এই ছবিটা আমি ছোট থাকতে দেখেছিলাম। পৃথিবীর শেষ প্রান্তে পৌঁছে এক পর্যটক তারকাখচিত গোলার্ধের সন্ধান পেয়েছে। কিন্তু সেই গোলার্ধ একটি দেয়ালের মত, সেই দেয়াল অনেকটা অলীক। তার মধ্যে দিয়ে মাথা বের করে সেই পর্যটক মহাশূন্যের ওপারে কি আছে সেটা দেখার চেষ্টা করছে। তার কাছে মনে হচ্ছে আর একটি মেঘালোক যার মাঝে রয়েছে আর একটি সূর্য, আর একটি সৌর জগৎ। ছবিটা অনেক জায়গাতেই ষোড়শ শতাব্দীর ইউরোপের কাঠ-খোদাই কাজ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। সেই উল্লেখে কোন শিল্পীর নাম নেই। তাহলে পনেরশো শতকের ইউরোপে ফ্ল্যাট আর্থ বা সমতল পৃথিবীর ধারণা কি বজায় ছিল? শুধু তাই নয় ছবিটিতে সব নক্ষত্ররা একটা তলে অবস্থিত যা কিনা এরিস্টোটলের সব নক্ষত্রররাই একটা স্ফটিক গোলকের ওপর অবস্থান করে সেই ধারণটা প্রকাশ করেছে। তাহলে নক্ষত্র স্ফটিক গোলকের বিশ্বাসও সেই সময় বর্তমান ছিল।
কিন্তু ইন্টারনেট ঘাটলে দেখা যাবে এই ছবিটার বিভিন্ন ধরণের রঙ দেখা যাবে। নিচের ছবিটা খেয়াল করুন, প্রথম ছবিটি থেকে এটার রঙ আলাদা এবং এর চারদিকে একটি সুদৃশ্য ফ্রেম দেয়া হয়েছে। তার মানে নিজেদের ইচ্ছামত অনেকেই মূল ছবিকে বদলেছেন।
কিন্তু শেষাবধি দেখা গেল অনেকেই এই সম্বন্ধে একমত হয়েছেন ছবিটা মধ্যযুগীয় নয় বরং অনেক পরের। নিচের সাদা কালো ছবিটি প্রথম উদয় হয় ফরাসী জ্যোতির্বিদ ফ্লামারিয়ঁর একটি বইতে ১৮৮৮ সালে (Camille Flammarion, L’Atmosphere: Météorologie Populaire, Paris, 1888)। এই বইতে ফ্লামারিয়ঁ মহাশূন্যের স্বরূপ উদ্ঘাটন করতে গিয়ে এই ছবির কাহিনী বর্ণনা করেছেন। মধ্যযুগের এক মিশনারী পার্থিব স্বর্গের খোঁজে সে শেষ পর্যন্ত সেই দিগন্তে পৌঁছেছিল যেখানে পৃথিবী ও আকাশ (বা স্বর্গ) মিশেছে এক সাথে। এই দুই বিশ্বের মাঝে সে একটা ফাটল আবিষ্কার করেছিল, যার মাঝ দিয়ে মাথা গলিয়ে সে স্বর্গ দেখেছিল।
দেখা গেল ছবিটার সৃষ্টি অনেক পরে যখন মানুষ শুধুমাত্র পৃথিবী নয় সৌর জগতের সঠিক মানচিত্র সম্বন্ধে অভিহিত। তাহলে ১৮৮৮ সনে এই ধরণের পরিত্যক্ত সমতল পৃথিবী বা নক্ষত্রের স্ফটিক গোলকের চিত্রণ করা কেন?
নিসন্দেহে এই ছবির মধ্যে এমন একটা কিছু আছে যা আমাদেরকে টানে। এক ধরণের রহস্য বোধ। মহাবিশ্বের শেষ কোথায়? স্পেস, স্থান বা দেশ বলতে আমরা কি বুঝি? ঊণবিংশ শতাব্দীতে সমতল পৃথিবীর ধারণাকে অনিচ্ছাকৃত ভাবে হলেও পুনর্জ্জীবিত করার জন্য অনেকে ফ্লামারিওঁকে দোষারোপ করেছেন, কিন্তু এই ছবিটির ব্যাপক ব্যবহার প্রমাণ করে যে এর মাঝে এমন এক রহস্যময়তা আছে যা সর্বজনীন। কিন্তু বিখ্যাত ব্রিটিশ বিজ্ঞানী জে ডি বার্নাল তাঁর ১৯৫৪ সনের বিজ্ঞানীর ইতিহাস বইএ এই ছবিটিকে মধ্যযুগীয় বলে অভিহিত করে একটা ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। ব্যাখ্যাটা ভুল ছিল। বার্নাল বলেছিলেন ইউরোপে মধ্যযুগে সমতল পৃথিবী (ফ্ল্যাট আর্থ) নক্ষত্রর স্ফটিক গোলকের ধারণা আবার ফিরে এসেছিল, সেটা এই চিত্রটিতে বর্ণিত হয়েছে। অথচ চিত্রটি ১৮০০ শতকের শেষে মাত্র খোদাই করে হয়েছিল, বার্নাল এই গবেষণাটা করেন নি। তাই ফ্লামারিওঁর বইএর ছবি বার্নাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত এমন ধারণার সৃষ্টি করেছে যে সমতল পৃথিবীর ধারণা ১৫০০ শতকে খুব ভাল ভাবেই প্রচলিত ছিল, ইউরোপীয় নাবিকেরা নাকি ভাবত আটলান্টিক পাড়ি দিলে তাদের জাহাজ মহাশূন্যে পড়ে যাবে, ইত্যাদি। প্রতি বছরই আমি কিছু ছাত্র পাই যারা মনে করে কলম্বাস পৃথিবী যে গোল সেটা আবিষ্কার করতেই আটলান্টিক অতিক্রম করেছিলেন।
কথাটা একেবারেই ঠিক নয়। পৃথিবী যে গোলাকৃতি সেই ধারণাটি অন্তত দু’হাজার সাতশো বছর পুরোনো।
পিথাগোরাসের সময় থেকে গ্রীসে গোলাকার পৃথিবীর কথা বলা হয়েছে, তারপর ইরাটোস্থেনিস (খ্রীষ্টপূর্ব ২৭৬-১৯৪), আর্যভট্ট (৪৭৬-৫৫০ খ্রীষ্টাব্দ) ও আল-বিরুনী (৯৭৩-১০৪৮ খ্রীষ্টাব্দ) পৃথিবীর ব্যাসার্ধ ও পরিধি প্রায় সঠিক ভাবে নির্ধারণ করেছিলেন। মধ্যযুগের ইউরোপে বিজ্ঞানী বা দার্শনিকেদের মাঝে পুনরায় সমতল পৃথিবীর ধারণা ফিরে আসে নি সেটা মোটামুটি বলা যায়। আর এরিস্টোটলের স্ফটিক নক্ষত্র গোলক যার পরে কিছু নেই?
দেশ-কালের সীমাবদ্ধতা বা অসীমতা দুটোই আমাদের সাধারণ বোধের বাইরে। বহু আগে, আজ থেকে প্রায় দু’হাজার পাঁচশো বছর আগে, গ্রীক দার্শনিক আর্খিটারাস (খ্রীষ্টপূর্ব ৪২৮-৩৪৭) এই প্রপঞ্চের উপস্থাপনা করেছিলেন। আর্খিটাস ছিলেন প্ল্যাটোর বন্ধু ও একজন পীথাগোরিয়ান। আর্খিটাস বললেন, মহাবিশ্বের প্রান্তে পৌঁছে যদি একটা বর্শা ছোঁড়া হয় তবে কি সেই বর্শা প্রতিফলিত হয়ে ফিরে আসবে নাকি এই বিশ্ব থেকে অদৃশ্য হয়ে যাবে? আর্খিটাসের এই প্রপঞ্চ মহাবিশ্বের চরিত্র নিয়ে একটা মূল প্রশ্ন রেখেছে। গ্রীক দর্শনের স্টইক ধারা এর উত্তরে এরিস্টোটলকে বর্জন করে বলেছিল নক্ষত্র মণ্ডলের পরে মহাবিশ্ব শেষ হয়ে যায় নি, বরং তার পরে এক বিশাল শূন্যতার অবস্থান। স্টইকদের কাছে সমগ্র মহাবিশ্বই ঈশ্বরের ভূমিকা পালন করছিল। স্টইকদের পথ ধরেই রোমান কবি লুক্রেসিয়াস (খ্রীষ্টপূর্ব ৯৯ – ৫৫) লিখেছিলেন “মহাবিশ্ব কোন দিকেই বদ্ধ নয়, যদি সে বদ্ধ থাকত তাহলে নিশ্চয় তার একটা সীমানা থাকত। কিন্তু কোন কিছুর সীমানা তখনই থাকতে পারে যখন তার বাইরে কিছু থাকে…মহাবিশ্বে যে কোন স্থানেই একজন থাকুক না কেন, মহাবিশ্ব সেই স্থান থেকে সর্বদিকেই অসীম পর্যন্ত বিস্তৃত।” আজ দু’হাজার বছর পরে আধুনিক কসমোলজীতে লুক্রেসিয়াসের কথা হয়তো সত্য হতে চলেছে।
Leave a Reply