চিন্তা করে দেখুন আজ থেকে প্রায় ৩৫ কোটি বছর আগে সমুদ্র থেকে উঠে এসেছিল কোন এক উভচর মাছ, তারপর কোটি কোটি বছর চলে গেছে, সেই মীন থেকে উদ্ভূত হল সরীসৃপ, পাখী, স্তন্যপায়ী জীব, পৃথিবী ঘুরল প্রায় দু’বার গ্যালাক্সির কেন্দ্রের চারধারে, অবশেষে মানুষ মাত্র সেইদিন যেন গাছ থেকে এল নেমে। আমরা প্রকৃতই জলজাত, আমরা জলের সন্তান।
কিন্তু আমরা জলেই থাকতে পারতাম। মৎস থেকে বিবর্তিত হতাম কিংবদন্তীর মৎসমানুষে।
কিন্তু সেই জলজ সভ্যতা কি জ্যোতির্বিদ্যার চর্চা করতে পারত? পৃথিবীরপৃষ্ঠ তাদের জন্য হত অস্পৃশ্য। সেখানে যদি তারা দূরবীনও স্থাপন করতে পারত, সেই দূরবীন তাদেরকে মহাসমুদ্রের নিচ থেকে চালনা করতে হত। তারা কি স্থলচর মানুষের মত মহাশূন্যে ভ্রমণের কথা ভাবতে পারত? আবিষ্কার করত কি তারা দূরবর্তী গালাক্সি, এই প্রসারণশীল মহাবিশ্বের রূপ? জলের নিচ থেকে উৎক্ষেপিত হত কি তাদের রকেট, সমুদ্রপৃষ্ঠের ফেনিল ঢেউ ভেদ করে বায়ুমণ্ডল পার হয়ে তাদের মহাকাশযান ভ্রমণ করত কি গভীর মহাশূন্যে? মৎসমানুষদের মহাকাশযান কি সাগরের জল দিয়ে ভর্তি থাকত? এ সবই হয়তো বিজ্ঞানকল্পকাহিনী মাত্র। তবু মনে হয় মহাবিশ্বের মাঝে জলের ব্যাপক উপস্থিতি বুদ্ধিমান জলচরপ্রাণী উদ্ভবের জন্য সহায়ক। আকাশগোলকে ঐ সব জ্বলন্ত তারাদের পাশে রয়েছে কি গ্রহ যার জলচর মৎসমানুষের ডুবন্ত অক্ষিপটে ধরা পড়ছে আমাদের সূর্যের ম্রিয়মান আলো?
ইংরেজ কবি ফিলিপ লারকিন জলে মুগ্ধ হয়ে লিখেছিলেন
আমাকে যদি ডাকা হত
সৃষ্টি করতে এক নতুন ধর্ম
আমি জলকে ব্যবহার করতাম…
কিন্তু এই যে সাগর ভরা জল, কোথা থেকে এসেছে এত জল? তারা কি পৃথিবী সৃষ্টির সময় থেকেই ছিল, নাকি পৃথিবী সৃষ্টি হবার পর বরফ জমাট ধূমকেতু সেই জল নিয়ে এসেছে আকাশ থেকে? আর একটা প্রশ্ন হল সেই জল কি সৃষ্টি হয়েছে সৌরজগত তৈরি হবার সময় গ্যাস ও ধূলির চাকতিতে, নাকি সেই জল অনেক আগে থেকেই বিদ্যমান ছিল প্রাকসৌর নীহারিকায়।
কত পুরোনো এই জল? নতুন গবেষণা বলছে আমাদের পৃথিবীর এই বিশাল জলরাশি নাকি আমাদের সৌর জগতের চেয়েও পুরোনো [১]। এই জলের অন্ততঃ অর্ধেক অংশ সৃষ্টি হয়েছে প্রাকসৌর যে নীহারিকা, অর্থাৎ যে হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম গ্যাস থেকে সৌরজগৎ সৃষ্টি হয়েছে, সেইখানে।
পৃথিবীর সমস্ত পুরাতন সভ্যতার সৃষ্টির শ্রুতিকথায় (মিথোলজিতে) জলের উপস্থিতি খুবই প্রধান। আর আমরা বলি জলের অপর নাম জীবন। আমাদের সময় হচ্ছে বৈজ্ঞানিক মিথের সময়। সেই মিথে জলের উৎস সন্ধানে আমরা গড়েছি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি, ইলেকট্রোলাইসিস, স্পেক্ট্রোমিটার, কম্প্যুটার।
আমরা বের করেছি যে একটি হাইড্রোজেন ও একটি অক্সিজেনের পরমাণুকে নিয়ে হয় একটি জলের অণু (H2O)। কিন্তু তার মাঝে হঠাৎ হঠাৎ হাইড্রোজেনের বদলে পাওয়া যায় একটি বা দুটি ডয়টেরিয়াম। ডয়টেরিয়াম (D) হচ্ছে ভারি হাইড্রোজেন, এর নিউক্লিয়াসের মাঝে হাইড্রোজেনের মত একটি প্রোটোন তো আছেই, তার সাথে রয়েছে একটি নিউট্রন। তাই ডয়টেরিয়াম দিয়ে তৈরি জলকে আমরা বলি ভারি জল। ভারি জলে থাকতে পারে একটি ডয়টেরিয়াম (HDO) অথবা দুটি (D2O)। পৃথিবীর সমুদ্রে প্রতি ৬,৪১০টি হাইড্রোজেন পরমাণুর জন্য একটি ডয়টেরিয়াম পরমাণু পাওয়া যাবে (D/H =৬,৪১০) ।
ধূমকেতুই যদি আমাদের সাগরের জল নিয়ে আসে তবে ধূমকেতুর ধূমায়িত বরফে ডয়টেরিয়াম ও হাইড্রোজেনের অনুপাত পৃথিবীর সাগরের মতই হবার কথা, অর্থাৎ D/H =৬,৪১০। ধূমকেতু বা অন্যান্য যে কোন খগোল বস্তুতে কত পরিমাণ ডয়টেরিয়াম আছে সেটা সেই বস্তুর আলোর বর্ণালী বিশ্লেষণে বেরিয়ে আসে। আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ নির্ধারণ করে সেটা ডয়টেরিয়াম থেকে বিকিরিত হচ্ছে কিনা বোঝা যায় আর সেই তরঙ্গদৈর্ঘে আলোর পরিমাণ নির্ধারণ করে সেখানে কত পরিমাণ ডয়টেরিয়াম আছে।
ছবি: Hartley ২ নামক ধূমকেতুর বরফজলে পৃথিবীর জলের মত D/H অনুপাত পাওয়া গেছে[২]।
কিন্তু জ্যোতির্বিদরা দেখলেন অনেক ধূমকেতুরই D/H অনুপাত পৃথিবীর জলের দ্বিগুণ। প্রায় হাল ছেড়ে দিচ্ছেন এমন অবস্থায় তাঁরা আবিষ্কার করলেন Hartley ২ নামে ধূমকেতুর বরফজলে পৃথিবীর মত D/H [২]। কিন্তু সমস্যা হল Hartley ২ সেই দূর কাইপার বেল্ট থেকে সৌর জগতের অভ্যন্তরে আসে, তার মাঝে যে ডয়টেরিয়ামের পরিমাণ সেটা সূর্যের কাছাকাছি যে ধূমকেতুগুলো বেশীর ভাগ সময় থাকে তাদের ডয়টেরিয়ামের পরিমাণ থেকে কম। অথচ বিজ্ঞানীরা আশা করছিলেন যত দূরের হবে ধূমকেতু তত তার ডয়টেরিয়াম কম থাকবে।
এর মধ্যে কিছু বিজ্ঞানী কম্প্যুটারে সিমুলেশন করলেন, তাঁরা বলছেন আমাদের বেশীর ভাগ জলের উৎস আদিম [১]। এই জলের অণু সৃষ্টি হয়েছে সেই পুরাতন সময় সাড়ে চারশো কোটি বছরেরও আগে, সৌর জগৎ যখন জন্মায় নি, সেই প্রাক সৌর নীহারিকার হিমশীতল আঁতুরঘরে, যেখানে তাপমাত্রা -২৬৩ ডিগ্রী সেলসিয়াস বা ১০ কেলভিন, মহাজাগতিক রশ্মির সহায়তায়। আর সেই প্রাচীন অণুই আমরা আজ পান করছি।
মহাবিশ্বের মাঝে জলের সৃষ্টি প্রথম কখন? জ্যোতির্বিদরা এর মধ্যেই আবিষ্কার করেছেন বহু দূরের এক কোয়াজার গ্যালাক্সি যার আলোর বর্ণালী বিশ্লেষণে জলের রেখা আছে [৩]। এই গ্যালাক্সি থেকে আলো আসতে ১১ বিলিয়ন বা ১১০০ কোটি বছর লাগে, তার মানে এই গ্যালাক্সিটি মহাবিশ্ব সৃষ্টির ৩ বিলিয়ন বছরের মধ্যেই সৃষ্টি হয়। আর সবচেয়ে দূরবর্তী গ্যালাক্সি, যার দূরত্ব নির্ধারণ করা গেছে, সেটি বিগ ব্যাং হবার ৭০০ মিলিয়ন বা ৭০ কোটি বছরের মধ্যেই গঠিত হয়। তার মধ্যে ভারি মৌলিক পদার্থের চিহ্ন পাওয়া গেছে। তার মানে আমরা ধরে নিতে পারি মহাবিশ্বে জলের অস্তিত্বও খুব প্রাচীন,সৃষ্টির কয়েক কোটি বছরের মধ্যেই সে হয়তো মহাবিশ্বে আবির্ভূত হয়েছে। অক্সিজেন সৃষ্টি হয়েছে প্রথম তারার গভীর অভ্যন্তরে, তারপর সুপারনোভা বিস্ফোরণে সেই অক্সিজেন ছড়িয়ে পড়েছে মহাশূন্যে, আদি হাইড্রোজেনের সাথে মিলিত হয়ে অক্সিজেন রূপান্তরিত হয়েছে জলের অণুতে।
ছবি: দূরবর্তী কোয়াজার MG J0414+0534 থেকে রেডিও টেলিস্কোপ দিয়ে জলের বিকিরণ আবিষ্কার করা হয়েছে [৩]।
সেই ১৩০০ কোটি বছর আগের আদি জল কি অনেক নক্ষত্র, গ্রহ, নিহারীকার সঙ্গ পেয়ে অবশেষে আমাদের সমুদ্রের ঢেউয়ে ভাসছে? আমাদের শরীরের অংশ হয়েছে? হতে পারে। আসলে আমরা নিজেদের শরীরে ইতিমধ্যে অনেক প্রাচীন মৌলিক পদার্থ বহন করছি যা কিনা অতি পুরাতন তারাদের গভীর অভ্যন্তরে, খুবই উঁচু চাপ ও তাপমাত্রায় তৈরি হয়েছে। আমাদের শরীরের কার্বন, নাইট্রোজেন, অক্সিজেন সৃষ্টি হয়েছে যে তারাদের ভিতর তারা সেই কবে বিস্ফোরিত হয়ে বিলীন হয়ে গেছে এই মহাবিশ্ব থেকে। আমরা তাদের প্রতিভূ হয়ে রয়েছি।
কিন্তু আদিম সৃষ্টির অংশ হিসেবে নিজেদের প্রমাণ করতে আমাদের বেশী ভাবতে হবে না। আমাদের দেহ বা চারদিকের বস্তু সৃষ্টি হয়েছে সেই প্রথম বস্তুকণা ও শক্তি থেকে, অথবা কোন পদার্থবিজ্ঞান বর্ণিত ক্ষেত্র থেকে। সেই অর্থে বলা যায় আমরা সূর্যের থেকে প্রাচীন, আমরা মহাবিশ্বের মত বর্ষীয়ান।
——-
উৎসপঞ্জী
[২] http://www.dailygalaxy.com/my_weblog/2013/08/-origins-comet-hartley-2-revealed-water-ice-similar-in-chemical-composition-to-earths-oceans.html
[৩] Water in the early universe, http://www.mpg.de/567262/pressRelease20081218
Leave a Reply