সমসাময়িক বিশ্বসৃস্টিতত্বের প্রধান দুটো প্রশ্নের একটি হল মহাবিশ্বের প্রভাত লগ্ন। আরও ভাল ভাবে বললে কখন ও কিভাবে প্রথম তারা ও গ্যালাক্সী সমুহ সৃস্টি হয়েছিল এবং মহাবিশ্বকে সর্বপ্রথম আলোকিত করেছিল। এসকল তারা-সৃস্টিশীল গ্যালাক্সী নিরপেক্ষ হাইড্রোজেন মেঘমালাকেও আয়নিত করতে শুরু করে আর এরই ফলে আজকের মহাবিশ্ব সম্পূর্ণ আয়নিত।
আজ থেকে প্রায় ১৪ কোটি বছর আগে এক মহাবিস্ফোরণের ফলে এই মহাবিশ্বের যাত্রা শুরু। জ্যোতির্বিজ্ঞানে আমরা যত দুরের বস্তু দেখি সেটা সময়ের নিরিখে ততটা প্রাচীন। আমাদের মহাবিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন যে নিদর্শন পাওয়া যায় তা হল ২.৭ ডিগ্রী তাপমাত্রার পটভূমি বিকিরণ। সে সময় মহাবিশ্বের বয়স ছিল তিন লক্ষ বছর। এই আদি বিকিরণের যে ছবি পাওয়া যায় তারই বিবর্তিত অবস্থা আজকের মহাবিশ্ব। তাই এটি আমাদের মহাবিশ্বের নীল নকশাও বটে। আদি অবস্থা থেকে তৈরি হওয়া ইলেকট্রন এবং প্রোটন যখন নিরপেক্ষ হাইড্রোজেন তৈরি করে এর পর আটকে থাকা এই বিকিরণ নিরপেক্ষ হাইড্রোজেন ভেদ করে বেরিয়ে আসে, অনেকটা মেঘের পৃষ্ঠ থেকে আলো বের হবার মত। এর পর মহাবিশ্বের সকল পদার্থ নিরপেক্ষ হাইড্রোজেন আকারে থাকে এবং এর ফলে মহাবিশ্ব একটা নিকষ কালো অন্ধকার এ নিমজ্জিত থাকে যতক্ষণ না পর্যন্ত প্রথম আলো ফুটে ওঠে, অর্থাৎ প্রথম তারাসমুহ জন্মলাভ করে। তবে এ সময় জন্মলাভ করা তারাদের বৈশিষ্ট্য কি এ নিয়ে অনেক মতভেদ আছে। ক্রমাগত গ্যালাক্সি এবং অন্যান্য কাঠামো তৈরি হয়।
তরুণ এসকল তারাগুলো থেকে সৃষ্ট অতিবেগুনী বিকিরণ চারপাশের নিরপেক্ষ হাইড্রোজেন পরমাণুর মেঘকে আয়নিত করতে শুরু করে। আর এ ঘটনাকেই বলা হয় পুণঃআয়নন। মহাবিশ্বের বয়স বাড়তে থাকে আর এই আন্তঃগ্যালাক্টিক হাইড্রোজেন মেঘমালা ক্রমশ আয়নিত হতে থাকে। বর্তমান মহাবিশ্বে আমরা দেখি এই আন্তঃগ্যালাক্টিক হাইড্রোজেন মেঘমালা সম্পূর্ণ আয়নিত। কিন্তু ঠিক কিভাবে ও কখন এই পুরো প্রক্রিয়াটি শুরু ও শেষ হয় এবং কি কি ধরনের জ্যোতিঃপদার্থিক প্রক্রিয়া এর জন্য দায়ী – এগুলোই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।
দুটি বিশেষ ঘটনার মাধ্যমে পুণঃআয়নন এর শুরু এবং শেষ সম্পর্কে ধারনা পাওয়া যায়। এর একটি হল দূরবর্তী কোয়েসার এর শোষণ বর্ণালী আর অপরটি হল পটভূমি বিকিরণ এর বিচ্ছুরণ।
জেমস গান ও পিটারসন ১৯৬৯ সালে গণনা করে দেখান যে দূরবর্তী কোয়েসার থেকে আগত বিকিরণ যদি আন্তঃগ্যালাক্টিক হাইড্রোজেন মেঘমালা দ্বারা শোষিত হয় তবে তার বর্ণালীর একটি অংশ অনেকাংশেই নিঃশোষিত হবে। এটি লাইম্যান-আলফা (তরঙ্গদৈর্ঘ্য ১২১৬ অ্যাংস্ট্রম) শোষণ নামে পরিচিত কেননা শোষণের ফলে ১২১৬ অ্যাংস্ট্রম এর চেয়ে ছোট তরঙ্গদৈর্ঘ্য (অতিবেগুনী) এর সব বিকিরণ নিঃশোষিত হয়ে যায়। দূরবর্তী কিছু কোয়েসার (যাদের লোহিত সরণ~৬)এর ক্ষেত্রে এই শোষণ লক্ষ্য করা গেছে। কিন্তু অতি সামান্য পরিমাণ নিরপেক্ষ হাইড্রোজেন এর উপস্থিতি সম্পূর্ণ লাইম্যান-আলফা শোষণ এর জন্য যথেষ্ট। তাই ধরা হয় লোহিত সরণ~৬ এর কাছাকাছি সময়ে (মহাবিশ্বের বয়স প্রায় ১ বিলিয়ন বছর) পুণঃআয়নন প্রক্রিয়া শেষ হয়।
পুণঃআয়নন প্রক্রিয়ার শুরুর সময় সম্পর্কে জানা যায় পটভূমি বিকিরণ থেকে। নিরপেক্ষ হাইড্রোজেন যখন আয়নিত হওয়া শুরু করে তখন যে ইলেকট্রন নির্গত হয় তার সাথে পটভূমি বিকিরণ এর ফোটন এর মিথষ্ক্রিয়া ঘটে। এই ব্যাপারটি থমসন বিচ্ছুরণ নামে পরিচিত। পটভূমি বিকিরণ এর তাপীয় এবং পোলারাইজেসন – এই দুই চিত্র বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে লোহিত সরণ ~১১ এর কাছাকাছি সময়ে (মহাবিশ্বের বয়স প্রায় ৪০০ মিলিয়ন বছর) পুণঃআয়নন শুরু হয়।
মহাবিশ্বে আমরা বিভিন্ন ধরনের বস্ত দেখি, আর তাই প্রশ্ন আসে অন্য কোন ঘটনাও কি পুণঃআয়ননে জড়িত ছিল নাকি শুধু নবীন তারা-সৃস্টিশীল গ্যালাক্সীরাই এর একমাত্র কারন। আমরা জানি যে এজিএন এর কেন্দ্র থেকেও উচ্চশক্তির বিকীরণ হতে পারে এবং ফলে তা আন্তঃগ্যালাক্টিক নিরপেক্ষ হাইড্রোজেনকে আয়নিত করতে পারে। কিন্তু পর্যবেক্ষণ থেকে দেখা যায় যে অতি দুরের মহাবিশ্বে এজিএনদের সংখ্যা আপেক্ষাকৃত অনেক কম। তাই এখন সবাই মোটামুটি একমত যে তারা-সৃস্টিশীল গ্যালাক্সীরাই পুনঃআয়নন শুরু করার জন্য প্রধানত দায়ী।
এবার পুনঃআয়ননের বিজ্ঞান নিয়ে আলোচনা করা প্রয়োজন। মুলত আমরা দেখতে চাই এসকল তারা-সৃস্টিশীল গ্যালাক্সী হতে উচ্চ শক্তির অতিবেগুনী আলোককণা উৎপাদনের হার কত। এটি আবার নির্ভর করে গ্যালাক্সীতে তারা সৃস্টির হার এবং তা থেকে কত পরিমাণ অতিবেগুনী আলোককণা বের হয়ে আন্তঃগ্যালাক্টিক মাধ্যমে ছড়াতে পারবে – এসবের উপর। তারা সৃস্টির হার হিসেব করা যায় গ্যালাক্সী থেকে নির্গত অতিবেগুনী বিকিরন এর ঘনত্ব থেকে। আর এর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি জানতে হয় তা হল গ্যালাক্সীদের ঔজ্জ্বল্য রাশি। মহাবিশ্বের প্রতি একক আয়তনে এবং একক ঔজ্জ্বল্যে মোট কতটি গ্যালাক্সী আছে তা জানতে পারলেই ঔজ্জ্বল্য রাশি নির্ধারণ করা যায়। এ উদ্দেশ্যে মহাকাশে জরিপ চালিয়ে গ্যালাক্সীদের সনাক্ত করে উজ্জ্বলতা অনুযায়ী তাদের বিন্যাস করা হয়। জ্যোতির্বিজ্ঞানিদের অন্যতম প্রধান কাজ হল এই ঔজ্জ্বল্য রাশি নির্ধারণ করা।
একটি নির্দিষ্ট শ্রেনীর গ্যালাক্সীদের ক্ষেত্রে এই রাশিটির মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট গ্যালাক্সীদের সম্পর্কে সামগ্রিক ধারনা পাওয়া যায়। বর্তমান মহাবিশ্বে দৃশ্যমান গ্যালাক্সীদের জন্য পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে এই রাশিটি সুচারুরূপে নির্ধারণ করা হয়েছে। এটি শেকটার রাশি নামে পরিচিত। তবে সময়ের সাথে এই রাশির পরিবর্তন সাধারণভাবে প্রত্যাশিত।
পুনঃআয়ননের শুরুর সময়ের তরুন তারা-সৃস্টিশীল গ্যালাক্সীদের ঔজ্জ্বল্য রাশি নির্ধারণ করা একটি দুরুহ কাজ। উচ্চ লোহিত সরণ এবং মহাবিশ্বের সম্প্রসারনের ফলে সকল অতিবেগুনী বিকিরন এখন বর্ণালীর অবলোহিত অংশে চলে এসেছে। এছাড়া অতি দূরে অবস্থানের কারনে এসকল গ্যালাক্সীদের আপাত উজ্জ্বলতাও অনেক কম। তাই সরাসরি এদের খুঁজে বের করা কঠিন। তবে এদের বর্ণালীতে একটি বিশেষ একটি বৈশিষ্ট্য আছে যা দিয়ে এদের সহযেই সনাক্ত করা যায়।
পুনঃআয়ননের সময়ে সৃস্ট তারা-সৃস্টিশীল গ্যালাক্সী থেকে নির্গত বিকিরন আমাদের কাছে দৃশ্যমান হবার মাঝে এর অতিবেগুনী অংশ আন্তঃগ্যালাক্টিক নিরপেক্ষ হাইড্রোজেন এর মাধ্যমে শোষিত হয়। আমরা আগেই জেনেছি যে স্থির তরঙ্গদৈর্ঘ্য ১২১৬ অ্যাংস্ট্রম থেকে এই শোষন শুরু হয়। শোষনের ফলে বর্ণালীতে হঠাৎ একটি ছেদ পড়ে। লোহিত সরণের কারনে যতই অতীতে যাওয়া যায় এই ছেদ ততই দীর্ঘতর তরঙ্গদৈর্ঘ্যে সরতে থাকে। যেমন লোহিত সরণ ৮ হলে এই ছেদ দেখা যায় ১ মাইক্রন তরঙ্গদৈর্ঘ্যে। ফলে এই ছেদ এর কাছাকাছি একজোড়া ফিল্টার দুরবীনের ক্যামেরায় ব্যবহার করে তারা-সৃস্টিশীল গ্যালাক্সীদের সনাক্ত করা যায়। আর একারনে এসকল গ্যালাক্সী লাইম্যান-ব্রেক গ্যালাক্সী নামে পরিচিত। তবে আরও নিশ্চিত হবার জন্য অন্যান্য তরঙ্গদৈর্ঘ্যও ব্যবহার করা প্রয়োজন হয় কেননা এরা অন্যকিছু বলে ভ্রম হতে পারে। এছাড়া যেহেতু ইমেজিং এর মাধ্যমে এদের সনাক্ত করা হয় তাই সবশেষে পুরোপুরি নিশ্চিত হবার জন্য এদের সরাসরি বর্ণালীবীক্ষণের মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ আবশ্যক।
হাবল দুরবীন এ স্থাপিত অবলোহিত ক্যামেরা এর মাধ্যমে পুনঃআয়ননের (লোহিত সরণ >৬) সময়কার অনেক প্রার্থী লাইম্যান-ব্রেক গ্যালাক্সী সনাক্ত করা হয়েছে। জাপানের সুবারু দুরবীন এবং ইউরোপের ভিএলটি ও এই ব্যাপারে কাজ করছে। এর উপর ভিত্তি করে সে সময়কার তারা-সৃস্টিশীল গ্যালাক্সীদের ঔজ্জ্বল্য রাশিও নির্ধারণ করা হয়েছে এবং সময় এর সাথে এর বিবর্তন লক্ষ্য করা গেছে। তবে অপেক্ষাকৃত উজ্জ্বলতর গ্যালাক্সীদের স্বল্পতার কারনে লোহিত সরণ ৮ এবং তার উর্ধে ঔজ্জ্বল্য রাশি এর স্বরুপ এখনও সঠিকভাবে নিরুপন করা যায়নি। ভবিষ্যতে তুলনামূলক বড় দৃস্টিক্ষেত্রের ক্যামেরা ব্যবহার করে এর সমাধান সম্ভব হতে পারে। সুতরাং পুনঃআয়ননে তারা-সৃস্টিশীল গ্যালাক্সীদের ভুমিকা নিয়ে যথেস্ট কাজের অবকাশ রয়েছে। আশা করা হচ্ছে জেমস ওয়েব মহাকাশ দুরবীন এর মাধ্যমে মহাবিশ্বের ঊষালগ্নের এসকল গ্যালাক্সীদের আরও ভালভাবে পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হবে এবং পুনঃআয়ননে তাদের ভুমিকা সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারনা লাভ যাবে।
আন্তঃগ্যালাক্টিক হাইড্রোজেন এর ভৌত অবস্থা সরাসরি দেখার সবচেয়ে সুবিধাজনক উপায় হল বেতার তরঙ্গে পর্যবেক্ষণ করা। আমরা জানি যে নিরপেক্ষ হাইড্রোজেন পরমাণু থেকে ২১ সেমি তরঙ্গদৈর্ঘ্যে বিকীরন নির্গত হয় ইলেকট্রনের অক্ষীয় ঘূর্ণন এর তারতম্যের জন্য। বেতার দুরবীন ব্যবহার করে এই বিকীরন সনাক্ত করা যাবে আর তা থেকে আন্তঃগ্যালাক্টিক নিরপেক্ষ হাইড্রোজেন এর মানচিত্র তৈরি করা যাবে। সময়ের সাথে এই মানচিত্রের পরিবর্তন থেকে আন্তঃগ্যালাক্টিক হাইড্রোজেন মেঘমালার নিরপেক্ষ বা আয়নিত অবস্থার চিত্র সরাসরি পাওয়া যাবে। ফলে পুনঃআয়ননের শুরু ও শেষ হবার সময়কাল এবং পুরো প্রক্রিয়া কিভাবে সম্পন্ন হয়েছিল তার উত্তর আমরা পেতে পারব। বর্তমানে লোফার, জিএমআরটি, এমডব্লিউএ
– এসকল বেতার দুরবীন ২১ সেমি তরঙ্গদৈর্ঘ্যে মহাকাশের মানচিত্র তৈরী করবে। প্রস্তাবিত এসকেএ বেতার দুরবীন এ ব্যাপারে অনেক বিস্তারিত তথ্য প্রদান করবে।
Leave a Reply