ফাইলি নামে একটি মহাকাশযান 67P চুরিউমভা-গেরাসিমেঙ্কো নামে একটি ধূমকেতুতে অবতরণ করেছে। এই ধূমকেতুটির নাম হয়েছে দুজন রুশ জ্যোতির্বিদের নামে যাঁরা ধূমকেতুটি ১৯৬৯ সনে আবিষ্কার করেছিলেন।
আমার প্রথম অভিযোগ হল এরকম একটা নাম এই যানটিকে দেওয়া হয়েছে যার উচ্চারণ সম্পর্কে কেউই একমত নন। ইংরেজিতে লেখা হচ্ছে Philae – এর উচ্চারণ শুনলাম ফিলাই, ফিলে, ফিলি, ফাইলাই। ১৫ নভেম্বর ইউটিউবে এইজন্য একটা ছোট কয়েক সেকেন্ডের ভিডিও দেয়া হয়েছে যেখানে এটাকে বলা হচ্ছে ফাইলাই। অথচ ৭ই জুনের ঐ একই উৎসের একটি ভিডিওতে বলা হচ্ছে উচ্চারণটা ফাইলিও হতে পারে। আমি কেন এটা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছি? আমার মতে মহাকাশযানের নাম এমন হতে হবে যাতে ভবিষ্যতের মানুষেরা অনায়াসে সেটাকে স্মরণ করতে পারে। এপোলো ১১র চাঁদের ল্যান্ডার যখন চাঁদে অবতরণ করল,আর্মস্ট্রং বলেছিলেন, “Houston, Tranquility Base here. The Eagle has landed.” ঈগল পাখী অবতরণ করেছে, এর থেকে সহজ কি হতে পারে।
আমি হয়তো একটু বেশী অভিযোগ করছি। আসলে ESA (European Space Agency) এই মিশনের প্রতিটি জিনিসের নাম প্রাচীন মিশর থেকে নিয়েছে। মূল মহাকাশযান হল রোজেটা যার নাম হয়েছে মিশরীয় শহর রোজেটার নামে (বর্তমান নাম রশিদ) যেখানে প্রাচীন মিশরীয় লেখন হাইরোগ্লিফ, ডেমোটিক নামে অন্য একটি লেখনী ও গ্রীক ভাষায় লিখিত একটি পাথর ১৭৯৯ সনে পাওয়া যায়। বিখ্যাত এই রোজেটা পাথরের এই তিনটি লেখনীর তুলনার মাধ্যমেই প্রাচীন মিশরীয় হাইরোগ্লিফের অর্থোদ্ধার হয়। আর রোজেটা মহাকাশযানের কাজ হল ধূমকেতুর অর্থোদ্ধার করা। ঠিক আছে, মানলাম, রোজেটা নামটা খারাপ নয়।
এবার দেখা যাক ফাইলি নামটা এল কোথা থেকে। ফাইলি হল নীল নদের ওপর একটি (বা দুটি) ছোট দ্বীপ যেখানে প্রাচীন মিশরের কিছু চমকপ্রদ মন্দির স্থাপনা ছিল। দুটি দ্বীপ বলে philae কথাটাও আসলে বহুবচন। নীল নদের ওপর বাঁধ দেবার ফলে জলাবদ্ধাতায় ফাইলি দ্বীপ ডুবে যাচ্ছিল, তখন এই স্থাপনাগুলো বাঁচানোর জন্য সেগুলো পার্শ্ববর্তী আগিলিকি নামে একটি দ্বীপে স্থানান্তরিত করা হয়। ঐ একই সময়ে দক্ষিণ মিশরে আসোয়ান বাঁধ তৈরি হচ্ছিল, সেই বাঁধের ফলে নাসের হ্রদ নামে যে জলাশয় সৃষ্টি হচ্ছিল তাতে আবু সিম্বেল নামে একটি জায়গা ডুবে যায়। আবু সিম্বেলে আজ থেকে প্রায় তিন হাজার আগে তৈরি বিশালাকায় কিছু স্থাপনা ছিল।
এখন মনে পড়ছে ১৯৬০য়ের দশকে UNESCO এই স্থাপনাগুলো বাঁচাবার প্রজেক্টে হাত দেয়। আমি ছোট ছিলাম, আমাদের ঢাকার বাড়িতে বাবা Life Magazine রাখতেন। ইংরেজী বুঝতাম না, কিন্তু একটি সংখ্যায় আবু সিম্বেলের মূর্তিগুলোর স্থান পরিবর্তনের যে বিশাল কাজ তার কিছু ছবি ছিল। একটি ছবি দিয়ে প্রচ্ছদ ছিল। সেই ছোট সময়ে ফারাওদের বিশাল মূর্তি মনে দাগ কেটেছিল। আমাদের এক পরিচিতজন ছোট ছোট রকমারী মূর্তি বানাতো, আগুনে পুড়িয়ে। তাকে বলেছিলাম পিরামিড বা ফারাও এরকম কিছু একটা বানিয়ে দিতে। আজ এতদিন পরে ইন্টারনেটে সেই Life পত্রিকার সেই প্রচ্ছদটা আবার খুঁজে পেলাম।
Life ম্যাগাজিনের ১৯৬৫ সালের UNESCOর আবু সিম্ব্লের স্থাপনা রক্ষার প্রচেষ্টার ওপর প্রচ্ছদ।
ফাইলি হল একটি হতভাগ্য দ্বীপ, তার নামে কি মহাকাশযানের নাম দিতে আছে?
আর আগিলিকি হল আর একটি দ্বীপ যেখানে ফাইলির স্থাপনাগুলোকে সরানো হল। ESA ধূমকেতুর পিঠে কোথায় ফাইলি নামবে সেটা ঠিক করল। নাম দিল জায়গাটার আগিলিকি। ফাইলিকে ছাড়া হল রোজেটা থেকে – বোধহয় প্রায় ২২ কিলোমিটার ওপর থেকে। ফাইলির লাগল প্রায় ৭ ঘন্টা ধূমকেতুর কাছে পৌঁছাতে, একদম শেষে সেটি সেকেন্ডে মাত্র ১ মিটার (ঘন্টায় ৩.৬কিলোমিটার) বেগে ধূমকেতুর বুকে এসে পড়ল।
এই ধূমকেতুটির ওপরিভাগের মাধ্যাকর্ষণ শক্তি পৃথিবীর চেয়ে ১০,০০০ গুণ কম, কাজেই প্রায় প্রতি সেকেন্ডে ১ মিটার গতিবেগে নামলেও সেটি সহজেই ধূমকেতুর উপরিতলের সঙ্গে সংঘর্ষে আবার মহাকাশে ফিরে যেতে পারে, ধূমকেতুতে সেটা নাও ফিরে আসতে পারে। এই জন্য ফাইলির সাথে যুক্ত ছিল হারপুন যা দিয়ে কিনা যানটিকে বেঁধে রাখা যাবে ধূমকেতুর সঙ্গে। কিন্তু ভাগ্য খারাপ। হারপুন কাজ করল না, আর ফাইলি আঘাতট খেল ধূমকেতুর সঙ্গে, যানটি আবার ফিরে যেতে থাকল মহাকাশে। কিন্তু ধূমকেতুর অল্প হলেও কিছু আকর্ষণ আছে, ঘন্টাখানেক পরে ফাইলি ফিরে এল, এরপর আবার হয়তো আর একটি আঘাত এল, তৃতীয়বারের মত ফাইলি যখন ফিরল তখন সেটি ধূমকেতুর বুকেই আশ্রয় পেলে। দুর্ভাগ্যবশতঃ সেটি এমন জায়গায় এসে পড়ল যেখানে সূর্যের আলো খুব অল্প সময়ের জন্য পড়ে, তাই ফাইলির ব্যাটারি চার্জ করা সম্ভব হল না, আর এই লেখাটি যখনলিখছি ফাইলি নীরব হয়ে গেছে। নীরব হবার আগে যানটি বিজ্ঞানের কিছু কাজ হয়তো করেছে, সেই তথ্য নাকি ESA পেয়েছে, এখন আমাদের অপেক্ষা করতে হবে তার বিশ্লেষণের জন্য।
কিন্তু আমি এই লেখাটা শুরু করেছিলাম রোজেটা বা ফাইলির কথা বলার জন্য নয়, বরং আজ থেকে প্রায় ন’বছর আগে একটি জাপানী মহাকাশযানের কথা বলার জন্য। সেই যানের নাম ছিল Hayabusa, আর সেটি গিয়েছিলে একটি খুবই ছোট গ্রহাণুতে, তারা নাম তারা দিয়েছিল Itokawa। হায়াবুসা মানে হল বাজপাখী আর ইটোকায়া ছিলেন একজন জাপানী রকেট বিজ্ঞানী।
ইটোকায়া মাত্র ৪০০/৫০০ মিটার লম্বা একটি গ্রহাণু। হায়াবুসা শুধু যে ইটোকায়াতে অবতরণ করেছিল তা নয়, সেটি সেই গ্রহাণুর ধূলিকণা সংগ্রহ করে পৃথিবীতে ফিরে এসেছিল। সেই ধূলিকণা বিশ্লেষণ করে অনেক তথ্য পাওয়া গেছে।
গ্রহাণু ইটোকায়া। এই গ্রহাণুর দৈর্ঘ্য কয়েকশো মিটার মাত্র।
হায়াবুসা যখন ইটোকায়ায় নামে তখন ফেসবুক একেবারে শিশু, স্মার্টফোন ছিল না, টুইটার বলে কিছু নেই। কাজেই সামাজিক মাধ্যমে খবরটা ছড়ানোর কোন অবকাশ ছিল না, কিন্তু হায়াবুসার কৃতিত্ব রোজেটার থেকে কোন অংশেই কম নয়, বরং বেশী বলে আমি মনে করি। ফাইলি প্রথম একটি ধূমকেতুতে গিয়েছে ঠিকই, কিন্তু যে প্রকৌশলে ফাইলি ধূমকেতু 67Pতে নেমেছে সেই প্রকৌশল অবলম্বনেই হায়াবুসা ইটোকায়ায় নেমেছিল। আর তারও আগে NASAর NEAR Shoemaker মহাকাশযান Eros নামে একটিগ্রহাণুতে অবতরণ করতে প্রেছিল যদিও অবতরণের পর পরই তার বার্তা স্তব্ধ হয়ে যায়।
গ্রহাণু ইটোকায়ার ওপর হায়াবুসার ছায়া দেখা যাচ্ছে।
তবুও রোজেটা হোক বা হায়াবুসা হোক কি শুমেকার হোক, এসব কিছুই মানুষের সম্মিলিত আকাঙ্খার ফসল। যে উৎসাহ নিয়ে আমরা ফাইলির অবতরণের কাহিনী শুনতে চেয়েছি সেটা আমাদের মহাবিশ্ব, আমাদের সৌর জগৎ, আমাদের বাসস্থানকে ভাল ভাবে চেনার জন্যই করেছি। আমাদের সবার মাঝে এই স্পিরিটটি বর্তমান। আমার স্পষ্ট মনে আছে এপোলো ১১র চাঁদে অবতরণের দিনটি। এর কিছুদিন পরে ঐ মিশনের তিনজন – আর্মস্ট্রং,কলিন্স ও অলড্রিন ঢাকায় এসেছিলেন, মতিঝিলের আজকের শাপলা চত্বরে এখনকার সোনালী ব্যাংকের সিঁড়ি থেকে আমি তাদের উদ্দেশ্যে হাত নেড়েছিলাম। ধূমকেতু 67P চোখে দেখাযায় না, মঙ্গলের কক্ষপথ ছাড়িয়ে পৃথিবী থেকে সেটি প্রায় ৫০০ মিলিয়ন কিলোমিটার দূরে ধনু রাশির দিকে। তাকে প্রদক্ষিণ করছে রোজেটা। সেই দিকে তাকিয়ে আমি হাত নাড়ি।
আর আজ থেকে ১,০০০ হাজার বছর পরে আমাদের কোন ভবিষৎ প্রতিনিধি হয়তো ফিরে যাবে এই ধূমকেতুতে। ফাইলিকে টেনে নিয়ে আসবে গহ্বরের ছায়া থেকে সূর্যের আলোকে। হাজার বছর পরে জেগে উঠবে মহাকাশযান। আমরা থাকবো না, কিন্তু আমাদের আশা আর আকাঙ্খা থেকে যাবে, থেকে যাবে আমাদের স্পিরিট। ফাইলি হয়তো আবার কাজ করবে।
(পূর্বে ব্যক্তিগত ব্লগ ও ফেসবুকে প্রকাশিত)
Leave a Reply