পরমাণুর অাভ্যন্তরীন মহাবিশ্বে ভ্রমণ
মূল: আইজ্যাক আসিমভ
অধ্যায়-২ : আলো
অনুচ্ছেদ-৪: বর্ণালীর বিবর্ধন
ম্যাক্সওয়েল তাঁর সমীকরণে কোনো ক্ষেত্রের তরঙ্গের স্পন্দনকাল সম্পর্ক কোনো সীমাবদ্ধতা রাখেন নি। একটি স্পন্দনের সময় এক সেকেন্ডেরও কম হতে পারে, সেই ক্ষেত্রে তরঙ্গের দৈর্ঘ্য হবে তিন লক্ষ কিলোমিটার বা তার চেয়ে বেশী। এমনি প্রতি সেকেন্ডে ডেসিলিয়ন পরিমান (১০^৩০) স্পন্দনও হতে পারে যেই ক্ষেত্রে একেকটি তরঙ্গদৈর্ঘ্য হবে এক সেন্টিমিটারের ট্রিলিয়নের ট্রিলিয়নের ভগ্নাংশ। এবং এর মধ্যবর্তী যেকোন মানই গ্রহণযোগ্য হতে পারে। আমরা যে আলো দেখি সেই আলোর তরঙ্গ যদিও এই সম্ভাবনার অত্যন্ত ক্ষুদ্র একটি অংশের প্রতিনিধিত্ব করে। সবচেয়ে দীর্ঘ দৃশ্যমান আলোক তরঙ্গের দৈর্ঘ্য হচ্ছে ০.০০০৭ মিলিমিটার, এবং সবচেয়ে ক্ষুদ্রটির তরঙ্গ দৈর্ঘ্য হচ্ছে এই দৈর্ঘটির অর্ধেক। এ থেকে কি বোঝা যায় এমন অনেক তড়িৎচৌম্বক বিকিরণ আছে যা আমরা দেখি না?
তবে সমগ্র মানব ইতিহাসে এই প্রশ্নটি স্ববিরোধী হিসেবেই দেখা হয়েছে যে, এমন কোনো আলো আছে কিনা যা আমরা দেখি না? কেননা, সংজ্ঞা অনুযায়ী, আলো তাকেই বলা হয় যা দেখা যায়। জার্মান-ব্রিটিশ জোতির্বিদ উইলিয়াম হার্শেল ১৮০০ সালে প্রথমবারের মতো দেখালেন এটি আসলে স্ববিরোধী নয়। সেই সময় ধারনা ছিলো যে সূর্য হতে প্রাপ্ত আলো এবং তাপ দু’টি ভিন্ন ধরনের ঘটনা। হার্শেল ভেবেছিলেন যদি আলোর মত তাপকেও আলাদা বর্ণালীতে বিশ্লেষন করা যেতো।
কিন্তু তাপের বিশ্লেষণ করা যায় নি। তাপ বেগুনী রংয়ের দিক থেকে ক্রমান্বয়ে লালের দিকে যেতে যেতে ক্রমশঃ বৃদ্ধি পেতে থাকে। এবং লালের একেবারে প্রান্তে গিয়ে সর্বোচ্চ হয়। চমৎকৃত হয়ে হার্শেল চিন্তা করলেন যদি থার্মোমিটারের বাল্বটিকে লালের পরে স্থাপন করা হয় তাহলে কী ঘটতে পারে? আরো বেশী চমৎকৃতির সাথে তিনি আবিষ্কার করলেন থার্মোমিটারের তাপমাত্রা দৃশ্যমান অংশের আলোর যেকোনো অংশের চেয়ে আরো বেড়ে যাচ্ছে। হার্শেল ভাবলেন তিনি তাপীয় তরঙ্গ শনাক্ত করেছেন।
এই পর্যবেক্ষণের কয়েক বছরের মধ্যেই অবশ্য আলোর তরঙ্গ তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছিলো এবং আরো ভালো ব্যাখ্যা দেওয়া তাই সম্ভব ছিলো। সূর্যালোক একটি নির্দিষ্ট সীমার তরঙ্গদৈর্ঘ্য ধারন করে যা একটি প্রিজমের মাধ্যমে বিশ্লেষণ করা যায়। আমাদের রেটিনা একটি নির্দিষ্ট সীমার তরঙ্গদৈর্ঘ্যের প্রতি প্রতিক্রিয়া দেখায় কিন্তু সূর্যালোক সেই সীমার বাইরে, লালের চেয়েও বড় তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো ধারন করে এবং তাই এদেরকে বর্ণালীর লাল আলোর সীমার বাইরেও পাওয়া যায়। আমাদের চোখ এতো দীর্ঘ তরঙ্গদৈর্ঘ্যের প্রতি কোনো সাড়া দেয় না তাই আমরা তাদের দেখি না কিন্তু যেভাবেই হোক তাদের উপস্থিতি আছে। এদের বলা হয় অবলাল (infrared, infra উপসর্গটি ল্যাটিন হতে এসেছে যার অর্থ ‘নীচে’ যদি আপনি বেগুনী থেকে লালকে উপর থেকে নীচের দিকে দেখে থাকেন।)
সকল আলোই যখন চামড়ায় আঘাত করে তখন হয় প্রতিফলিত হয় অথবা শোষিত হয়। যখন শোষিত হয় তখন এর শক্তি আমাদের চামড়ার অণুগুলোর গতিবৃদ্ধি করে তাই আমরা তাপ অনুভব করি। আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য যতো বেশী হয় ততোই এটি আমাদের চামড়া বেশী ভেদ করতে পারে তাই শোষিতও হয় বেশী। এই কারনে যদিও আমরা অবলাল দেখিনা আমরা এটিকে তাপ হিসেবে অনুভব করতে পারি। এবং একই কারনে থার্মোমিটারেও এর প্রতি সাড়া পাওয়া যায়।
যদি দেখানো যেতো অবলাল সত্যিই তরঙ্গ দিয়ে গঠিত যার তরঙ্গদৈর্ঘ্য লাল আলোর চেয়ে বেশী তাহলে নিশ্চয় ভালোই হতো । কেউ চাইলে দু’টি চিরের মধ্য দিয়ে অবলাল আলো চালিয়ে হয়তো ইন্টারফেরেন্স ডোরা পেতে পারে কিন্তু সেগুলো সে দেখতে পাবে না। হয়তোবা এগুলোকে থার্মোমিটারের মাধ্যমে শনাক্ত করা যেতে পারে যেখানে উজ্জ্বল ডোরায় উচ্চ তাপমাত্রা এবং অনুজ্জ্বল ডোরায় নিন্ম তাপমাত্রা দেখাবে।
১৮৩০ সালে ইতালিয় পদার্থবিদ লিওপোলদো নোবিলি (Leopoldo Nobili ১৭৮৪-১৮৩৫) একটি থার্মোমিটার উদ্ভাবন করলেন যা এই কাজের জন্য উপযুক্ত। তাঁর একজন সহকর্মী ছিলেন ইতালিয় পদার্থবিদ মেসিডোনিও মেলোনি (Macedonio Melloni, ১৭৯৮-১৮৫৪)। যেহেতু কাচ অবলাল রশ্মির একটি বড় অংশ শোষন করে নেয় তাই মেলোনি কাচের বদলে রকসল্টের প্রিজম ব্যবহার শুরু করলেন যা অবলাল রশ্মির জন্য স্বচ্ছ। ফলশ্রুতিতে ইন্টারফেরেন্স ডোরা উৎপন্ন হলো এবং নোবিলির থার্মোমিটারে তাপমাত্রার হ্রাস বৃদ্ধি পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে সেগুলোর উপস্থিতি প্রমাণিত হলো। মেলোনি দেখালেন যে অবলাল রশ্মি কোনো রকম ব্যাক্তিক্রম ছাড়াই আলোর সব বৈশিষ্ট্য ধারন করে- শুধুমাত্র পার্থক্য হলো এদের খালি চোখে দেখা যায় না।
বর্ণালীর অন্যপ্রান্তের অবস্থা কী, যেপাশে বেগুনী আলো অন্ধকারে মিলিয়ে যায়? এই অংশের গল্পের শুরু ১৬১৪ সালে, যখন ইতালিয় রসায়নবিদ এনজেলো সালা (Angelo Sala, ১৫৭৬-১৬৩৭) দেখতে পেলেন একটি পরোপুরি সাদা যৌগ সিলভার ক্লোরাইড সূর্যালোকে উন্মুক্ত রাখলে কালো হয়ে যায়। এখন আমরা জানি কেন এমন হয়; আলোর শক্তি আছে এবং তা সিলভার ক্লোরাইডের অণুকে ভেঙ্গে সিলভারের সূক্ষ গুড়া উৎপন্ন করে যা কালো দেখায়।
আনুমানিক ১৭৭০ সারে সুইডিশ রসায়নবিদ কার্ল উইলহেম শিলে (Karl Wilhelm Scheele, ১৭৪২-১৭৮৬) সৌর বর্ণালী ব্যবহারের মাধ্যমে এই বিষয়ের আরো গভীরে গেলেন যা সালা-র সময়ে অজ্ঞাত ছিলো। তিনি চিকন সাদা কাগজের ফালিকে সিলভার নাইট্রেটের দ্রবণে সিক্ত করে শুকিয়ে নিলেন এবং বর্ণালীর বিভিন্ন স্থানে রাখলেন। তিনি দেখলেন কাগজের ফালিটি লাল আলোর নিচে সবচেয়ে ধীরে কালো হয় এবং লাল আলো থেকে যতোই দূরে নেওয়া হয় এবং বেগুনী আলোর যতোই কাছে নেওয়া হয় ততোই দ্রুত রং বদলায়। বেগুনী আলোতে রং বদলায় সবচেয়ে তাড়াতাড়ি। লাল থেকে বেগুনীর দিকে আলোর শক্তি বৃদ্ধি পায় বলেই এধরনের ঘটনা ঘটে (আমরা এখন তা জানি যার কারনগুলো পরবর্তীতে আলোচনা করা হবে)।
হার্শেল ১৮১০ সালে অবলাল রশ্মি আবিষ্কার করা মাত্রই জার্মান রসায়নবিদ জন উইলহেম রিটার (Johann Wilhelm Ritter, ১৭৭৬-১৮১০) বর্ণালীর অন্যপ্রান্ত পরীক্ষা করে দেখতে উৎসাহিত হলেন। ১৮০১ সালে তিনি কাগজের টুকরোকে সিলভার নাইট্রেট দ্রবনে সিক্ত করে শিলে’র পরীক্ষাটির পুনরাবৃত্তি করেন তবে তিনি কাগজের ফালিকে স্থাপন করলেন বেগুনী আলোর বাইরে যেখানে কোনো আলো দৃশ্যমান ছিলো না। তিনি যেমনটি হতে পারে বলে আশা করেছিলেন, কাগজের ফালিটি আলোবিহীন স্থানে বেগুনী আলোর চেয়ে আরো দ্রুততায় কালো হয়ে গেলো। এই ঘটনা অতিবেগুনী (ultraviolet) রশ্মির জন্ম দিলো যেখানে ল্যাটিন ভাষায় ultra উপসর্গটির মানে হচ্ছে ‘ছাড়িয়ে (beyond)’।
অবলাল এবং অতিবেগুনী রশ্মির উপস্থিতি পাওয়া গিয়েছিলো বর্ণালির ঠিক কিনারা বরাবর। ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণ অনুযায়ী বিকিরণ কিনারা ছাড়িয়ে আরো অনেক দূর অবধি পাওয়া যাওয়ার কথা। যদি এই ধরনের বিকিরণ পাওয়া যেত তাহলে ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণগুলো আরো প্রবলভাবে সমর্থিত হতো, তবে এই সমীকরণগুলো ছাড়া কেউ হয়তো ভাবতেও পারত না যে এধরনের বিকিরণের অস্তিত্ব থাকতে পারে।
১৮৮৮ সালে, জার্মান পদার্থবিদ হেইনরিখ রুডলফ হার্জ (Heinrich Rudolf Hertz, ১৮৫৭-১৯৮৪) মাঝে ফাঁক বিশিষ্ট একটি চারকোণা তার ব্যবহার করেছিলেন শনাক্তকারী (ডিটেক্টর) যন্ত্র হিসেবে। তিনি তাঁর গবেষণাগারে একটি স্পন্দনযোগ্য বিদ্যুৎপ্রবাহ স্থাপন করেন। যেহেতু বিদ্যুৎ প্রবাহ স্পন্দিত অবস্থায় রাখা ছিলো তাই এর মধ্য থেকে এক ধরনের বিকিরন উৎপন্ন হওয়ার কথা; বিদ্যুৎ যখন এক দিকে চলমান থাকবে তখন বিকিরণের ঢেউ যদি উপরের দিকে উঠে থাকে তাহলে বিপরীত দিকে প্রবাহ শুরু হলে ঢেউ নীচের দিকে নামার কথা। এই ধরনের বিকিরণের তরঙ্গদৈর্ঘ্য অনেক দীর্ঘ হওয়ার কথা। কেননা, যদিও বিদ্যুতের দিকপরিবর্তনের হার অনেক বেশীও হয় প্রতিটি স্পন্দনের সাথে সাথে তুলনামূলকভাবে আলো অনেক দূরে চলে যায়।
যদি তড়িৎচৌম্বক তরঙ্গ হার্জের চারকোণা ডিটেক্টরটিকে অতিক্রম করে তাহলে সেই তারের মধ্যে কিছুটা বিদ্যুৎপ্রবাহ উৎপন্ন হওয়ার কথা এবং ডিটেক্টরের ফাঁকা স্থানে স্ফুলিঙ্গ তৈরি হওয়ার কথা। হার্জ তাঁর ধারনা অনুযায়ী স্ফুলিঙ্গ পেলেন। একই সাথে তিনি সেই কক্ষের বিভিন্ন স্থানে স্ফুলিঙ্গ পেলেন যেখানে বিকরণের ঢেউ খুব উচ্চ বিস্তারে কিংবা খুব নিন্ম বিস্তারে থাকে, কিন্তু এই দুটির মাঝামাঝি অবস্থায় কোনো স্ফুলিঙ্গ পেলেন না। এই পদ্ধতিতে তিনি তরঙ্গের নকশার লেখচিত্র পেলেন এবং এর দৈর্ঘ্য নির্নয় করতে সক্ষম হলেন।
হার্জ যে তরঙ্গ আবিষ্কার করেছিলেন তা হচ্ছে বেতার তরঙ্গ যা অবলাল বিকিরণের সীমার চেয়ে আরো অনেক অনেক দূরে অবস্থান করে এবং এদের তরঙ্গদৈর্ঘ্য হয় কয়েক সেন্টিমিটার থেকে কয়েক কিলোমিটার পর্যন্ত।
এই ঘটনার পর ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণগুলোকে আর কেউ প্রশ্নবিদ্ধ করেনি। যদি উজ্জ্বল ইথার থেকে থাকে তাহলে তা তড়িৎ এবং চৌম্বকত্বও ধারন করে। যদি এর বাইরে আর কোনো ইথার থেকে থাকে তাহলে তা শুধু মাত্র মহাকর্ষের জন্যই বিদ্যমান।
১৮৯৫ সালে অতিবেগুনী রশ্মির সীমার চেয়ে অনেক অনেক অগ্রবর্তী স্থানে তড়িৎচৌম্বক তরঙ্গ আবিষ্কৃত হলো যার তরঙ্গদৈর্ঘ্য মাত্রাতিরিক্ত ছোট; তবে আমরা এই বিষয়টিতে আরো পরে আসব। তার আগে আরো কিছু বিষয় আলোচনা করে নিতে হবে।
Leave a Reply