ঐ ধূমকেতু আর উল্কাতে
চায় সৃষ্টিটাকে উল্টাতে।
-কাজী নজরুল ইসলাম
ধূমকেতু নিয়ে কিছুদিন আগেও আমাদের মধ্যে একটা সংস্কার প্রচলিত ছিল, মানুষ ধূমকেতুকে হয় দুঃসময় না হয় নতুন সামাজিক পটপরিবর্তনের বার্তা হিসেবে দেখত। তাঁর অনুবাদ-চর্চা নামক সঙ্কলনে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, ‘অষ্টাদশ শতাব্দী পর্য্যন্ত সকল যুগের সাহিত্যেই দেখা যায় যে, ধূমকেতুকে লোকে তখন দুঃখের ভীষণ অগ্রদূত বলিয়া বিশ্বাস করিত… Milton বলেন যে, ধূমকেতু তাহার ভয়াবহ কেশজাল ঝাড়া দিয়া মহামারী ও যুদ্ধবিগ্রহ বর্ষণ করে। রাজা হইতে আরম্ভ করিয়া দীনতম কৃষক পর্য্যন্ত সমগ্র জাতি এই অমঙ্গলের দূতসকলের আবির্ভাবে ক্ষণে ক্ষণে দারুণতম আতঙ্কে নিমগ্ন হইত। ১৪৫৬ খ্রীষ্টাব্দে, হ্যালির নামে পরিচিত ধূমকেতুর পুনরাগমনে যেমন সুদূরব্যাপী ভয়ের সঞ্চার হইয়াছিল পূর্ব্বে আর কখনও তেমন হইয়াছে বলিয়া জানা যায় নাই। বিধাতার শেষ বিচারের দিন আগতপ্রায় এই বিশ্বাস ব্যাপক হইয়াছিল। লোকে সমস্ত আশা ভরসা ছাড়িয়া দিয়া তাহাদের বিনাশদণ্ডের জন্য প্রস্তুত হইতে লাগিল। ১৬০৭ খ্রীষ্টাব্দে ইহা আবার স্বীয় আবির্ভাবে জগৎকে শঙ্কিত করিয়া তুলিল এবং ভজনালয়গুলি ভয়াভিহত জনসঙ্ঘে পূর্ণ হইয়া গেল।’
ভাল উজ্জ্বল ধূমকেতু আকাশের একটা বিশাল অংশ জুড়ে কয়েক সপ্তাহ ধরে দীর্ঘায়িত কুয়াশার মত ছড়িয়ে থেকে একটা বিস্ময়কর দৃশ্যের অবতারনা করতে পারে। বর্তমান সময়ে আমরা ধূমকেতুর আসল রূপটা চিনি, বেশ কয়েকটি ধূমকেতুতে মহাকাশযানও পাঠানো হয়েছে। তাদের পাঠানো তথ্যাবলী ও পৃথিবী থেকে তাদের সূক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ করে সৌর জগতে ধূমকেতুর বিশেষ স্থান সম্পর্কে আজ আমরা অবগত। ধূমকেতু একটি বা কয়েকটি পাথর খণ্ডের সমষ্টি যার উপরিভাগ বরফ ও ধূলিকণা দিয়ে ঢাকা। আজ থেকে প্রায় সাড়ে চার হাজার কোটি বছর পূর্বে সৌর জগৎ সৃষ্টির সময় এই ধূমকেতুগুলি সূর্য বা কোন বড় গ্রহের অন্তর্ভূক্ত হয় নি। আমরা এটাও জানি যতক্ষণ না কোন ধূমকেতু পৃথিবীর বুকে আছড়ে পড়ছে ততক্ষণ পৃথিবীর কোন ঘটনার ওপরই সে প্রভাব ফেলতে পারবে না। অনেক বিজ্ঞানীর ধারনা ১৯০৮ সনে সাইবেরিয়ার তুঙ্গুস্কা অঞ্চলে যে বিস্ফোরণ ঘটেছিল সেটা একটা ধূমকেতু পতনের ফলেই। সেই বিস্ফোরণে প্রায় ২,০০০ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে সব গাছ উপড়ে পড়েছিল। এমন কি এই সেদিন, এই বছরের ১৫ই ফেব্রুয়ারিতে, সাইবেরিয়াতে যে উল্কা বিস্ফোরণ হল তাকেও অনেকে ধূমকেতু বলছেন। অন্যদিকে এই লেখাটা লেখার সময় বাংলাদেশের বর্তমান সঙ্কট ও আন্দোলন নিয়ে আমি ভাবছি। নিঃসন্দেহে যে কোন ধূমকেতু আগমনের সময় পৃথিবীর কোন না কোন দেশ এক ধরনের সঙ্কটের মধ্যে দিয়ে যায়। এ থেকেই বোঝা যায় ধূমকেতু কেন এরকম অশনি সংকেত হিসেবে যুগ যুগে প্রতিভাত হয়েছে।
প্যানস্টার্স ধূমকেতুঃ যে সব বছরে আকাশে ধূমকেতুর আবির্ভাব হয় সেই বছরগুলো জ্যোতির্বিদ ও আকাশপ্রেমীদের জন্য খুব আনন্দের সময়। আর এই বছর দু-দুটো ভাল ধূমকেতু আকাশে দেখা যাবে বলে পর্যবেক্ষণকারীরা বলছেন। এদের মধ্যে প্রথমটিকে এই মার্চ মাসেই খালি চোখে দেখা যাবে। ২০১১ সনে আবিষ্কৃত এই ধূমকেতুটির বৈজ্ঞানিক নাম হচ্ছে C/2011 L4, যদিও হাওয়াইয়ের PANSTARRS দুরবিন সিস্টেম দিয়ে আবিষ্কৃত হয়েছে বলে একে PANSTARRSও (প্যানস্টার্স) বলা হচ্ছে। ধূমকেতুটিকে দক্ষিণ গোলার্ধ থেকে ইতিমধ্যেই দেখা গিয়েছে।
মার্চের ৫ তারিখের পর থেকে সূর্যাস্তের পরে উত্তর গোলার্ধ থেকে একে দেখা যাবে, তবে হয়তো বাইনোকুলারের সাহায্য নিতে হবে। ১০ই মার্চ প্যানস্টার্স ধূমকেতুটি সূর্যের সবচেয়ে কাছাকাছি অনুসূর বা পেরিহিলিয়ন বিন্দুতে থাকবে, মনে করা হচ্ছে এই সময়ে এই ধূমকেতুটির উজ্জ্বলতার মান হবে +১ বা আকাশের উজ্জ্বল কোন তারার সমান।
ISON ধূমকেতুঃ কিন্তু ২০১৩ সনে প্যানস্টার্স থেকেও চমকপ্রদ আর একটি ধূমকেতু আকাশে দেখা যাবে। এই ধূমকেতু নিয়ে এখন অনেক আলোচনা হচ্ছে কারণ সেটি নাকি চাঁদের সমান উজ্জ্বল হবে। ২০১২ সালের ২১শে সেপ্টেম্বর এই ধূমকেতুটি রুশ দেশে একটি ছোট প্রতিফলক দুরবিন দিয়ে আবিষ্কার করেন ভিতালি নোভস্কি ও আর্তিয়েম নভোচিনক। তাঁরা International Scientific Optical Network (ISON) এর দুরবিন দিয়ে এই ধূমকেতুটি আবিষ্কার করেছেন বলে এর নাম হয়েছে C/2012 S1 (ISON), হয়তো কোন একদিন এটির নাম হবে নোভস্কি-নভো্চিনক। আপাততঃ এই ধূমকেতুকে সবাই ISON অভিহিত করছে।
আমরা আশা করছি এই বছরের নভেম্বর মাস থেকেই ধূমকেতুটিকে খালি চোখে দেখা যাবে, সেই সময় এটি স্পাইকা বা চিত্রা তারার কাছ দিয়ে যাবে। নভেম্বরের শেষের দিকে এই ধূমকেতুটিকে ভোর হবার আগে পূবাকাশে দেখা যাবে। বুধ, শনি ও এই ধূমকেতুটি তখন একটি ত্রিভুজ সৃষ্টি করবে। ২০১৩ সালের ২৮শে নভেম্বর ISON সূর্যের সূর্য পৃষ্ঠের মাত্র ১.১ মিলিয়ন বা ১১ লক্ষ কিলোমটার ওপর দিয়ে অনুসুর বিন্দু পার হবে। যদিও ঐ সময় ধূমকেতুটির উজ্জ্বলতার মান সর্বোচ্চ হবার কথা, তবুও সূর্যের এত নিকটে তাকে দেখা হয়তো সহজ হবে না। অনুসুর পার হয়ে যাবার পর সন্ধ্যার আকাশে দুই গোলার্ধ থেকেই এটিকে পশ্চিম আকাশে দেখা যাবে। ২০১৪ সালের ১৪/১৫ জানুয়ারী পৃথিবীর, এই ধূমকেতুটি যে কক্ষপথের ভ্রমণ করে, তার মধ্যে দিয়ে যাবার কথা, তাতে মনে হয় কিছু উল্কাপাত দেখা যাবে।
৪ নং চিত্রে ডিসেম্বর মাসে পূবাকাশে ISON ধূমকেতুটির অবস্থান দেখান হয়েছে। কিছু হিসেবে বলা হচ্ছে ISON এর সর্বোচ্চ মান পূর্ণ চন্দ্রের মত হবে। তবে এটা পুরোপুরিই নির্ভর করবে এই ধূমকেতুটির আলোক-প্রতিফলন ক্ষমতার ওপর। তাছাড়া সূর্যের এত কাছ দিয়ে যাবার সময় এই ধূমকেতুটি ভেঙ্গেও যেতে পারে। এই ধরনের ধূমকেতুকে sungrazing বা সূর্যস্পর্শী বলা হয়। অনেকের স্মৃতিতে ১৯৬৫র ধূমকেতু ইকেয়া-সেকির কথা মনে থাকতে পারে। ইকেয়া-সেকি নাকি সূর্য পৃষ্ঠের মাত্র পাঁচ লক্ষ কিলোমিটার ওপর দিয়ে গিয়েছিল এবং সূর্য যখন মধ্য গগনে তখনও তাকে নাকি সূর্যের পাশে দেখা গেছে। এটির উজ্জ্বলতার মাত্রা -১০ পর্যন্ত উঠেছিল। ISON হয়তো ইকেয়া-সেকিকে ছাড়িয়ে যাবে।
আমাদের সৌর জগতে গ্রহের চেয়ে ধূমকেতুর সংখ্যা অনেক অনেক বেশী। সৌর জগতে ধূমকেতুরা বেশ কয়েকটি জায়গায় আস্তানা গেড়েছে। একটি হল নেপচুনের কক্ষপথের একটু বাইরে, প্রায় ৩০ থেকে ৫০ জ্যোতির্বিদ্যার একক দূরত্বে। (১ জ্যোতির্বিদ্যার একক বা Astronomical Unit হচ্ছে পৃথিবী থেকে সূর্যের গড় দূরত্ব, ১৫০ মিলিয়ন কিলোমিটারের এই দূরত্ব অতিক্রম করতে আলোর প্রায় ৮ মিনিট সময় লাগে।) এই জায়গাটাকে বলা হয়ে থাকে কাইপার বেল্ট। সূর্য থেকে হ্যালির ধূমকেতুর দূরবর্তী অবস্থান উৎস এই কাইপার বেল্ট অঞ্চলে। এছাড়াও বৃহস্পতির কক্ষপথের মধ্যেও বেশ কিছু ধূমকেতু রয়েছে, সূর্যের চারদিকে তাদের পরিক্রমণের সময় মাত্র কয়েক বছর।
হ্যালির ধূমকেতু কাইপার বেল্ট থেকে আসলেও বেশীর ভাগ ধূমকেতুর উৎস হচ্ছে ওর্ট মেঘ। অনুমান করা হয় মূল সৌর জগতের বাইরে, প্রায় ৫০,০০০ জ্যোতির্বিদ্যার একক দূরত্বে অবস্থিত, এই অঞ্চলে হচ্ছে প্রায় এক ট্রিলিয়ন বা দশ লক্ষ কোটি ধূমকেতুর বসবাস। কোন কোন সময়ে সৌর জগতের কাছাকাছি কোন নক্ষত্র আসলে সেটার মাধ্যাকর্ষণজনিত অভিঘাতে এই ধূমকেতুগুলি সূর্যের দিকে রওনা হয়। সূর্যের কাছাকাছি পৌঁছাতে সেগুলির কয়েক মিলিয়ন বা কয়েক দশক লক্ষ বছর লেগে যায়। এই ধূমকেতুগুলির কক্ষপথ অধিবৃত্ত (প্যারাবলিক) বা পরাবৃত্ত (হাইপারবলিক) আকারের হয়ে থাকে। ওর্ট মেঘ থেকে আগত বেশীরভাগ ধূমকেতুই পুনরায় ফিরে আসে না।
সূর্য থেকে অনেক দূরে ধূমকেতু শুধুমাত্র একটা পাথর, ধুলা, বরফ ও জমাট গ্যাসের খণ্ড। এই খণ্ডটির ব্যাস ৪০ কিলোমিটারের নিচে। এটির গ্যাসের মধ্যে রয়েছে মূলত কার্বন-ডাই-অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড, মিথেন ও এমোনিয়া। সূর্যের কাছাকাছি এলে সৌর বিকিরণে গ্যাস আয়নিত হয়ে একটা প্লাজমা লেজ তৈরি করে যা কিনা সরাসরি সূর্যের বিপরীতমুখী থাকে, অন্যদিকে একটা ধুলার লেজ সৃষ্টি হয় যা কিনা কিছুটা ধূমকেতুটির গতিমুখের উল্টোদিকে বিস্তৃত হয়। এই প্লাজমা, গ্যাস, বাষ্প ও ধুলা মিলিয়ে ধূমকেতুর কেন্দ্রের চারদিকে যে হালকা অস্বচ্ছ গোলকের সৃষ্টি হয় তাকে কোমা বলা হয়। মূল ধূমকেতুটি যেখানে মাত্র কয়েক কিলোমিটার, কোমার আকার সূর্যের সমান হতে পারে, আর আয়ন লেজ কয়েক জ্যোতির্বিদ্যার একক (কয়েক শো মিলিয়ন কিলোমিটার) পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে। সন্ধ্যা বা ভোরের আকাশে কুয়াশার মত দেখতে বিস্তৃত ধূমকেতুর লেজ আমাদের মনে বিস্ময় না জাগিয়ে পারে না।
কিন্তু প্রতিবার সূর্য প্রদক্ষিণ করার সময় ধূমকেতুর অল্প অল্প ক্ষয় হয়। তাই থেকে ধারণা করা যায় যে, যে সমস্ত ধূমকেতু এখন আমরা আকাশে দেখি তারা কেউই বহু পুরাতন হতে পারে না। অন্যদিকে ধূমকেতুর ফেলে যাওয়া ধূলিকণা উল্কারেখা হয়ে আমাদের আকাশে দেখা দেয়। বিখ্যাত সব উল্কাবৃষ্টি সবই ধূমকেতুর দান।
আমাদের ধারণা পৃথিবীর বুকে যে এত জল, সেই জলের সাপ্লাই এসেছে পৃথিবী সৃষ্টির পরবর্তী সময়ে প্রচুর সংখ্যক ধূমকেতু পতনের ফলেই। এছাড়া ২০০৯ সালে NASAর স্টারডাস্ট মিশন ধূমকেতুতে জৈবিক হাইড্রো-কার্বোনের লম্বা অণু আবিষ্কার করে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে গ্লাইসিন নামের এমিনো এসিড। অনেক বিজ্ঞানী এমনও মনে করেন যে DNA ও RNAর অংশ আডেনাইন ও গুয়ানাইন ধূমকেতুতেই প্রথম সৃষ্টি হয়েছিল এবং পরবর্তীতে পৃথিবীর সঙ্গে কোন ধূমকেতুর সংঘর্ষের ফলেই পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়। এই গবেষণা সমর্থিত হলে বলা যাবে পৃথিবী বক্ষে ধূমকেতু শুধুমাত্র প্রাণ রক্ষার উপাদান জলই শুধু নিয়ে আসে নি, মূল প্রাণের উপাদানও নিয়ে এসেছে।
প্যানস্টার ও ISON ধূমকেতুকে পর্যবেক্ষণ করতে পৃথিবীর সমস্ত সৌখীন জ্যোতির্বিদরা প্রস্তুতি নিচ্ছেন। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে এই ধূমকেতু দেখতে উচ্চ মান সম্পন্ন দুরবিন লাগবে না, খালি চোখই যথেষ্ট। খুব বেশি হলে একটা নিচু মানের বাইনোকুলার ব্যবহার করা যেতে পারে। যারা ছবি তুলতে চান তাদের জন্যেও এটা একটা সুবর্ণ সুযোগ। যে কোন ওয়াইড এঙ্গেল লেন্সের ক্যামেরা স্ট্যান্ডে বসিয়ে বিভিন্ন মাপের এক্সপোজার সময় নিয়ে পরীক্ষা করলেই চলবে। সূর্যের অনুসুর অতিক্রম করার পূর্বে ও পরে এই ধূমকেতুগুলির গতিবেগ ও মানের উজ্জ্বলতা যাচাইয়ের জন্য কর্মসূচি নেয়া যেতে পারে। এছাড়া সৌর জগতে ধূমকেতুর অবস্থান ও পৃথিবীতে প্রাণ সৃষ্টি ও সংরক্ষণে ধূমকেতুর সম্ভাব্য ভূমিকা নিয়েও আলোচনা প্রোগ্রামের পরিকল্পনা করা হতে পারে। আমরা সবাই অধীর আগ্রহে আকাশের এই চমকপ্রদ প্রদর্শনীর অপেক্ষা করছি, আমরা আশা করছি ২০১৩ সন ধূমকেতুর বছর হিসেবে আমাদের নিরাশ করবে না।
(পূর্ব ফেসবুকে নোট হিসেবে প্রকাশিত)
Leave a Reply