সুন্দরবন বাঁচাও

লেখাটি বিভাগে প্রকাশিত

সুন্দরবন বিশ্বের সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বন। বাংলাদেশের একটি অমূল্য সম্পদ যার কোন কিছুর বিনিময়েই কোন ক্ষতি করা যায় না। অথচ আজ সামান্য বিদ্যুতের কি অন্ধ মোহে আমরা ভুলতে বসেছি এর অবদানকে। বছরের পর বছর এটি বাংলাদেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঢাল হিসেবে কাজ করেছে। দেশের জন্য বারবার এনে দিয়েছে গৌরব ও সম্মান। ১৯৯২ সালের ২১ শে মে সুন্দরবন রামসার স্থান হিসেবে স্বীকৃতি পায়। ১৯৯৭ সালে  ইউনেস্কো এটিকে “বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান” এর অন্তর্ভূক্ত করে। সুন্দরবনে রয়েছে সামুদ্রিক স্রোতধারা, কাদা চর এবং ম্যানগ্রোভ বনভূমির লবণাক্ততাসহ ছোট ছোট দ্বীপ। দেশের অন্তত ৪০ লাখ মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সুন্দরবনের প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর নির্ভরশীল। অসংখ্য উদ্ভিদ ও প্রাণীর আবাসস্থল সুন্দরবনে জালের মতো ছড়িয়ে আছে ৪৫০টি নদী ও খাল। এর জীববৈচিত্র্যের ভান্ডার অন্যান্য অনেক বনকেও হার মানায়।

২০০৭ সালে “জলবায়ুর পরিবর্তন ও বিশ্ব ঐতিহ্যের পাঠ” শীর্ষক ইউনেস্কোর রিপোর্টে বলা হয়েছে যে, মানবসৃষ্ট অন্যান্য কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের যে ৪৫ সে.মি. উচ্চতা বৃদ্ধি হয়েছে, তা সহ মানবসৃষ্ট আরও নানাবিধ কারণে সুন্দরবনের ৭৫ শতাংশ ধংস হয়ে যেতে পারে (জলবায়ু পরিবর্তনের উপর আলোচনায় প্রকাশিত আন্তঃসরকার পরিষদের মত অনুযায়ী ২১ শতকের মধ্যেই)। এর আগেই আমরা নিজেরাই যেন নেমেছি সুন্দরবন ধ্বংসের পায়তারা করতে। গৃহপালিত পশু হিসেবে হরিণ পালনের অনুমোদন, রয়েল বেঙ্গল টাইগারের সংখ্যা কমে যাওয়া, সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে নৌযান চলাচল শুরু করার মতো হুমকির পাশাপাশি বর্তমানে সুন্দরবনের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে সুন্দরবন থেকে মাত্র ১৪ কিলোমিটার দূরে রামপাল কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রস্তাব।

ভারতীয় কোম্পানি এনটিসিপির সাথে বাংলাদেশের যৌথ বিনিয়োগ চুক্তি হয় রামপালে ১৩২০ মেগাওয়াটের কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের। সুন্দরবনের ওপর এর পরিবেশগত প্রভাব ভয়াবহ যা চুক্তি করার আগে বিবেচনায়ই আনা হয়নি। এর ফলাফল স্বরূপ ধীরে ধীরে ধ্বংস হয়ে যাবে সুন্দরবন যাকে পরে শত চেষ্টাতেও আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে না। সামান্য বিদ্যুতের জন্য আমরা যা হারাচ্ছি তা কি আমরা জানি?

১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ এর পাশাপাশি আমরা কি পাচ্ছি?

১) কৃষিক্ষেত্রে:

  • প্রস্তাবিত প্রকল্প এলাকার ৯৫ শতাংশই কৃষি জমি ও চারপাশের ১০ কি.মি ব্যাসার্ধের এলাকার ৭৫ শতাংশ কৃষি জমি যেখানে চিংড়ি, ধান ও অন্যান্য ফসল চাষ করা হয়। এছাড়া বনের সাথে সংযোগ থাকায় এলাকার নদী খাল স্বাদু লোনা পানির মাছের সমৃদ্ধ ভান্ডার। বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের ফলে প্রকল্প এলাকায় ধান, মাছ, গৃহপালিত পশুপাখি ইত্যাদির উৎপাদন ধ্বংস হবে ।
  • বিভিন্ন ধরণের নির্মাণ কাজ, ড্রেজিং, বিভিন্ন ধরণের রাসায়নিক তৈল নি:সরণ ইত্যাদির ফলে পশুর মাইদারা নদী, সংযোগ খাল, জোয়ারভাটার প্লাবণ ভূমি ইত্যাদি এলাকার মৎস আবাস, মৎস চলাচল বৈচিত্র ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে। ৮টি ইউনিয়নের প্রায় ৪০ টি ইউনিয়নের ৭/৮ হাজার পরিবার ক্ষতির শিকারহবে।

২) জীববৈচিত্র্যের ওপর প্রভাব:

  • জালের মতো ছড়িয়ে থাকা খাল নদী জৈববৈচিত্র্য ও ভারসাম্য রক্ষা করে। নৌযান চলাচল, তেল নি:সরণ, শব্দদূষণ, আলো, বর্জ্য নি:সরণ ইত্যাদির কারণে সুন্দরবনের জীববৈবিত্র্য মারাত্নকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বিশেষ করে রয়েল বেঙ্গল টাইগার, হরিণ, ডলফিন, ম্যানগ্রোভ বন ইত্যাদির উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে।
  • বিভিন্ন কারণে গাছপালা ও পশুর নদীর তীরের ঝোপ ঝাড় কেটে ফেলা হবে। এতে করে পাখি বিশেষ করে সারস বক জাতীয় পাখির বসতি নষ্ট হবে।
  • রাতে জাহাজ চলের সময় জাহাজের সার্চ লাইটের আলো নিশাচর প্রাণী সহ সংরক্ষিত বনাঞ্চল সুন্দরবনের পশুপাখির জীবনচক্রের উপর মারাত্বক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে ইত্যাদি।

৩) বায়ূ দূষণ:

  • বিদ্যুৎ কেন্দ্রের  জন্য ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি, যানবাহন, জেনারেটর ইত্যাদি থেকে তেল পুড়িয়ে ক্ষতিকর কার্বন ডাই অক্সাইড নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইড নির্গত হবে। প্রতি বছর কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমণের পরিমাণ হবে ৭৯ লক্ষ টন সুন্দরবনের পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে।
  • বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে প্রতিদিন প্রায় ১৪২ টন বিষাক্ত সালফার ডাইঅক্সাইড (SO2) ৮৫ টন বিষাক্ত নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইড (NO2) নির্গত হবে। ফলে  সুন্দরবনের বাতাসে SO2 NO2 এর ঘনত্ব বর্তমান ঘনত্বের তুলনায় কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়ে গোটা সুন্দরবন ধ্বংস করবে।
  • ২৭৫ মিটার উঁচু চিমনী থেকে নির্গত গ্যাসীয় বর্জ্যের তাপমাত্রা হবে ১২৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস। যা সুন্দরবনের স্বাভাবিক তাপমাত্রাকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে এবং ভারসাম্য নষ্ট হবে।
  • কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রে বছরে ৪৭ লক্ষ ২০ হাজার টন কয়লা পুড়িয়ে লক্ষ ৫০ হাজার টন ফ্লাই অ্যাশ লক্ষ টন বটম অ্যাশ উৎপাদিত হবে। এতে বিভিন্ন ভারী ধাতু যেমন আর্সেনিক, পারদ, সীসা, নিকেল, ভ্যানাডিয়াম, বেরিলিয়াম, ব্যারিয়াম, ক্যাডমিয়াম, ক্রোমিয়াম, সেলেনিয়াম, রেডিয়াম মিশে থাকে।

৪) পানি দূষণ:

  • নির্মাণ স্থলের নিকটবর্তি নদীখালের পানিতে নির্মাণ যন্ত্রপাতি যানবাহনের তেল নি:সরিত হয়ে পানি দূষণ ঘটাতে পারে।
  • ড্রেজিং এর ফলে নদীর পানি ঘোলা হবে। ড্রেজিং সঠিক ভাবে নিয়ন্ত্রণ করা না হলে তেল গ্রীজ ইত্যাদি নি:সৃত হয়ে নদীর পানির দূষিত হবে।
  • পশুর নদী থেকে ঘন্টায় ৪০০০ মিটার পানি প্রত্যাহারের ফলে পানির লবণাক্ততা, নদীর পলি প্রবাহ, প্লাবন , জোয়ার ভাটা, মাছ সহ নদীর উদ্ভিদ প্রাণী জগৎ ইত্যাদির উপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে।
  • কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে পানি নির্গমন করা হলে নির্গত পানির তাপমাত্রা, পানি নির্গমণের গতি, পানিতে দ্রবীভূত নানান উপাদান বিভিন্ন মাত্রায় পানি দূষণ ঘটাবে যা গোটা সুন্দরবন এলাকার পরিবেশ ধ্বংস করবে।

৫) শব্দ দূষণ:

নির্মাণ কাজের যন্ত্রপাতি যানবাহন ব্যাবহারের ফলে শব্দ দূষণ হবে। এক্ষেত্রেও নির্মাণ পর্যায়ে শব্দ দূষণের মাত্রা সুন্দরবন প্রকল্পের চারপাশের পরিবেশের উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে।

৬) স্বাস্থ্যগত ঝুকি:

  • কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে নির্গত সালফার, নাইট্রোজেন, কার্বন ইত্যাদির বিভিন্ন যৌগ কিংবা পারদ, সীসা, ক্যাডমিয়াম, ব্যারিয়াম ইত্যাদি ভারী ধাতুর দূষণ ছাড়াও কুলিং টাওয়ারে ব্যাকটেরিয়া সংক্রামণের কারণেও আশপাশের এলাকায় ব্যাপক আকারে নিউমোনিয়া জাতীয় রোগ ছড়িয়ে পড়ে।
  • সালফার ডা্ই অক্সাইড ও নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ বৃদ্ধির কারণে অ্যাসিড রেইন হওয়ার আশংকা বেড়ে যাবে। অ্যাসিড রেইন হলে এলাকার জীববৈচিত্র্য ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং এলাকাবাসীর মধ্যে নানা ধরনের রোগ দেখা দেবে।
  • বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে উৎপাদিত ভারী ধাতুসমূহ ক্যান্সার সহ নানাবিধ রোগের কারণ যা ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।

সর্বোপরি বলা যায়, মাত্র ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের জন্য আমরা যা হারাবো তা কোন সংখ্যা দিয়ে প্রকাশ করা যাবে না। সুন্দরবন আমাদেরকে মায়ের মতো আগলে রেখেছে। আজ সামান্য স্বার্থে আমরা মাকে ভুলে গিয়ে ধ্বংসের চিন্তায় মগ্ন হয়ে আছি যার ফলাফল আমরা কল্পনাও করতে পারি না। তা্ই আমাদের নীতিনির্ধারকদের কাছে আকুল অনুরোধ, এখনো সময় আছে হিসেব নিকেশ করার, ধ্বংসের পথ থেকে সৃষ্টির পথে আসুন।

সূত্র:

১. “Final Report on Environmental Impact Assessment (EIA) of 2 of 2 × (500-660) MW Coal Based Power Plant to be constructed at the location of Khulna”

২. Wikipedia

লেখাটি 455-বার পড়া হয়েছে।

ই-মেইলে গ্রাহক হয়ে যান

আপনার ই-মেইলে চলে যাবে নতুন প্রকাশিত লেখার খবর। দৈনিকের বদলে সাপ্তাহিক বা মাসিক ডাইজেস্ট হিসেবেও পরিবর্তন করতে পারেন সাবস্ক্রাইবের পর ।

Join 908 other subscribers