জীবনের অন্ধকার অঞ্চল – প্রাণের নতুন ডোমেইন?

পদার্থবিদ্যার এক রহস্যজনক বিষয় হলো ডার্ক ম্যাটার। মহাবিশ্ব সৃষ্টির সময় হিসেব মতো যে বস্তু ও শক্তি তৈরি হওয়ার কথা, বিজ্ঞানীরা তার মাত্র ৪%-র হিসেব পেয়েছেন। বাকি ৯৬% বস্তু-শক্তির অস্তিত্ব এখনো বোঝা যাচ্ছে না। এদেরকে বলা হয় ডার্ক ম্যাটার ও ডার্ক এনার্জি নামে।

মহাবিশ্বের যেমন ৯৬% জিনিসকে আমরা জানি না। ঠিক তেমনই ১% অণুজীবকে আমরা কালচার মিডিয়াতে চাষ করতে পারি। বাকি ৯৯% অণুজীব কালচার মিডিয়ামে দেখা দেয় না। তাই এদেরকে জীববিজ্ঞানের “ডার্ক ম্যাটার” বলে ডাকা হয়।

সম্প্রতি ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার একদল জীববিজ্ঞানী এই ৯৯% অণুজীবদের জন্য ন্যূনতম একটি ডোমেইন প্রস্তাব করেছেন। আমরা জানি, সকল কোষীয় জীবনকে তিনটি ডোমেইন বা জৈব-অঞ্চলে ভাগ করা হয়। এরা আমাদের পরিচিত ইউক্যারিয়া, ব্যাক্টেরিয়া আর আর্কিয়া। আর্কিয়া আলাদা ডোমেইন হিসেবে স্বীকৃতি পায় ১৯৭০ সালের দিকে। আর্কিয়া ও ব্যাক্টেরিয়ার মধ্যে আপাত অনেক সাদৃশ্য থাকলেও তাদের প্রাণ রাসায়নিক ধর্ম ব্যাক্টেরিয়ার চাইতে ভিন্ন। 16s rRNA বিশ্লেষণ বলে যে ব্যাক্টেরিয়ার তুলনায় আর্কিয়ারা ইউক্যারিয়টদের বেশি কাছে।

৯৯% ব্যাক্টেরিয়াকে আমরা কালচার মিডিয়াতে চাষ করতে পারি না বলে কি অন্য কোন ভাবে তাদের খবর

ক্রেইগ ভেন্টর

জানা যাবে না? এগিয়ে এলেন ক্রেইগ ভেন্টর এবং তার দলবল। টাইম ম্যাগাজিন ক্রেইগ ভেন্টরকে ২০০৭ সালে বিশ্বের একশ প্রভাবশালী ব্যাক্তির মধ্যে একজন বলে স্বীকৃতি দেয়। অথচ তিনি একজন বিজ্ঞানী, কোন রাজনীতিবিদ কিংবা কোটিপতি ব্যাবসায়ী নন। গতবছর কৃত্রিম জিনোম দিয়ে ব্যাক্টেরিয়ার কোষে কৃত্রিম প্রাণ নিয়ে গবেষণার জন্য তিনি বেশ আলোচিত হয়েছিলেন। তিনি হিউম্যান জিনোম প্রজেক্টেরও একজন কর্ণধার ছিলেন। হিউম্যান জিনোম প্রজেক্টে কাজ করার সময় তিনি শটগান জিনোমিকসের উন্নতি সাধন করেন। শটগান জিনোমিকস এমন একটি পদ্ধতি যার মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা কোন নমুনায় উপস্থিত অণুজীবদের কালচার মিডিয়ামে চাষ না করেই তাদের ডিএনএ বিশ্লেষণ করতে পারেন।

গত ২০০৩ সাল থেকে একদল বিজ্ঞানী আটলান্তিক, প্রশান্ত ও ভারতীয় মহাসাগরের বিভিন্ন জায়গা থেকে নমুনা সংগ্রহ করেন। তারপর শটগান জিনোমিকস পদ্ধতির মাধ্যমে সেসব নমুনায় উপস্থিত সকল অণুজীবের জিনোম পড়া শুরু করেন অর্থাৎ জিনোম সিকোয়েন্সিং করেন। বিশেষ করে তাদের লক্ষ্য ছিলো 16s rRNA বিশ্লেষণ। নমুনাগুলো নিয়ে কাজ করার সময় কিছু অদ্ভূত পর্যবেক্ষণ পাওয়া গেল। আমরা জানি , 16s rRNA কে ব্যবহার করা হয় জৈববিবর্তন ভিত্তিক ফাইলোজেনেটিক শ্রেণিবিন্যাস করার সময়। এর ভিত্তিতে আধুনিক ট্রি অব লাইফ তৈরি করা হয়। মহাসাগরের বিভিন্ন নমুনায় দেখা গেল, 16s rRNA-র recA, rpoB জিনগুলো একেবারেই অন্যরকম। নমুনায় এসব জিনের এমন সব সিকোয়েন্স পাওয়া গেল যা অন্য কোন জীবের ক্ষেত্রে দেখা হয় নি। এই সিকোয়েন্সের দুইটি সাধারণ ব্যাখ্যা হতে পারে:

এরা কোন ভাইরাসের জেনেটিক সিকোয়েন্সের অংশ
অথবা এরা আসলে জীবন বৃক্ষের নতুন একটি ডোমেইনের নিদর্শন

ভেন্টর আর তার সহবিজ্ঞানীরা ভাবছেন, এই সিকোয়েন্সগুলো জীবনের নতুন ডোমেইন হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। অবশ্য মিমিভাইরাস (mimivirus) কে অনেকেই ভাইরাস না বলে জীবনের নতুন একটি ডোমেইনে ফেলতে চান। কারণ এর অনেকগুলো জিনই দেখা যায় কেবলমাত্র কোষীয় জীবনেই উপস্থিত। বিজ্ঞানী এইসন মনে করছেন, মিমি ভাইরাসকে যদি জীবনের চতুর্থ ডোমেইন বলি, তাহলে নতুন আবিষ্কৃত জেনেটিক সিকোয়েন্স জীবনের পঞ্চম ডোমেইনটিকে নির্দেশ করছে।

শটগান জিনোমিকস পদ্ধতি নিয়ে আরো কিছু কথা বলা যেতে পারে। আমরা জানি, কোন জীবের জিনোম সম্পর্কিত ডিসিপ্লিন হলো জিনোমিকস। জিনোমিকস জীবের ডিএনএ সিকোয়েন্সিং এবং জেনেটিক ম্যাপিং নিয়ে কাজ করে। বড় কোন জিনোমকে টানা একবারেই পড়ে সিকোয়েন্স বের করা যায় না। এজন্য জিনোমটিকে অনেকগুলো ছোট ছোট টুকরাতে ভাগ করে তারপর তার জেনেটিক কোড উদ্ধার করা হয়। এই পদ্ধতিকেই বলে শটগান জিনোমিকস।

ইংরেজিতে কন্টেন্ট রাইটার হয়ে গড়ে তুলতে পারেন নিজের ফ্রিল্যান্স-ক্যারিয়ার।

কীভাবে? দেখুন ফ্রি-মাস্টারক্লাস ভিডিও

আরাফাত রহমান
অণুজীববিজ্ঞানের ছাত্র ছিলাম, বর্তমানে ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া, রিভারসাইড-এ পিএইচডি গবেষক। যুক্ত আছি বায়ো-বায়ো-১ ও অনুসন্ধিৎসু চক্র বিজ্ঞান সংগঠনের সঙ্গে। আমার প্রকাশিত বই "মস্তিষ্ক, ঘুম ও স্বপ্ন" (প্রকৃতি পরিচয়, ২০১৫) ও "প্রাণের বিজ্ঞান" (প্রকৃতি পরিচয়, ২০১৭)।