রে একেবারেই অজানা।
সোজা কথায়, এখন পর্যন্ত আমরা ডায়ার ওল্ফকে “ফিরিয়ে” আনতে পারিনি—আমরা শুধু তার কয়েকটি গুণাবলি আধুনিক নেকড়ের শরীরে ‘অনুকরণ’ করেছি। ডায়ার নেকড়ে ফিরে আসেনি। ফিরে এসেছে তার কিছু বৈশিষ্ট্য, ধূসর নেকড়ের শরীরে ভর করে।
তাহলে এতো আয়োজন, এতো গবেষণা—সবই কি বৃথা?
একেবারেই না। কলোসাল বায়োসায়েন্সের সহপ্রতিষ্ঠাতা ও বিশ্বখ্যাত জিনবিজ্ঞানী ড. জর্জ চার্চের মতে, এ এক ‘ডি-এক্সটিংশন’-এর পথচলার শুরু। এটিকে বলা যায়, বিলুপ্ত প্রাণীদের ফিরিয়ে আনার এক সাহসী প্রয়াস। একটি যুগান্তকারী প্রাথমিক ধাপ।
শুধু তাই না, কলোসাল বায়োসায়েন্স তাদের ডি-এক্সটিঙ্কশন প্রকল্পে বেশ কয়েকটি অত্যাধুনিক প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও প্রয়োগ করেছে। তারা বিশেষভাবে ধূসর নেকড়ের রক্ত থেকে এন্ডোথেলিয়াল প্রোজেনিটর কোষ (EPCs) সংগ্রহের একটি নতুন পদ্ধতি তৈরি করেছে, যা পূর্বে প্রচলিত ক্লোনিং পদ্ধতিতে দেখা যেত না। এই EPCs সংগ্রহের মাধ্যমে, তারা জিন সম্পাদনা ও ক্লোনিং প্রক্রিয়ায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধন করেছে।
ভবিষ্যতে তারা এই পদ্ধতি আরও নিখুঁত করে ম্যামোথ, তাসমানিয়ান টাইগারসহ আরও বহু বিলুপ্ত প্রাণীকে বাস্তবের আলোয় ফিরিয়ে আনার পরিকল্পনা করছে।
নৈতিকতা এবং পরিবেশগত দৃষ্টিকোণ
ডায়ার নেকড়ে ফিরিয়ে আনার এই প্রচেষ্টাকে আমরা একদিকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির এক অনন্য কীর্তি হিসেবে দেখতে পারি, কিন্তু অন্যদিকে জেগে ওঠে জটিল কিছু প্রশ্ন—যেগুলোর উত্তর যতোটা না বিজ্ঞান নির্ভর, ততোটাই দর্শন ও নীতি নৈতিকতা নির্ভর।
প্রথমত, প্রশ্ন আসে পরিবেশগত ভারসাম্য নিয়ে। ডায়ার নেকড়ে এমন এক প্রাণী, যে তার সময়ের ইকোসিস্টেমের সাথে খাপ খাইয়ে নিয়েছিল—যেখানে ছিল ম্যামথ, বিশালাকৃতির বাইসন, আর হিমযুগের ঘন বন। সে সময় তারা ছিল শীর্ষ শিকারি (apex predator)। কিন্তু আজকের পৃথিবী, যেখানে বন কাটা হয়েছে, প্রাণী সংখ্যা কমে গেছে, এবং মানুষের আধিপত্য সব জায়গায়, সেই পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্রের জন্যে ডায়ার নেকড়ের বৈশিষ্ট্য সমূহ কতোটাই বা উপযুক্ত?
এমন প্রাণী ফিরিয়ে আনার মানে কেবল তাদেরকে জীবিত করা নয়, বরং তাদের জন্য উপযুক্ত পরিবেশও পুনর্গঠন করা। না হলে, এই প্রাণীগুলো কৃত্রিম জার থেকে মুক্তি পেয়েই আবার বিলুপ্তির পথে হাঁটবে, এবং তখন দায়টা থাকবে আমাদের ওপরেই বর্তাবে।এখানেই ঢুকে পড়ে এক গভীরতর প্রশ্ন—নৈতিকতা। আমরা কি কেবল পারার ক্ষমতা দেখাতে এমন হারিয়ে যাওয়া প্রাণিদের ফিরিয়ে আনতে চাচ্ছি? নাকি এর পেছনে সত্যিই আছে আমাদের দায়বদ্ধতা—যে প্রাণীদের আমরা বিলুপ্ত হতে দিলাম, তাদের ফিরিয়ে আনার?
কিছু কিছু সমাজবিদের মতে এটা ঈশ্বরসুলভ ঔদ্ধত্য—প্রকৃতির নিয়মকে উল্টে দেওয়ার চেষ্টা, যেখানে মৃত্যু আর বিলুপ্তি ছিল এক অনিবার্য ধারা। কিন্তু আরেকদিকে, এটিকে দেখা যায় এক অভিভাবকের দায়িত্ব হিসেবে। আমরাই তো বন কেটেছি, বাস্তুতন্ত্র ভেঙেছি, প্রতিনিয়ত ভেঙেও যাচ্ছি, প্রাণীদের নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছি। তাহলে যদি একদিন আমাদের হাতে সেই প্রাণীদের ফিরিয়ে আনার সুযোগ থাকে—তবে কি আমাদের তা করা উচিত নয়?
এই প্রশ্নগুলোর কোনও সহজ উত্তর নেই। কারণ বিজ্ঞান কেবল কি করা সম্ভব তা বলে, কিন্তু কি করা উচিত, সে উত্তর আমাদের মানবতা, বিবেক, আর দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই আসতে হয়। এই সমস্ত দ্বিধা-দ্বন্দ্বের মধ্যেও এক জিনিস অস্বীকার করা যায় না। এই প্রয়াসে আমরা দেখতে পাই এক অসামান্য সাহসিকতা। এটা কেবল প্রযুক্তির নয়, কল্পনার, কৌতূহলের, আর দায়বদ্ধতার এক জৈব-সাহিত্য। আমরা এই গ্রহের একমাত্র প্রজাতি, যারা মৃত্যুর গল্পকে নতুনভাবে লেখার চেষ্টা করছে। যেখানে বিলুপ্তির পরেও শেষ হয় না ইতিহাস। কলোসাল বায়োসায়েন্সের উপদেষ্টা অ্যান্ড্রু পাস্ক বলেন,
“ডায়ার নেকড়ের এই প্রকল্পটি প্রমাণ করে যে, হারিয়ে যাওয়া বৈচিত্র্য ফিরিয়ে আনার ক্ষমতা এখন মানুষের হাতে রয়েছে।”
সুতরাং, ডায়ার নেকড়েকে ফিরিয়ে আনার এই প্রচেষ্টা, যতোই বিতর্কিত হোক, একটি সাহসী অধ্যায়। এটি সেই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার যাত্রা, যেগুলো এতদিন শুধু দর্শনের বইয়ে ছিল। এখন সেগুলো পরীক্ষাগারেও আছে। আর আমরা—মানুষজাতি—সেই পরীক্ষার পরীক্ষকও, পরীক্ষার্থীও।
তথ্যসূত্রঃ
Leave a Reply