একটা গাছের পাতা দেখেই কি বলে দেয়া যায় পাতার কোষে কি হচ্ছে? উদ্ভিদের কোষের ভিতরের প্রোটিন কি দেখা যায়? এই প্রশ্নগুলির উত্তর পাওয়া গিয়েছে আলোক নিঃসরণকারী এক ধরণের জেলিফিশ থেকে। এখন প্রশ্ন জাগতে পারে এই জেলিফিসের সাথে উদ্ভিদ কোষের কার্যকলাপ দেখতে পাওয়ার সম্পর্ক কোথায়? এই প্রশ্নের উত্তর দেয়ার আগে চলুন একটু জানার চেষ্টা করি কেন ও কিভাবে এই জেলিফিশ আলো নিঃসৃত করে! এ থেকে হয়তো আমরা আমাদের কাঙ্খিত উত্তরের কাছে পৌঁছে যাব।
শুরু করি একটুখানি ইতিহাস দিয়ে। ১৯৬০ সালে Osamu Shimomura প্রাকৃতিকভাবে আলোক নিঃসরণকারী জেলিফিশ নিয়ে গবেষণা করার জন্যে জাপান থেকে প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটিতে চলে আসেন। Shimomura এবং তাঁর সহযোগী বিজ্ঞানীদের গবেষণার কেন্দ্রবিন্দু ছিল Aequorea Victoria নামের এক জেলিফিশ। জেলিফিশটির প্রধান বৈশিষ্ট্য হল এটি সবুজ রং নিঃসৃত করে। Shimomura ও তাঁর সহকর্মীরা ওয়াশিংটন ষ্টেট থেকে প্রায় ১০,০০০ জেলিফিশ সংগ্রহ করেন। তাঁরা জেলিফিশগুলোর বাহিরের রিং অর্থাৎ যে অংশটি সবুজ আলো নিঃসৃত করে সে অংশটি রেখে বাকিগুলো ফেলে দেন। তাঁরা দুধরণের প্রোটিন পৃথক করতে সক্ষম হন। প্রোটিন দুটি হলো একিউরিন এবং গ্রিন ফ্লুরেসেন্ট প্রোটিন (GFP) । একিউরিনের আলোক নিঃসরণ করার জন্যে ক্যালসিয়াম দরকার হয়। আর গ্রিন ফ্লুরেসেন্ট প্রোটিন(GFP) এর আলোক নিঃসরণের জন্যে প্রয়োজন অতিবেগুনী রশ্মি ( UV) । GFP এর বড় সুবিধা হলো এটি কাজ করার জন্যে অন্য কোন পদার্থের দরকার হয় না। আর এই ব্যাপারটি GFP দিয়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে গবেষণার দ্বার খুলে দিয়েছিল।
এতক্ষণের ইতিহাস থেকে আমরা বুঝেছি জেলিফিশের আলোক নিঃসরণের জন্যে একিউরিন এবং GFP দায়ী। আর এই GFP আবিস্কার ও এর উন্নতি সাধনের জন্যে ২০০৮ সালে তিনজন বিজ্ঞানী রসায়নে নোবেল পুরস্কার পান। তাঁরা হলেন Osamu Shimomura, Martin Chalfie এবং Roger Y. Tsien।
১৯৯২ সালে Douglas Prasher GFP জিনকে ক্লোন করেন। আর তার দুই বছর পর Maritn Chalfie এই জিন একটি E.coli ব্যাকটেরিয়া এবং একটি কেঁচোকৃমি C.elegans এ প্রবেশ করান। এই ব্যাকটেরিয়া ও কৃমিতে যখন অতিবেগুনী রশ্মি ফেলা হলো তখন তাদের থেকেও সবুজ আলো নিঃসৃত হলো। এ কাজটি থেকে একটা ব্যাপার পরিষ্কার হলো যে এ প্রক্রিয়ায় GFP জিনকে যেকোনো প্রজাতিতে প্রবেশ করানো সম্ভব। এদিকে আবার Roger Tsien বিভিন্ন প্রকারের GFP তৈরি করেন। অর্থাৎ এক এক ধরণের GFP এক এক ধরণের আলো দিবে।
এখন নিশ্চয়ই আপনি বুঝতে পারছেন আমি সামনে কি বলতে যাচ্ছি। হা ঠিক ধরেছেন! এখন যদি আমি E.coli ব্যাকটেরিয়া কিংবা কেঁচোকৃমির মত উদ্ভিদ কোষেও GFP প্রবেশ করাই, তখন কি হবে? তখন কি তাঁরা ব্যাকটেরিয়া কিংবা কৃমির মত আলো প্রদর্শন করবে না? অবশ্যই করবে। আর এই অবস্থাকে কাজে লাগিয়ে আমরা কোষের ভিতরের প্রোটিনের স্থান পরিবর্তন এবং তার প্রাথমিক অবস্থা সবকিছু চিত্রিত করতে পারব, বিশ্লেষণ করতে পারব। উদাহরণ হিসেবে বলতে গেলে আমরা মেমব্রেন প্রোটিন দেখতে পারব এবং কিভাবে কোষপর্দা স্থান পরিবর্তন করে তা বুঝতে পারবো। এই পদ্ধতি ব্যবহার করে আমারা কোষের ভিতরে সমন্বিত প্রোটিনের জটিল কাজকর্মের একটি সম্পূর্ণ চিত্র পেতে পারি।
এতক্ষণে নিশ্চয়ই আপনি আপনার উত্তর পেয়ে গিয়েছেন। কিন্তু আরেকটা প্রশ্ন হয়তো আপনাকে জ্বালাতন করা শুরু করেছে। প্রশ্নটি হচ্ছে।, GFP কি প্রাণীর শরীরে প্রবেশ করানো যায় না? উত্তর হচ্ছে যায়। GFP ব্যবহার করে এ পর্যন্ত নানা ধরণের প্রাণী তৈরি করা হয়েছে। আমি একে একে বলছি তাদের নিয়ে। আল্বা (Alba) নামে একটি খরগোশ তৈরি করেছিলেন শিল্পী Eduardo Kac. তাঁকে সহযোগিতা করেছিলেন জেনেটিসিস্ট Louis Marie Houdebine । আরেকটি উদাহরণ হচ্ছে Glofish। এটি উজ্জ্বল লাল, সবুজ, নীলসহ আরও অনেক রঙের পাবেন। এটি পৃথিবীর একমাত্র জেনেটিক্যালি মডিফাইড পোষা প্রাণী যা জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত। Yorktown Technologies এই মাছটির সকল স্বত্ব সংরক্ষণ করে। এই কোম্পানিই প্রথম এই মাছটির বাণিজ্যিকিকরণ করে। MeonPets নামের একটি আমেরিকান কোম্পানি Neonmice নামক ইঁদুর বাজারজাত করেছে। ন্যাশনাল তাইওয়ান ইউনিভার্সিটির এনিমেল সাইন্স এন্ড টেকনোলজি ডিপার্টমেন্টের একদল গবেষক কিছু শুকর পালন করেছিলেন যা কিনা GFP দিয়ে তৈরি! ছবিগুলো দেখলে বুঝবেন কি দারুণ ও অদ্ভুত প্রাণী তৈরি করেছেন তাঁরা!
GFP নিয়ে যখন এত কিছু তখন ফাইন আর্টস বাদ যাবে কেন! Julian Voss- Andreae নামক একজন জার্মান শিল্পী GFP এর গঠনের উপর ভিত্তি করে ‘Green Fluorescent Protein’ এবং ‘Steel Jellyfish’ নামে দুটি ভাস্কর্য তৈরি করেছেন।
লেখা শেষ করব GFP নিয়ে মজার একটি খবর দিয়ে। আপনার খাবার থেকে যদি জেলিফিশের মত আলো বের হয় কেমন হবে! এমনটাই ভেবেছেন Charlie francis নামের একজন ব্রিটিশ উদ্যোক্তা। তিনি GFP ব্যবহার করে একধরণের আইসক্রিম তৈরি করেছেন। আপনি যখন আইসক্রিমটি চুষবেন তখন আপনার মুখের গরমে আইসক্রিমে ব্যবহৃত প্রোটিনের PH লেভেল বেড়ে যাবে। ফলে সেটি আলো নিঃসৃত করবে। চিন্তা করুন আপনি আইসক্রিম খাচ্ছেন আর আইসক্রিম এবং আপনার মুখ থেকে আলো বেরুচ্ছে। দারুণ না?! এখন হয়তো আইসক্রিমটির দাম জানতে চাইবেন! বেশি না!! প্রতি আইসক্রিম মাত্র ১৪০ ডলার! খেয়ে দেখতে পারেন কোন এক সময়! আর আমাকে একটা দিতে ভুলবেন না কিন্তু!
*** লেখাটি নিচের লেখাগুলোর ভাবানুবাদঃ
১. https://theconversation.com/how-glow-in-the-dark-jellyfish-revolutionised-plant-biology-19118
২. http://www.dailymail.co.uk/news/article-2483133/Fancy-glow-dark-ice-cream-World-uses-jellyfish-protein-create-glow–scoop-costs-140.html
৩. উইকিপিডিয়া
# নোবেল প্রাইজ ডট অর্গ- এ একটা পিডিএফ ফাইল আছে এ সম্পর্কে আগ্রহীরা দেখতে পারেন।
http://www.nobelprize.org/nobel_prizes/chemistry/laureates/2008/advanced-chemistryprize2008.pdf
বিশেষ কৃতজ্ঞতাঃ
আরাফাত রহমান ভাই। উনিই লেখাটি অনুবাদ করতে বলেছিলেন। অনেক ধন্যবাদ ভাইয়া 🙂
Leave a Reply