দর্শনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস: অধ্যায় ১
২৪০০ বছর আগের কথা । বেশি বেশি প্রশ্ন করার জন্য এথেন্সে একজনকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়েছিল । তাঁর আগে অনেক দার্শনিক ছিলেন, সবাই প্রশ্নও করতেন কিন্তু সক্রেটিসের বেলায়ই সেটা চরম আকার ধারণ করেছিল । তবে এটাও ঠিক যে, দর্শনের যদি বিশেষ কোন সেবক থেকে থাকেন, সেটা হলেন সক্রেটিস ।
চ্যাপ্টা নাক, মোটা ও বেঁটে, মলিনবেশ এবং কিছুটা উদভ্রান্ত এবং আগ্রহী দৃষ্টি, তাঁকে আসলে সক্রেটিস বলে মানানসই মনে হতো না । যদিও শারীরিকভাবে কুৎসিত এবং কখনো নোংরা, তাঁর ছিল প্রচন্ড মানসিক শক্তি ও মেধাবী একটি মন । এথেন্সের সবাই এটা স্বীকার করে নিয়েছিল যে, তাঁর মতো আর কেউ ছিল না এবং সম্ভবত আর আসবেও না । তিনি ছিলেন অদ্বিতীয় । কিন্তু তিনি চরম বিরক্তিকরও ছিলেন । তিনি নিজেকে ঘোড়ামাছি বা ডাঁশ মাছির সাথে তুলনা করতেন । ডাঁশ মাছি খুবই বিরক্তিকর একপ্রকার মশা, কিন্তু বেশি ক্ষতি করে না । যদিও এথেন্সের সবাই তাঁকে ঠিক একইভাবে মূল্যায়ন করত না । কেউ কেউ তাঁকে ভালওবাসত; অনেকে তাঁকে ভাবত বিপদজনক অশুভ প্রভাব বিস্তারকারি হিসেবে ।
তারুণ্যে তিনি ছিলেন সাহসী সৈনিক । স্পার্টান ও তাদের মিত্রদের বিরুদ্ধে তিনি পেলোপনেসিয়ান যুদ্ধে বীরত্বের সাথে অংশগ্রহণ করেন । মধ্য বয়সে তিনি বাজারে বাজারে ঘোরাঘুরি করতেন, প্রায়ই মানুষজনকে ধরে থামাতেন আর বুদ্ধিদীপ্ত কিন্তু বিব্রতকর সব প্রশ্ন করতেন । এই ছিল তাঁর একমাত্র কাজ । কিন্তু তিনি যে প্রশ্নগুলো জিজ্ঞেস করতেন সেগুলো ছিল ক্ষুরধার এবং পাণ্ডিত্বপূর্ণ । খুব সহজ-সরল মনে হলেও আসলে প্রশ্নগুলোর উত্তর অতটা সহজ সরল বা সরাসরি দেয়ার মতো ছিল না মোটেই ।
উদারহরণ হিসেবে ইউথিডেমোসের সাথে কথোপকথনের কথা বলা যায় । সক্রেটিস তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, প্রতারণা করা কি অনৈতিক? “অবশ্যই”, সহজ-সরল উত্তর দিলেন ইউথিডেমোস । তিনি ভাবলেন সেটাই তো স্বাভাবিক । কিন্তু, সক্রেটিসের প্রশ্ন ছিল একটু অন্যরকম । তিনি পুনরায় প্রশ্ন করলেন, ধর তোমার কোন বন্ধু আত্মহত্যা করতে যাচ্ছে এবং তুমি তার অস্ত্রটা চুরি করলে, তাহলে? সেটা কি প্রতারণার মধ্যে পড়ে? অবশ্যই তা প্রতারণার মধ্যে পরে, পুনরায় উত্তর দিলেন ইউথিডেমোস । কিন্তু ঠিক এ কাজটা করা ই কি উচিত আর নৈতিক নয়? এটা একটা ভাল কাজ, একজনের জীবন রক্ষা করছেন, বন্ধুকে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করছেন – যদিও কাজটি প্রতারণা । অসহায় ভাবে ইউথিডেমোস বললেন, হ্যাঁ, তা ঠিক । চতুর পাল্টা-যুক্তি প্রয়োগ করে সক্রেটিস ইউথিডেমোসকে দেখিয়ে দিলেন যে, প্রতারণা সব ক্ষেত্রেই অনৈতিক কাজ নয় । ইউথিডেমোস এ ব্যাপারটা আগে কখনও এভাবে ভেবে দেখেননি ।
বার বার তিনি একটা বিষয়ই সবাইকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতেন । তারা যা জানে বলে দাবি করে বা বিশ্বাস করে তা’ তারা আদৌ জানে না । খুব আত্মবিশ্বাসের সাথে হয়ত একজন সৈন্যাধ্যক্ষ তাঁর সাথে কথা শুরু করল সাহস, আত্মবিশ্বাস, কৌশল, দেশপ্রেম ইত্যাদি বিষয়ে । কিন্তু বিশ মিনিট সক্রেটিসের সাথে কথা বলার পর তাঁকে পুরোপুরি কিংকর্তব্যবিমূঢ়, মানসিক ভাবে বিধ্বস্ত একজন বলে মনে হবে । এরকম অভিজ্ঞতা যে কারো জন্যই বিব্রতকর । লোকজন সত্যিকার অর্থেই কি বুঝে বা জানে এটা বের করা সক্রেটিসের খুব প্রিয় একটা কাজ ছিল । এবং প্রশ্ন করত মানুষ যে সব বিষয়ের উপর ভিত্তি বা বিশ্বাস করে তাদের জীবন ধারণ করত । তিনি নিজেকে স্বার্থক মনে করতেন যখন কথোপকথনের মাধ্যমে একেক জনকে বুঝিয়ে দিতে পারতেন যে, ঐ ব্যক্তি কত কম জানে । তাঁর মতে, আমি এটা জানি, এটা বিশ্বাস করার চেয়ে, আমি এটা জানি না, এটা জানা অনেক ভাল ।
ঐ সময় এথেন্সে বিত্তবানদের ছেলেদের দর্শনের শিক্ষকদের কাছে পাঠানো হতো জ্ঞানার্জনের জন্য । দর্শনের শিক্ষকরা ছিলেন খুবই চতুর প্রকৃতির । তাঁরা ছাত্রদের বক্তৃতা দেয়া শেখাতেন । এ জন্য তাঁরা অনেক উঁচু সম্মানী আদায় করতেন । কিন্তু সক্রেটিস কোন প্রকার সম্মানী নিতেন না । তিনি দাবি করতেন, তিনি কিছুই জানেন না । আর কিছুই না জানলে তিনি শেখাবেন কি করে? যদিও তা’তে বক্তৃতা শোনার জন্য ছাত্র আসার কমতি ছিল না । দর্শনের অন্যান্য শিক্ষকদের কাছে এ কারণে তিনি তেমন গ্রহণযোগ্যতা পান নি ।
তাঁর বন্ধু ক্যারোফন একদিন ডেলফির ওরাকল এর কাছে গেলেন । ওরাকল ছিলেন একজন জ্ঞানী মহিলা, এবং ভবিষ্যৎ বক্তা । আগতদের প্রশ্নের উত্তর দিতেন তিনি । তাঁর উত্তরগুলো অনেকটা গোলকধাধার মতো শোনাত । ক্যারোফন জিজ্ঞেস করলেন, “সক্রেটিসের চেয়ে জ্ঞানী কেউ আছে কি?” “না”, সরাসরি উত্তর দিলেন ওরাকল। আরো বললেন, “কেউই সক্রেটিসের চেয়ে জ্ঞানী নয় ।”
ক্যারোফন যখব সক্রেটিসকে এ কথা বললেন, প্রথমে সক্রেটিস তা বিশ্বাস করলেন না । ব্যাপারটা তিনি কোনভাবেই ব্যাখ্যা করে উঠতে পারলেন না । তিনি আশ্চর্য হলেন এই ভেবে যে, “এত কম জেনে আমি কিভাবে এথেন্সের সবচেয়ে জ্ঞানী হলাম?” বছরের পর বছর তিনি লোকজনকে প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলেন তাঁর চেয়ে জ্ঞানী কেউ আছে কি না জানার জন্য । শেষ পর্যন্ত তিনি ওরাকল এর কথার মর্মার্থ বুঝতে পারলেন । ওরাকল ঠিকই বলেছিলেন । অনেক লোক’ই তাদের নির্দিষ্ট কাজ সম্পর্কে খুব ভালভাবে জানে কিন্তু পুরো জীবন সম্পর্কে বাস্তব ধারণা খুব কম বা নেই অনেক ক্ষেত্রে । রং মিস্ত্রী তাদের রং-এর কাজ খুব ভালভাবে জানে এবং সৈন্যরা খুব ভাল যুদ্ধ করতে পারে । কিন্তু তারা কেউ-ই সত্যিকার অর্থে জ্ঞানী না । তারা সত্যিকার অর্থেই জানত না তারা কি বিষয়ে কথা বলছে বা কেন কোন কাজ করছে । তারা শুধু কাজ করার পদ্ধতিটি ভালভাবে জানত ।
গ্রীক শব্দ “জ্ঞানের প্রতি ভালবাসা” থেকে “দর্শন” শব্দের উতপত্তি । দর্শনের পশ্চিমা ধারা, যা এই বই এ বর্ণনা করা হয়েছে, গ্রীস থেকে উৎপন্ন হয়ে পৃথিবীর বেশিরভাগ অংশে ছড়িয়ে পড়েছে । কখনো কখনো তা পূর্বাঞ্চলের ধারণা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে । গুরুত্বপূর্ণ কেউ এটাকে সত্য বলেছে বলেই সেটাকে সত্য বলে বিশ্বাস করার চেয়ে জ্ঞানকে মূল্যায়ন ও গ্রহণ করা হয় যুক্তি-তর্ক, কার্যকারণ সম্পর্ক নিরূপণ এবং প্রশ্ন করার মাধ্যমে । অনেক তথ্য জানা বা নির্দিষ্ট কোন কিছু কিভাবে করতে হয় তা’ই জানা সক্রেটিসের জ্ঞানের সংজ্ঞা ছিল না । বরং আমাদের বেঁচে থাকার গতি-প্রকৃতি, কার্যকারণকে জানা এবং এর সর্ব্বোচ্চ যতটুকু আমরা জানতে পারি, এ ছিল তার কাছে জ্ঞান । আজও দার্শনিকেরা কম-বেশী তা’ই করছেন যা সক্রেটিস করেছিলেন: কঠিন কঠিন সব প্রশ্ন করা, কারণ এবং প্রমান খোঁজা, বাস্তবতার গতি-প্রকৃতি এবং কিভাবে আমরা আমাদের জীবন ধারণ করব ইত্যাদি সম্পর্কিত যেসব কঠিন এবং গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন আমরা আমাদের করি সব সময় সে সবের উত্তর খোঁজা । যদিও আধুনিক দার্শনিকরা গত আড়াই হাজার বছরের দার্শনিক চিন্তা ধারার উপর ভিত্তি করে তাঁদের নতুন নতুন দার্শনিক মতবাদগুলো ব্যক্ত করছেন, কিন্তু সক্রেটিসের ক্ষেত্রে সে সুযোগ ছিল না । পশ্চিমা দর্শনের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন দার্শনিকের চিন্তা ধারা বিস্তারিত পর্যবেক্ষণ করা এ বইয়ের উদ্দেশ্য । জ্ঞানের এ ধারাটা মূলত সক্রেটিসই আরম্ভ করেছিলেন ।
সক্রেটিস এত জ্ঞানী হওয়ার পেছনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো তিনি সব সময় সব বিষয়ে প্রশ্ন করতেন, বিনা প্রশ্নে কোন কিছু মেনে নিতেন না এবং তিনি তাঁর মতামত নিয়ে তর্ক-বিতর্ক করতেন । তাঁর মতে, জীবন তখনই স্বাথর্ক যখন তুমি জান যে তুমি কি করছ, কেন করছ, এবং কি উদ্দেশ্যে করছ । জ্ঞানহীন, কর্মহীন, উদ্দেশ্যহীন জীবন কেবল গবাদি পশুর জন্য, মানুষের জন্য নয় ।
অন্যান্য দার্শনিকদের থেকে আরো একটা বিষয়ে সক্রেটিস ব্যতিক্রম ছিলেন, তিনি কোন কিছুই লিখে রাখতে চাইতেন না । তাঁর মতে কথা বলা লেখার চেয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও কার্যকরি । লিখিত বাক্য সাথে সাথে আপনাকে উত্তর দিতে পারে না, যখন আপনি কোন কিছু বোঝেন না, তখন লিখিত বাক্য আপনাকে তা অন্য কোন উপায়ে বোঝাতে পারে না । তিনি বলতেন, মুখোমুখি কথা বলা লেখা থেকে অনেক কার্যকরী । কথা বলার সময় আমরা বুঝতে পারি কোন ধরনের লোকের সাথে কথা বলছি, সে অনুযায়ী আমরা কথার ধরণ পরিবর্তন করতে পারি, ফলে বক্তব্য অর্থপূর্ণভাবে আদান-প্রদান করা যায় । সক্রেটিস যেহেতু লিখেন নি, তাঁর বিশ্বাস, তাঁর ধারণা, তিনি কি নিয়ে বিতর্ক করতেন তা জানতে পারি তাঁর সবচেয়ে কাছের ছাত্র প্লেটোর লেখার মাধ্যমে । প্লেটো সক্রেটিসের কথোপকথন পর্যায়ক্রমিক ভাবে লিখে রেখেছিলেন । এগুলোকে বলা হয় “প্লেটোর সংলাপ” (Platonic Dialogues) এবং এগুলো সাহিত্য এবং দর্শনের খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজ বলে আজো বিবেচিত । এ জন্য প্লেটোকে তাঁর সময়কার শেক্সপিয়র আখ্যায়িত করা হয় । সংলাপগুলো পড়ে আমরা জানতে পারি সক্রেটিস কেমন ছিলেন, তিনি চিন্তায় ও চেতনায় কি প্রকৃতির ছিলেন এবং কারো কারো জন্য কতটা বিরক্তিকর ছিলেন ।
সত্য কথা বলতে সক্রেটিস বলে আদৌ কেউ ছিলেন কি না এ ব্যাপারেও সন্দেহ আছে । এমনও হতে পারে, সক্রেটিস যে কথাগুলো বলেছেন বলে আমরা বলছি সেগুলো আদৌ সক্রেটিসের নয় । প্লেটো হয়তো তাঁর নিজের ধ্যান ধারণাগুলো সক্রেটিস নামক একটি বানানো চরিত্রের মুখ দিয়ে তাঁর সংলাপের মাধ্যমে আমাদের বলেছেন।
“পৃথিবী আমরা যেভাবে দেখি তা আদৌ তেমন নয়”, বেশীরভাগ লোকই ধারণা করে এ মতবাদ সক্রেটিসের চেয়ে প্লেটোর হওয়ার সম্ভাবনা বেশী । বাস্তবতা এবং সাধারণত আমরা যা পর্যবেক্ষণ করি এর মধ্যে বিশাল পার্থক্য বিদ্যমান । আমরা যা দেখি তাকেই বাস্তবতা বলে মনে করি । আমরা ভাবি আমরা ব্যাপারটা বুঝি কিন্তু আসলে তা নয় । প্লেটো বিশ্বাস করতেন একমাত্র দার্শনিকরাই আসলে পৃথিবীকে বুঝতে পারে । তাঁরা বাস্তবতার গতি প্রকৃতি উদ্ঘাটন করে চিন্তার মাধ্যমে, যেখানে অন্যরা নির্ধারণ করে তাদের ইন্দ্রিয়র মাধ্যমে । প্লেটোর মতে, যেহেতু দার্শনিকরা বাস্তবতা সম্পর্কে বাস্তবিকই চিন্তা করতে পারে, তাঁরাই সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করা উচিত এবং তাঁদেরই থাকবে সব রকম সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা । তাঁর বিখ্যাত সৃষ্টি, প্রজাতণ্ত্র (The Republic) এ তিনি একটি কাল্পনিক নিখুঁত সমাজের বর্ণনা দেন । এ ব্যবস্থায় দার্শনিকেরা থাকবেন রাষ্ট্রের সর্ব্বোচ্চ পর্যায়ের নীতিনির্ধারক এবং তাঁরা বিশেষ শিক্ষা বা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করবেন রাষ্ট্র চালনা সহ প্রায় প্রয়োজনীয় সমস্ত বিষয়ে । কিন্তু তাঁরা তাঁদের জীবন বিসর্জন দিবেন অধীনস্ত আপামর জনসাধারণের কল্যাণে । দার্শনিকদের পরবর্তী স্তরে থাকবে সৈন্যরা । তাঁরা প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত হবেন দেশকে রক্ষা কারার জন্য, এবং অভ্যন্তরীন শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য । সৈন্যদের পরবর্তী স্তরে থাকবে সাধারণ কর্মচারীরা । এই তিন প্রকার জনগণ থাকবে নিখুঁত সুসম অবস্থায় । প্লেটোর চিন্তায় এটি এমন একটি সমতা যেটা অনেকটা মানুষের মনের সুসম অবস্থাকে প্রকাশ করে । মনের যুক্তিসংগত অংশ যা অনুভূতি আর আকাঙ্খার নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে এ অবস্থায় উন্নীত করে । দুঃখজনকভাবে তাঁর সমাজের কাঠামো ছিল গভীরভাবে গণতন্ত্র বিরুদ্ধ এবং জনগণকে নিয়ন্ত্রণ করবে সম্মিলিতভাবে মিথ্যা আর বলপ্রয়োগের মাধ্যমে । তিনি বেশিরভাগ চিত্রকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করবেন, যদি তিনি ভাবেন যে এগুলো বাস্তবতাকে যথার্তরূপে প্রতিফলিত করছে না । শিল্পীরা চিত্রায়িত করে যা দৃশ্যমান, কিন্তু দৃশ্যমান বস্তু তার মূল গঠন কাঠামো থেকে দর্শকের দৃষ্টি সরিয়ে নেয় । প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রে জীবনের সব কিছুই উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষ দ্বারা কঠোর ভাবে পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হবে । বর্তমান সময় আমরা এই রকম রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে বলতাম সমগ্রতাবাদী (totalitarian) রাষ্ট্র । প্লেটোর মতে, ভোট অধিকার মানে হলো, জাহাজের যাত্রীদের হাতে জাহাজ চালানোর ভার ছেড়ে দেয়ার মতো । তাঁর মতে, এর চেয়ে যারা জানে তাঁরা কি করছে এবং ঐ বিষয়ে দক্ষ তাদের কাছে দায়িত্ব ছেড়ে দেয়া অনেক ইতিবাচক, গুরুত্বপূর্ণ, এবং ফলপ্রসু ।
পঞ্চম শতাব্দীর এথেন্স প্লেটোর কল্পনাপ্রসূত প্রজাতন্ত্র (The Republic) থেকে অনেক ভিন্ন ছিল । অনেকটা আধুনিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মতোই, যদিও জনগণের মাত্র ১০ শতাংশ ভোট দিতে পারত । মহিলা এবং দাশরা স্বাভাবিকভাবেই ভোটাধিকার বঞ্চিত ছিল । কিন্তু আইনের চোখে সবাইকে সমান মনে করা হত এবং রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে সবার প্রভাব বিস্তার করার একটা ব্যবস্থা ছিল লটারি ব্যবস্থার মাধ্যমে ।
প্লেটো যেভাবে সক্রেটিসকে মূল্যায়ন করেছেন এথেন্সের জনগণ সেভাবে মূল্যায়ন করেনি । বরঞ্চ অনেকটা নেতিবাচক ভাবেই করত । বেশিরভাগ এথেন্সবাসী মনে করত সক্রেটিস বিপদজনক এবং ইচ্ছাকৃত ভাবেই সে শাসন গোষ্ঠীর বিরোধিতা করছে । ৩৯৯ খৃষ্টপূর্বাব্দে, যখন সক্রেটিস ৭০ বছর বয়সী, এথেন্সের মেলিটাস, সক্রেটিসকে কোর্টে হাজির করেন । মেলিটাস দাবি করেন, সক্রেটিস এথেনীয় সৃষ্টিকর্তাকে অস্বীকার করে এবং তাঁর নিজের বানানো একজন সৃষ্টিকর্তাকে বসানোর চেষ্টা করছেন । তিনি আরো দাবি করেন যে সক্রেটিস এথেন্সের যুবক সম্প্রদায়কে খারাপ আচরণ করতে উৎসাহিত করছেন, প্রশাসনের বিরুদ্ধাচরণ করতেও উৎসাহ যোগাচ্ছেন । আর এ সবগুলোই খুব মারাত্মক অভিযোগ । এখন জানা অসম্ভব যে এ অভিযোগগুলো কতটা সঠিক ছিল । এমনও হতে পারে সক্রেটিস রাষ্ট্রীয় ধর্ম পালনে তাঁর ছাত্রদের অনুৎসাহিত করতো এবং এর কিছু কিছু প্রমানও পাওয়া গেছে যে তিনি এথেনীয় গণতন্ত্র নিয়ে মশকরা করতেন । এটা তাঁর চরিত্রের সাথেও সঙ্গতিপূর্ণ ছিল । যা সত্য তা হলো, বেশীরভাগ এথেনীয় জনগণই এসব অভিযোগ বিশ্বাস করেছিল ।
তাঁর দোষ-নির্দোষ এর ব্যাপারে তারা ভোট গ্রহণ করল । ৫০১ জনের বিশাল জোরি বোর্ডের অর্ধেকের বেশী লোক তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করল এবং মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিল । যদি চাইতেন, তিনি তাঁর যুক্তি-তর্কের মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ডাদেশ থেকে নিজেকে সহজেই মুক্ত করতে পারতেন । তা’ না করে তিনি তাঁর ডাঁশ মাছি স্বভাবসূলভ কূটতর্কের মাধ্যমে সবাইকে বিরক্ত করলেন । উল্টো এই দাবী করলেন যে, তিনি কোন অন্যায় তো করেন-ই নি বরং তাঁকে স্বাধীনভাবে ছেড়ে দিয়ে তাঁর সারাজীবনের খাদ্যের ব্যবস্থা করা উচিত সরকার থেকে । স্বাভাবিকভাবেই এটা হিতে বিপরীত হয়েছিল তাঁর জন্য ।
তাঁর মৃত্যুদণ্ড দেয়া হলো হেমলক গাছের বিষ পানে মুত্যুগ্রহণের জন্য । এ বিষের প্রতিক্রিয়ায় সমস্ত শরীর আস্তে আস্তে অবশ হয়ে যায় এবং শেষ পর্যন্ত মৃত্যুবরণ করে । সক্রেটিস প্রথমে তাঁর স্ত্রী এবং তিন সন্তান থেকে বিদায় নিলেন । তারপর তাঁর ছাত্রদের কাছ থেকেও বিদায় নিলেন । তিনি যদি চুপচাপ জীবনধারণ করার চেষ্টা করতেন, ক্ষমতাবানদের সাথে আপোষ করার কথা বিবেচনা করতেন, ক্ষমতাবানদের সমালোচনা না করতেন এবং কঠিন কঠিন সব প্রশ্ন করা থেকে নিজেকে বিরত রাখতেন, তাহলে তাঁর হেমলক পান করতে হতো না । তিনি মৃত্যুবরণ করবেন কিন্তু প্রশ্ন করা থেকে নিজেকে বিরত রাখবেন না । তাঁর বিবেক তাঁকে সব সময় প্রশ্ন করার জন্য প্ররোচিত করতো এবং তিনি তা’ উপেক্ষা করতে পারতেন না । তাই তিনি এক পেয়ালা হেমলক পান করার পথ বেছে নিলেন এবং খুবই দ্রুত মৃত্যুর কুলে ঢলে পড়লেন ।
সক্রেটিস আজও বেঁচে আছেন প্লেটোর সংলাপে । এই দৃড়চেতা মেধাবী মানুষটি সত্যিকার অর্থেই আমাদের চারপাশ এবং জীবন কেন ও কেমন এ ব্যাপারে প্রশ্ন করতে থাকলেন আমৃত্যু । তিনি বরং মৃত্যুকে মেনে নিবেন কিন্তু সত্য জানার ক্ষেত্রে পিছপা হবেন না । সেই থেকে আজ পযর্ন্ত তিনি দার্শনিকদের উৎসাহের কারণ হয়ে আছেন ।
সক্রেটিসের সরাসরি প্রভাব পড়েছে যাঁরা তাঁর বেশি কাছাকাছি ছিলেন । প্লেটো তাঁর শিক্ষকের ঐতিহ্য অনুযায়ী সক্রেটিসের মৃত্যুর পরও একই ভাবে শিক্ষা দিয়ে যেতে থাকলেন । এরিষ্টটল ছিলেন প্লেটোর স্বার্থক ছাত্র । যদিও এরিষ্টটল এদের দু’জন থেকেই একেবারে ভিন্ন ধরণের চিন্তাধারার অধিকারী ছিলেন ।
মূল: A Little History of Philosophy by Nigel Warburton
Chapter 1: The Man Who Asked Questions
Socrates and Plato
Leave a Reply