বাস্তবতা একটি ত্রিমাত্রিক হলোগ্রাম ছাড়া কিছুই নয় । অনেক পদার্থবিদরা এটা নিয়ে একমত । এটা আমাদের জন্য গ্রহণ করা কঠিন । কারণ এ ব্যাপারটা আমাদের জীবন আর বাস্তবতাকে অনেকটা ম্যাট্রিক্স মুভির বাস্তবতার সাথে মিলিয়ে দেয় ।
ক্রেগ হোগান হলেন শিকাগোতে অবস্থিত ফারমিল্যাবের একজন জ্যোতিঃপদার্থবিদ । তিনি এবং তার দল একটি যন্ত্র বানাচ্ছেন । যন্ত্রটির নাম হলোমিটার । আমাদের বাস্তবতা কি সত্যই ম্যাট্রিক্স মুভির মত মোহাচ্ছন্ন কিনা তা এই যন্ত্রটি পরিমাপ করে দেখবে ।
সিমেট্রি ম্যাগাজিন হোগােনর কাজ নিয়ে একটি রিপোর্ট তৈরি করেছে । সেখানে বলা হয়েছে ,
” স্থানকালের ধারণা এতটা মসৃণ নাও হতে পারে – এটা অনেকটা ডিজিটাল ছবির মত , যত বেশী জুম করা হয় তত ঝাপসা ও খন্ডায়িত হতে থাকে । যা পূর্বে স্টিফেন হকিং এবং অন্যদের দ্বারা প্রস্তাবিত হয়েছিল । গত বছর জার্মানিতে জিইও৬০০ পরীক্ষায় একটি অজানা আওয়াজ পাওয়া যায় যা এই মডেলের একটি সম্ভাব্য প্রমাণ । এই পরীক্ষায় কৃষ্ণবিবর থেকে আগত মহাকর্ষীয় তরঙ্গমালার খোঁজ করা হচ্ছিল । হোগান মনে করেন , স্থানকালের ছবির পিক্সেলের দৃঢ়তার নিম্নতম সীমার কারণে পরীক্ষাটি হোঁচট খেয়েছিল । গণিতের দ্বারা ইহা প্রমাণিত যে , কৃষ্ণবিবরে স্থান ও কাল সঙ্কুচিত অবাস্থায় থাকে এবং সেখানে আদৌ তৃতীয় মাত্রার কোন অস্তিত্ব নেই । ”
হলোগ্রাফিক মহাবিশ্ব থিয়োরি নামে একটা থিয়োরি আছে । এটি সর্বপ্রথম প্রস্তাব করেন জেরার্ড হুফট এবং চার্লস থর্ন । এটাকে লিওনার্ড সাসকিন্ড স্ট্রিং থিয়োরির সাহায্যে ব্যাখ্যা করেন । এই থিয়োরি বলে যে , মহাবিশ্ব তার দৃশ্যমান অংশে আঁকা দ্বিমাত্রিক তথ্যের কাঠামো এবং আমরা যে তিনটি মাত্রা দেখি তা এই দুটি মাত্রার স্বল্প শক্তির বৃহত্তর পরিসরে ফলপ্রসূ বর্ণনা মাত্র ।
এবার পূর্বোক্ত হলোমিটার প্রসঙ্গে আসি । হলোমিটার হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে সংবেদনশীল লেজার ইন্টারফেরোমিটার যা এখনো নির্মাণাধীন । এটি স্থানকালের হলোগ্রাফিক হ্রাসবৃদ্ধি নির্ণয়ে সক্ষম ।
হলো্মিটার পরীক্ষাটি সম্পর্কে ক্রেগ হোগান বলেছেন , ” আমরা মহাবিশ্বের ক্ষুদ্রতম একক নির্ণয়ের চেষ্টা চালাচ্ছি । এটা অনেক মজার একটা প্রাচীন কায়দার পরীক্ষা যার ফলাফল আপনি জানেন না । ”
আমরা প্রত্যেকে ইন্টারনেটের কল্যাণে ঝাপসা ও খন্ডায়িত ছবি এবং গোলমেলে প্রেরিত শব্দের সাথে পরিচিত । হলোমিটার প্রকৃতি কর্তৃক আরোপিত কম্পনাংকের এইরুপ সমতুল্য শব্দ নির্ণয়ের জন্য খোঁজ চালাবে যা পাওয়া গেলে আমাদের মহাবিশ্ব মরীচিকার মত এক প্রকার ভ্রম ব্যতীত কিছুই হবে না । এটি স্থানকালের অন্তঃস্থায়ী আওয়াজকে সনাক্ত করবে যা প্রকৃতি কর্তৃক আরোপিত চূড়ান্ত সর্বোচ্চ কম্পাঙ্ক আমাদের দৃষ্টিগোচর করবে । হোগানের দল যন্ত্রটির একটি এক মিটার লম্বা প্রোটোটাইপ
তৈরি করেছে । তারা পুরো ৪০ মিটার লম্বা হলোমিটারটি তৈরি করছেন এবং তারা আশা করছেন যে , পরবর্তী বছর থেকে এটি তথ্য সংগ্রহ শুরু করবে ।
হলগ্রাফিক মূলনীতি নিয়ে একটা ক্ষুদ্র উদাহরন দেই । ধরুন একটা বালতিতে কিছু পানি আছে । বালতিটি যতটুকু পানি ধারণ করতে পারে তা সাধারনভাবে আমরা বালতির আয়তন হিসেবে ধরে নেই । কিন্তু হলগ্রাফিক মূলনীতি বলে যে বালতির ধারণক্ষমতা তার আয়তনের চেয়ে পৃষ্ঠতলের ক্ষেত্রফলের উপর বেশী নির্ভরশীল । অর্থাৎ কোন একটি নক্ষত্র যে পরিমান শক্তি বিকিরন করবে তা এর পৃষ্ঠতলের ক্ষেত্রফলের উপর নির্ভরশীল । একটি সাধারন হলোগ্রামের কাজের প্রকৃতি এই ব্যাপারটির সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ । আর যেকোনো ক্ষেত্র দ্বিমাত্রিক তা সবাই জানেন । আর আমরা ত্রিমাত্রিক কোন দৃশ্য দেখার জন্য দ্বিমাত্রিক কোন পৃষ্ঠের দিকেই তাকাই ।
হলোমিটার নামটি এসেছে হলোগ্রাফিক ইন্টারফেরোমিটার থেকে । এটি দুটি সম্পূর্ণ আলাদা ইন্টারফেরোমিটার নিয়ে গঠিত । এই দুটির একটির উপর আরেকটা বসানো । প্রতিটা ইন্টারফেরোমিটারে আলোক তরঙ্গ দুভাগে ভাগ হয়ে ভিন্ন পথে ভ্রমণ করে । অতঃপর একটি আয়নায় প্রতিফলিত হয়ে ফিরে আসে । তখন তাদের দশাপার্থক্য পরিমাপ করা হয় । যদি কোন ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কম্পনও আলোক তরঙ্গকে বাধাগ্রস্থ করে অর্থাৎ কম্পনাংকের খুব সামান্য হ্রাসবৃদ্ধি ঘটে তাও ইহা পরিমাপ করবে ।
প্রায় ১০০ বছর ধরে ইন্টারফেরোমিটার ব্যবহৃত হয়ে আসছে । কিন্তু হলোমিটার এদের মধ্যে সবচেয়ে নিখুঁত । এটি পারমানবিক ঘড়ির চেয়েও নিখুঁতভাবে সময় পরিমাপ করতে পারে । উচ্চ কম্পনাংকের শব্দের কম্পাংক নির্ণয়ে এটি খুবই পারদর্শী । হলমিটারের বাইরে বিজ্ঞানীরা কিছু সেন্সর লাগাবেন যাতে সাধারন কম্পনগুলো বাদ দেয়া যায় । প্রশ্ন করতে পারেন যে , মহাবিশ্বের এত আওয়াজের মধ্যে হলগ্রাফিক আওয়াজকে পৃথক করা যাবে কিভাবে ? কারণ যেকোনো কম্পনাংকের জন্য এর মান ধ্রুবক । নির্মাণাধীন হলোমিটারটির বাহু যেহেতু ৪০ মিটার লম্বা সেহেতু হলগ্রাফিক আওয়াজের কম্পাংক হবে ৩.৭৫ মেগাহার্জ ।
হলগ্রাফিক আওয়াজকে হোয়াইট নয়েজ বা শ্বেত আওয়াজও বলা হয় । যদি গবেষণাটিতে হলগ্রাফিক আওয়াজের অস্তিত্ব পাওয়া যায় , তাহলে আমাদের ত্রিমাত্রিক ধারণার বাইরে মহাবিশ্বের দ্বিমাত্রিক প্রকৃতির প্রমাণ মিলবে অতি ক্ষুদ্র প্ল্যাঙ্ক স্কেলে ।
Leave a Reply