পরমাণুর অাভ্যন্তরীন মহাবিশ্বে ভ্রমণ
মূল: আইজ্যাক আসিমভ
অধ্যায়-২ : আলো
অনুচ্ছেদ-৫: শক্তির বিভাজন
তড়িৎ, চৌম্বকত্ব, আলো এবং মহাকর্ষ এসবই শক্তির বিভিন্ন রূপ যাদের মাধ্যমে কোনো কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব। এদের একটির চেয়ে আরেকটিকে খুবই ভিন্ন ধরনের মনে হলেও একটিকে অন্যটিতে রূপান্তর করা যায়। যেমনটি আমরা এরই মধ্যে দেখেছি বিদ্যুৎকে চৌম্বকত্বে রূপান্তর করা যায় যা এর বিপরীত প্রক্রিয়ার জন্যও প্রযোজ্য এবং একটি স্পন্দিত তড়িৎচৌম্বক ক্ষেত্র আলো উৎপন্ন করতে পারে। মহাকর্ষের প্রভাবে পানির পতন ঘটানো যায়, যেই পতিত পানি একটি টারবাইনকে ঘোরানোর মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারে। তাপগতিবিদ্যায় শক্তি এবং এর পারষ্পরিক রূপান্তর সম্বন্ধে আলোচনা করা হয়।
এ ধরনের রূপান্তর কখনোই পরোপুরি দক্ষতার সাথে হয় না। প্রতিটি প্রক্রিয়ায় কিছু না কিছু শক্তি সর্বদাই হারিয়ে যায়। তবে হারিয়ে যাওয়া শক্তি উধাও হয়ে যায় না, বরং তাপে পরিণত হয় যা শক্তির আরেকটি রূপ। যদি তাপশক্তিকেও আমলে নেওয়া হয় তাহলে বলা হয় এই যাবৎ কোনো শক্তিই হারিয়ে যায় নি এবং কোথাও কোনো প্রকার শক্তি উৎপন্নও হয় নি। অন্য ভাষায়, এই মহাবিশ্বের মোট শক্তির পরিমান সুনির্দিষ্ট। এটিই হচ্ছে শক্তির নিত্যতা সূত্র, কিংবা তাপগতিবিদ্যার প্রথম সূত্র যা চূড়ান্তভাবে জার্মান পদার্থবিদ হারমান লুডভিগ ফার্দিনান্দ ভন হেলমহলজ্ (Hermann Ludwig Ferdinand von Helmholtz, ১৮২১৪-১৮৯৪) ১৮৪৭ সালে প্রতিষ্ঠিত করেন।
একভাবে দেখলে তাপ হচ্ছে শক্তির মৌলিক রূপ। যেকোন ভিন্ন রূপের শক্তিকে পুরোপুরিভাবে তাপে রূপান্তর করা যায় কিন্তু তাপকে সম্পূর্ণরূপে অপর শক্তিতে রূপান্তর করা যায় না। এই কারনে তাপগতি নিয়ে অধ্যয়ন করার জন্য তাপই হচ্ছে শক্তির সবচেয়ে সুবিধাজনক রূপ (তাপগতিবিদ্যা বা thermodynamics, গ্রীক ভাষায় যার অর্থ তাপের প্রবাহ)।
১৭৬৯ সালে যখন ব্রিটিশ ইঞ্জিনিয়ার জেমস ওয়াট (James Watt, ১৭৩৬-১৮১৯) কর্তৃক যখন প্রথম ব্যবহারিক বাষ্পীয় ইঞ্জিন উদ্ভাবিত হয় তার আগে থেকেই তাপ নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা হয়ে আসছে। তারপর যখন শক্তির সংরক্ষণশীলতার বিষয়ে মানুষ উপলব্ধি করতে সক্ষম হলো তখন থেকে এই গবেষনা আরো ব্যপকতা লাভ করেছে। বাষ্পীয় ইঞ্জিনের আবির্ভাবের পরবর্তী সময়ে তাপ নিয়ে দুই ধরনের তত্ত্ব প্রচলিত ছিলো। কিছু কিছু বিজ্ঞানী মনে করতেন তাপ একধরনের সূক্ষ প্রবাহী পদার্থ যা এক বস্তু থেকে অন্য বস্তুতে ভ্রমন করতে পারে। অন্যদল মনে করতেন তাপ হচ্ছে একধরনের গতি যা পদার্থের অণু এবং পরমাণুর নড়া-চড়া এবং স্পন্দনের সাথে সম্পর্কিত।
দ্বিতীয় ধারনাটি অর্থাৎ গতীয় (kinetic) তত্ত্বটি (গ্রীক ভাষায় kinetic অর্থ হচ্ছে গতি) শেষ পর্যন্ত যথার্থ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় যখন ম্যাক্সওয়েল এবং অপর একজন অস্ট্রীয় পদার্থবিদ লুডভিগ এডওয়ার্ড বোল্টজম্যান (Ludwig Eduard Boltzmann, ১৮৪৪-১৯০৬) গাণিতিক ভাবে তা উপস্থাপন করেন। তাঁরা দেখান যে যা কিছুই তাপ হিসেবে পরিচিত তার সবই অণু-পরমাণুর গতি বা স্পন্দনের মাধ্যমে সন্তোষজনকভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। যেমন গ্যাসের ক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাই, এর অণু-পরমাণুগুলোর গতি কিংবা স্পন্দনের গড়বেগই তাপমাত্রার পরিমাপ হিসেবে পাওয়া যায় যদি আমরা এর অণু-পরমাণুর ভরসমূহকেও আমলে নিই। যেকোনো বস্তুর গতিশীল কণাগুলোর মোট গতিশক্তিই (যা তার ভর এবং বেগ থেকে পাওয়া যায়) ওই বস্তুর মোট তাপের পরিমাপক।
স্বাভাবিক ভাবেই এখান থেকে বোঝা যাচ্ছে, একটি বস্তু যতোই ঠান্ডা হতে থাকবে তার অণু-পরমাণুগুলোর গতি ততোই কমতে থাকবে। এটি যদি যথেষ্ট পরিমান ঠান্ডা হয়ে যায় তাহলে এর কণাগুলোর গতিশক্তি একটি সর্বনিন্ম অবস্থায় পৌঁছাবে। এটিকে এরপর আর ঠান্ডা করা যাবে না এবং এর তাপমাত্রাও হয়ে যাবে পরমভাবে শূন্য। এই ধারনাটি প্রথম প্রস্তাব করেন এবং স্পষ্টভাবে প্রকাশ করেন ব্রিটিশ গণিতবিদ উইলিয়াম থমসন (William Thomson, ১৮২৪-১৯০৭) যিনি লর্ড কেলভিন নামেই সমাধিক পরিচিত। পরমশূন্যের (absolute zero) চেয়ে কোনো বস্তুর তাপমাত্রা সেলসিয়াস স্কেলে যত ডিগ্রি বেশী তা-ই হচ্ছে তার প্রকৃত বা পরম তাপমাত্রা। যদি পরম শূন্য তাপমাত্রা -২৭৫.১৬ oC হয় তাহলে ০ ডিগ্রি হবে ২৭৩.১৫ ০K (কেলভিন) অথবা ২৭৩.১৫ ০A (absoulte) (পরম তাপমাত্রা বোঝাতে এখন আর ডিগ্রি (০) প্রতীকটি ব্যবহার করা হয় না, তবে আসিমভের মূল বইতে এর ব্যবহার রয়েছে)।
যে কোনো বস্তু যার তাপমাত্রা তার পরিপার্শ্বের চেয়ে বেশী তা তড়িৎচৌম্বক তরঙ্গের বিকরণের মাধ্যমে তাপ হারিয়ে ফেলার প্রবণতা দেখায়। তাপমাত্রা যতো বেশী হয় বিকিরণও ততোই তীব্র হয়। ১৮৭৯ সালে অস্ট্রীয় পদার্থবিদ জোসেফ স্টেফান (Joseph Stefan, ১৮৩৫-১৮৯৩) এটি যথার্থভাবে তুলে ধরেন। তিনি দেখালেন যে, মোট বিকিরণ পরম তাপমাত্রার চতুর্থঘাতের সমানুপাতিক। অর্থাৎ, যদি পরম তাপমাত্রা দ্বিগুণ করা হয় (উদাহরণস্বরূপ ৩০০ k থেকে 600 K বা ২৭ ০C থেকে ৩২৭ ০C) তাহলে মোট বিকিরণ বৃদ্ধি পাবে ২ X ২ X ২ X ২ বা ১৬ গুণ।
ইতিপূর্বে আনুমানিক ১৮৬০ সালে জার্মান পদার্থবিদ গুস্তাভ রবার্ট কার্শফ (Gustav Robert Kirchhoff, ১৮২৪-১৮৮৭) প্রতিষ্ঠিত করেন যে কোনো বস্তুর তাপমাত্রা যদি তার পরিপার্শ্ব হতে কম হয় তাহলে তা নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো শোষন করে তাপমাত্রা বৃদ্ধি করে এবং একই ভাবে তাপমাত্রা পরিপার্শ্ব হতে বেশী হলে সেই একই তরঙ্গদৈর্ঘ্য বিকিরণের মাধ্যমে তাপমাত্রা হ্রাস করে। এর ফলশ্রুতিতে জানা গেলো যদি কোনো বস্তু সবরকম তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো শোষন করে (এদের ‘কৃষ্ণবস্তু (black body)’ বলা হয় যারা আপতিত আলোর কোনো অংশ প্রতিফলিত না করে সবটুকুই শোষন করে), উত্তপ্ত অবস্থায় সব তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোই বিকিরণ করে।
বস্তুতঃ এই বিশ্বের কোনো বস্তুই পুরোপুরি সব দৈর্ঘ্যের আলোক তরঙ্গ শোষণ করে না, তবে সরু গর্ত বিশিষ্ট একটি বস্তুর ক্ষেত্রে এমনটি ধরে নেওয়া যায়। কোন বিকিরণ যদি সেই সরু গর্তে ঢুকে যায় তাহলে তার পক্ষে পুনরায় বের হয়ে আসা সম্ভব হয় না এবং শেষ পর্যন্ত পুরোপুরি শোষিত হয়ে যায়। কাজেই এধরনের একটি বস্তুকে যখন উত্তপ্ত করা হয় তখন সবরকমের তরঙ্গদৈর্ঘ্যের কৃষ্ণবস্তু বিকিরণই সেই গর্তের ভেতর থেকে বের হয়ে আসার কথা।
১৮৯০ এর দশকে জার্মান পদার্থবিদ উইলহেম ভিন (Wilhelm Carl Werner Otto Fritz Franz Wien, ১৮৬৪-১৯২৮) সর্বপ্রথম এই ধারনার অগ্রগতি সাধন করেন। যখন তিনি কৃষ্ণবস্তু বিকিরণ নিয়ে কাজ করেন তিনি দেখতে পান যে আগের ধারনার সাথে মিল একটি বিশাল বিস্তৃতির তরঙ্গদৈর্ঘ্যের বিকিরণ নির্গত হচ্ছে এবং সবচেয়ে ক্ষূদ্র এবং সবচেয়ে বড় তরঙ্গদৈর্ঘ্যের বিকিরণের পরিমান খুব কম এবং এদের মাঝামাঝি মানের বিকিরণের পরিমান সবচেয়ে বেশী। ভিন দেখতে পেলেন, তাপমাত্রা বৃদ্ধির সাথে সাথে সর্বোচ্চ বিকিরণের তরঙ্গদৈর্ঘ্য ক্রমান্বয়ে কমতে থাকে। এই ঘটনা তিনি ১৮৯৫ সালে ঘোষনা করলেন।
স্টেফানের এবং ভীনের সূত্র আমাদের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার সাথে মিলে যায়। ধরা যাক, একটি বস্তুর তাপমাত্রা আমাদের শরীরের তাপমাত্রার চেয়ে সামান্য বেশী।আমরা যদি এই বস্তুটির কাছে আমাদের হাত রাখি তাহলে এই বস্তু থেকে বিকিরিত উষ্ণতা আমরা কিছুটা অনুভব করব। বস্তুর তাপমাত্রা বৃদ্ধি করলে বিকিরণ আরো তীব্র হয় এবং সর্বোচ্চ বিকিরণের তরঙ্গদৈর্ঘ্য কমতে থাকে। ফোটানো পানি পূর্ণ একটি কেতলি উষ্ণতা যথেষ্টই অনুভবযোগ্য হবে যদি আমরা আমাদের হাত এর কাছাকাছি নিই। যদি তাপমাত্রা বৃদ্ধি করা হতে থাকতে তাহলে একসময় তার তরঙ্গদৈর্ঘ্য এতোই ক্ষূদ্র হবে যে আমাদের চোখের রেটিনায় তা অনুভব করতে পারব। আমরা প্রথমে বস্তুটিকে লাল দেখব কেননা দৃশ্যমান আলোর সীমার মধ্যে লাল আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্যই সবচেয়ে বেশী এবং এই ধরনের আলোই তাপমাত্রা বৃদ্ধি করতে করতে প্রথমে নিঃসৃত হবে। যদিও স্বাভাবিকভাবে তখনো সর্বোচ্চ বিকিরণের তরঙ্গদৈর্ঘ্য থাকবে অবলাল সীমানায়। তবে এই অবস্থায় নির্গত তরঙ্গদৈর্ঘ্যের সীমার মধ্যে দৃশ্যমান আলোর লাল অংশ কিছুটা ঢুকে যাবে তাই এটি আমাদের দৃষ্টিগোচর হবে।
এরপরে তাপমাত্রা আরো বৃদ্ধির সাথে সাথে বস্তুটি আলো উজ্জ্বলতর হতে থাকবে এবং রংও বদলাতে থাকবে এবং তখন আরো বেশী বেশী ক্ষূদ্র তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো বিকিরিত হতে থাকবে। পর্যায়ক্রমে বস্তুটি যখন আরো বেশী তপ্ত হয়ে উঠবে তখন এর রং বদলাতে বদলাতে লাল থেকে কমলা তারপর হলুদ হতে থাকবে। পর্যায়ক্রমে যখন কোনো কিছুর তাপমাত্রা সূর্যপৃষ্ঠের তাপমাত্রার সমান হবে তখন তা সাদা তপ্ত অবস্থায় পৌঁছাবে যে অবস্থায় সর্বোচ্চ বিকিরণের তরঙ্গদৈর্ঘ্য হবে দৃশ্যমান আলোর সীমা। এটি যদি আরো উত্তপ্ত হতে থাকে তাহলে তার রং হবে নীলচে-সাদা (ধরে নিই যে আমাদের চোখ নষ্ট না করে আমরা এর দিকে তাকিয়ে থাকতে পারছি) কেননা এ্ই সময় এর সর্বোচ্চ বিকিরণের সীমা থাকবে অতিবেগুনীর এলাকায়।
তাপ/আলোর এই ক্রমপরিবর্তন উনিশ শতকের বিজ্ঞানীদের মধ্যে একটু সমস্যা সৃষ্টি করলো কেননা কৃষ্ণবস্তুর বিকিরণ অনুধাবন করাটা একটু কষ্টসাধ্য। ১৮৯০ এর দশকের শেষের দিকে ব্রিটিশ পদার্থবিদ জন উইলিয়াম স্ট্রাট (John William Strutt, লর্ড রেলে (Lord Rayleigh) নামে পরিচিত, ১৮৪২-১৯১৯) ধরে নিয়েছিলেন যে কৃষ্ণ বস্তুর ক্ষেত্রে প্রতিটি তরঙ্গদৈর্ঘ্যের জন্য বিকিরণের সুযোগ সমান এবং তাপমাত্রা বৃদ্ধির সাথে সাথে সর্বোচ্চ বিকিরণের তরঙ্গদৈর্ঘ্য সুষমভাবে পরিবর্তিত হবে। অনুমাননির্ভর হয়ে তিনি একটি সমীকরণও প্রতিষ্ঠিত করেন যেখানে তিনি দেখান কীভাবে দীর্ঘ তরঙ্গদৈর্ঘ্য হতে ক্ষুদ্র তরঙ্গদৈর্ঘ্যের দিকে যেতে যেতে বিরিরণ সুষমভাবে পরিবর্তিত হয়। যদিও এই সমীকরণে একটি মাঝামাঝি সর্বোচ্চ তীব্রতার তরঙ্গদৈর্ঘ্যের বিকিরণ দেখানো হয়নি যা তরঙ্গদৈর্ঘ্য হ্রাস পাওয়ার সাথে সাথে তীব্রতায় হ্রাস পেতে থাকে।
এর বদলে এই সমীকরণ থেকে দেখা গেলো যে তরঙ্গদৈর্ঘ্য যতোই ছোট হতে থাকবে তীব্রতা ততোই বৃদ্ধি পেতে থাকবে। এর মানে হচ্ছে যে কেউ অপেক্ষাকৃত ক্ষূদ্রতর তরঙ্গদৈর্ঘ্যে সহজেই বিকিরণ করতে পারবে। অতিরিক্ত তাপ খুব সহজেই বেগুনী, অতিবেগুনী কিংবা এর চেয়ে ছোট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের মাধ্যমে পাঠিয়ে দিতে পারবে। এই বিষয়টিকে মাঝে মাঝে ‘বেগুনী বিপর্যয়’ বলা হয়ে থাকে। কিন্তু বেগুনী বিপর্যয় কখনো ঘটতে দেখা যায় না তাই নিঃসন্দেহে রেলে’র চিন্তা-ভাবনায় কোনো কিছু ভুল হয়েছিলো। ভিন নিজেও একটি সমীকরণ প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন যদিও এটি ক্ষূদ্র তরঙ্গদৈর্ঘ্যের বিকিরণের বন্টনের ক্ষেত্রে যথার্থতা দেখায় কিন্তু দীর্ঘ তরঙ্গদৈর্ঘ্যের ক্ষেত্রে দেখায় না। দেখে মনে হয়, পদার্থবিদরা বিকিরণের সীমার অর্ধেকটা করে ব্যাখ্যা করতে পারছেন কিন্তু পুরো বিকিরণের সীমা একসাথে ব্যাখ্যা করতে পারছেন না।
অবশেষে জার্মান পদার্থবিদ ম্যাক্স কার্ল আর্নষ্ট লুডভিগ প্ল্যাঙ্ক (Max Karl Ernst Ludwig Planck, ১৮৫৮-১৯৪৭) এই সমস্যাটি আমলে নিলেন। তিনি মনে করলেন রেলে যেমনটি ভেবেছিলেন কৃষ্ণ বস্তু হতে সকল তরঙ্গদৈর্ঘ্যের বিকিরণের সম্ভবনা সমান এই ধারনায় কিছু একটা সমস্যা আছে। কেমন হয় যদি ক্ষূদ্রতর তরঙ্গদৈর্ঘ্য বিশিষ্ট বিকিরণের সম্ভবনা তুলনামূলকভাবে কম থাকে?
এই ব্যাপারটিকে একভাবে গ্রহণযোগ্যতা দেওয়া যায় যদি ধরে নেওয়া যায় যে শক্তি নিরবচ্ছিন্ন নয় এবং ইচ্ছামত চিরস্থায়ীভাবে ক্ষূদ্র থেকে ক্ষূদ্রতরভাবে ভাগ করা যায় না। (প্ল্যাঙ্কের সময়কাল পর্যন্ত পদার্থবিদরা শক্তিকে নিরবচ্ছিন্ন বলে অনুমোদন দিয়েছিলেন। কেউই কখনো কল্পনা করেন নি যে শক্তি এমন ক্ষূদ্র ক্ষূদ্র কণা দিয়ে গঠিত যাদের আর ভাগ করা যায় না।)
প্ল্যাঙ্ক মনে করলেন, শক্তির ক্ষূদ্রতম ভাগ তরঙ্গদৈর্ঘ্য হ্রাসের সাথে সাথে বড় হতে থাকে। এর মানে হচ্ছে একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় ক্ষূদ্র তরঙ্গদৈর্ঘ্য বিশিষ্ট বিকিরণের তীব্রতা বেশী থাকে যেমনটি রেলে ধারনা দিয়েছিলেন। কিন্তু পর্যায়ক্রমে, আরো ক্ষূদ্র তরঙ্গদৈর্ঘ্যের দিকে যেতে যেতে বিকিরণের ক্ষূদ্রতম অংশ যা প্রেরণ করা যায় তা এতো বড় হয়ে যায় যে, এতো বড় শক্তির এককে বিকিরিত করতে বেশ কষ্ট হয়। এই কারনেই বিকিরণের একটি সর্বোচ্চ সীমা থাকবে যেখানে বিকিরণ সর্বোচ্চ হবে এবং এরপর থেকে আরো ক্ষূদ্র তরঙ্গদৈর্ঘ্যের জন্য বিকিরণের পরিমান কমে যাবে।
তাপমাত্রা বৃদ্ধির সাথে সাথে যথন তাপের তীব্রতা বাড়তে থাকে তখন শক্তির অপেক্ষাকৃত বড় প্যাকেটগুলো পাঠানোও সহজ হয় এবং তাই সর্বোচ্চ বিকিরণের তরঙ্গদৈর্ঘ্য সরে যেতে পারে, যেটুকু সরে গেলে ভিনের সূত্র কার্যকর হয়। সংক্ষেপে বলা যায় প্ল্যাঙ্কের অনুমান কৃষ্ণবস্তু বিকিরণের সমস্যার পুরোপুরি সমাধান করল। প্ল্যাঙ্ক এসব ক্ষূদ্র শক্তির এককের নাম দিলেন কোয়ান্টা (quanta, একবচনে quantum; ল্যাটিন ভাষায় যার অর্থ ‘কী পরিমান?’)। এরপর সমস্যা শুধু একটাই থেকে গেলো আর তা হচ্ছে বিভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্যের একেকটি কোয়ান্টায় আসলে কী পরিমান শক্তি থাকে।
১৯০০ সালে প্ল্যাঙ্ক তাঁর কোয়ান্টাম তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত করেন যা একই সাথে কৃষ্ণবস্তুর উচ্চ ও নিন্মতরঙ্গদৈর্ঘ্যের বিকিরণ ব্যাখ্যা করে। এই তত্ত্বটি পরবর্তীতে এতোই গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণিত হয়েছে যে, প্ল্যাঙ্ক তাঁর সময়ে কখনো কল্পনাও করতে পারেন নি যে ১৯০০ সালের পূর্ববর্তী সমগ্র পদার্থবিজ্ঞানকে বলা হবে ক্লাসিকাল পদার্থ বিজ্ঞান এর এর পরবর্তী কালের পদার্থবিজ্ঞানকে বলা হবে আধুনিক পদার্থবিজ্ঞান। কৃষ্ণবস্তু নিয়ে এই গবেষণার জন্য ভিন ১৯১১ সালে এবং প্ল্যাঙ্ক ১৯১৮ সালে নোবেল পুরষ্কার পান।
Leave a Reply