আমরা কি নিজেদেরকে চিনতে পারি? নিজেকে কি চেনা সম্ভব? প্রাচীন গ্রীক চিন্তাবিদরা ভাবতেন হ্যাঁ, সম্ভব। কিন্তু যদি উনারা ভুল হয়ে থাকেন? যদি মনোজগতের কিছু নিষিদ্ধ এলাকা বদ্ধ রুমের মতো আটকানো থাকে যেখানে সরাসরি প্রবেশ করা যায় না? সিগমুন্ড ফ্রয়েড মনের এই অন্ধকার অঞ্চলকে বলতেন অচেতন, নির্জ্ঞান মন।
মানুষ সারা জীবন ধরে যত ধরনের কাজকর্ম করে বেড়ায়, তার পেছনে নানান কামনা–বাসনা–ইচ্ছা কাজ করে। এসব কামনা–বাসনা অনেক সময় আমাদের সচেতন মন থেকে লুকানো থাকে। আমাদের বিভিন্ন কর্মকান্ডকে প্রভাবিত করে এই গোপন বাসনাগুলো। সভ্যতার সবচেয়ে সেরা কিংবা নিকৃষ্টতম বিষয়ের উৎস খুঁজে পাওয়া যাবে অচেতনে। ফ্রয়েড মনে করতেন নির্জ্ঞান মনের এই সুপ্ত বাসনারা দেখা দেয় স্বপ্নে, ছদ্মবেশে।
অচেতন মন
পেশাগত জীবনের শুরুতে ফ্রয়েড ছিলেন একজন স্নায়ুবিদ (নিউরোলজিস্ট)। থাকতেন বর্তমান আস্ট্রিয়ার ভিয়েনাতে। বেশ কয়েকজন কমবয়স্ক রোগী নিয়ে কাজ করার সময় তিনি ধীরে ধীরে মনের গভীরের ক্রিয়াকলাপ নিয়ে আগ্রহী হতে থাকলেন। তিনি অনুভব করতে লাগলেন যে রোগীদের মনোজগতের কোন গোপন অংশ তাদের আচরণ নিয়ন্ত্রণ করছে। অথচ রোগীরা সেই প্রক্রিয়া সম্পর্কে একেবারে কিছুই জানেন না। ফ্রয়েড হিস্টিরিয়া এবং অন্যান্য বিকারগ্রস্থ রোগী নিয়ে কাজ করতেন। হিস্টিরিয়াগ্রস্থ বেশিরভাগ রোগীই ছিলো নারী, অনেকেই রাত্রে ঘুমের মধ্যে হাঁটতো, বিভিন্ন অলীক ঘটনা দেখতো (হ্যালুসিনেশন), এমনকি পক্ষাঘাতগ্রস্থও ছিলো। কিন্তু কেন এসব সমস্যা হচ্ছে জানা ছিলো না। চিকিৎসকরাও এসব উপসর্গের কোন শারীরিক কারণ খুঁজে পাচ্ছিলেন না। ফ্রয়েড তার রোগীদের খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করেন, তাদের ব্যাক্তিগত ইতিহাস খুব সুক্ষ্ণভাবে বিশ্লেষণ করেন। রোগীদের পীড়াদায়ক কোন অতীত স্মৃতি বা অসুস্থ কামনা থেকে এই প্রতিক্রিয়া তৈরি হচ্ছে — তা বুঝতে পারলেন তিনি। এই রোগীদের চিকিৎসা করার জন্যে তিনি এক অভিনব উপায় খুঁজে বের করলেন। রোগীদের একটি শয্যায় শুইয়ে আরাম করতে দিতেন। তারপর তাদের মনে যা যা আসে, সেগুলো নিয়ে কথা বলতে দিতেন। অনেক সময় এই কথা বলার মাধ্যমে রোগীর মনের লুকানো চিন্তাভাবনা বের হয়ে যেতো। তখন রোগীরা আগের চাইতে ভালো বোধ করতেন। এই বিস্ময়কর ফলাফল দেখে মনে হয় যে অচেতনের বিভিন্ন চিন্তাভাবনা রোগীরা সরাসরি মুকাবেলা করতে চাচ্ছিলো না। সচেতনে জানতোই না যে নির্জ্ঞান মন এই সুপ্তবাসনা বা পুরনো কোন স্মৃতির আবেগ লালন করছে। ফ্রয়েডের সাথে কথা বলার কারণে এগুলো দিনের পরিস্কার অলোতে চলে আসে। ফলে একটা বদ্ধ মানসিক চাপ থেকে রোগীরা রেহাই পায়। এ থেকে শুরু হয় ফ্রয়েডের বিখ্যাত মনোবিশ্লেষণ চিকিৎসা।
অবদমিত কামনা
তবে কেবল স্নায়ুরোগী বা হিস্টিরিয়াগ্রস্থদের মনের অচেতনে বাসনা ও স্মৃতি লুকানো থাকে এমনটা নয়। ফ্রয়েড মনে করতেন আমাদের সবার নির্জ্ঞান মনে ধূসর স্মৃতি ও বাসনা অবদমিত আছে। এসব কামনা সবসময় প্রকাশের উপযোগী হয় না। অচেতনে অনেক কিছু লুকানো থাকে বলেই সমাজে জীবনযাপন সম্ভব হয়। আমাদের চারপাশে বিভিন্ন ঘটনা ঘটে চলছে। সেগুলো দেখেশুনে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নানান কথা ও ভাবনার আসে – নানান অনুভূতির উদয় হয়। এই ভাবনা ও বোধ আপনাআপনি আসে, এদেরকে সচেতন মন ঠেকাতে পারে না। আমরা নিজেদের কাছ থেকে এই ভাবনা-অনুভূতির স্রোত লুকিয়ে রাখতে চাই। এদেরকে ফ্রয়েড বলতেন অবদমিত কামনা। এসব অবদমিত অন্ধকার কামনার অনেকগুলি হিংসা-বিদ্বেষপূর্ণ, অনেকগুলি যৌনভাবনা তাড়িত। এদের প্রকাশ করা অত্যন্ত বিপজ্জনক। তাই সচেতনভাবে প্রকাশিত না করে আমাদের মন এদের অচেতনের আস্তাকুঁড়ে ফেলে দেয়। অবদমিত কামনার মধ্যে শক্তিশালীগুলো প্রয়শই তৈরি হয় শৈশবে। শৈশবের খুব শুরুর ঘটনা প্রাপ্তবয়স্কের জীবনে আবার ফেরত আসতে পারে। যেমন ধরা যাক ইডিপাস কমপ্লেক্স। প্রাচীন গ্রীক নাটকের একটি চরিত্র হলো ইডিপাস। ইডিপাস ঘটনাক্রমে নিজের পিতাকে হত্যা করে মাকে বিয়ে করে ফেলে। সবটুকুই হয় নিজের অজান্তেই, ইডিপাস নিজে কি করছে তা না বুঝেই। ফ্রয়েড মনে করতেন সব পুরুষের অচেতনে নিজের পিতাকে হত্যা করে মাতার সাথে সঙ্গমে লিপ্ত হওয়ার বাসনা থাকে। শুরুর এই অবদমিত কামনা অন্তত কিছু লোকের পরবর্তী জীবনকে একটা ভিন্ন, বিকৃত রূপ দেয়।
সব অবদমিত কামনা যে যৌনবিষয়ক বা বিদ্বেষপূর্ণ হবে এমনটা না। কিছু হতে পারে মৌলিক দ্বন্দ্বের প্রকাশ। সচেতনভাবে আমরা কোন কিছু চাই, কিন্তু মনের গহীনে হযতো সেটা চাই না। হয়তো আপনি কোন পরীক্ষার প্রস্তুতী নিতে চাচ্ছেন। বুঝতে পারছেন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্যে হয়তো সেই পরীক্ষা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। বিগত বছরের প্রশ্ন যোগাড় করলেন, কোচিঙেও ভর্তি হলেন। হাতে বেশ কিছু সময় নিয়ে পরীক্ষা দিতে গেলেন। পরীক্ষার হলে দেখলেন আপনি প্রবেশপত্রই নিয়ে আসেন নি। কিংবা টেনশনের কারণে অনেক জানা জিনিস ভুল দাগিয়ে এলেন। ফ্রয়েড বলবেন সচেতনে পরীক্ষা গুরুত্বপূর্ণ বুঝতে পারলেও মনের গহীনে ব্যার্থতার আশংকা রয়ে গেছে আপনার। এই ব্যার্থতার ভয় হয়তো আপনি স্বীকার করতে চান না, কিন্তু অচেতন মন সেটা ভিন্নভাবে প্রকাশ করলো।
গভীর অচেতনের রাজপথ
গভীর মনের এইসব অন্ধকার ভাবনা বাস্তবে খুব কম ক্ষেত্রেই প্রকাশিত হওয়ার সুযোগ পায়। আমাদের মন এই অন্ধকার বাসনা চেপে রাখে, আসল রূপে প্রকাশ পেতে দেয় না। কিন্তু এই চেপে রাখা সবসময় সফল হয় না। অন্ধকার কামনা-বাসনা নিজেদেরকে প্রকাশিত করে, কিন্তু সরূপে নয়, ছদ্মবেশে। যেমন ধরা যাক স্বপ্ন। স্বপ্নে অবদমিত কামনারা দেখা দিতে পারে।
ফ্রয়েড স্বপ্নকে বলতেন অচেতনকে বোঝার রাজপথ। স্বপ্ন দেখে আমাদের যা মনে হয় স্বপ্নের আসল অর্থ ঠিক তেমনটা না। স্বপ্নমঞ্চের সামনে কিছু ঘটনা ঘটতে থাকে, যা আমরা ‘স্বপনে‘ দেখি। আর পর্দার অন্তরালে কিছু বিষয়বস্তু থাকে, যা কিনা স্বপ্নের আসল মানে। মনোবিশ্লেষকের কাজ হলো স্বপ্নের এই প্রকৃত অর্থ খুঁজে বের করা। স্বপ্নে আমাদের সামনে যা যা আসে তার সবকিছুই বিভিন্ন রূপক বা প্রতীক। এই রূপকেরা অচেতন মনের গোপন কামনার প্রতীক হিসেবে কাজ করে। যেমন ধরা যাক, কোন স্বপ্নে সাপ কিংবা তলোয়ার অথবা বন্ধ ছাতা থাকলে তা আসলে যৌনবিষয়ক ছদ্মবেশী স্বপ্ন! সাপ, লাঠি বা ছাতা সবই ধ্রুপদী ফ্রয়েডীয় রূপক, এরা সবাই পুরুষ লিঙ্গের প্রতীক হিসেবে কাজ করে। পাঠকের কাছে এই ধারণা হাস্যকর, অর্থহীন কিংবা ফালতু মনে হতে পারে। সেক্ষেত্রে ফ্রয়েড হয়তো বলতেন পাঠকের সচেতন মন তার মাঝে এই ধরনের যৌনচিন্তার উপস্থিতি সনাক্ত হতে দিতে চাচ্ছে না, তাই তার এরকমটা মনে হচ্ছে!
ফ্রয়েড ও স্বপ্নের মানে
স্বপ্নের মানে নিয়ে ফ্রয়েডের আগ্রহের শুরু তার মনোরোগীদের নিয়ে কাজ করার সময় থেকে। তিনি দেখলেন রোগীদের স্বপ্নের বিষয়বস্তুর সাথে তাদের মানসিক সুস্থতার একটা সম্পর্ক আছে। শারীরিক উপসর্গ দেখে যেমন বিভিন্ন রোগ নিরূপন করা যায়, তেমনি তিনি ভাবলেন স্বপ্ন বিশ্লেষণ করে রোগীদের মানসিক অবস্থারও অন্তর্দৃষ্টি পাওয়া যাবে। ফ্রয়েডের স্বপ্ন বিষয়ের বই হলো The Interpretation of Dreams। এই বইটি লেখার আগে ফ্রয়েড মোটামুটি হাজারখানেকেরো বেশি স্বপ্নের চিকিৎসাগত ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। স্বপ্ন বিষয়ে এই বইয়ে তার বেশ কিছু সিদ্ধান্ত রয়েছে:
১. গত কয়েকদিনে ঘটে যাওয়া ঘটনা মনে যে ছাপ রেখে যায়, স্বপ্ন সেই স্মৃতিগুলো ব্যাবহারে তুলনামূলকভাবে বেশি অগ্রাধিকার থাকে। তবে স্বপ্নে শৈশবের স্মৃতিও নানা ভাবে ফিরে ফিরে আসে।
২. স্বপ্ন ঠিক কোন ধরনের স্মৃতিকে নির্বাচন করবে তা জাগ্রত মনের কাছে গুরুত্ববহ নয়। অচেতন মন সাধারণত বড়সড় বা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার উপর মনোযোগ দেয় না, কিন্তু সামান্য বা খেয়াল করা হয় নি এমন ঘটনাগুলো মনে রাখে।
৩. সাধারণত স্বপ্নের দৃশ্যকল্পগুলো এলোমেলো, অর্থহীন হিসেবে ধরে নেয়া হয়। আসলে স্বপ্ন পরস্পর সম্পর্কহীন ব্যাক্তি, ঘটনা ও আবেগের সমন্বয়সাধন করে। ফলে তৈরি হয় একটি ”গল্প‘।
৪. স্বপ্নের কেন্দ্রীয় বিষয়বস্তু সবসময়েই ‘আমি‘।
৫. স্বপ্নের একাধিক অর্থ থাকতে পারে। অনেকগুলো চিন্তা স্বপ্নে একটি দৃশ্র্যে ঘনীভূত হতে পারে। স্বপ্নের দৃশ্যগুলো নিজেদের রূপ বদলাতে পারে। যেমন চেনা কাউকে দেখে স্বপ্ন শুরু হলেও দেখা যাবে তিনি হঠাৎ অচেনা হয়ে গেছেন। “ছিলো রুমাল, হয়ে গেল বেড়াল” ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে।
৬. প্রায় সব স্বপ্নই হলো ‘ইচ্ছে পূরণ‘ বিষয়ের। স্বপ্নে উদঘাটিত হতে পারে খুব গভীর প্রেরণা বা বাসনা যেগুলো হয়তো বাস্তবে পূর্ণ হতে চায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই প্রেরণা বা বাসনার শিকড় থাকে শৈশবে।
ফ্রয়েডের সমসাময়িক অনেক লেখক মনে করতেন নিত্যদিনের ঘটনাগুলো মনের উপর যে ছাপ ফেলে তাই স্বপ্নের মূল কারণ। কিন্তু ফ্রয়েডের মতে নিত্যদিনের স্মৃতি এবং পরিবেশের সংবেদন স্বপ্নে ‘কাঁচামাল‘ হিসেবে কাজ করে। তারা স্বপ্নের কারণ নয়, শুধু অন্য কোন অর্থ তৈরির জন্যে মন তাদের ব্যাবহার করছে।
ছদ্মবেশী স্বপ্ন
স্বপ্নে অচেতন মন নিজেকে প্রকাশ করে। অচেতন মনের ”ইচ্ছেপূরণে’-র হাতিয়ার হলো স্বপ্ন। কিন্তু স্বপ্নমঞ্চের পেছনে না বলা বাসনাটা এতো অস্পষ্ট কেন? কেন অদ্ভূত সব প্রতীক আর খাপছাড়া দৃশ্যকল্প দিয়ে স্বপ্ন জড়ানো থাকে? কেন গোপন বাসনার নগ্নতাকে এড়ানো হয় স্বপ্নে?
ফ্রয়েড এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন। আমাদের অনেক কামনা–বাসনা সচেতন মন কর্তৃক অবদমিত হয়। অবদমিত কামনাগুলো অচেতন মনের অতলে পড়ে থাকে। অচেতন থেকে সচেতন মনে প্রবেশ নিষেধ তাদের। আমাদের সচেতন মন কখনোই এইসব কামনা–বাসনার অস্তিত্ব মেনে নিতে চাইবে না। অচেতন মন থেকে সচেতনে উঠে আসতে পারার সুযোগ তখনই সম্ভব যদি অবদমিত কামনাগুলো কোনরূপ ছদ্মবেশ ধারণ করে। স্বপ্নে অচেতন মন এই সুযোগ নেয়। অবদমিত কামনাগুলো এমন ভিন্নরূপ নেয় যে তাদের অর্থ উল্টে যায়। ফ্রয়েড এই অর্থ–বিকৃতির তুলনা দিয়েছেন রাজনৈতিক লেখকের সাথে। কোন রাজনৈতিক লেখক বর্তমান শাসকের কড়া সমালোচনা করে একটি লেখা লিখতে চান। কিন্তু সেই লেখা হয়তো তাকে বিপদের মুখে ফেলে দিতে পারে। শাসকের সেন্সরশীপ বা নিষেধাজ্ঞার আওতায় আসতে পারেন লেখক। তাই তিনি মধ্যপন্থা অনুসরণ করতে পারেন, ‘সহনীয়‘ পর্যায়ের সমালোচনা লিখতে পারেন। মূল সমালোচনার ভাষা কিছুটা বিকৃত করে দিতে পারেন লেখক। স্বপ্নে আমাদের গহীন মন ঠিক এই কাজটাই করে। অবদমিত কামনার বার্তা সচেতন মনকে পৌছিয়ে দেয় বার্তাটাকে প্রীতিকর রূপে, কিংবা অন্যকিছুর ছদ্মবেশে সাজিয়ে। আমরা কেন স্বপ্ন খুব তাড়াতাড়ি ভুলে যাই? ফ্রয়েড মনে করতেন ‘সচেতন মন‘ চেষ্টা করে তার জাগ্রত এলাকায় অচেতন মনের প্রভাব হ্রাস করানোর জন্যে। একারণে ঘুম থেকে জাগার পর সচরাচর আমাদের স্বপ্নের কথা মনে থাকে না।
ফ্রয়েডের স্বপ্নতত্ত্বের আরেকটি বক্তব্য হলো স্বপ্ন সব সময়েই আত্মকেন্দ্রীক। স্বপ্নে অন্য কেউ দেখা দেয়ার মানে হতে পারে তারা আমাদেরই একটি ভিন্ন প্রতীক; অথবা ওই ব্যাক্তিকে আমরা কোন দৃষ্টিতে দেখি তার প্রকাশ। ফ্রয়েড মনে করতেন স্বপ্নমঞ্চে কোন অদ্ভুত লোক দেখা দেয়ার মানে তিনি ঐ ব্যাক্তির জীবনের এমন কোন দিকের প্রতীক হিসেবে কাজ করছেন যা কি না জাগ্রত অবস্থায় কখনোই প্রকাশ পেতো না। স্বপ্ন কোন ভাবনা খুব জোড় দিয়ে প্রকাশ করতে পারে যেটা কিনা সচেতনভাবে অবদমিত হয়। আর সেই বার্তা সবসময়ই নিজেকে নিয়ে, সমাজ, পরিবার বা পরিপার্শ্ব অন্য কিছু নিয়ে নয়।
সমালোচনা
মানুষের চিন্তার ইতিহাসে যেসব মনীষীরা খুব বড়সড়ো নাড়া দিয়ে গেছেন তাদের মাঝে অন্যতম ফ্রয়েড। তবে অনেক মনোবিদই ফ্রয়েডের মূলনীতিগুলো স্বীকার করেন না। এমন কি অনেকে তো ফ্রয়েডের তত্ত্বকে অবৈজ্ঞানিক বলে ভাবেন। যেমন দার্শনিক কার্ল পপার মনে করেন, ফ্রয়েডের মনোসমীক্ষণের অনেক সিদ্ধান্ত সত্য না মিথ্যা তা প্রমাণ করা সম্ভব নয়। পপার দর্শনের অনুযায়ী বৈজ্ঞানিক যে কোন গবেষণায় এমন পরীক্ষা করার সুযোগ থাকতে হবে যাতে বোঝা যায় ঐ তত্ত্বটি ভুল। পপারের মতে যদি সব ধরণের বাস্তব বা সাম্ভাব্য পর্যবেক্ষণ কোন বক্তব্যের পক্ষে যায় তাহলে তা বৈজ্ঞানিক নয়। কারণ তাহলে সেই বক্তব্য মিথ্যা প্রমাণের কোন উপায় থাকে না। একটি বৈজ্ঞানিক বক্তব্যের জন্যে এমন কোন পর্যবেক্ষণের সম্ভাবনা থাকতেই হবে যার ফলে ওই বক্তব্য ভুল বলে প্রমাণিত হয়। পপার একটি আগ্রহোদ্দীপক উদাহরণ দিয়েছেন। এক লোক এক বাচ্চাকে নদীতে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলো। অন্যদিকে আরেক লোক এসে সেই বাচ্চাকে উদ্ধার করলো। পপার বলেন ফ্রয়েডের তত্ত্ব দিয়ে এই দুই ঘটনাকেই সমানভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। ফ্রয়েডের তত্ত্ব হয়তো বলবে প্রথম লোকটি তার ইডিপাস তাড়নাকে অবদমিত করার ফলে ধাক্কা দিয়ে নদীতে ফেলে দেয়ার মতো ধ্বংসাত্মক আচরণ করছে। অন্যদিকে দ্বিতীয় ব্যাক্তি তার অচেতন কামনাকে একটা মহিমান্বিত স্তরে নিয়ে গেছে যার কারণে অন্যের উপকারে আসে এমন সব কাজে নিজেকে নিয়োজিত করছে। যেহেতু ফ্রয়েডের তত্ত্ব দুইটি বিপরীত পর্যবেক্ষণের ক্ষেত্রে একই ব্যাখ্যা হাজির করছে, পপারে মতে সেহেতু এই তত্ত্ব অবৈজ্ঞানিক।
ফ্রয়েড বেঁচে থাকলে এই কথার জবাবে হয়তো বলতেন পপারের মধ্যে নিশ্চয়ই কোন অবদমিত তাড়না আছে যার কারণে মনোবিশ্লেষনের প্রতি তিনি আক্রমণাত্মক সমালোচনা করছেন!
তথ্যসূত্র:
A Little History of Philosophy by Nigel Warburton
50 Psychology Classics by Tom Butler-Bowdon।
Leave a Reply