মাইটোকন্ড্রিয়াল বিবি হাওয়া (Mitochondrial Eve), আমাদের আদি মাতা

ধারণা করা হয় প্রায় ২ লক্ষ বছর আগে বেঁচে ছিলেন এই বিবি হাওয়া। ইনি থাকতেন পূর্ব আফ্রিকায়, Homo heidelbergensis এর বিস্তারের শেষে এবং Homo neanderthalensis এর আবির্ভাবের শুরুর দিকটায়। কিন্তু তখনও আফ্রিকা থেকে মানুষের এই পরদাদারা পৃথিবীর অন্য অংশে ছড়ানো শুরু করেন নি। সেমিটিক ধর্ম থেকে Eve (বিবি হাওয়া) টার্ম টা নেয়া হয়েছে। ধারণা করা হয় এই মহিলা থেকে এখনকার যুগের সকল আধুনিক মানুষ এসেছেন। একে মাইটোকন্ড্রিয়াল বিবি হাওয়া বলার কারণ, এই লক্ষাধিক বছর আগের মানুষটির মাইটোকন্ড্রিয়াটির জেনোম (ডিএনএ) এখনও আমরা লালন করি আমাদের কোষে। এবং এটা মা থেকে মা এ পরিবাহিত হয়েছে লক্ষ বছর ধরে এবং ভবিষ্যতেও হবে।

একটু ব্যাখ্যা করি।

মাইটোকন্ড্রিয়া হল কোষের ভেতরের একটা অঙ্গাণু যেটা কোষের জন্য শক্তি তৈরি করে, সেজন্য একে কোষের পাওয়ারহাউস বলে। চিন্তা করে দেখলে এটা একটা ব্যাকটেরিয়ার মত। এর একটা নিজস্ব ডিএনএ ও আছে, যেটা বৃত্তাকার (আমাদের মূল জেনোম বৃত্তাকার না, রৈখিক), ব্যাকটেরিয়াতে যেমন দেখা যায় তেমন। ধারণা করা হয় বিবর্তনের শুরু দিকে এক ব্যাকটেরিয়া আরেকটা এককোষী জীবের ভিতরে ঢুকে সেখানেই থেকে যাওয়ার ফলে মাইটোকন্ড্রিয়া তৈরি হয়েছে। এই মাইটোকন্ড্রিয়ার জেনোম থেকে কোষের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রোটিনও তৈরি হয়।

মানব-কোষ, মাইটোকন্ড্রিয়া এবং মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ

যাই হোক, যেহেতু জন্মাবার সময় আমাদের ভ্রূণ তৈরি হয় মায়ের কোষকে ‘হোস্ট’ বা ‘বাসস্থান’ হিসেবে রেখে সেহেতু বাবার মূল ডিএনএ টা (নিউক্লিয়ার) আসে ভ্রূণে, কিন্তু মাইটোকন্ড্রিয়া আসেনা। আর বাবার ডিএনএ এবং মা’র ডিএনএ রিকম্বনেশানের (একটার সাথে আরেকটা বিভিন্ন বিন্যাসে মিশে যায়) মাধ্যমে নতুন ডিএনএ তৈরি করে যেটা বাচ্চার ডিএনএ হয়। কিন্তু মাইটোকন্ড্রিয়ার ক্ষেত্রে সেটা হয়না, কারন শুধু মার কাছ থেকে এই ডিএনএ আসছে, বাবারটা নাই। ফলে যেই ডিএনএ টা মাইটোকন্ড্রিয়ায় আছে সেটা মার কাছ থেকে রিকম্বিনেশান ছাড়াই সন্তানের কাছে চলে আসে। (তবে মিউটেশান ঘটতে পারে।) এই জন্য আমরা যদি বর্তমান মানুষের সঙ্গে মাইটোকন্ড্রিয়াল বিবি হাওয়া’র কোন মিল খুঁজি তবে সেটা হবে এই মাইটোকন্ড্রিয়ার ডিএনএ’র মিল, যেটা লক্ষ লক্ষ বছর ভ্রমণ করেছে। মাইটোকন্ড্রিয়াল বিবি হাওয়া তাই আমাদের আদি মাতা।

নিউক্লিয়ার জেনোম বাবা-মা উভয় থেকেই পরিবাহিত হয়, কিন্তু মাইটোন্ড্রিয়াল জেনোম শুধু মা থেকে

নিয়ানডারথালদের মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএটি তে কিকি জিন আছে দেখে নিন।

এখন আসি অন্য একটা বিষয়ে।

যেহেতু এই ডিএনএ টা রিকম্বিনেশান ছাড়াই আমাদের দেহে প্রবাহিত হয়েছে সেহেতু প্রাণীতে প্রাণীতে মিল খোঁজার জন্য এই ডিএনএ’র পার্থক্য বোঝার চেয়ে ভাল উপায় মনে হয় আর নেই। একটা উদাহরণ দেই। ৩৮ হাজার বছর আগের এক নিয়ানডারথাল মানুষের মাইটোকন্ড্রিয়ার জেনোম সিকোয়েন্স প্রকাশিত হয়েছিল ২০১০ সালে। দেখা গেছে বর্তমান মানুষের থেকে মাত্র ৩৮৫ টা বেইস (ডিএনএ’র এককের অংশ) এ শুধুমাত্র পার্থক্য। যেখানে বর্তমান এইপ শিম্পাঞ্জীর সঙ্গে মানুষের মাইটোকন্ড্রিয়ার জেনোমের পার্থক্য ১৪৬২ টি বেইস এ। এখানে কয়েকটা বিষয় ভাবতে পারেন, ১. এই হাজার হাজার বছরে এত অল্প পরিবর্তন হয়েছে মিউটেশান এর কারনে, কারন রিকম্বিনেশান ঘটেনি। ২. বর্তমান বিভিন্ন এপস (যেমন শিম্পাঞ্জী, গরিলা) এর সঙ্গে মানুষের বিভাজন শুরু হয়েছিল নিয়ান্ডারথাল আবির্ভাবেরও অনেক অনেক বছর আগে, তাই নিয়ান্ডারথালের চেয়ে শিম্পাঞ্জীর সঙ্গে পার্থক্যটা বেশি।

মানুষের সঙ্গে নিয়ান্ডারথাল এবং শিম্পাঞ্জীর মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ’র পার্থক্য দেখে নিন। সবুজঃ মানুষ-মানুষ, লালঃ মানুষ-নিয়ান্ডারথাল, নীলঃ মানুষ-শিম্পাঞ্জী। X-axis এ সংখ্যাগুলোয় দেখুন মানুষের সঙ্গে নিয়ান্ডারথালদের চেয়ে শিম্পাঞ্জীর বেইসের পার্থক্য অনেক বেশি।

বর্তমানে বেঁচে থাকা শিম্পাঞ্জীর চেয়ে নিয়ান্ডারথালের সঙ্গে মানুষের বেশি মিল। এটা থেকে কি বোঝা যায় বলুন তো? মানুষের বিবর্তন যে হয়েছে সেটা এখন বুঝছেন তো?


খান ওসমান Avatar

মন্তব্য

  1. bazlur Rahim Avatar

    I am interested to contact with you. Would you please send few of your Bangla article. I am editor of a socio-health monthly magazine (of bangladesh). Currently visiting USA.

    1. খান ওসমান Avatar
      খান ওসমান

      কোন পত্রিকার কথা বলছেন? আমি আসলে ব্লগের বাইরে এখনও লিখছিনা। আগ্রহের জন্য ধন্যবাদ।

  2. আরাফাত রহমান Avatar

    বিষয়টা ইন্টারেস্টিঙ। অামার মনে হয় মাইটোকন্ড্রিয়াল ইভ বিষয়টা আরেকটু ভেঙে বলাটা দরকার ছিলো।

    মাইটোকন্ড্রিয়াল ইভ যেমন, তেমনি আছেন মাইটোকন্ড্রিয়াল এডাম। মজা হলো মাইটোকন্ড্রিয়াল ইভ মাইটোকন্ড্রিয়াল এডামের চেয়ে সত্তুর হাজার বছর পুরনো! তার মানে কি এডামের আগে ইভ এসেছে? তা নিশ্চয়ই নয়।

    এই লেখাটা দেখা যায় http://www.somewhereinblog.net/blog/utsablog/6224

    1. খান ওসমান Avatar
      খান ওসমান

      Mitochondiral Adam বলতে আসলে কিছু নাই। আপনি বোধহয় Y-chromosomal Adam এর কথা বোঝাচ্ছেন। সেটা একটা অন্য দিকের আলোচনা হত। ঠিক Mitochondiral ইনহেরিটেন্স যেমন, তেমন না।

      কিন্তু ইভ নিয়ে একটু বেশি বললে ভাল হত হয়তো, তবে কেউ আরও পড়ে নিতে পারেন উইকিপিডিয়া থেকে, সেখানে বেশ বড় করে লেখা রয়েছে।

      1. খান ওসমান Avatar
        খান ওসমান

        এডাম ইভ নিয়ে আগে পরের ব্যাপার এখানে খাটেনা কারন দুইজন দুই দিক দিয়ে বিবেচনা করা। একজন মাইটোকন্ড্রিয়া, আরেকজন ওয়াই ক্রোমোজম। এরা বাইবেলিয় চরিত্রও না।

        1. খান ওসমান Avatar
          খান ওসমান

          এবং আরেকটা কথা। 🙂 আপনার দেয়া লেখাটায় অনেক তথ্যে আছে, কিন্তু সেটা ২০০৬ সালে লেখা। তথ্যগত অনেকগুলি ভুল সেজন্য রয়ে গেছে। নিয়ান্ডারথালের জেনোম সিকোয়েন্স তখনো হয়নাই। মাইটোকন্ড্রিয়ার তো হয়নাই ই। সেজন্য অনেককিছুই অনুমানের উপর ছিল।

          1. আরাফাত রহমান Avatar

            নিয়ন্ডারথালদের জিনোম সিকোয়েন্স হয়ে গেছে এটাতো জানতামই না। অারেকটা কথা আমি কিন্তু আপনার ছোট, তুমি করে বললেই পারেন।

      2. আরাফাত রহমান Avatar

        বোকা বনে গেলাম 😮 … মাইটোকন্ড্রিয়াল এডাম কোথ্থেকে আসলো! ঘুম চোখে মাইটোকন্ড্রিয়াল এডাম আবিষ্কার করে ফেল্লাম, হা হা হা …

        1. খান ওসমান Avatar
          খান ওসমান

          হেহে..

    2. bengalensis Avatar

      মাইটোকন্ড্রিয়াল এডাম বলতে কিছু নেই। কারন এটা ডিম্বানু থেকে রেপ্লিকেট হয়েই সন্তানের মধ্যে যায়। শুক্রানুর সাথে এর কোনো সম্পর্ক থাকার কথা নয়।

  3. সৈয়দ মনজুর মোর্শেদ Avatar
    সৈয়দ মনজুর মোর্শেদ

    অনেক ভালো লেগেছে 🙂

  4. skyship Avatar
    skyship

    ভালো লেখা, আরও পড়ার আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষায় থাকলাম………………

  5. Anirban Maitra Avatar
    Anirban Maitra

    এই মহিলাটির মা’কে মাইটোকন্ড্রিয়াল ইভ বলা হচ্ছে না কেন? ☹️

Leave a Reply