অপবিজ্ঞান তথা Pseudoscience হল সেইসব তত্ত্ব যা বিজ্ঞান হিসেবে দাবী করা হয় কিন্তু সেগুলো বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত নয়। সাধারণত সস্তা জনপ্রিয়তা অর্জনের জন্য, বই বিক্রয় বাড়ানোর জন্য, প্রতারণার মাধ্যম হিসেবে কিংবা ব্যবসায়িক স্বার্থ উদ্ধারের জন্য অপবিজ্ঞান, বিজ্ঞানের ফাঁকে ফাঁকে ঢুকিয়ে দেয়া হয়। নিজেদের অজান্তেই আমরা সাধরন মানুষ প্রতিনিয়ত অপবিজ্ঞানের শিকার হচ্ছি। এমন অনেক কিছুই আছে যা আমরা বিজ্ঞান বলে জানি কিংবা আমাদেরকে জানানো হয় কিন্তু সেটা আসলে বিজ্ঞান নয়। এধরনের অপবিজ্ঞানের ফাঁদ থেকে দুরে থাকার জন্য আজ এই লেখার অবতারনা করছি।
অপবিজ্ঞান সেই তত্তকেই বলা হবে যা বিজ্ঞান হিসেবে উপস্থাপন করা হবে, যার সাথে বৈজ্ঞানিক অন্যান্য তথ্য উপাত্তের সম্পর্ক দেখানো হবে কিন্তু পরীক্ষা নিরীক্ষা করে তার সত্যতা প্রমাণ করা যাবে না। অপবিজ্ঞানের সবচেয়ে স্থূল উদাহরন হচ্ছে বৈজ্ঞনিক ভাবে ধর্মের ব্যখ্যা হাজির করা। অনেক সময় অপবৈজ্ঞানিক তত্তগুলো অন্যান্য বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের সাথে এত গভীরভাবে জড়িয়ে যায় কিংবা এবং বৈজ্ঞানিক ভাবে উপস্থাপন করা হয় যে, সেগুলোকে পরীক্ষিত বিজ্ঞান থেকে সহজে আলাদা করা যায় না। তবে বিজ্ঞানীরা প্রতিনিয়ত বিজ্ঞানের ভিতর থেকে অপবিজ্ঞানের বিষয়গুলো দুর করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন।বিজ্ঞানের অগ্রগতির সাথে সাথে অবশ্য এই অপবৈজ্ঞানিক তত্ত্বগুলো সনাক্তকরণ বেশ সহজ হয়ে যাচ্ছে। অপবৈজ্ঞানিক তত্ত্বগুলোর তালিকা বর্ণনা করতে গেলে একটা মোটা বই লিখে ফেলা যাবে। তাই এখানে শুধু অতি গুরুত্বপূর্ণ, আমাদের জীবন ঘনিষ্ট কিংবা প্রতারণার হাত থেকে বাঁচার জন্য যেটুকু জানা দরকার সেটুকুই আলোচনা করব।
জোতিষশাস্ত্র: সবচেয়ে প্রকট, নগ্ন অবৈজ্ঞানিক তত্ত্ব যেটা ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার মাঝে প্রভাব বিস্তার করে আছে তা হল জোতিষশাস্ত্র। জোতিষশাস্ত্র অত্যন্ত প্রাচিন একটি তত্ত্ব। এর সাথে বিজ্ঞান কোনো ভাবেই খাপ খায় না। তথাপি এটা আমাদের দেশসহ সারা পৃথিবীব্যাপী বহুলভাবে সমাদৃত। এমন কি শিক্ষিত শ্রেণীর বিশাল একটা অংশ জোতিষশাস্ত্রের ফাঁদে আটকা পড়ে আছে। সাধারন মানুষের নির্ভরতা সুযোগ নিয়ে অনেকেই জোতিষচর্চার ব্যবসা ফেঁদে যুগ যুগ ধরে আমাদেরকে ঠকিয়ে আসছে। ইদানিং একে গণিতের একটি শাখা সংখ্যাতত্ত্বের সাথে মিলিয়ে বৈজ্ঞানিক ফ্লেভার দেয়া হচ্ছে। আমাদের দেশের সর্বাধিক প্রচলিত দৈনিক হিসেবে দাবীকৃত পত্রিকাটির হোম পেইজে রাশিচক্রের বিশাল লোগো সবারই চোখে পড়ে থাকবে।
সমতল পৃথিবী তত্ত্ব: পৃথিবীতে এখনো এমন কিছু সংগঠন আছে যারা পৃথিবী সমতল দাবী করে। এই ব্যপারে তারা প্রচারনা চালায় এমনকি যুক্তিও হাজির করে।
সৃষ্টিতত্ত্ব: এই তত্ত্ব অনুসারে পৃথিবীতে প্রত্যেকটি প্রজাতি, কোন একজন বুদ্ধিমান সত্ত্বা কর্তৃক আলাদা আলাদা ভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে। অথচ বৈজ্ঞানিক ভাবে এটা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, পৃথিবীতে প্রাকৃতিক নিয়ে সরলপর্যায়ে প্রাণের উৎপত্তি ঘটেছে এবং ধীরে ধীরে বিবর্তন প্রক্রিয়ায় অন্যান্য প্রজাতির বিকাশ হয়েছে। সৃষ্টি তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করার জন্য সৃষ্টিতত্ত্ববাদীরা এখনো সারা পৃথিবীতে বহুলমাত্রায় সক্রিয় আছে।বিংশ শতাব্দীর একটা বড় সময় ধরে বাইবেলীয় সৃষ্টিতত্ত্ববাদীরা সারা আমেরিকায় বিবর্তন বিরোধী প্রচার চালায় এবং স্কুলের পাঠসূচী থেকে বিবর্তন সরিয়ে দেয়ার সবাত্মক চেস্টা চালায়। কিন্তু শেষপর্যন্ত বিবর্তনবাদীদের যুক্তির কাছে তাদের পরাজয় স্বীকার করতে হয় এবং আদলতের মাধ্যমে বিবর্তন তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়।
বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল: বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলে প্রকৃত পক্ষে কোন রহস্য নেই। (এটা নিয়ে শিঘ্রই একটি পোস্ট দেয়ার ইচ্ছা আছে।) অথচ এটার ব্যখ্যা হিসেবে যেসব উদ্ভট থিউরী দেয়া হয়েছে তার কয়েকটি হল:
১. এখানে এলিয়েন উপস্থিত আছে।
২. এখানে স্থান-কাল কুন্ডলীকৃত হয়ে আছে। সেকারনে স্থান ও কালের বিভ্রম তৈরি হয়।
৩. কোন কোন লেখক বিভিন্ন বৈজ্ঞনিক তত্ত্ব উল্লেখ করে দাবী করেছেন এখানে ওয়র্মহোল আছে! ইত্যাদি ইত্যাদি….।
জলবায়ু পরিবর্তন অস্বীকার: অনেকেই ধারনা করে থাকেন জলবায়ু পরিবর্তনের যে দাবী করা হয় সেটা আসলে ভিত্তিহীন! আর যদি পরিবর্তন হয়েই থাকে তার সাথে কার্বনডাই-অক্সাইডের কোন সম্পর্ক নাই। সামু ব্লগেই এধরনের পোস্ট দেখেছিলাম।
চাঁদে অবতরনের সন্দেহ-তত্ত্ব: চাঁদে অবতরনের যখেষ্ট প্রমাণ ও উপাত্ত থাকা সত্ত্বেও বই ও ম্যাগাজিনের কাটতি বাড়ানোর জন্য একটি শ্রেণী এই ঘটনা মিথ্যা বলে প্রচার চালায়। এমনকি এর বিরুদ্ধে বৈজ্ঞানিক তথ্যপ্রমানও হাজির করা হয়!
আধ্যাত্মিকতা: অনেকেই ভাবেন আত্মার সাথে আত্মার যোগাযোগ ঘটে টেলিপ্যাথির মাধ্যমে। আধ্যাত্মিক উপায়ে অনেককিছু অর্জন করা যায়। যদিও এধরনের কোন বৈজ্ঞানিক তথ্য-প্রমান এখনো পাওয়া যায় নি।
হোমিওপ্যাথি: হোমিও প্যাথি চিকিৎসার কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নাই। এর ভিত্তি হল বিশ্বাস। অর্থাৎ আমি যদি বিশ্বাস করি যে আমার রোগ ভালো হয়ে যাবে, তাহলে আমার রোগ ভালো হয়ে যাবে। আর ওষুধ হিসেবে যা দেয়া হয় সেটা আসলে placebo। মেডিকেল সায়েন্সে faith healing (placebo এর মাধ্যমে) এর যেটুকু গুরুত্ব আছে হোমিওপ্যাথি আসলে সেটুকুই করতে পারে।
অতিন্দ্রীয় ক্ষমতা: টেলিপ্যাথি, পূর্ববোধ, আধ্যাত্মিক কিছু কিছু বিষয় এর অন্তর্গত।
বিজ্ঞান পুঁজি করে ব্যবসা: সবচেয়ে প্রকৃষ্ট উদাহরন হল হরলিক্স। হরলিক্স থেকে যে পুস্টি পাওয়া যায় দৈনন্দিন সুষম খাবার থেকে তার চেয়ে অনেক ভালো পুস্টি পাওয়া যায়। একটু সচেতন হলেই দেখতে পাবেন হরলিক্স খায় এমন বাচ্চা আর হরলিক্স খায় না এমন বাচ্চার সুস্থতার মধ্যে আদৌ কোন পার্থক্য নেই। সেই সাথে বলে রাখি, বয়সের তুলনায় মাত্রা-তিরিক্ত লম্বা হওয়া এক ধরনের রোগ। হরমোন imbalance এর কারনে এটা হয়ে থাকে। গত শতাব্দী ধরে দেখা যাচ্ছে বিজ্ঞান জগতে যখন যে নতুন জিনিসটি আবিষ্কার হয় সেটা দিয়ে সাধারণ মানুষের অজ্ঞাতার সুযোগ নিয়ে ব্যবসা ফেঁদে বসা হয়। মেরী কুরি যখন রেডিয়াম আবিষ্কার করেন তখন রেডিয়াম চকলেট, রেডিয়াম ক্রিম, রেডিয়াম কসমেটিক বের হয়ে গিয়েছিল! কিছদিন আগেও আমাদের দেশের বয়ষ্ক লোকজন বাতের ব্যথার উপশমের জন্য এক ধরনের চুম্বক যুক্ত ব্যন্ড পরতেন, যা প্রতারণা ছাড়া কিছুই নয়। যখন ইলেক্ট্রিসিটি আবিষ্কার হয়েছিল তখন একধরনের ব্যবসায়িক মহল ইলেক্ট্রিক শকের মাধ্যমে (!) রোগ নিরাময়ে পদ্ধতির প্রচলন ঘটিয়েছিলো। (সব ভুক্তভোগীর প্রতি আমার সমবেদনা)। বিজ্ঞান পুঁজি করে ব্যবসা নিয়ে বিস্তারিত পোস্ট দেয়ার একটা ইচ্ছা থাকল।
পরিশেষে একটা কথা বলতে চাই: সাধু সাবধান।
সবাই বিজ্ঞানের সংস্পর্শে আসুন এবং অপবিজ্ঞান থেকে দুরে থাকুন।
তথ্যসূত্র:
http://en.wikipedia.org/wiki/Homeopathy
http://en.wikipedia.org/wiki/Pseudoscience
http://www.experiment-resources.com/junk-science.html
http://en.wikipedia.org/wiki/Alternative_medicine
http://www.worldcat.org/title/environmental-science-under-siege-fringe-science-and-the-104th-congress/oclc/57343997
http://www.sciencemag.org/content/291/5513/2515.full
http://web.archive.org/web/20071122222054/http://liftoff.msfc.nasa.gov/News/2001/News-MoonLanding.asp
http://www.astrosociety.org/education/resources/pseudobib05.html#10
http://www.nsf.gov/statistics/seind02/c7/c7s5.htm#c7s5l2
Leave a Reply