মানুষ যেদিন থেকে ‘মহাজাগতিক জীব’ বিষয়টি নিয়ে ভাবতে শুরু করেছে মূলত সেদিন থেকেই তাদের সাথে যোগাযোগের আগ্রহের সূত্রপাত। সেই ঊনিশ শতক থেকেই গণিতবিদ ও গবেষকগণ মাহাজাগতিক জীবের সাথে যোগাযোগের বিভিন্ন পদ্ধতি নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করে যাচ্ছেন। এই নিয়ে ঊনিশ শতক থেকেই বিস্তর বই ও প্রবন্ধ লেখা হচ্ছে। তখনকার দিনে অনেক মানুষই মনে করতেন মঙ্গল, শুক্র কিংবা চাঁদে বুদ্ধিমান প্রাণীর অস্তিত্ব থাকার সম্ভবনা রয়েছে। তবে তখনো রেডিও তরঙ্গ আবিষ্কৃত না হওয়ায় এবং অন্যগ্রহে নভোযান পাঠানোর মত প্রযুক্তি না থাকায় এ বিষয়ে তেমন অগ্রগতি হয় নি।
ঊনিশ শতকের বিখ্যাত গণিতবিদ কার্ল ফ্রেডরিখ গাউস(Carl Friedrich Gauss) পীথাগোরাসের উপপাদ্যের জ্যামিতিক চিত্রটি প্রথিবীর বুকে দশ মাইল দৈর্ঘ্যে আঁকার পরামর্শ দিয়েছিলেন যেন মহাকাশ থেকে অন্য কোন বুদ্ধিমান প্রাণী সেটা দেখতে পায় এবং আমাদের গণিতের অগ্রগতি তথা সভ্যতা সম্বন্ধে ধারনা লাভ করে।
পীথাগোরাসের উপপাদ্যের জ্যামিতিক চিত্রণ
জোসেফ যোহান লিট্রো নামক একজন জোতির্বিদ বললনে, সাহারা মরুভুমিতে বিশাল বিশাল চওড়া পরিখা খনন করা হোক। তারপর সেখানে কেরোসিন ঢেলে প্রতি রাতে ছয় ঘন্টা আগুন জ্বেলে আমাদের উপস্থিতি জানান দেয়া যাবে। একই সময়ে অন্যান্য অনেক জোতির্বিদ বিভিন্ন গ্রহে প্রাণের অস্তিত্ব খোঁজায় ব্যস্ত ছিলেন। এরই মধ্যে ১৮৮২ সালে ফ্রান্জ ভন গ্রুখুইসেন নামক একজন জোতির্বিদ দাবী করলেন তিনি চাঁদের মাটিতে বিশাল শহর এবং চাষাবাদের লক্ষণ দেখেছেন। তবে অন্যান্য জোতির্বিদগণ তাঁর এই দাবী অগ্রহনযোগ্য প্রমাণ করে দিলেন। ঊনিশ শতকের শেষ দিকে জোতির্বিদদের মধ্যে ধারনা তৈরি হয়েছিল যে, যেই গ্রহ সূর্য থেকে যতদূরে সেই গ্রহ ততো বেশী পুরোনো। এই ধারনা অনুযায়ী মঙ্গল, পৃথিবীর চেয়ে পুরোনো গ্রহ, তাই সবার দৃষ্টি চলে গেলো মঙ্গলের দিকে। গিওভান্নি শিয়াপারেল্লি নামের একজন জোতির্বিদ ১৮৭৭ সালে মঙ্গলে কিছু নালা আবিষ্কার করলেন এবং বুদ্ধিমান প্রাণীর অস্তিত্বের ধারনা বদ্ধমূল হল। এসবের ফলশ্রূতিতে ১৯০০ সালে এক লাখ ফ্রাঁ (ফরাসী মুদ্রা)মূল্যমানের গুজম্যান প্রাইজ ঘোষিত হল যেটা আন্তঃগ্রহ যোগাযোগকারী প্রথম ব্যক্তিটিকে দেয়ার কথা ছিল! কিন্তু সবরকম ভুল ধারনার অবসান হলে মানুষ বুঝতে পারলো তারা সৌরজগতে মোটামুটি একা।
১৯৫৩ সালে ল্যান্সলট হগবেন (Lancelot Hogben ) গাণিতিক সংখ্যা এবং চিন্থের সমন্বয়ে একটি সাংকেতিক ভাষা প্রবর্তন করেন যা কিছু ছোট এবং বড় পালসের সমন্বয়ে তৈরি। এটা অনেকটা মোর্স কোডের মত। এরপর ১৯৬০ সালে Lincos উদ্ভাবিত হয় (Lincos = Lingua Cosmica বা মহাজাগতিক ভাষা)। এই ভাষাটিও গাণিতিক সংখ্যা ও চিন্থের সমন্বয়ে তৈরি যা মাহাজাগতিক জীবের সাথে সাধারণ আলাপ আলোচনা চালানোর জন্য তৈরি করা হয়। ১৯৬২ সালে পৃথিবী থেকে প্রথম মেসেজটি পাঠানো হয়। এটা একটি রাডার থেকে প্রেরণ করা হয় শুক্র গ্রহের দিকে মুখ করে। মেসেজটি মোর্স কোড আকারে পাঠানো হয়।
তবে সবচেয়ে আলোচিত বার্তাটি বোধকরি Arecibo message. এটা Arecibo radio telescope থেকে ১৯৭৪ সালের ১৬ নভেম্বর প্রেরণ করা হয়। এটা M13 নামক তারকপুঞ্জের দিকে তাক করে প্রেরণ করা হয়। এটি ছিলো একটি বাইনারী মেসেজ। অথাঁৎ অনেকগুলো ০ এবং ১ এর সমন্বয়ে মেসেজটি তৈরি হয়েছে। মেসেজটি ছিলো এই রকম:
00000010101010000000000 00101000001010000000100 10001000100010010110010 10101010101010100100100 00000000000000000000000 00000000000011000000000 00000000001101000000000 00000000001101000000000 00000000010101000000000 00000000011111000000000 00000000000000000000000 11000011100011000011000 10000000000000110010000 11010001100011000011010 11111011111011111011111 00000000000000000000000 00010000000000000000010 00000000000000000000000 00001000000000000000001 11111000000000000011111 00000000000000000000000 11000011000011100011000 10000000100000000010000 11010000110001110011010 11111011111011111011111 00000000000000000000000 00010000001100000000010 00000000001100000000000 00001000001100000000001 11111000001100000011111 00000000001100000000000 00100000000100000000100 00010000001100000001000 00001100001100000010000 00000011000100001100000 00000000001100110000000 00000011000100001100000 00001100001100000010000 00010000001000000001000 00100000001100000000100 01000000001100000000100 01000000000100000001000 00100000001000000010000 00010000000000001100000 00001100000000110000000 00100011101011000000000 00100000001000000000000 00100000111110000000000 00100001011101001011011 00000010011100100111111 10111000011100000110111 00000000010100000111011 00100000010100000111111 00100000010100000110000 00100000110110000000000 00000000000000000000000 00111000001000000000000 00111010100010101010101 00111000000000101010100 00000000000000101000000 00000000111110000000000 00000011111111100000000 00001110000000111000000 00011000000000001100000 00110100000000010110000 01100110000000110011000 01000101000001010001000 01000100100010010001000 00000100010100010000000 00000100001000010000000 00000100000000010000000 00000001001010000000000 01111001111101001111000
এই মেসেজটিতে ১৬৭৯টি বাইনারি অঙ্ক রয়েছে। ১৬৬৯টি অঙ্ক বাছাই করার কারন হল এটি একটি সেমিপ্রাইম সংখ্যা অর্থাৎ দুটি প্রাইম সংখ্যা ৭৯ X ২৩ এর গুণফল। এই মেসেজটিকে ৭৯টি সারি এবং ২৩টি কলাম আকারে ভাগ করে দেখা যায়।
00000010101010000000000
00101000001010000000100
10001000100010010110010
10101010101010100100100
00000000000000000000000
00000000000011000000000
00000000001101000000000
00000000001101000000000
00000000010101000000000
00000000011111000000000
00000000000000000000000
11000011100011000011000
10000000000000110010000
11010001100011000011010
11111011111011111011111
00000000000000000000000
00010000000000000000010
00000000000000000000000
00001000000000000000001
11111000000000000011111
00000000000000000000000
11000011000011100011000
10000000100000000010000
11010000110001110011010
11111011111011111011111
00000000000000000000000
00010000001100000000010
00000000001100000000000
00001000001100000000001
11111000001100000011111
00000000001100000000000
00100000000100000000100
00010000001100000001000
00001100001100000010000
00000011000100001100000
00000000001100110000000
00000011000100001100000
00001100001100000010000
00010000001000000001000
00100000001100000000100
01000000001100000000100
01000000000100000001000
00100000001000000010000
00010000000000001100000
00001100000000110000000
00100011101011000000000
00100000001000000000000
00100000111110000000000
00100001011101001011011
00000010011100100111111
10111000011100000110111
00000000010100000111011
00100000010100000111111
00100000010100000110000
00100000110110000000000
00000000000000000000000
00111000001000000000000
00111010100010101010101
00111000000000101010100
00000000000000101000000
00000000111110000000000
00000011111111100000000
00001110000000111000000
00011000000000001100000
00110100000000010110000
01100110000000110011000
01000101000001010001000
01000100100010010001000
00000100010100010000000
00000100001000010000000
00000100000000010000000
00000001001010000000000
01111001111101001111000
এভাবে কলাম এবং সারিতে ভাগ করার একটা তাৎপর্য আছে। এই সংখ্যাটির ০গুলোকে সাদা এবং ১গুলোকে যদি কালো ধরা হয় এবং এভাবে কলাম ও সারিতে ভাগ করা হয় তাহলে তা নিচের চিত্রটির মত দেখা যায়।
এই ছবিটির একেকটি অংশ দিয়ে পৃথিবীতে প্রাণের উৎপত্তি ও সভ্যতা বিকাশের একেকটি বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করা হয়।
একেবারে উপরের অংশে ১ থেকে ১০ পর্যন্ত সংখ্যাগুলো অনুভূমিক ভাবে বাইনারীতে লেখা হয়েছে।
তার পরের অংশে যে মৌলিক পদার্থগুলো (হাইড্রোজেন, কার্বন, নাইট্রোজেন, অক্সিজেন ফসফরাস) দিয়ে ডিএনএ তৈরি সেগুলোর পারমানবিক সংখ্যা দেয়া আছে।
এর পরের অংশে আছে ডি.এন.এ. এর বিভিন্ন অংশের আণবিক সংকেত।
এর পরের অংশে ডি.এন.এ. এর দ্বিসূত্রাকার প্যাঁচানো আকৃতিটি দেয়া আছে। এবং মাঝখানে লম্বা অংশে ৪.৩ বিলিয়ন লেখা আছে। (তখনকার দিনে মানুষের ডি.এন.এ.তে নিউক্লিওটাইডের সংখ্যা ৪.৩ বিলিয়ন বলে ধারনা করা হত। প্রকৃতপক্ষে এই সংখ্যাটি হবে ৩.২ বিলিয়ন)।
এর নিচে মাঝখানে মানুষের আকৃতি দেয়া আছে। বাঁ পাশে মানুষের গড় উচ্চতা ১২৬ মিলিমিটার এবং ডানপাশে তৎকালীন জনসংখ্যা ৪.৩ বিলিয়ন লেখা হয়েছে।
এর পরের অংশে সৌরজগত দেখানো হয়েছে। প্রথমে বাঁয়ে সুর্য এবং ক্রমান্বয়ে বাকী গ্রহগুলো উপস্থিত আছে। তৃতীয় গ্রহ পৃথিবীতে বিশেষায়িত করার জন্য এক ঘর উপরে তুলে দেয়া হয়েছে।
একেবারে শেষে আছে অ্যারেসিবো রেডিও টেলিস্কোপটি। যেখান থেকে বার্তাটি প্রেরণ করা হয়েছে। নীচের টেলিস্কোপটির ব্যাস এবং বার্তাটির তরঙ্গদৈর্ঘ্যও দেয়া হয়েছে।
অ্যারেসিবো টেলিস্কোপটি দেখতে নিচের ছবিটির মত।
আমাদের পৃথিবী থেকে এম১৬ তারকাপুঞ্জের দুরত্ব ২৫ হাজার আলোকবর্ষ। কাজেই এই বার্তাটি যদি সেই তারকাপুঞ্জের কোন বুদ্ধিমান প্রাণীর নিকট আদৌ পৌঁছায়, তা পৌঁছাবে ২৫হাজার বছর পর। এবং বার্তাটি পেয়ে তারা যদি প্রত্যুত্তর করে তাও পৌঁছাতে সময় লাগবে আরো ২৫ হাজার বছর। এই দীর্ঘ সময়ে মানব সভ্যতা কোথায় যাবে তা কেবল সময়ই বলতে পারে। এতদিন মানব সভ্যতা টিকে থাকবে তো। সমগ্র পৃথিবীতে যেভাবে পরিবেশ দূষন চলছে সেই হারে চলতে থাকলে আগামী দু’শ বছরের মধ্যে মানব সভ্যতার অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাওয়ার সম্ভবনা আছে। এই বার্তাটির কি সত্যিই কোন তাৎপর্য আছে মানব সম্প্রদায়ের জন্য? সেই প্রশ্ন পঞ্চাশ হাজার বছরের (কম পক্ষে ২৫ হাজার) জন্য তুলে রাখলাম।
Leave a Reply