শীত আসছে। তাই বাজার থেকে কিনে এনেছেন চামড়ার জ্যাকেট, পায়ে দিয়েছেন চামড়ার জুতো আর হাতে চামড়ার তৈরী ব্যাগ। কি একটিবারের জন্যও কি ভেবে দেখেছেন এর পেছনের গল্পটি কেমন? কি ভয়াবহ স্বাস্থ্য ও পরিবেশ বিধ্বংসী প্রক্রিয়ায় এগুলো আপনার হাতে এসে পৌঁছেছে?
পৃথিবীর অর্ধেকের বেশী ট্যানারী শিল্প গড়ে উঠেছে নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশগুলোতে। উচ্চ লাভ, নি¤œ মজুরি এবং পরিবেশ সম্পর্কে অনীহা ও অসচেতনতাই এর প্রধান কারণ। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের হাজারীবাগে ১৯৬০ সালে পাঞ্জাবী ট্রেডার্স নামে ট্যানারী শিল্পের সূচনা হয়।পরবর্তীতে স্বাধীনতার পরে এটি ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করে। বাংলাদেশের ৯০% ট্যানারী হাজারীবাগে অবস্থিত। বর্তমানে এখানে প্রায় ২০০ টির বেশি ট্যানারী শিল্প রয়েছে। হাজারীবাগ একটি অত্যন্ত ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা। প্রায় ২৫ হেক্টর জায়গার উপরে ট্যানারী গুলো অবস্থিত। বাংলাদশেরে ট্যানারি শিল্পগুলো বছরে প্রায় দেড় কোটি র্বগফুট চামড়া প্রক্রিয়াজাত করে। এর ৮৫% বিদেশে রফতানি করে এবং বাকি ১৫% চামড়া দিয়ে স্থানীয় বাজাররে জন্য শিল্পজাত পণ্য তৈরি করা হয়। মূলতঃ ঈদ-উল-আযহায় বিপুল পরিমাণে চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণের জন্য আসে, তাই এ সময়ে এর তৎপরতা বেশি থাকে।
বিপুল পরিমাণে নির্গত দূষিত পানি ও এতে দ্রবীভূত উচ্চ ঘনত্বের বিভিন্ন দূষিত পদার্থ (যেমন: ক্রোমিয়াম ও ট্যানিন) থাকার কারণে এর পরিবেশগত প্রভাব ভয়াবহ। শুধুমাত্র পরিবেশ নয়, এসব কারখানায় কর্মরত শ্রমিকদের স্বাস্থ্যও হুমকিস্বরূপ।
উচ্চ মাত্রায় ক্রোমিয়ামসহ আরো প্রায় ৪০টি ভারী ধাতু, এসিড ও বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ এতে ব্যবহার করা হয়, যার মাত্র ২০% ট্যানিং প্রক্রিয়ার সময় চামড়া দ্বারা শোষিত হয়। বাকি ৮০% ই বর্জ্য হিসেবে নির্গত হয় যার শোধনের কোন ব্যবস্থা নেই। হাজারীবাগে প্রতিদিন ৭.৭ মিলিয়ন লিটার তরল পদার্থ ও ৮৮ মিলিয়ন টন কঠিন পদার্থ বর্জ্য হিসেবে নিঃসৃত হয়। এগুলো কোনরূপ পরিশোধন ছাড়াই সরাসরি ছেড়ে দেয়া হয় পরিবেশে। এর ক্রোমিয়াম, ক্যাডমিয়াম, আর্সেনিক ও লেড নদীর মাছে পুঞ্জীভ’ত হয় এবং খাদ্য শৃঙ্খলের মাধ্যমে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে।
আমাদের প্রিয় বুড়িগঙ্গা নদী দূষণের অন্যতম প্রধান উৎস হাজারীবাগের ট্যানারী শিল্প। গত ৪৫ বছর ধরে এই ট্যানারীগুলো ক্রোমিয়াম নির্গত করে নদীকে দূষিত করে যাচ্ছে। প্রতিদিন ২১,০০০ কিউবিক মিটার অপরিশোধিত পানি হাজারীবাগের ট্যানারীগুলো থেকে নদীতে ফেলা হচ্ছে। Department of Environment এর এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত ৫০ বছর ধরে ৯৫% ট্যানারী অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে। সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা যায়, প্রতিবছর প্রায় ৬০,০০০ টন চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণ করা হয়, যা থেকে প্রতিদিন প্রায় ৯৫,০০০ লিটার অপরিশোধিত তরল বর্জ্য নির্গত হয়। হাজারীবাগের ট্যানারী শিল্পের একটিতেও Effluent treatment plant (ETP) বা বর্জ্য পরিশোধনাগার নেই। অর্থাৎ অত্যন্ত বিষাক্ত এই বর্জ্যগুলো কোনকিছু চিন্তা না করেই ছেড়ে দেয়া হচ্ছে পরিবেশে।
এর স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি অন্য সব শিল্পকে হার মানায়। তীব্র দূর্গন্ধ, দূষিত তরল আর যে কোন সময় দুর্ঘটনার ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে হয় শ্রমিকদের। তাদের নিরাপত্তার জন্য নেই কোন ধরনের পদক্ষেপ। প্রচুর পরিমাণে ব্যবহৃত ক্রোমিয়াম শ্বসনতন্ত্র, পরিপাকতন্ত্র, জননতন্ত্রকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। World Health Organization (WHO) এর মতে, হাজারীবাগে ৮০০০ এরও বেশি শ্রমিক পরিপাক, চর্ম ও অন্যান্য বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত। সবচেয়ে ভয়াবহ দিক এটি যে, এ শিল্পে জড়িত ৯০% শ্রমিক ৫০ বছর বয়সের আগেই মারা যায়। একটিবার ভাবুন, একজন ট্যানারী শ্রমিক আপনার আমার মতোই মানুষ। অথচ এই ট্যানারী মালিকদের উদাসীনতা আর অর্থলোলুপতার কারণে গড় আয়ুর চেয়ে কত কম বয়সে তাকে মৃত্যুবরণ করতে হচ্ছে।
হাজারীবাগের ট্যানারীর দূষণ মারাতœক রূপ লাভ করায় সরকার এটিকে সাভারের হেমায়েতপুরে ধলেশ্বরী নদীর তীরে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। । নদীর তীরে বেড়িবাঁধ দিয়ে করে এবং চারদিকে সীমানা প্রাচীর দিয়ে ইতোমধ্যইে চামড়া শিল্পের জন্য একটি ইন্ডাষ্ট্রিয়াল জোন গড়ে তোলা হয়েছে। এতে করে কি আমরা এর ভয়াবহতা থেকে রক্ষা পাবো নাকি বুড়িগঙ্গার মতো আরেকটি নদী হুমকির মুখে পড়তে যাচ্ছে সেটিই এখন দেখার বিষয়।
তথ্যসূত্র:
Leave a Reply