পরমাণুর অাভ্যন্তরীন মহাবিশ্বে ভ্রমণ
মূল: আইজ্যাক আসিমভ
অধ্যায়-২ : আলো
অনুচ্ছেদ-২: চার প্রকার প্রতিভাস
পুরোপুরি সন্তোষজনক উত্তর খুবই বিরল এবং এই কথা বিজ্ঞানের জন্য খুবই প্রযোজ্য যেখানে প্রতিটি উত্তর একেকটি নতুন ও আরো সূক্ষ প্রশ্নের জন্ম দেয়। আমরা যদি স্বীকৃতি দিয়ে দিই যে, আলো; শব্দ কিংবা আন্দোলিত পুকুরের মতোই তরঙ্গের সমাহারে গঠিত তাহলে সমস্যা থেকে যায় যে, আলো খুব সহজেই শূন্য মাধ্যমে চলতে পারে যেখানে শব্দ কিংবা পানির তরঙ্গ তা পারে না।পানির তরঙ্গ তৈরি হয় কেননা পানির অণুগুলো নিয়মিত উপরে-নীচে স্পন্দিত হতে থাকে। যদি পানি না থাকত তাহলে পানির তরঙ্গও থাকত না। শব্দ তরঙ্গ তৈরি হয় বায়ুর অণুগুলোর (কিংবা অন্য পদার্থের অণু বা মাধ্যম যার মধ্য দিয়ে শব্দ চলাচল করে) আগে-পিছে আন্দোলনের মাধ্যমে। যদি বায়ু বা অন্য মাধ্যম না থাকত তাহলে শব্দ তরঙ্গও থাকতো না।
কিন্তু আলোর তরঙ্গের ক্ষেত্রে এমন কী আছে যা উপরে-নীচে স্পন্দিত হয়? এটি কোনো ধরনের পদার্থ হতে পারে না কেননা আলো তো শূন্য মাধ্যম দিয়েও চলাচল করে যেখানে স্পষ্টতই কোনো পদার্থ নেই। নিউটন ১৬৮৭ সালে যখন সর্বজনীন মহাকর্ষ নিয়ে কাজ করছিলেন তখন একই রকমের সমস্যায় পড়েছিলেন। সূর্য পৃথিবীকে ১৫ কোটি কিলোমিটার দূর থেকে এর মহাকর্ষীয় গ্রীবায় ধরে রেখেছে শূন্যের ভিতর দিয়ে। কীভাবে শূন্যের মধ্য দিয়ে ভ্রমন করে মহাকর্ষীয় প্রভাব সম্ভব?
নিউটন হালকাভাবে চিন্তা করে দেখলেন, হয়তোবা শূন্য মাধ্যম পুরোপুরি শূন্য নয়, এর বদলে এটি এমন এক ধরনের পদার্থ দিয়ে গঠিত যা সাধারণ পদার্থের চেয়ে আরো সূক্ষ এবং এই কারনে সহজে শনাক্ত করা যায় না। শূন্য মাধ্যমের এই পদার্থের নাম দেওয়া হলো ইথার (ether) যা এরিষ্টটলের “aether” নামের প্রতি সম্মানপূর্বক দেওয়া হয়েছে, যেটিকে এরিস্টটল ধারনা করেছিলেন সমগ্র স্বর্গীয় বস্তুসমূহের গঠনের উপাদান হিসেবে। সূর্যের মহাকর্ষের মাধ্যমে ইথারে টান লাগে যা পর্যায় ক্রমে ইথারের একপ্রান্ত থেকে অপরপ্রান্তে পরিবাহিত হয় এবং শেষ পর্যন্ত তা পৃথিবীর প্রতি সূর্যের টান হিসেবে প্রতীয়মান হয়। হয়তোবা এটিই সেই ইথার (কিংবা অন্যরকম) যার উপরে-নিচে স্পন্দনের মাধ্যমে আলো অতিক্রম করে। এটিকে সম্পূর্ণ মহাবিশ্বেই ছড়িয়ে থাকতে হবে কেননা আমরা খুব দূরবর্তী তারকাও দেখতে পাই। আরো ব্যাপার হচ্ছে এটি এতই সূক্ষ এবং বিরল ধরনের পদার্থ যে এটি পৃথিবী বা অন্যান্য স্বার্গীয় বস্তুর চলাচলে কোনো রকম বাধা সৃষ্টি করে না। ফ্রে’নেল প্রস্তাব করলেন ইথার এমন পদার্থ যা পৃথিবী ও অন্যান্য স্বর্গীয় বস্তুকে ভেদ করে যেতে পারে।
ইথারের কণা তরঙ্গের আন্দোলনের সময় যখন উপরে উঠে তখন বিপরীত দিকে একটি বল অনুভব করে যা তাদের নিচে টেনে ধরে এবং সাম্যাবস্থা থেকে নিচের দিকে নামায়। এই সময় তারা পুনরায় উপরের দিকে টান অনুভব করে এবং উপরে উঠতে থাকে, এভাবেই ওঠা-নামা চলতে থাকে।কোনো মাধ্যম যতো বেশী দৃঢ় হবে এই ওঠা-নামা ততোই দ্রুততর হবে এবং তরঙ্গ ততোই দ্রুত এই মাধ্যমের মধ্য দিয়ে চালিত হবে। আলো প্রতি সেকেন্ডে ২৯৯,৭৯২ কিলোমিটার (১৮৬,২৯০ মাইল) পথ অতিক্রম করে। ড্যানিশ জোতির্বিদ ওলস রেমার (Olaus Roemer, ১৬৪৪-১৭১০) সর্বপ্রথম স্থুল ভাবে আলোর গতি পরিমাপ করেন। যদি ইথারের মধ্য দিয়ে আলোকে অতিক্রম করতে হয় তাহলে তাকে স্টীলের চেয়ে দৃঢ় হতে হবে।
শূন্য মাধ্যমকে যদি এমন সূক্ষ কিছু দিয়ে তৈরি হতে হয় যা বিনা বাধায় এর মধ্য দিয়ে কোনো বস্তুকে যেতে দেয় আবার একই সাথে তাকে স্টীলের চেয়েও দৃঢ় হতে হয় তাহলে পরো ব্যাপারটি বিভ্রান্তিকর অবস্থায় গিয়ে দাঁড়ায় কিন্তু বিজ্ঞানীদের কাছে সেই্ মূহুর্তে এই পরিস্থিতি ধরে নেওয়া ছাড়া আর কিছু করার ছিলো না।
আলো এবং মহাকর্ষের বাইরেও আরো দু’টি ঘটনা সেই সময়ে পরিচিত ছিলো যা শূন্য মাধ্যমের মধ্য দিয়ে অনুভব করা সম্ভব। এই দু’টি বিষয় হচ্ছে তড়িৎ এবং চৌম্বকত্ব। প্রচলিত ইতিহাস অনুযায়ী এ দু’টিরই প্রথম চর্চা করেছেন গ্রীক দার্শনিক থ্যালেস। তিনি নির্দিষ্ট এক ধরনের লোহার আকরিক নিয়ে অধ্যয়ন করেন যা এজিন সাগরের সমুদ্রতটে অবস্থিত ম্যাগনেসিয়া নামক শহরের কাছাকাছি পাওয়া যায়। এটি লোহার টুকরোকে আকর্ষণ করার মতো ক্ষমতা প্রাপ্ত এবং এর নাম তিনি ho magnetes lithos (the Magnesian rock ম্যাগনেসিয়ার পাথর) দিয়েছিলেন বলে জানা যায়। সেই থেকে আজ পর্যন্ত লোহাকে আকর্ষনে সক্ষম সকল বস্তুকে ম্যাগনেট (magnet বাংলায় চুম্বক) নামে ডাকা হয়।
থ্যালেস আরো দেখলেন এম্বারের টুকরোকে (পাইন গাছ হতে নির্গত রেজিন) যদি ঘষা হয় তাহলে তা সুনির্দিষ্টভাবে লোহাকেই নয় বরং যেকোনো হালকা বস্তুকে আকর্ষণ করে। দু’ই ঘটনার এই পার্থক্য থেকে বোঝা যায় এ্যাম্বারের এই আকর্ষণ চৌম্বকত্ব নয় বরং অন্য কিছু। এ্যাম্বারের গ্রীক হচ্ছে electron এবং কালক্রমে এই ধরনের ঘটনা ইলেক্ট্রিসিটি (electricity বাংলায় তড়িৎ বা বিদ্যুৎ) নামে প্রসার লাভ করল।
একাদশ শতকের কোনো এক সময়ে চীনে (যদিও ঠিক কোন স্থানে এবং কার মাধ্যমে তা জানা যায় না) আবিষ্কৃত হয়েছিলো যে চৌম্বক আকরিক হতে তৈরি কিংবা ইস্পাতকে চৌম্বক আকরিকের সাথে ঘষে চুম্বকে পরিণত করা কোনো সূঁচকে যদি মুক্তভাবে ঝুলতে দেওয়া যায় তাহলে তা উত্তর-দক্ষিন দিকে দুই প্রান্ত নির্দেশ করে নিজেকে বিন্যাস্ত করে। শুধু তা-ই নয়, যদি সুঁচের প্রান্তগুলোকে চিহ্নিত করা হয় তাহলে দেখা যায় একটি নির্দিষ্ট প্রান্ত সর্বদাই একটি নির্দিষ্ট দিকেই মুখ করে থাকে।
যে প্রান্তটি উত্তর দিকে মুখ করে থাকে তাকে উত্তর মেরু এবং অপর প্রান্তকে দক্ষিন মেরু আখ্যা দেওয়া হয়। ফরাসি পন্ডিত পেট্রাস পেরেগ্রিনাস (Petrus Peregrinus, ১২৪০-?) এই ধরনের সূঁচ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করলেন এবং দেখলেন যে একটি সুঁচের উত্তর মেরু অপরটির দক্ষিন মেরুকে আকর্ষণ করে। অপর দিকে দু’টি সুঁচের উত্তর মেরু পরস্পরকে বিকর্ষণ করে। সংক্ষেপে, সমধর্মী মেরু পরস্পরকে বিকর্ষণ করে এবং বিপরীত ধর্মী মেরু পরস্পরকে আকর্ষণ করে।
১৭৮৫ সালে ফরাসি পদার্থবিদ চার্লস অগাস্তে দ্যা কুলম্ব (Charles Augustin de Coulomb, ১৭৩৬-১৮০৬) যে বলে একটি উত্তর মেরু অপর একটি দক্ষিন মেরুকে আকর্ষণ করে বা অপর একটি উত্তর মেরুকে বিকর্ষণ করে তা মেপে দেখেন। তিনি দেখলেন যে, আকর্ষণ বা বিকর্ষণ দুরত্ব বৃদ্ধির সাথে সাথে দুরত্বের বর্গীয় (square) হারে কমতে থাকে (বিপরীত বর্গীয় সূত্র)। অর্থাৎ আপনি যদি পূর্বের দুরত্বের চেয়ে দু’টি বস্তুর দুরত্ব x গুণ বৃদ্ধি করেন তাহলে তাদের মধ্যবর্তী বলের মান হয়ে যাবে আগের মানের 1/x X 1/x বা 1/x^2। ১৬৮৭ সালে নিউটন যখন মহাকর্ষ বল নিয়ে কাজ করছিলেন তখন তিনিও সেখানে বিপরীত বর্গীয় সূত্রটি ক্রিয়াশীল দেখতে পেয়েছিলেন।
সেই হিসবে পৃথিবীর কেন্দ্র হতে চাঁদের দুরত্ব, পৃথিবীপৃষ্ঠের দূরত্বের চেয়ে ষাট গুণ। তাই পৃথিবীকর্তৃক চাঁদের টান এর পৃষ্ঠের প্রতি টানের তুলনায় ১/৬০ X ১/৬০ বা ৩৬০০ ভাগের ১ ভাগ। তবে, এই টান দু’টি বস্তুর ভরের গুণফলের সাথে সমানুপাতিক এবং পৃথিবী ও চাঁদ এতোই ভারী যে এতো বিশাল দূরত্বে থাকা সত্ত্বেও তাদের মধ্যবর্তী মহাকর্ষীয় টান চাঁদকে এর কক্ষপথে ধরে রাখার জন্য যথেষ্ট। এই একই কারনে পৃথিবী চাঁদের সাথে যে দূরত্বে আছে, সূর্যের সাথে সে ৪০০ গুণ বেশী দুরত্বে থাকা সত্ত্বেও সূর্য পৃথিবীকে এর কক্ষপথে ধরে রাখতে পারছে। বস্তুতপক্ষ, বিশালাকার গ্যালক্সিগুচ্ছগুলো পরস্পরের কাছ থেকে কোটি কোটি আলোকবর্ষ দুরে অবস্থান করা সত্ত্বেও পরস্পরকে মহাকর্ষীয় টানে ধরে রেখেছে।
হ্যাঁ এটি ঠিক যে দু’টি চুম্বকায়িত সুঁচের মধ্যে চৌম্বক আকর্ষণ বল তাদের মধ্যবর্তী মহাকর্ষীয় বলের চেয়ে ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন গুণ বেশী শক্তিশালী। তাহলে কেনই আমরা মহাকর্ষীয় টানের বিষয়ে অবগত কিন্তু চৌম্বক টানের বিষয়ে উদাসীন? কেন জোতিঃবস্তুগুলো পরস্পরের সাথে মহাকর্ষের মাধ্যমে যুক্ত যখন তাদের মধ্যবর্তী চৌম্বক বল সম্বন্ধে আমরা কিছুই শুনিনি?
উত্তরটি হচ্ছে চৌম্বকত্ত্ব আকর্ষণ ও বিকর্ষণ নিয়ে গঠিত এবং এদের প্রাবল্যও সমান। অপরদিকে মহাকর্ষ শুধুই আকর্ষণ প্রয়োগ করে। মহাকর্ষীয় বিকর্ষণ বলতে কিছু নেই। এই মহাবিশ্ব পুরোটাই চুম্বক দিয়ে পূর্ণ। যেমনটি আমরা পরবর্তীতে দেখতে পাবো, প্রতিটি পরমাণুই একেকটি ক্ষূদ্র চুম্বক। এই পরমাণুগুলো মহাবিশ্বে সবদিকেই মুখ করে আছে এবং যে পরিমান আকর্ষণ পরস্পরের প্রতি প্রয়োগ করে একই পরিমান বিকর্ষণও প্রয়োগ করে। মোটের উপর এই দুই ধরনের বল পরষ্পরকে বাতিল করে দেয় এবং সার্বিকভাবে আমরা তাই মহাবিশ্বে খুব একটা চৌম্বক আকর্ষণ বা বিকর্ষণ বল অনুভব করি না।
অপরদিকে মহাকর্ষ কেবল আকর্ষণ বল হওয়ায় শুধুই পরিমানে বাড়তে পারে। যদিও মহাকর্ষ খুবই দুর্বল বল হওয়ায় সাধারণ বস্তুসমূহে এমনটি পাহাড়-পর্বতেও তার অস্তিত্ত্ব সহজে অনুভব করা যায় না। তবে যখন আপনি পৃথিবী ও সূর্যের মত আকারের বস্তুর কথা ভাববেন তখন সেখানে মহাকর্ষ বল পাবেন প্রকান্ড রকমের।
তারপরেও চৌম্বকত্বের ভুমিকা অনস্বীকার্য। ধরে নিন আপনি একটি চুম্বকে পরিণত হওয়া ইস্পাত দন্ডের উপরে একটি শক্ত কাগজ রাখলেন। এরপর কিছু লোহার গুড়ো কাগজের উপর ছড়িয়ে টোকা দিলেন। এই টোকায় লোহার গুড়োগুলো চৌম্বকের সাপেক্ষে সরে গিয়ে কিছু বিশেষ অবস্থান গ্রহণ করবে। শেষ পর্যন্ত দেখা যাবে লোহার গুড়োগুলো কিছু বাঁকা রেখায় নিজেদেরকে সাজিয়ে নিয়েছে যেগুলো চুম্বকের এক মেরু হতে অপর মেরু পর্যন্ত বিস্তৃত। পেরেগ্রিনাস এই ঘটনাটি প্রথম দেখতে পেলেন এবং পরবর্তীতে ১৮৩১ সালে ইংলিশ বিজ্ঞানী মাইকেল ফ্যারাডে (Michael Faraday, ১৭৯১-১৮৬৭) এই ব্যাপরটি আমলে নিয়ে কাজ শুরু করেছিলেন।
ফ্যারাডের কাছে মনে হয়েছে চৌম্বকত্বের প্রভাব স্থানের মধ্য দিয়ে সর্বত্র প্রসারিত যা বিপরীত বর্গীয় সূত্রের মাধ্যমে দুরত্বের সাথে সাথে ধীরে ধীরে কমতে থাকে। এই স্থানের মধ্য দিয়ে কেউ চাইলে বিপুল সংখ্যক রেখা (চৌম্বক বলরেখা) আঁকতে পারে যেসব এলাকায় চৌম্বক ক্ষেত্র একই হবে। লোহার গুড়ো চৌম্বকক্ষেত্রের এই রেখা বরাবর নিজেদের বিন্যাস্ত করে যার ফলে রেখাগুলো দৃশ্যমান হয়।
এই কারনেই কম্পাসের ভিতরে চৌম্বক শলাকা উত্তর এবং দক্ষিন দিক নির্দেশ করে। পৃথিবী নিজেই একটি চুম্বক এবং শলাকাগুলো এই চৌম্বক রেখা বরাবর নিজেদের বিন্যাস্ত করে যা পৃথিবীর এক মেরু হতে বের হয়ে অপর মেরুতে গমন করে (পৃথিবীর চৌম্বক মেরু দু’টি একেবারে উত্তরে আর একেবারে দক্ষিণে। তবে তা ভৌগলিক উত্তর ও দক্ষিন মেরু হতে বেশ খানিকটা দূরে দূরে)। চৌম্বকক্ষেত্র এবং বলরেখা ধরে নিলে বেশ কিছু বাস্তবতাকে সহজেই ব্যাখ্যা করা যায় এবং ফ্যারাডের এই মনোভাব অদ্যাবধি বহুল প্রচলিত। (মহাকর্ষের এবং তড়িতের বলক্ষেত্র আছে এবং বলরেখার বিষয়টি সেসব ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য)।
এর মধ্যে বিদ্যুতের বিষয়টিরই বা ফলাফল কী? ইংলিশ পদার্থবিদ উইলিয়াম গিলবার্ট (William Gilbert, ১৫৪৪-১৬০৩) থ্যালেসের গবেষনাকে বিস্তৃত করেন। তিনি ১৬০০ সালে প্রকাশিত একটি বইতে ব্যাখ্যা করেন যে এ্যাম্বার ছাড়াও অন্যান্য বস্তুও ঘর্ষনের ফলে হালকা বস্তুকে আকর্ষণ করতে পারে। গিলবার্ট এই ধরনের সকল বস্তুকে নাম দিলেন ইলেক্ট্রিক (electric বা তাড়িতিক বা বৈদ্যুতিক)।
১৭৩৩ সালে ফরাসী রসায়নবিদ চার্লস ফ্রান্সোয়া দ্যা সিস্টার্নি দ্যুফে (Charles Fran�ois de Cisternay Dufay, ১৬৯৮-১৭৩৯) কাচ দন্ড এবং রেজিন নিয়ে পরীক্ষা করলেন যাদের উভয়টিকেই বিদ্যুতায়িত করা গিয়েছিলো। ঘর্ষনের ফলে তাদের উভয়টিই হালকা বস্তুকে আকর্ষনে সক্ষম হলো। উভয়েই ছোট ছোট শোলার টুকরাকে আকর্ষণ করল যেটুকরোগুলো ফলশ্রুতিতে তড়িতায়িত হয়েছিলো।
কাচের মাধ্যমে বিদ্যুতায়িত একটুকরো শোলা, রেজিনের মাধ্যমে তড়িতায়িত এক টুকরো শোলাকে আকর্ষণ করে। কিন্তু উভয় শোলার টুকরো যদি শুধু কাচের মাধ্যমে কিংবা শুধু রেজিনের মাধ্যমে বিদ্যুতায়িত করা হয় তাহলে দেখা যায় যে তারা পরস্পরকে বিকর্ষণ করছে। দ্যুফে তাই উপসংহার টানলেন এই ভেবে যে বিদ্যুৎ আসলে দুই প্রকার। একপ্রকার পরস্পরকে বিকর্ষণ করে কিন্তু অন্যপ্রকারকে আকর্ষণ করে, যেমনটি দেখা যায় দুইধরনের চৌম্বক মেরুর ক্ষেত্রে।
আমেরিকান পন্ডিন বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন (Benjamin Franklin, ১৭০৬-১৭৯০) এই বিষয়টিকে আরেকধাপ এগিয়ে নিলেন। তিনি প্রস্তাব করলেন বিদ্যুৎ আসলে এক রকমই যা প্রতিটি বস্তু স্বাভাবিক ভাবে একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় ধারন করে কিন্তু শনাক্ত করা যায় না। যদি কোনো নির্দিষ্ট বস্তুকে ঘষা হয় তাহলে কিছু পরিমান বিদ্যুৎ সরে যায়, আর অন্য কোন নির্দিষ্ট বস্তুতে ঘষা হলে তাকে কিছু পরিমান বিদ্যূৎ যুক্ত হয়। যেসব বস্তুতে অতিরিক্ত বিদ্যুৎ যুক্ত হয় সেগুলোকে ধনাত্মক, আর যেসব বস্তু হতে বিদ্যুৎ সরে যায় সেগুলোকে ঋনাত্মক বলা যায়।
এই পরিস্থিতিতে, একটি ধনাত্মকভাবে চার্জযুক্ত বস্তু একটি ঋনাত্মক ভাবে চার্জযুক্ত বস্তুকে আকর্ষণ করতে পারে কেননা তাদের সান্নিধ্য পরস্পর চার্জের আদান প্রদানের সুযোগ তৈরি করে যাতে একবস্তু থেকে অতিরিক্ত চার্জ অপর বস্তুতে গিয়ে তার ঘাটতি প্রশমিত করতে পারে। দু’টি বস্তু পরস্পরকে নিষ্ক্রিয় করে দিয়ে চার্জহীন অবস্থায় পরিণত হবে। (ফ্রাঙ্কলিন তাঁর পরীক্ষায় এই চার্জহীন অবস্থা পর্যবেক্ষণ করেন)। অপরদিকে দু’টি ধনাত্মক চার্জযুক্ত বস্তু পরস্পরকে বিকর্ষণ করবে যেমনটি করবে দু’টি ঋনাত্মক চার্জ বিশিষ্ট বস্তু। কেননা এই উভয় ক্ষেত্রে একবস্তু থেকে অপরবস্তুতে চার্জ স্থানান্তরিত হয়ে তাদের প্রশমিত করার সুযোগ নেই।
ফ্রাঙ্কলিনের কাছে শুধু এই সিদ্ধান্তই নেওয়ার মতো থাকলে যে তিনি দুই ধরনের বস্তুর মধ্যে কোনটিকে অতিরিক্ত চার্জ যুক্ত আর কোনটিকে ঘাটতি বিশিষ্ট আখ্যা দেবেন। সেই সময় এটি বলার কোনো উপায় ছিলো না তাই ফ্রাঙ্কলিন দৈবভাবে তা বাছাই করলেন। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, ঘষা কাচে অতিরিক্ত চার্জ আছে তাই ধনাত্মক (positive, +) বলে ধরতে হবে আর ঘষা রেজিনের মধ্যে চার্জের ঘাটতি আছে তাই ঋনাত্মক (negative, -) হিসেবে গন্য হবে।
সেই থেকে আজ পর্যন্ত যেসব মানুষ বিদ্যুৎপ্রবাহ নিয়ে কাজ করেন তাঁরা ধরে নিয়েছেন বিদ্যুৎ ধনাত্মক হতে ঋনাত্মকের দিকে প্রবাহিত হয়। দুর্ভাগ্যবশতঃ ফ্রাঙ্কলিনের সঠিক অনুমানের ব্যাপারে ফিপটি-ফিপটি সম্ভবনা ছিলো, এবং তাঁর অনুমান ভুল বলে প্রামানীত হলো। রেসিন দন্ডই ছিলো প্রকৃতপক্ষে অতিরিক্ত চার্জ বিশিষ্ট তাই বিদ্যুৎ আসলে ঋনাত্মক প্রান্ত হতে ধনাত্মক প্রান্ত বরাবর প্রবাহিত হয়। তবে তড়িৎ প্রকৌশলে এতে কিছু যায় আসে না। আপনি প্রবাহের যে দিকই ধরে নিন না কেন ফলাফল একই হবে যদি না আপনি মাঝ পথে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে অন্য কিছু ধরে নেন।
Leave a Reply