অধ্যায়-৩ : ইলেক্ট্রন
অনুচ্ছেদ-৩: এক্স রে
আগের অধ্যায়ে আমি উল্ল্যেখ করেছিলাম তড়িৎ-চৌম্বক তরঙ্গ অতিবেগুনীর সীমা ছাড়িয়ে ক্রমান্বয়ে আরো ক্ষূদ্রতর তরঙ্গের দিকেও আবিষ্কৃত হয়। এই বিষয়ে আমি সেখানে বিস্তারিত আলোচনা করিনি তবে এখন আলোচনা করার সময় চলে এসেছে।
১৮৯০ এর দশকে জার্মান পদার্থবিদ উইলহেম কোনার্ড রন্টজেন (Wilhelm Konrad Roentgen, ১৮৪৫-১৯২৩) তাঁর নিজস্ব স্বকীয় পন্থায় ক্যাথোড রে নিয়ে গবেষনা করছিলেন। হার্জ এবং থমসনের মত তিনি এদের প্রকৃতি সম্বন্ধে সচেতন ছিলেন না তবে বিশেষ বিশেষ রাসায়নিক দ্রব্যের উপর এদের প্রভাব সম্বন্ধে অবগত ছিলেন। ক্যাথেড রে এই দ্রব্যগুলোর উপর আঘাত হেনে এদের মধ্যে ঔজ্জ্বল্য তৈরি করে। এর মানে হচ্ছে রাসায়নিক দ্রব্যগুলো ক্যাথোড রে থেকে শক্তি গ্রহণ করে এবং এরপর দৃশ্যমান আলো রূপে এই শক্তি ত্যাগ করে।
যেসব বস্তু ক্যাথোড রে-এর আঘাতে ঔজ্জ্বল্য প্রদর্শন করে তাদের মধ্যে একটি হচ্ছে বেরিয়াম প্লাটিনোসায়ানাইড। রন্টজেনের ল্যাবরেটরিতে এই যৌগের প্রলেপ দেওয়া কাগজ ছিলো।
এই ঔজ্জ্বল্য খুবই অকিঞ্চিৎকর ছিলো তাই যথাসম্ভব ভালোভাবে পর্যবেক্ষণের জন্য রন্টজেন ঘর অন্ধকার করে রাখেন এবং তাঁর পরীক্ষাসংক্রান্ত যন্ত্রপাতি কালো কার্ডবোর্ডের পাত দিয়ে ঢেকে রাখেন। এই অবস্থায় তিনি যন্ত্রপাতির ভেতরে উঁকি দিতে পারেন যা সম্পূর্ন অন্ধকার এবং যখন তিনি বিদ্যুৎপ্রবাহ চালু করেন তখন টিউবের মধ্য দিয়ে ক্যাথোড রে অতিক্রম করে এবং রাসায়নিক প্রলেপ দেওয়া এক টুকরো কাগজের উপর পড়ে ঔজ্জ্বল্য তৈরি করে যা তিনি দেখতে পান এবং পর্যালোচনা করতে পারেন।
১৮৯৫ সালের ৫ নভেম্বর রন্টজেন বিদ্যুৎপ্রবাহ চালু করলেন এবং করা মাত্রই ক্ষীণ একটি আলোর ঝলক তাঁর চোখে পড়ে যার উৎস যন্ত্রপাতির ভিতরে ছিলো না। তিনি ভালোভাবে তাকালেন এবং দেখলেন যন্ত্রপাতি থেকে বেশ খানিকটা দূরে বেরিয়াম প্লাটিনোসায়নাইডে প্রলেপিত কাগজে ঈষৎ উজ্জ্বল্য দেখা গেলো।
রন্টজেন বিদ্যুৎপ্রবাহ বন্ধ করলেন এবং প্রলেপিত কাগজ আবার কালো দেখালো। তিনি বিদ্যুৎ চালু করলেন এবং প্রলেপিত কাগজ আবার উজ্জ্বল হলো। তিনি কাগজটিকে অন্য কক্ষে নিয়ে গেলেন এবং অন্ধাকার করার জন্য পর্দা ফেলে দিলেন। যখন তিনি ক্যাথোড রে টিউব চালু করলেন তখন এই কক্ষে রাখা প্রলেপিত কাগজ আবার উজ্জ্বল হলো।
রন্টজেন সিদ্ধান্ত নিলেন যে, ক্যাথোড রে টিউব এমন বিকিরণ উৎপন্ন করছে যা ক্যাথোড রে নয়- এই বিকিরণ কার্ডবোর্ড এমনকি দুটি কক্ষের মধ্যবর্তী দেয়াল ভেদ করে যেতে পারে, যা ক্যাথোড রে পারে না। তিনি এই নতুন বিকিরণের উপর তাঁর প্রথম রিপোর্ট প্রকাশ করলেন ১৮৯৫ সালের ২৮ ডিসেম্বর এবং যেহেতু এই বিকিরণের প্রকৃতি সম্বন্ধে তিনি কিছুই জানতেন না তাই তিনি একে এক্স রে (X ray) বলে ডাকলেন। এরপর থেকে চিরদিনের জন্য নামটি এই বিকিরণের সাথে যুক্ত হয়ে গেলো। এই আবিষ্কারের জন্য রন্টজেন ১৯০১ সালে নোবেল পুরষ্কার পেলেন যে বছর থেকেই নোবেল পুরষ্কার দেওয়া শুরু হয়েছে।
আলো নিয়ে গবেষণার শুরুর দিকে যেমন সমস্যা হয়েছিলো আলোর প্রকৃতি নিয়ে কিংবা পরবর্তীতে ক্যাথোড রে নিয়ে, এই অবস্থায় এক্স রে নিয়েও একই সমস্যা আর অনিশ্চয়তায় পড়া গেল ।কিছু পদার্থবিদ ভাবলেন এক্স রে হচ্ছে কণিকার বিচ্ছুরণ, কেউ ভাবলেন এরা আসলে তরঙ্গ।যাঁরা এগুলোকে তরঙ্গ ভেবেছিলেন (রন্টজেন নিজেও এই দলের অন্তর্গত) তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ মনে করলেন এগুলো অনুদৈর্ঘ্য তরঙ্গ, শব্দের তরঙ্গের মতো। অন্যরা ধারনা করলেন এগুলো অনুপ্রস্থ তরঙ্গ, আলোর তরঙ্গের মতো। যদি এগুলো অনুপ্রস্থ তরঙ্গ হয় তাহলে তা একধরনের তড়িৎচৌম্বক তরঙ্গ হতে পারে যেটি অতিবেগুনী রশ্মির চেয়ে অনেক ক্ষূদ্র তরঙ্গদৈর্ঘ্য বিশিষ্ট, যেমনটি সম্প্রতি আবিষ্কৃত হয়েছে রেডিও তরঙ্গ, যা অবলাল তরঙ্গের চেয়ে অনেক অনেক দীর্ঘ।
সমস্যা হলো কীভাবে বিভিন্ন রকম বিকল্প চিন্তা থেকে আসলটি বাছাই করা যায়। আলো তরঙ্গ হিসেবে দেখা দেয় কেননা এটি ইন্টারফেরেন্স প্রদর্শন করে। ইন্টারফেরেন্সের প্রদর্শনীর জন্য আলোকে দু’টি কাছাকাছি স্থাপিত চিরের মধ্য দিয়ে পাঠানো হয়। ইন্টারফেরেন্সের ঘটনা আরো স্পষ্ট দেখা যায় অপবর্তন গ্রেটিং এর মাধ্যমে, কাচের প্লেট যার উপরে সূক্ষ আঁচড় কেটে দেওয়া হয়। আলো যখন এই আঁচড় অতিক্রম করে তখন স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান ইন্টারফেরেন্স তৈরি হয় যা খুব নিঁখুতভাবে তরঙ্গদৈর্ঘ্য নির্ণয়ের সুযোগ করে দেয়।
তরঙ্গদৈর্ঘ্য যত ক্ষূদ্র হবে দুটি আঁচড়ের মধ্যে ব্যবধান ততো কম হতে হবে। অপবর্তন গ্রেটিং কাজ করবে না যদি এক্স রে খুবই ক্ষূদ্র তরঙ্গদৈর্ঘ্যের অনুপ্রস্থ তরঙ্গ হয়ে থাকে। পরবর্তীতে জার্মান পদার্থবিদ ম্যাক্স থিওডোর ফেলিক্স ভন লাওয়া (Max Theodor Felix von Laue, ১৮৭৯-১৯৬০) অনুধাবন করলেন অবিশ্বাস্য পরিমান নিকটবর্তী আচড় বিশিষ্ট অপবর্তন গ্রেটিং উৎপাদন করার কোনো প্রয়োজন নেই। প্রকৃতি ইতিমধ্যে এই কাজ করে রেখেছে।
বিভিন্ন বস্তুর ক্রিষ্টালগুলো অণু এবং পরমাণু দিয়ে গঠিত হয় যাতে এরা সুষম সজ্জায় বিন্যাস্ত থাকে। এটা বোঝা যায় ক্রিষ্টালের টুকরোকে ভাঙ্গার চেষ্টা করলে এদের বিশেষ বিশেষ তলে এবং সুনির্দিষ্ট কোণায় ভেঙ্গে যাওয়ার প্রবণতা থেকে। দেখে মনে হয় তারা একটি তল বরাবর ভেঙ্গে যাওয়ার চেষ্টা করে যেই তলে পাশাপাশি দুই স্তরের পরমাণু থাকে। লাওয়া ভাবলেন কেন এক্সরে এই ক্রিস্টালের স্তরগুলো ছেদ করে যাবে না? একটি ক্রিষ্টালের পরমাণুর স্তরগুলোর মাঝের পরপর দু’টি ফাঁকা স্থান অপবর্তনের গ্রেটিংএ আঁচড়ের মতোই কাজ করতে পারে এবং একই ক্ষেত্রে দু’টি আঁচড়ের মাঝে ফাঁকা দুরত্ব হবে মাত্র একটি পরমাণুর ব্যাস এবং এই ব্যবস্থাটি হয়তো এক্সরের জন্য ইন্টারফেরেন্স ইফেক্ট প্রদর্শন করতে পারে।
যদি এক্স রে কে এমন কোনো বস্তুর মধ্য দিয়ে যেতে হয় যার অণুগুলো বিক্ষিপ্তভাবে এলোমেলো অবস্থায় থাকে তাহলে এক্সরেও কিন্তু এদিক-সেদিক এলোমেলোভাবে বিক্ষিপ্ত হবে। তবে একটি ছায়াময় প্রতীতি তৈরি হবে যার কেন্দ্র থাকবে অন্ধকারময় এবং ক্রমশঃ বাইরের সবদিকে উজ্জ্বল হতে থাকবে।
যদি এক্স রে কে ক্রিষ্টালের সুবিন্যাস্ত সজ্জ্বার পরমাণুর স্তরের মধ্য দিয়ে যেতে হয় তাহলে অপবর্তন প্যাটার্ন তৈরি হবে এবং একটি ফটোগ্রাফিক প্লেটের উপর পৃথক উজ্জ্বল এবং অনুজ্জ্বল ছোপ তৈরি হবে এবং কেন্দ্রের সাপেক্ষে একটি প্রতিসম প্যাটার্ন তৈরি হবে।
১৯১২ সালে লাওয়া জিংক সালফাইডের ক্রিস্টালের মধ্য দিয়ে এক্স রে চালনার পরীক্ষাটি করার চেষ্টা করলেন। এবং এটি নিখুঁত ভাবে সেই পূর্বের অনুমিত ফলাফলই দেখালো যা এক্সরে অনুপ্রস্থ তরঙ্গ হলে দেখানোর কথা। এটি এই প্রসঙ্গের মীমাংসা করল এবং ১৯১৪ সালে এই কাজের জন্য লাওয়া নোবেল পুরষ্কার লাভ করলেন।
ব্রিটিশ পদার্থবিদ উইলিয়াম হেনরি ব্র্যাগ (William Henry Bragg, ১৮৬২-১৯৪২) তাঁর পুত্র উইলিয়াম লরেন্স ব্র্যাগ (William Lawrence Bragg) এর সাথে মিলে দেখতে পেলেন যে এক্স রে অপবর্তনের ঘটনাটিকে এক্স রের প্রকৃত তরঙ্গদৈর্ঘ্য নির্ণয়ের কাজে ব্যবহার করা যায় যদি ক্রিস্টালের অন্তর্গত দু’টি পরমাণু-স্তরের মধ্যবর্তী দুরত্ব জানা যায়। এটি তাঁরা নিষ্পন্ন করলেন ১৯১৩ সালে এবং দেখালেন যে এক্স রে এর তরঙ্গদৈর্ঘ্য, দৃশ্যমান আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্যের ১/৫০ থেকে ১/৫০০০০ ভাগের মধ্যে। এই কাজের জন্য তাঁরা পিতা-পুত্র ১৯১৫ সালের নোবেল পুরষ্কার ভাগাভাগি করে নেন।
(সবগুলো পর্ব একত্রে)
Leave a Reply